মঙ্গলবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৮

তৃতীয় লিঙ্গের তিন প্রহরী

পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় নীলা একদিন টের পেলেন, অন্য ছেলে-মেয়েদের চেয়ে তিনি আলাদা। মেয়েদের সঙ্গে মিশতে খুব ভালো লাগত তাঁর। ছেলেরা দুষ্টুমি করত। বাথরুমে ঢুকলে দরজা বাইরে থেকে আটকে দিত। মেয়েদের বান্ধবী হিসেবে দেখলেও ছেলেদের প্রতি অন্য রকম এক অনুভূতি কাজ করত নীলার মনে। পছন্দের ছেলেটির জন্য আগেভাগে স্কুলে গিয়ে বেঞ্চ খালি রাখতেন, পাশে বসার চেষ্টা করতেন।

ছোটবেলায় শুধু মা-ই জানতেন, নীলা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। সমাজ যাঁদের ‘হিজড়া’ নামে ডাকে। ধীরে ধীরে নিজের পরিবর্তন বুঝতে পেরে ছেলেদের পোশাক ছেড়ে বড় বোনের জামা-কাপড় পরা শুরু করেন নীলা। এ জন্য ভাইয়ের অনেক মার খেতে হয়েছে তাঁকে। তবু মেয়েদের মতো সাজতেন।
নীলার বাড়ি বাগেরহাট। পরিবারে ভাই-বোন ও মা আছেন। বোঝার বয়স হওয়ার আগেই মারা গেছেন বাবা। পরিবারে শান্তি না পেয়ে একসময় আরেক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে নবীনগরের ‘নিরিবিলি’তে চলে আসেন তিনি। একবার গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষিকা সাকিনা আক্তার জেন্ডার স্টাডিজের ওপর এক গবেষণার কাজে গিয়েছিলেন ‘নিরিবিলি’তে। নীলা তখন সেখানে গুরুর কাছে থাকেন। দোকানে দোকানে টাকা সংগ্রহ করাই তাঁদের প্রধান কাজ। নীলা জানালেন, ‘সাকিনা আক্তার আমাদের প্রস্তাব দেন, ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পেলে কাজ করব কি না। ভাবলাম, মানুষ ভালো বলবে, সম্মান দেবে। তাহলে যাব না কেন?’
গণবিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের সুযোগ পেলেন নীলা। শুরুতে যোগ দেওয়া নিয়ে তাঁর সংশয় ছিল। ভেবেছিলেন, কোনো হেনস্থার শিকার হতে হয় কি না। কিন্তু ১ অক্টোবর চাকরিতে যোগ দিয়ে তাঁর ধারণা পাল্টে গেল। বললেন, ‘আগে লোকজন আমাদের অবজ্ঞা করত। এখন কেউ তা করে না। শিক্ষার্থীরা মান্য করে চলে, আমাদের কথা শুনে তাঁরা স্বেচ্ছায় আইডি কার্ড পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে। এই তো সেদিন কিছু শিক্ষার্থী এসে বলল, মেলা উপলক্ষে তারা যে দোকানটি দিয়েছে, আমরা যেন সেটির নাম রেখে দিই।’
নীলা জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা থাকলে শিক্ষকদের মতো তাঁদেরও খাবার দেওয়া হয়। এমনিতে সকালে রান্না করে নিয়ে আসা খাবার সকাল ও দুপুরে খান। বাসায় একাই থাকেন। নিজের রান্না নিজেই করেন। প্রথমবার বেতন পাওয়ার পর মায়ের জন্য দুই হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। গুরুকে মিষ্টি কিনে দিয়েছেন। বান্ধবীদের ডেকে ছোট একটা পার্টি করেছেন। জানালেন, গত সপ্তাহে ঘোড়াপীর মাজারের কাছে চা খেতে গিয়েছিলেন। লোকজন উত্সাহ দিয়ে বলেছে, ‘তোমরা এখন কাজ করছ দেখে খুব ভালো লাগছে।’ এমন প্রশংসা শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি নীলা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ