মঙ্গলবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৮

‘কেউ আমারে আটকাইয়া রাখতে পারব না’

দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিলেও ক্লাসে কখনো দ্বিতীয় হয়নি কামরুন নাহার লিজা। শুধু তা-ই নয়, চিত্রাঙ্কন, রচনা প্রতিযোগিতাসহ আরো নানা বিষয়ে রয়েছে তার দক্ষতা।


২০১১ সালের কথা। ত্রিশালের চিকনা মনোহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঢুকল ছোট্ট একটি মেয়ে। জীর্ণ পোশাক আর শীর্ণ দেহের মেয়েটি চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছিল প্রধান শিক্ষকের দিকে। জানাল, তার নাম লিজা। মেয়ের এক হাতে ধরে আছেন মা। কেন এসেছে—প্রধান শিক্ষক এমন প্রশ্ন করতেই মেয়েটির চটপট উত্তর—‘আমি এই স্কুলে পড়তে চাই, স্যার। আমি ভালো করে পড়াশোনা করব। আপনি দেইখেন, স্যার। কেউ আমারে আটকাইয়া রাখতে পারব না।’ বিশ্বাস করলেন প্রধান শিক্ষক। ব্র্যাক স্কুল থেকে পড়াশোনা করে আসা মেয়েটি ভর্তি হলো তৃতীয় শ্রেণিতে।
২০১৮ সাল চলছে। চলে গেছে বেশ কয়েকটি বছর। আত্মবিশ্বাসী, চঞ্চল মেয়েটি তার কথা রেখেছে।   ক্লাসে কখনো দ্বিতীয় হয়নি সে। এখন পড়ে ত্রিশাল নজরুল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে। লিজা উপজেলার সদর ইউনিয়নের চিকনা মনোহর গ্রামের রফিকুল ইসলামের মেয়ে। লিজা মা-বাবার তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। বাবা রফিকুল ইসলাম আগে দিনমজুরের কাজ করতেন, এখন অন্যের জমি বর্গা চাষ করে সংসারের খরচ জোগাড় করেন। মা পারভীন আক্তার সেলাইয়ের কাজ করেন। সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাওয়া অনেকটা স্বপ্নের মতো তাঁদের কাছে। কিন্তু নিজের চেষ্টায় ও কিছু মানুষের সহায়তায় সব প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করে এগিয়ে চলেছে। পিইসি ও জেএসসিতে বৃত্তি পেয়েছে। স্কুলের যেকোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সব সময় সেরা। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে উপজেলা, এমনকি জেলায়ও এখন তার পদচারণ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। যেকোনো ছবি আঁকতে বললে সময় নেয় ১০ মিনিট।
 পাশে পেয়েছে যাঁদের
লিজা চিকনা মনোহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন বর্তমানে দরিরামপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল কাইয়ুম। অসাধারণ প্রতিভাধর, কিন্তু আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত মেয়েটির প্রতি বিশেষ একটা জায়গা তৈরি হয় তার মনে। দরিদ্র দিনমজুর বাবার অভাবের ছোঁয়া স্পর্শ করতে দেননি তিনি। উপজেলা পর্যায়ে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ হওয়ার পর যাতায়াতের ভাড়ার টাকার অভাবে জেলাভিত্তিক প্রতিযোগিতায় যেতে পারছিল না লিজা। তখন কাইয়ুম স্যারই তাকে নিয়ে যান জেলা পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য। যাওয়ার মতো ভালো পোশাক না থাকায় তার ব্যবস্থাও করেন তিনি। প্রাথমিকের গণ্ডি পার হয়ে নজরুল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির পরও নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে শুরু করেন। লিজাও বাবার মতোই সম্মান করে সব পরামর্শ মেনে চলে তাঁর। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় আরেকটি ঘটনা ঘটে। অর্থনৈতিক দুর্দশা আর আশপাশ থেকে আসা বিয়ের প্রস্তাবে মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন মা-বাবা। বাধ সাধেন আব্দুল কাইয়ুম। লিজার বাড়িতে গিয়ে বিয়ের বিষয়ে তার মা-বাবাকে নিরুত্সাহিত করে ওর পড়াশোনার খরচের দায়িত্ব নেন।
এদিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গড়া ত্রিশাল সায়েন্স ল্যাব শিক্ষা পরিবারের সদস্যরা তাকে নানা বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছে। সায়েন্স ল্যাব শিক্ষা পরিবারের সাজিদুল ইসলাম সাজু, ইউনুস জামিল রানা, আল ইমরান নুরুল্লাহ আল কাউছার বলেন, অদম্য লিজার স্বপ্নপূরণে আমরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। এতে লিজা যেমন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবে, তেমনি অন্যরাও লেখাপড়ায় অনুপ্রাণিত হবে।
 লিজাকে নিয়ে যা বললেন শিক্ষকরা
আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘লিজা অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী, ক্লাসের প্রথম দিনই তার মেধা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সে সব সময় সেরা ছিল। তা ছাড়া ছবি আঁকা, কবিতা আবৃত্তি, রচনা প্রতিযোগিতা—সব ধরনের প্রতিযোগিতায় কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে যখন লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম, তখন আমি তার লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। লিজা একদিন দেশসেরা হয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখবে।’
নজরুল  বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভর্তির পর থেকে এই প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষক লিজার প্রাইভেটের কোনো অর্থ নেন না। ওর প্রতিভাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সবাই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আশা করছি, এবার এসএসসিতেও সেরা রেজাল্ট করবে।’
 আত্মপ্রত্যয়ী লিজা
ত্রিশালে শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত ‘বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ ব্রিগেডের’ হয়ে সামাজিক দায়িত্ব পালনে লিজা সবার আগে থাকে। তার আত্মবিশ্বাসও খুব বেশি। এ প্রসঙ্গে রফিকুল ইসলাম একটা ঘটনার উল্লেখ করেন। ব্রিগেড সদস্যদের জন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে সাইকেল সরবরাহ করা হয়। যারা সাইকেল চালাতে পারে না, তাদের শেখানোর ব্যবস্থা করা হয় স্কুলের পক্ষ থেকে। কিন্তু লিজার বেলায় ঘটল ভিন্ন ব্যাপার। স্কুল ছুটির পর লিজা তাকে সাইকেল দিয়ে দিতে বলল। রাতে শিখে কাল সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসবে। যেই কথা সেই কাজ। লিজা বিকেলে হেঁটে হেঁটে সাইকেল নিয়ে গেলেও বাড়ির আঙিনায় এক রাতে সাইকেল চালানো শিখে পরের দিন সকালে বাড়ি থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে স্কুলে এসে হেড মাস্টারের সামনে হাজির হয়ে বলে—‘স্যার, আমি সাইকেল চালানো শিখে ফেলেছি।’
লিজা দরিদ্র ঘরের সন্তান হলেও ব্যক্তিগত অনুদান (আব্দুল কাইয়ুম ব্যতিক্রম) নিতে নারাজ। তার পারিবারিক অসচ্ছলতার কথা চিন্তা করে রফিকুল ইসলাম স্যার কারো কাছ থেকে অনুদান নিয়ে তাকে সহযোগিতার প্রস্তাব দিলে লিজা রাজি হয়নি। বলে—স্যার, আমি কারো দয়ায় বড় হতে চাই না। তবে সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান আমাকে সহযোগিতা করলে ভিন্ন কথা। পরবর্তী সময় প্রধান শিক্ষক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর একটি আবেদন করতে বললে তাত্ক্ষণিক বসে সে আবেদন লিখে দেয়। 
লিজা বলে, দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি আমি। কাইয়ুম স্যারসহ অন্যান্য শ্রদ্ধেয় শিক্ষক যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দিতেন, তবে হয়তো এত দিনে আমার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যেত। আমি সবার দোয়া নিয়ে লেখাপড়া করে বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে চাই। মা-বাবাসহ যারা সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের মুখ উজ্জ্বল করতে চাই। চাই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে প্রত্যয়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে।
লিজার মা পারভীন আক্তার বলেন, আমার যত কষ্টই হোক না কেন, আমার মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যাব। আমার এই মেয়েকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন।
 লিজার নানা অর্জন
♦    ২০১২ সালে লিজা ত্রিশালের চিকনা মনোহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্রোহী কবির জন্মবার্ষিকীতে আয়োজন করে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। ওই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে চিত্রাঙ্কনে প্রথম স্থান লাভ করে মেয়েটি।
     ওই বছরই উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত জাতীয় শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে উপজেলায় তৃতীয় স্থান অর্জন করে।
♦    ২০১৩ সালে উপজেলায় চিত্রাঙ্কনে প্রথম হয়।
♦    ২০১৪ সালে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র আয়োজিত শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করে।
♦    এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে লিজার বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ও প্রথম পুরস্কার ছিনিয়ে আনা। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট আয়োজিত শিশু-কিশোরদের রচনা প্রতিযোগিতায় ‘খ’ বিভাগ থেকে অংশগ্রহণ করে দেশসেরা ‘উত্তম’ প্রতিযোগী নির্বাচিত হয়। পুরস্কার নেয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে।
♦    এ ছাড়া চিত্রাঙ্কন, রচনা প্রতিযোগিতা, আবৃত্তিতে এরই মধ্যে সে অর্জন করেছে অর্ধশত সনদপত্র।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ