রবিবার, ৩০ জুলাই, ২০২৩

সত্য মানুষকে মুক্তি দেয় (ইসলামিক সত্য গল্প)

 শিশু, কিশোর ও কিশোরীদের জন্য ইসলামিক শিক্ষণীয় গল্প “সত্য মানুষকে মুক্তি দেয়”। গল্পের লেখক হযরত ওমর (রাঃ) এর শাসনকালের একটি সত্য ঘটনা গল্প আকারে বর্ণনা করেছেন এবং শিক্ষণীয় দিকগুলো উপস্থাপন করেছেন। 


সত্য মানুষকে মুক্তি দেয় : ইসলামিক শিক্ষনীয় সত্য গল্প! 

বলিষ্ঠ এক যুবক। আরবের মরু এলাকায় তার বাস। মদীনা থেকে দূরে বহু দূরে অবস্থান করে সে। বিশেষ প্রয়োজনেই কেবল মদীনায় যায়। কয়েকদিন থাকে । আবার ফিরে আসে।

তখন চলছিল সিংহ পুরুষ হযরত ওমর (রা.) এর শাসনকাল । একদিন যুবকের মদীনায় যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দিল। বিশেষ প্রয়োজন । যেতেই হবে । না যেয়ে উপায় নেই ।

দিনক্ষণ ঠিক করে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল যুবক। যেতে হবে তাকে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে অনেক দূরে। সুদূর মদীনায়। সফর সঙ্গী হিসেবে একটি উট ছাড়া অন্য কেউ নেই । হাতে সময় ছিল খুবই কম । সেজন্য জরুরি বিশ্রাম ব্যতীত বাকি সময়টুকুতে বিরামহীন ভাবে চলছিল সে ।

চলার পথে ক্লান্ত দেহটাকে খানিক চাঙ্গা করে নেওয়ার জন্য এক সময় বিশ্রাম নিচ্ছিল যুবক। ভীষণ পিপাসা ও ক্ষুধা নিবারণের উদ্দেশ্যে সঙ্গে নিয়ে আসা সামান্য খাদ্য ও পানি বিশ্রামের শুরুতেই গলার নিচে পাঠিয়ে দিয়েছে সে। এবার উটটাকে খেজুর বাগানে ছেড়ে দিয়ে একটি গাছের ছায়ায় মনের সুখে ঘুমিয়ে পড়েছে।

আরব দেশে প্রচুর খেজুর বাগান রয়েছে। ছোট বড় মাঝারি সব ধরনের বাগানই আছে সেখানে। যে বাগানটিতে যুবক বিশ্রাম নিচ্ছিল সেটি খুব বেশি একটা বড় ছিল না। একজন মালি বাগানটি দেখাশুনা করত । পানি দিত। আগাছা পরিস্কার করত। ভাল ফলনের জন্য যা কিছু করা দরকার সবই করত সে।

সেদিন মালি বাগানে কাজ করছিল। হঠাৎ তার নজরে পড়ল, একটি উট এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। উটের পায়ে পিষ্ঠ হয়ে কিছু চারা গাছ ইতোমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে। এ অবস্থা দেখে মালি রেগে যায় । সঙ্গে সঙ্গে উটটিকে তাড়ানোর উদ্দেশ্যে উহার প্রতি একটি পাথর নিক্ষেপ করে। উটটিকে মেরে ফেলার কোন ইচ্ছা মালির ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তার নিক্ষেপিত পাথরটি উটটির ঠিক বুক বরাবর প্রচন্ড বেগে আঘাত হানে। এতে ছটফট করতে করতে তৎক্ষণাৎ উটটি মারা যায় ।

মালি ভয়ে কাঁপতে থাকে । এক অজানা আশংকায় তার বুক দুরু দুরু করে । চেহারায় ফুটে উঠে উৎকণ্ঠার ভাব। একটু দূরে হঠাৎ এক যুবককে দেখতে পেয়ে ভাবে, উটের মালিক হয়তো সেই হবে। মালি দেরি করে না। সে ছুটে যায় বেদুঈন যুবকের নিকট। খুলে বলে সবকিছু। তারপর বিনীত কণ্ঠে ক্ষমা প্রার্থনা করে যুবকের নিকট ।

যুবক উটটিকে সীমাহীন ভালবাসত। সেটি ছিল তার সবচাইতে প্ৰিয় উট। তদুপরি এ মুহূর্তে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে এটি। তাই উটের মৃত্যুর কথা শুনে যুবক দিশেহারা হয়ে পড়ল। হারিয়ে ফেলল হিতাহিত জ্ঞান। ক্রোধে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে মালির দাড়ি ধরে সজোরে ঝাকুনি দিতে লাগল। এ সময় মালি ছিল বেশ অসুস্থ। তাই যুবকের ঝাকুনি সহ্য করতে না পেরে সেও এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল ।

এবার যুবক কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কি করল, কি করা তার উচিত কিছুই বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ পর হুঁশ ফিরে এলে সেও কেঁদে ফেলল । অস্ফুট স্বরে বলতে লাগল, একি করলাম আমি! অন্যায়ভাবে আমি একজন মানুষকে হত্যা করলাম!

এতক্ষণে মালির ছেলেরা বাগানে এসে উপস্থিত। তারা যুবকের মুখ থেকে সবকিছু শুনল । তারপর বিচারের জন্য তাকে নিয়ে গেল খলীফার দরবারে। খলীফা উভয় পক্ষের বক্তব্য শ্রবণ করলেন। যুবক তার বক্তব্য প্রদানে বিন্দুমাত্রও মিথ্যার আশ্রয় নিল না। সে অকপটে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করল ।

বাদী বিবাদীর কথা শুনে খলীফা কিছুক্ষণ ভেবে নিলেন। যুবকের সত্যবাদিতায় তিনি মুগ্ধ হলেন। কিন্তু হত্যার পরিবর্তে হত্যা- ইসলামের এই বিধানের কারণে যুবককে কতল করার নির্দেশ দিলেন ।

যুবক বলল, খলীফার নির্দেশ শিরোধার্য। তার ফায়সালা অবশ্যই কার্যকর হবে । তবে আমার একটি আবেদন ছিল ।

: বল তোমার কী আবেদন? খলীফা গম্ভীর কন্ঠে বললেন ।

: আমীরুল মুমেনীন! হুকুম তামীলের পূর্বে পরিবার পরিজনকে একনজর দেখতে চাই। চির বিদায় আনতে চাই তাদের কাছ থেকে। এটিই আমার জীবনের শেষ ইচ্ছা ।

: তোমার এ আবেদন পূর্ণ হতে পারে । তবে এজন্য প্রয়োজন একজন জামিনদারের । তুমি না এলে তোমার পরিবর্তে তাকেই কতল করা হবে ।

খলীফার দরবার লোকে লোকারণ্য। চতুর্দিকে কেবল মানুষ আর মানুষ । যুবককে চিনে এমন কেউ এখানে নেই । উপস্থিত সকলের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নেয় যুবক। তার দৃষ্টি যেন এ কথাই বলছিল- হে উপস্থিত জনতা! তোমরা যে কেউ আমার জামিন হতে পার। যে কোন মূল্যের বিনিময়ে নির্ধারিত সময়ে এখানে আমি উপস্থিত হবোই ।

নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশ। কেউ কোন কথা বলছে না। একে অপরের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে তারা । সময় বয়ে চলছে তার আপন গতিতে।

উপস্থিত লোকদের মধ্যে একজন ছিলেন আবু যর গিফারী (রা.)। তিনি এতক্ষণ সকলের বক্তব্য মনোযোগ সহকারে শুনছিলেন। যুবকের সত্যবাদিতায় ইতোমধ্যেই তিনি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। এবার জামিনের প্রশ্ন আসায় তিনি দাঁড়িয়ে বললেন, আমি এ যুবকের জামিন হব। তাকে জীবনের শেষ আকাঙ্খা পূর্ণ করার সুযোগ দেওয়া হোক।

জামিন পেয়ে যাওয়ায় খলীফা যুবককে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিলেন। যুবক বিলম্ব করল না। ছুটে চলল স্বজনদের পানে। কয়েকদিন পূর্বে এক সুন্দরী কন্যাকে বিয়ে করেছিল সে। পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন বিশেষ করে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী কিভাবে তাকে চির বিদায় জানাবে, কি হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হবে-চলার পথে এ চিন্তাটিই বারবার ঘোরপাক খাচ্ছিল তার মাথায়।

যুবক কখনো মিথ্যা বলে নি। প্রতারণা করে নি। আজীবন সে গেয়েছে সত্যের জয়গান। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সে গোটা জীবন সংগ্রাম করেছে। সততা, সত্যবাদিতা ও ওয়াদা পালনে সে ছিল সর্বদা সচেষ্ট ।

পথ চলতে গিয়ে যুবক ভাবে, আজ যদি আমি সততার পরিচয় না দিয়ে ওয়াদা ভঙ্গ করে পুনরায় ফিরে না যাই তবে আমি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাব। রক্ষা পাব আক্রমণ থেকে। সুখে শান্তিতে আরো কিছুদিন বসবাস করতে পারব একান্ত আপনজনদের সাথে। কিন্তু না, জীবনের চেয়ে ওয়াদার মূল্য, জীবনের চেয়ে সততার মূল্য অনেক, অনেকগুণ বেশি। সুতরাং জীবনের মায়ায় প্রিয়জনদের কান্না ভেজা চেহারা পানে তাকিয়ে কখনো মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া যাবে না। ভঙ্গ করা যাবে না প্রতিশ্রুতি, গুড়িয়ে দেওয়া যাবে না সততার সুরম্য প্রাসাদ ।

যুবক বাড়ির দিকে যতই এগিয়ে চলছে ততই মনকে শক্ত করে নিচ্ছে। এভাবে চলতে চলতে এক সময় সে বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয় । ভনিতা না করে ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে সবার নিকট বলে ফেলে খলীফার ফয়সালার কথা। সেই সাথে এও বলে যে, বিলম্ব করা যাবে না, আমাকে এখনই যেতে হবে।

যুবকের কথায় পিতা-মাতা, আত্মীয়-অনাত্মীয় সকলের চোখেই পানি দেখা দেয়। বারবার হুঁশ হারায় নব বিবাহিতা যুবতী স্ত্রীও। সে এক করুণ ও মর্মান্তিক দৃশ্য!

খলীফার নিকট ফিরে যেতে অনেকে যুবককে বাধা দেয়। যুক্তির মারপ্যাচে বিভিন্ন উপায়ে বুঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু যুবক নাছোড় বান্দা । সে তার ওয়াদা পালনে এক পায়ে খাড়া। জীবন রক্ষার জন্য প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে কিছুতেই সে রাজি নয়। সুতরাং সবাইকে শেষ বারের মত বিদায় জানিয়ে দ্রুত ঘোড়া হাকিয়ে খলীফার নিকট উপস্থিত হল সে।

খলীফা বললেন, হে যুবক! তোমার প্রতিশ্রুতি পূরণ, তোমার কর্তব্য নিষ্ঠা ও সততায় আমি যারপর নাই খুশি হয়েছি, কিন্তু নিজের পক্ষ থেকে তোমাকে সহযোগিতা করার কোন উপায় আমার নেই। একথা বলে মালীর ছেলেদের দিকে তাকালেন তিনি। অতঃপর জানতে চাইলেন তাদের মতামত।

এ মুহূর্তে মালীর ছেলেরা যেমন যুবকের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে পারে, ঠিক তেমনি ক্ষমার ঘোষণা দিয়ে তাকে রক্ষাও করতে পারে। মজলিসে পিন পতন নীরবতা। সবাই এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে ছেলেদের মুখের দিকে । তারা কি বলে, সে কথা শুনার জন্য সকলেই এখন উন্মুখ হয়ে আছে। যুবক একপাশে দাঁড়িয়ে আছে মাথানত করে।

যুবকের সততায় কেবল খলীফা ও উপস্থিত জনতাই নয়, মালীর ছেলেরাও অত্যধিক মুগ্ধ হয়েছিল। তাই খলীফার প্রশ্নের জবাবে এক বাক্যে তারা বলে উঠল, আমরা যুবককে ক্ষমা করে দিলাম। তাদের এ উদারতায় মহানুভব খলীফা খুশি হয়ে বললেন, আমি দেশ জয়ে যে আনন্দ পাইনি, সে আনন্দ আজ তোমাদের মধ্যে পেলাম।

অতঃপর খলীফা হযরত আবু যর গিফারী (রা.) কে কাছে ডাকলেন । বললেন, হে রাসূলের প্রিয় সাহাবী! আপনি কেন এ অপরিচিত যুবকের জামিন হতে গেলেন? যদি সে না ফিরত তবে আপনার অবস্থা কি হত তা একটু ভেবে দেখেছেন কি?
উত্তরে তিনি বললেন, হে মান্যবর খলীফাতুল মুসলিমীন! যুবকের সত্যবাদিতার প্রতি আমার আস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলেই আমি এতবড় ঝুঁকি নিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। মালী হত্যার ঘটনাকে সে যেভাবে অকপটে স্বীকার করে নিয়েছে, তাতেই আমার মনে হয়েছে যে, সে এক সত্যবাদী যুবক । জীবন বাঁচানোর জন্য কখনোই সে মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিবে না । এক কথায়, সততা, সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততায় মুগ্ধ হয়েই আমি তার জামিন হয়েছি।

এক ফোঁটা চোখের পানি – ইসলামিক গল্প

 এক ফোঁটা চোখের পানি, হলো একটি ইসলামিক গল্প। আল্লাহর দরবারে এক ফোঁটা চোখের পানি মূল্য কত তা সম্মানিত লেখক গল্পের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। গল্প প্রিয় পাঠক পাঠিকাদের জন্য “এক ফোঁটা চোখের পানি” গল্পটি এখানে তুলে ধরা হলো। 


সাহাবীদের গল্প: এক ফোঁটা চোখের পানি! 

মানুষ কাঁদে। বিভিন্ন কারণে কাঁদে। সে বিপদ-মসিবতের সম্মুখীন হয়ে যেমন কাঁদে, তেমনি কাঁদে আনন্দের আতিশয্যেও। আবার কখনো কখনো পাপ করার পর অনুতপ্ত হয়ে অনুশোচনার অশ্রুও সে ঝরায়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে ছোট্ট বালকের মতো ।

আল্লাহ পাক কান্নাকে অত্যন্ত ভালবাসেন। পছন্দ করেন। বান্দা যখন কোনো গুনাহ করে চরমভাবে লাঞ্ছিত হয়; অনুশোচনার আগুন তার ভিতরটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়; ঝরঝর করে ঝরতে থাকে অনুতপ্ত হৃদয়ের তপ্ত অশ্রু, তখন আল্লাহ পাকের রহমতের সাগরে জোশ্ উঠে। ফলে এরূপ ব্যক্তিকে আল্লাহ তা’আলা কেবল ক্ষমার ঘোষণাই দেন না, বরং তাকে পূর্বের চেয়ে অধিক মর্যাদাকর স্তরে উন্নীত করেন। অন্তর্ভুক্ত করে নেন নৈকট্যশীল বান্দাদের মধ্যে।

এক হাদীসে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দু’টি চক্ষুর উপর জাহান্নামের আগুন হারাম। প্রথমত: যে চক্ষু আল্লাহর ভয়ে কেঁদেছে। দ্বিতীয়ত: যে চক্ষু ইসলাম ও মুসলমানদের হেফাজতের জন্য জাগ্রত রয়েছে।

অপর এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে চক্ষু আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম এবং যে চক্ষু নাজায়েজ দেখা থেকে বিরত রয়েছে তার উপরও জাহান্নামের আগুন হারাম এবং যে চক্ষু আল্লাহর রাস্তায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে তার উপরও জাহান্নামের আগুন হারাম।

অন্য এক দীর্ঘ হাদীসের শেষাংশে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা’আলার নিকট বান্দার তিনটি কাজ অতীব প্রিয়-

  • (ক) জান ও মাল দ্বারা আল্লাহর রাহে শক্তি ব্যয় করা
  • (খ) পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্রন্দন করা
  • (গ) অনু কষ্টের সময় ধৈর্য ধারণ করা । 

উপরোক্ত হাদীসসমূহ এবং সংক্ষিপ্ত আলোচনা দ্বারা একথা স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হলো যে, চোখের ঐ পানি যা আল্লাহর ভয়ে নির্গত হয় তার মূল্য অনেক বেশি। এর দ্বারা বান্দা অতি অল্প সময়ে মাওলা পাকের নিকটবর্তী হতে পারে। পরিগণিত হতে পারে তার প্রিয় বান্দা হিসেবে। আর এ জন্যই মানুষের প্রকাশ্য শত্রু শয়তানের নিকট অনুতাপের অশ্রু অত্যন্ত অপছন্দনীয়। সে কিছুতেই গুনাহগারদের চোখের পানিকে বরদাশত করতে পারে না। কারণ সে জানে যে, বান্দা হাজার হাজার গুনাহ করে যে পরিমাণ আল্লাহ থেকে দূরে সরবে, অল্প সময় অনুতাপ ও অনুশোচনার অশ্রু ফেলে সে অনেক বেশী আল্লাহর নিকটবর্তী হয়ে যাবে । নিম্নে এ ধরনের একটি ঘটনাই পাঠক সমীপে উল্লেখ করছি।

ছোট্ট একটি গৃহ । এরই এক কোণে বিশ্রাম নিচ্ছেন রাসূলের প্রিয় সাহাবী হযরত মুআবিয়া (রা.)। একটানা দীর্ঘক্ষণ মানুষের অভাব অভিযোগ শ্রবণের ফলে তিনি এখন ভীষণ ক্লান্ত । তাই বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন তিনি ।

হঠাৎ কারো ডাকে হযরত মুআবিয়া (রা.)-এর ঘুম ভেঙ্গে যায়। তিনি উঠে বসলেন। এদিক ওদিক তাকালেন। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না । ভাবলেন, কে আমাকে ঘুম থেকে উঠাল? দরজা-জানালা বন্ধ ৷ কোনো মানুষেরতো ভিতরে আসার উপায় নেই । তাহলে ঘটনা কি?

মুআবিয়া (রা.) বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তন্ন তন্ন করে গোটা কামরা তালাশ করলেন। হঠাৎ দেখলেন, একটি লোক দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে । তার মুখখানা কালো কাপড়ে ঢাকা ৷

: কে তুমি? মুআবিয়া (রা.) কঠিন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন।

: আমি আপনার এক অতি পরিচিত ব্যক্তি ।

: কি তোমার নাম?

: আমার নাম সবাই জানে। আমি ইবলিস।

: অভিশপ্ত ইবলিশ। তুই এখানে কেন। কি মতলব নিয়ে এখানে এসেছিস?

: হযরত! রাগ করবেন না। অন্য সময় আমি মন্দ উদ্দেশ্য নিয়ে আপনার নিকট আসলেও এখন কিন্তু মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছি।

: বল, তোমার মহৎ (!) উদ্দেশ্যটা কি?

: জনাব ! নামাজের সময় শেষ হয়ে আসছে, তাই আপনাকে জাগিয়ে দিয়েছি। যেন মসজিদে গিয়ে যথাসময়ে নামাজ আদায় করতে সক্ষম হন। আপনার নিশ্চয় জানা আছে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- সময় শেষ হওয়ার আগেই জলদি ইবাদত আদায় কর ।

: আমি এতো বোকা নই যে তোর একথা বিশ্বাস করব! তোর কথা তো ঐ চোরের ন্যায় হলো, যে ঘরে চুরি করতে এসে বলে যে, আমি পাহারা দিতে এসেছি। সুতরাং তোর কথা সম্পূর্ণ মিথ্যে। যদি নিজের মঙ্গল চাস্ তবে সত্য কথা খুলে বল।

: মুহতারাম! আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমিও তো এক সময় আল্লাহর রহমতের সমুদ্র থেকে পানি পান করেছি। তাঁর সন্তুষ্টির বাগান থেকে পরিতৃপ্ত হয়েছি। আজ কোনো এক কারণে তাঁর অভিসম্পাতের পাত্রে পরিণত হয়েছি। তথাপি তাঁর অনুগ্রহের দ্বার তো একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। তাই এ অভিশপ্ত জীবনেও মাঝে মাঝে ভাল কাজ করে তাঁকে স্মরণের স্বাদ অনুভব করি। অন্তরের মণিকোঠায় শান্তি খুঁজি।

: কথাটি সত্য। তবে তোর বেলায় নয়। কারণ, আজ পর্যন্ত তুই লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছিস। মানুষের মঙ্গল তোর উদ্দেশ্য নয়। মনে রাখবি, কোনো প্রকার চালাকি কিংবা বাকপটুতা দেখিয়ে তোর শেষ রক্ষা হবে না । হে অভিশপ্ত! বল, তুই কেন এবং কি উদ্দেশ্যে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়েছিস?

: হযরত! আমার প্রতি আপনাদের স্বভাবগত বৈরীতা আছে। আপনারা আমাকে দু’চোখে দেখতে পারেন না, তাই আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না। আসলে আমার কাজ হলো, সৎলোকদের সৎকাজের দিকে এবং অসৎলোকদের পাপ কাজের দিকে দিকে উদ্বুদ্ধ করা ।

এবার মুআবিয়া (রা.) অত্যধিক রাগান্বিত হলেন। তিনি দাঁতে দাঁত পিষে বজ্রকন্ঠে বললেন, শয়তান কোথাকার! আবারো বলছি কথার মারপ্যাচ খাটানোর চেষ্টা করবি না। আসল উদ্দেশ্যটা খুলে বল্ । নইলে.. মুআবিয়া (রা.)-এর কথা শেষ হলো না । এরই মধ্যে ইবলীস বলে উঠল-

কারো প্রতি খারাপ ধারণা জন্মালে তার সত্য কথাটি শত দলিল প্রমাণ দিয়ে উপস্থাপন করলেও মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না । কারণ একবার মনে সংশয়ের সৃষ্টি হলে দলিল প্রমাণ দ্বারা সেই সংশয় আরো বৃদ্ধি পায় ৷ আমার অপরাধ শুধু এখানেই যে, আমি একটি ভুল করে বসেছিলাম। এতে গোটা দুনিয়ায় আমার দুর্নাম রটে গেছে। এখন অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজে পাপ করে, আর সে পাপের অভিসম্পাত আমার উপর এসে পড়ে। এছাড়া সত্যবাদী বা মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার এমন কি কষ্ঠিপাথর আপনার নিকট আছে যে, আপনি আমাকে বারবার মিথ্যুক সাব্যস্ত করছেন? ইবলীস কিছুটা উত্তেজিত হয়েই কথাগুলো বলল।

মুআবিয়া (রা.) বললেন- হ্যাঁ, আমার নিকট সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করার কষ্টিপাথর অবশ্যই আছে । তা এই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“মিথ্যা অন্তরে সংশয়ের জন্ম দেয় আর সত্য মনে স্বস্তি আনয়ন করে ৷”

অর্থাৎ মিথ্যা মানুষের অন্তরকে অস্থির করে তুলে। শান্ত মনকে অশান্ত করে। দিল কিছুতেই তখন স্থির হয় না। পক্ষান্তরে সত্য কথায় অন্তরে স্বস্তি আসে, দিল শান্ত হয় এবং নিজে তা গ্রহণ করতে উদ্বেলিত হয়। হে বিতাড়িত শয়তান! আমি মহান আল্লাহর অপরিসীম অনুগ্রহে · আমার চরিত্রকে কুপ্রবৃত্তির চাহিদা, লোভ ও হিংসা থেকে পবিত্র করে নিয়েছি। আমার দিল এ পরিমাণ পবিত্র ও আলোকিত হয়ে গেছে যে, আমি সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে সক্ষম।

হে অভিশপ্ত! জবাব দে এবং সত্য করে বল কেন তুই আমাকে ঘুম থেকে ডেকে জাগিয়ে তুলেছিস। কেননা, তুই মানুষের প্রকাশ্য শত্রু ৷ তুই চাস প্রতিটি মানুষ যেন এমন গভীর ঘুমে আছন্ন থাকে, যাতে তার নামাজ কাযা হয়ে যায়। এ পর্যায়ে এসে হযরত আমীরে মুআবিয়া (রা.) শয়তানকে শক্ত করে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ফেললেন এবং বললেন, এবার সত্য কথা না বলা পর্যন্ত তোকে ছাড়ছি না৷

শয়তান এবার বিপাকে পড়ে গেল। সে বাধ্য হলো সত্য কথা বলতে। কেননা, এতক্ষণে তার সকল প্রকার ধোঁকাবাজী ও ছল-চাতুরীর মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গেছে। সে বলল-

দেখুন জনাব! আমি আপনাকে এ জন্য ঘুম থেকে জাগ্রত করেছি যেন আপনি জামাতের সাথে নামাজ আদায় করে আশ্বস্ত হন এবং এই ভেবে মনে মনে তৃপ্তি অনুভব করেন যে, আমি ফরজ নামাজ আদায় করতে পারলাম । নতুবা আপনার অভ্যাস আমার ভাল করেই জানা আছে যে, যদি ঘুম কিংবা অন্য কোনো কারণে আপনার এক ওয়াক্ত নামাজও ছুটে যায়, তাহলে সমগ্র দুনিয়া আপনার সামনে অন্ধকার হয়ে আসে। সীমাহীন পেরেশান ও অস্থির হয়ে পড়েন আপনি। এমনকি এর জন্য আপনি অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়ে এত বেশি কান্নাকাটি ও অশ্রু বিসর্জন দেন যা আপনাকে সময় মত নামাজ পড়ার চেয়েও অধিক সম্মানজনক স্থানে উন্নীত করে দেয় । আর আপনি এত সওয়াব ও মর্যাদার অধিকারী হওয়াটা আমার একেবারে সহ্যের বাইরে। কিছুতেই আমি এটাকে বরদাস্ত করতে পারি না । তাই আমি আপনাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছি। নইলে নামাজ আমার সহ্যের বস্তু ছিল কোন কালে যে, তার জন্য আমি আপনাকে জাগিয়ে তুলব !

ইবলীসের এ বক্তব্য শুনে হযরত মুআবিয়া (রা.) বললেন, হ্যাঁ, এবার তুই সত্য কথা বলেছিস্। বাহ্যত তুই আমাকে ভালোর দিকে আহবান করলেও তোর উদ্দেশ্য ভাল নয়। তোর মতলব খুবই খারাপ। তুই চাস আমি অনুতপ্ত হৃদয় নিয়ে আল্লাহর দরবারে যেন হাজির হতে না পারি এবং চক্ষুদ্বয় থেকে অনুশোচনার অশ্রু ঝরাতে না পারি। কারণ, মু’মিন ব্যক্তি অনুতপ্ত হয়ে যে অশ্রু বিসর্জন দেয়, তা আল্লাহর দরবারে তাকে অধিক সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করে। আর তোর জন্য তা দেখা দেয় অত্যধিক মর্মজ্বালা হয়ে ।

প্রিয় মুসলিম ভাইগণ! আমি আগেও বলেছি এবং এখনও বলছি যে, আল্লাহর ভয়ে কিংবা তাঁর স্মরণে কান্নাকাটি করা অনেক বড় নিয়ামত । বড় ভাগ্যবান ঐ সমস্ত ব্যক্তি যাদেরকে আল্লাহ তা’আলা এ নিয়ামত দান করেছেন। হাদীস শরীফে আছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করেছে, সে ঐ পর্যন্ত জাহান্নামে প্রবেশ করবে না, যে পর্যন্ত দুধ স্তনের মধ্যে পুনঃ প্রবেশ না করে।

অর্থাৎ দুধ স্তনের মধ্যে প্রবেশ করা যেমন অসম্ভব, তেমনি তার জাহান্নামে প্রবেশ করাও সেরূপ অসম্ভব । আরেক হাদীসে আছে-

যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কেঁদেছে, এমনকি তার চোখের এক ফোঁটা পানিও মাটিতে পড়েছে, কিয়ামতের দিন তাকে কোনো আজাব দেওয়া হবে না ।

সুতরাং আমার সকল পাঠক-পাঠিকা ও মা-বোনদের বলছি- আসুন, আজ থেকেই আমরা দিবা-রাত্রির একটি নির্জন প্রহর বেছে নেই এবং ঐ সময় আল্লাহ তা’আলাকে গভীরভাবে স্মরণ করি। অতীতের গুনাহের কথা মনে করে বারঝর করে কাঁদতে থাকি । অনুতপ্ত হৃদয় থেকে অনুশোচনার অশ্রু বিসর্জন দেই। আমার বিশ্বাস, আমাদের এ অশ্রু কখনোই বৃথা যাবে না, যেতে পারে না। হাদীস শরীফে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- যেদিন আল্লাহর ছায়া ব্যতীত অন্য কোনো ছায়া হবে না, সেদিন আল্লাহ তা’আলা সাত ব্যক্তিকে আপন রহমতের ছায়ার নিচে আশ্রয় দান করবেন। তন্মধ্যে একজন হলো ঐ ব্যক্তি যে নির্জনে বসে আল্লাহর জিকির করে এবং তার চক্ষু থেকে অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকে। বুখারী, মুসলিম

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে চক্ষু থেকে আল্লাহর ভয়ে সামান্য মাছির মাথা পরিমাণ পানিও বের হয়েছে আল্লাহ পাক ঐ চেহারাকে দোজখের জন্য হারাম করে দিয়েছেন ৷ তিনি আরও বলেন- মানুষের অন্তর যখন আল্লাহর ভয়ে কাঁপতে থাকে তখন গাছের পাতার মতো তাঁর পাপসমূহ ঝরে যায়।

হযরত উকবা ইবনে আমের (রা.) একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে জিজ্ঞেস করেন- হে আল্লাহ রাসূল! নাজাতের উপায় কি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আপন জিহ্বাকে সাবধানে চালনা কর। ঘরে বসে থাক এবং আপন অপকর্মের জন্য কাঁদতে থাক ৷

একদা আম্মাজান হযরত আয়েশা (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার উম্মত থেকে কেউ কি বিনা হিসাবে বেহেশতে প্রবেশ করবেন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হ্যাঁ, যে আপন গুনাহকে স্মরণ করে কাঁদতে থাকে (সে বিনা হিসেবে বেহেশতে প্রবেশ করবে)। অন্য এক হাদীসে আছে, দু’টি ফোঁটা আল্লাহর নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয়। একটি অশ্রুর ফোঁটা, অন্যটি আল্লাহর রাস্তায় পড়া রক্তের ফোঁটা।

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাযীঃ) বলেন, যার কান্না আসে সে তো কাঁদবেই আর যার কান্না আসে না সে কমপক্ষে কান্নার ভান করবে ।

মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদের (রা.) চোখের পানি মুখে এবং দাঁড়িতে মুছে দিতেন এবং বলতেন- বর্ণিত আছে, জাহান্নামের আগুন ঐ স্থান স্পর্শ করে না যেখানে কান্নার পানি পৌঁছায় ।

হযরত ছাবেত বানানী (রহঃ)-এর চোখে বেদনা অনুভূত হলে তিনি ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। ডাক্তার বললেন-আপনি কান্না বন্ধ করলেই চোখ ভাল হয়ে যাবে। জবাবে তিনি বলেন- কান্না বন্ধ করা আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় । কেননা, ঐ চক্ষুর কি মূল্য আছে যে চক্ষু কাঁদে না ।

এযীদ ইবনে মাইসারা (র.) বলেন, মানুষ সাত কারণে কেঁদে থাকে। যথা-

  • ১) আনন্দের দরুন।
  • ২) পাগলামির দরুন।
  • ৩) ব্যথার কারণে।
  • ৪) ভয় পেলে।
  • ৫) দেখানোর জন্য।
  • ৬) নেশা অবস্থায়।
  • ৭) আল্লাহর ভয়ে ।

শেষোক্ত কান্নাই এমন কান্না যার একটি মাত্র ফোঁটা অগ্নির সমুদ্রকে নিভিয়ে দিতে সক্ষম ।

কা’আব আহবার (রা.) বলেন, যার হাতে আমার জান সেই আল্লাহর কসম করে বলছি- আল্লাহর ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে চেহারা ভিজিয়ে ফেলা আমার নিকট পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ সদকা করার চেয়েও অধিক পছন্দনীয়৷

আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে উল্লিখিত ঘটনা ও হাদীসসমূহ থেকে শিক্ষা নিয়ে আল্লাহর ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসানোর অভ্যাস গড়ে তোলার তৌফিক নসীব করুন। আমীন ।

আর পাঠক-পাঠিকাদের সমীপে আরজ হলো, এ বিশেষ মুহূর্তে আপনারা অধম লেখক ও তার পরিবার পরিজনকে যেন ভুলে না যান । হতে পারে আপনাদের এ নেক দোয়া ও সুদৃষ্টি তাদেরকে সফলতার স্বর্ণ শিখরে পৌছে দিবে এবং কিয়ামতের কঠিন দিনে নাজাতের অসিলা হবে । হে দয়াময় প্রভু! তুমি আমাদের সকলের উপর অনুগ্রহ বর্ষণ কর। তোমার হুকুমগুলো একশভাগ মানার তৌফিক দাও। আমীন । ছুম্মা আমীন৷  

টুকরো কথা।

শরীয়তের একটি বিন্দু মুছে যাওয়া আসমান জমীন স্থানচ্যুত হওয়ার চাইতেও গুরুতর। হযরত ঈসা (আঃ)

নবীজির স্ত্রীদের নাম ও নামের তালিকা অর্থসহ

 নবীদের সর্দার প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর নাযিলকৃত সর্বশেষ গ্রন্থ আল কুরআনুল কারীমে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান দান করেছেন। রাসূল (সাঃ)-মের স্ত্রীদেরকে মুমিনদের মা বলে সম্বোধন করা হয়েছে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন বলেন..

“নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের (বিশ্বাসীগণদের) মাতা”। (সূরা আল-আযহাব-৬)   



রাসূল (সাঃ)-মের স্ত্রীগণ সাধারণ নারী ছিলেন না। তাই মহান আল্লাহ তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন….

“হে নবী পত্মীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও।” (সূরা আল আযহাব-৩২)

বর্তমানে অনেক মুসলিম নারীগণ বিবাহের পর নিজের নামের পাশে স্বামীর নাম যোগ করে পরিচয় দিতে থাকেন। পক্ষান্তরে মহানবী (সাঃ)-এর পবিত্র সহধার্মিণীগণ রাসূল (সাঃ)-মের স্ত্রী হবার সৌভাগ্য লাভ করেও তারা নামের শেষে রাসূল (সাঃ)-মের নাম যোগ করেনি বরং নবীজির স্ত্রীগণ তাদের নামের শেষে পিতার নাম যোগ করেই পরিচয় দিতেন। আর নামের শেষে পিতার নাম যোগ করে পরিচয় দেওয়াই হচ্ছে আল কুরআনের প্রকৃত শিক্ষা। মহান আল্লাহ পাক বলেনঃ

“তোমরা তাদেরকে পিতৃ পরিচয়ে ডাক, এটাই আল্লাহর কাছে ন্যায় সঙ্গত”। (সূরা আল আযহাব-৫) 

এ সম্পর্কে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

“কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে ডাকা হবে তোমাদের নামে এবং তোমাদের পিতার নামে।” 

মুহাম্মদ (সাঃ)-মের স্ত্রীদের নাম অর্থসহ

প্রিয় পাঠক পাঠিকা, আপনার নবজাতক শিশু কন্যার নাম যাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের নাম অনুকরণে একটি নাম নির্বাচন করতে পারেন সেজন্য আজ আমি নবীজির স্ত্রীদের নাম ও নামের অর্থগুলি আমার বাংলা পোস্ট.কমের মাধ্যমে আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি। প্রিয় নবীজির স্ত্রী হবার সৌভাগ্য যারা লাভ করেছিলেন সেসকল সৌভাগ্য ও মর্যাদাবান নারীদের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিচে তুলে ধরা হলো। তাহলে চলুন নবীজির স্ত্রীদের নাম ও নামের অর্থ জানা শুরু করি… 

০১. খাদিজাহ ( Khadijah ) = অসম্পূর্ণ।

পূর্ণ নামঃ খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (Khadijah Binti Khuwailid)। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-মের প্রথম স্ত্রী ও সর্ব প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী  ব্যক্তি ও নারী এবং সফল ব্যবসায়ী। রাসূল (সাঃ) সর্বপ্রথম প্রিয় স্ত্রী খাদিজাহকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিয়েছিলেন এবং উম্মুল মুমিনিন ( বিশ্বাসীগণদের মাতা) হযরত খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ বিনাপ্রশ্নে নবীজির দাওয়াত কবুল করেছিলেন। পবিত্র চরিত্রের জন্য মা খাদিজাহ বিনতে খুওয়াইলিদ ইসলাম গ্রহণের পূর্বেই তাহিরা উপাধি লাভ করেছিলেন যার অর্থ পবিত্র। তিনি খাদিজাতুল কোবরা নামেও পরিচিত। 

০২. সাওদাহ (Sawda) = খেজুর গাছের পূর্ণভূমি।

পূর্ণ নামঃ সাওদাহ বিনতে জামআ ( Sawda Bint Jam’a) । তিনি প্রথমে আস-সাকরান ইবনে আমরকে বিয়ে করেন এবং তাদের ছেলে আব্দুর রহমান ইবনে সাকরান জালুলা যুদ্ধে নিহত হন। প্রথম স্বামী আস-সাকরান ইবনে আমর মৃত্যুর পরে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) সাওদা বিনতে জাম’আ কে বিয়ে করেন এবং উম্মুল মুমিনিন মর্যাদা লাভ করেন। 

০৩. আয়িশাহ ( Aishah)= জীবন্ত।

পূর্ণ নামঃ আয়িশা বিনতে আবু বকর (Aishah Binti Abu Bakar)। উম্মুল মুমিনিন মা আয়িশাহ সিদ্দীকা ছিলেন নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর তৃতীয় স্ত্রী ও প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু বকর (রাঃ) মেয়ে। পিতা আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ছিলেন রাসূল (সাঃ) এর একজন বিশ্বস্ত  সাহাবী ও সহচর ছিলেন। উম্মুল মুমিনিন মা আয়িশাহ সিদ্দীকা (রাঃ) ইসলামের ঐতিহ্যগত ইতিহাসেও তার অবদান অনস্বীকার্য এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

০৪. হাফসাহ (Hafsah) = একত্রিত।

পূর্ণ নামঃ হাফসা বিনতে ওমর( Hafsah Binti Umar)। নবীজির স্ত্রী ও উম্মুল মুমিনিন। মা হাফসা (রাঃ) ছিলেন দ্বিতীয় খলিফা ও প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) এর মেয়ে। তিনি প্রথমে হুনাইস ইবনে হুজাইফাকে বিয়ে করেন ও পরে বিধবা হন। ইদ্দত শেষ হবার পর পিতা ওমর (রাঃ) প্রথমে হযরত উসমান ইবনে আফফান (রাঃ) ও পরে হযরত আবু বকর সিদ্দিকী (রাঃ) কে হাফসা (রাঃ) কে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। এই দুই সাহাবী প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে তখন বাবা ওমর নবী মুহাম্মদ (সাঃ)কে বিয়ের প্রস্তাব দিলে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) তিনি হাফসাকে বিয়ে করেন। 

০৫. জয়নব ( Zaynab )= সুগন্ধি।

পূর্ণ নামঃ জয়নব বিনতে খুযায়মা (Zaynab Bint Khuzayma)। তিনি আরবের সুলাইম গোত্রের মেয়ে। জয়নব (রাঃ) প্রথম স্বামীর নাম আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রাঃ)। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রাঃ) উহুদ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করলে প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) জয়নব বিনতে খুযায়মাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। মহিলা সাহাবী জয়নব (রাঃ) নবীজির বিয়ের প্রস্তাবে সম্মত হলে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)  জয়নব (রাঃ)কে ৪০০ দিরহাম মোহরানা দিয়ে জিলহজ্জ মাসের শেষেরদিকে বিয়ে করেন। নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে বিবাহের তিন মাসের মাথায় উম্মুল মুমিনিন জয়নব বিনতে খুযায়মা (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন এবং জান্নাতুল বাকিতে সমাহিত করা হয়। 

০৬. জুওয়াইরিয়া (Juwayriyya)= প্রবাহিত ধারা।

পূর্ণ নামঃ জুওয়াইরিয়া বিনতে আল হারিস (Juwayriyya Bint Al Harith) । মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর স্ত্রী ও মুসলমানদের মা। উম্মুল মুমিনিন জুওয়াইরিয়া (রাঃ) তিনি ছিলেন বনু মুস্তালিক গোত্রের প্রধান আল হারিস ইবনে আবি দিয়ারের কন্যা। যখন রাসূল (সাঃ) জুওয়াইরিয়া (রাঃ)-কে বিয়ে করেন তখন তাঁর বয়স ছিল ২০ এবং রাসূলের (সাঃ) বয়স ছিল ৫৮। রাসূল (সাঃ) জুওয়াইরিয়া (রাঃ) কে ৫ হিজরি সনে বিবাহ করেছিলেন।  

০৭. মাইমূনাহ ( Maymunah )= বারকাত প্রাপ্তা।

পূর্ণ নামঃ মাইমুনা বিনতে আল হারিস আল হিলালিয়াহ ( Maymunah Binti Al-Harith Al Hilaliyah) । নবীজির স্ত্রী ও মুসলমানদের মাতা। মাইমুনা (রাঃ) এর প্রকৃত নাম  ছিল বাররাহ কিন্তু রাসূল (সাঃ) তাঁর নাম পরিবর্তন করে মায়মুনা রেখেছিলেন। মায়মুনা (রাঃ) ছিলেন রাসূলের (সাঃ) স্ত্রীদের মধ্যে সর্বশেষ স্ত্রী। 

০৮. সাফিয়া (Safiyah)= ছাটাইকৃত ।

পূর্ণ নামঃ সাফিয়া বিনতে হুওয়াই (Safiyah Binti Huyay )। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী ও উম্মুল মুমিনিন (মুসলমানদের মাতা) । তিনি ছিলেন মদিনার ইহুদী গোত্র বনু নাদিরে গোত্র প্রধান হুওয়াই ইবনে আকতাবের কন্যা। প্রথমে সাফিয়া (রাঃ) সালাম ইবনে মিশকামের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবব্ধ হন ও পরে তালাক প্রাপ্ত হন। 

০৯. মারিয়া (Maria) = বাছুরওয়ালি গাভী ।

পূর্ণ নামঃ মারিয়া আল কিবতিয়া (Maria Al Qibtiyya)। রাসূলের (সাঃ) এর স্ত্রী ও উম্মুল মুমিনিন। মারিয়া বিনতে শাম’উন তিনি মারিয়া আল-কিবতীয়া নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি একজন মিশরীয় খৃষ্টান নারী ও কৃতদাসী ছিলেন। তৎকালীন আলেক্সান্দ্রীয় কিবতীয় অর্থডক্স রাজ্যপাল মুকওকিস তাঁকে ও তাঁর বোন সিরিন বিনতে শামউনকে রাসূলের (সাঃ) নিকট উপহার স্বরূপ প্রেরণ করেন। হযরত মারিয়া (রাঃ) ইসলাম গ্রহন করলে রাসূল (সাঃ) তাকে বিবাহ করেন। 

১০. রায়হানা (Raihanah)= ফুলের তোড়া ।

পূর্ণ নামঃ রায়হানা বিনতে যায়েদ (Raihanah Binti Zaid)। নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর স্ত্রী ও মুসলিমদের মাতা। হযরত রায়হানা (রাঃ) তিনি ছিলেন বনু নাযির গোত্রের একজন ইহুদি নারী। তিনি ইসলাম গ্রহণের রাসূল (রাঃ) রায়হানা (রাঃ)-কে বিবাহ করেন। 

১১. উম্মে সালামাহ (Umme Salamah= নরম হাত-পা ওয়ালী মা।

পূর্ণনামঃ উম্মে সালামাহ হিন্দ বিনতে আবি উমাইয়া ( Umme Salamah Hind Bint Abu Umayya)। উম্মে সালামাহ (রাঃ) এর প্রকৃত নাম ছিল হিন্দ আল-মাখজুমিয়া। তিনি ও তাঁর প্রথম স্বামী আবু সালামা ইবনে আল আসাদ প্রথম যুগে ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। উহুদ যুদ্ধে উম্মে সালামাহ (রাঃ) স্বামী মারাত্মকভাবে আহত হন এবং শেষ অবধি  মারা যান। এ সময় উম্মে সালামাহ (রাঃ) এর সন্তান সংখ্যা চারজন। এই অসহায় অবস্থা থেকে উম্মে সালামাহকে (রাঃ) পরিক্রাণ দিতে মহানবী (সাঃ) তাকে বিবাহ করেন। 

১২. উম্মে হাবীবাহ (Umme Habibah) = প্রিয় পাত্রীর মা।

পূর্ণ নামঃ রামালাহ বিনতে আবি সুফিয়ান ( Ramlah Binti Abu Sufyan) । নবীজির স্ত্রী ও উম্মুল মুমিনিন। তিনি উম্মে হাবীবাহ নামে বেশি পরিচিত। রামালাহ বিনতে আবি সুফিয়ান (রাঃ) ছিলেন আবু সুফিয়ান বিনে হারব ও সাফিয়া বিনতে আবি আল আ’স এর মেয়ে। প্রাথমিক জীবনে উম্মে হাবিবাহ (রাঃ) উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাশের স্ত্রী ছিলেন। প্রথম স্বামী উবায়দুল্লাহ হাবশায় হিজরতের পর ইসলাম ত্যাগ করলে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। 

হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বংশধরদের উপর করুণা ও অশেষ রহমত বর্ষণ করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বোচ্চ প্রশংসিত এবং সম্মানের অধিকারী। 

এরই নাম খাঁটি তওবা (সালাবা (রাঃ) তাওবার ঘটনা!)

 এরই নাম খাঁটি তওবা, এটি সালাবাতুল আনসারি (রাঃ)-এর তাওবার ঘটনা। এই সাহাবীর তওবার ঘটনাটি অনেক আলেম ওয়ালামাগণ বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে বর্ণনা করেন।


এরই নাম খাঁটি তওবা – সালাবা (রাঃ) এর তাওবার ঘটনা!

হিজরতের পর আনসার আর মুহাজিরদের মাঝে গড়ে উঠেছে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক। মদীনার আনসারগণ মুহাজির ভাইদের জন্য ত্যাগ ও কুরবানীর অপূর্ব নজির পেশ করছেন। তাদের আরাম ও শান্তির জন্য অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানসহ সকল ধরনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন ৷ এমনকি একাধিক স্ত্রী থাকলে মুহাজির ভাইয়ের পছন্দমত কোনো একজনকে তালাক দিয়ে তাকে তার হাতে তুলে দেয়ার আগ্রহও পেশ করছেন । মোট কথা মক্কা থেকে আগমনকারী মুহাজির ভাইদের কোনো প্রকার কষ্ট ও অসুবিধা যাতে না হয় সেদিকে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে চলছেন মদীনার আনসারগণ।

আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন স্বয়ং রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি একেকজন মুহাজিরকে একেকজন আনসারীর ভাই বানিয়ে দিয়েছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তকে আনসারগণ এতটাই আনন্দচিত্তে গ্রহণ করেছিলেন যে, পূর্বে কারো দুই ভাই থাকলে এখন তিনি মনে করতেন, আমার ভাই তিনজন। এক কথায় আনসারগণ মুহাজিরদেরকে আপন ভাইয়ের মতোই শ্রদ্ধা, ভক্তি ও সম্মান দিতেন।

সাঈদ ইবনে আব্দুর রহমান ছিলেন মুহাজির সাহাবী । হিজরতের পর তিনি ও সালাবাতুল আনসারী (রা.)-এর মাঝে সৃষ্টি হয় ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাবূক অভিযানে গেলেন, তখন তাঁর সাথে গমন করেছিলেন হযরত সাঈদ ইবনে আব্দুর রহমান (রা.)। আর সালাবাতুল আনসারী (রা.) পেয়েছিলেন সাঈদ (রা.) – এর বাড়িঘর দেখাশুনার দায়িত্ব।

সালাবা (রা.) প্রত্যহ সাঈদ (রা.) এর বাড়িতে আসতেন । খোঁজ- খবর নিতেন। কোনো কাজ থাকলে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে পালন করতেন।

একদিনের ঘটনা।

সালাবা (রা.) সাঈদ (রা.) এর বাড়ী আসলেন। খোঁজ খবর নিলেন। এ সময় বাড়ীতে সাঈদ (রা.) -এর সুন্দরী স্ত্রী ছাড়া আর কেউ ছিল না। এ সুযোগে সালাবা (রা.) কে অভিশপ্ত শয়তান ফুসলাতে লাগল । বারবার ধোঁকা দিল। হযরত সালাবা (রা.) শয়তানের ধোঁকায় পড়ে গেলেন। তিনি অগ্র-পশ্চাত না ভেবে পর্দা সরিয়ে ঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। অতঃপর সাঈদ (রা.)-এর স্ত্রীর হাত স্পর্শ করলেন।

এ অপ্রত্যাশিত অস্বাভাবিক আচরণে সাঈদ (রা.)-এর স্ত্রীর বুক থর থর করে কেঁপে উঠে। শিউরে উঠে তার শরীর। বিবর্ণ হয়ে উঠে মুখমণ্ডল। চোখ দু’টোতে ফুটে উঠে ভয়ার্ত ভাব। তিনি বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলেন-

‘হে আল্লাহর বান্দা! আপনার যে ভাই খোদার রাহে জিহাদে গিয়েছেন, আপনি কি তার আমানতে খেয়ানত করতে উদ্যত হয়েছেন?”

 এতটুকু কথা সালাবা (রা.)-এর অন্তরে ঝড়ের তাণ্ডব শুরু করল । একটা অভূতপূর্ব আলোড়ন দোলা দিয়ে গেল তার হৃদয় মনে। কেঁপে উঠল অন্তরাত্মা । তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন।

ভুল বুঝতে পেরে তিনি এক মুহূর্ত কাল বিলম্ব করলেন না । সাথে সাথে ক্ষমা, ক্ষমা বলে চিৎকার করে সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন। বারবার প্রচণ্ড আওয়াজে বলতে লাগলেন- “ইলাহী! আমি পাপী। আমি গুনাহগার। কিন্তু তুমি ক্ষমাশীল দয়াবান ।”

ঘটনার কয়েকদিন পর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক অভিযান শেষে সাহাবীদের নিয়ে মদীনায় তাশরীফ আনলেন। তখন মদীনায় যারা ছিলেন তাদের সকলেই গাজী ভাইদের সংবর্ধনার জন্য এগিয়ে এলেন। কিন্তু সালাবা (রা.)-কে কোথাও দেখা গেল না। তিনি ক্ষমা প্রাপ্তির আশায় পাগলের ন্যায় এদিক সেদিক উদভ্রান্তের ন্যায় ঘুরতে লাগলেন।

সাঈদ (রা.) বাড়ি এসে সব কিছু শুনলেন। সালাবা (রা.)-এর উপর চরম অসন্তুষ্ট হলেন। কিন্তু যখন তিনি ক্ষমা প্রাপ্তির ব্যাপারে তার নজিরবিহীন অস্থিরতার কথা শুনলেন তখন তার রাগ পড়ে গেল। তিনি ভাবলেন, শয়তানের ধোঁকায় পড়েই সালাবা এমনটি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। সুতরাং এখন তার অনুসন্ধান করা দরকার।

সাঈদ (রা.) সালাবা (রা.)-কে এখানে সেখানে সর্বত্র খুঁজে ফিরলেন। অবশেষে অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে পেয়ে বললেন- ভাই সালাবা! তুমি আমার সঙ্গে চল । আমরা তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি ।

সালাবা (রা.) বললেন, না, আমি এভাবে যাব না। যদি তুমি আমার হাতকে ঘাড়ের সঙ্গে বেঁধে সেই রশি ধরে আমাকে একটি অপমানিত গোলামের ন্যায় টেনে নিয়ে যাও, তবেই আমি যাব, অন্যথায় নয় ৷

: এরূপ করার কোনো প্রয়োজন নেই । তুমি আমার সাথে এমনি চল ।

: না, এভাবে আমি যাব না। যেতে পারি না। কারণ আমি যে মারাত্মক পাপ করেছি তার পরিণতি আমি দুনিয়াতেই ভোগ করতে চাই, আখিরাতে নয় ।

: মাফ করে দিলে তো সেই পাপের ফল ভোগ করার কোনো প্রয়োজন থাকে না ৷

: তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু আমি তোমার আমানতে হাত দিয়ে যে জঘন্য অপরাধ করেছি, তার অপমানজনক শাস্তি ভোগ না করলে আমার অস্থির মন কখনোই শান্ত হবে না। অতএব আমাকে নিতে চাইলে আমি যেভাবে বলেছি, সেভাবেই তোমাকে নিতে হবে ।

সালাবা (রা.)-এর দৃঢ়তায় সাঈদ (রা.) বিপদে পড়লেন। শেষ পর্যন্ত অপারগ হয়ে তিনি তাই করলেন ।

সালাবা (রা.) হাত ঘাড়ের সাথে বাঁধা অবস্থায় সর্বপ্রথম হযরত উমর (রা.) এর কাছে পৌঁছলেন। বললেন-আমি এরূপ পাপ করেছি। আমার এ অন্যায়ের জন্য তওবার কোন ব্যবস্থা আছে কি?

ঘটনা শুনে উমর (রা.)-এর সুন্দর মুখমণ্ডল রাগে রক্তাক্ত হয়ে উঠে। উজ্জ্বল দীপ্ত চোখ দু’টোতে যেন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। অধর দংশন করেন তিনি। অবশেষে দাঁতে দাঁত পিষে বলেন, বেরিয়ে যাও এখান থেকে । আমার নিকট তোমার কোনো তওবার ব্যবস্থা নেই ।

এরপর তারা হাজির হলেন হযরত আবূ বকর (রা.)-এর দরবারে। তাঁর নিকট সমস্ত ঘটনা খুলে বলার পর তওবার পন্থা বাতলানোর অনুরোধ করলে তিনিও তা প্রত্যাখ্যান করেন ।

সেখান থেকে নিরাশ হয়ে তারা হযরত আলী (রা.)-এর দরবারে পৌঁছলেন। কিন্তু তিনিও তাদেরকে নিরাশ করে ফিরিয়ে দিলেন। বললেন, আমার নিকট তোমার জন্য তওবার কোনো ব্যবস্থা নেই ৷

তারপর সালাবা (রা.) এক বুক আশা নিয়ে দয়ার সাগর রাহমাতুল্লিল আলামীন রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে উপস্থিত হলেন । তিনি ভাই সাঈদকে সম্বোধন করে বললেন, ভাই সাঈদ! আশা করি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিরাশ করবেন না ।

সেখানে যাওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাবা (রা.)-এর মুখের দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে তাকালেন। বললেন, সালাবা! তুমি তো আমাকে দোজখের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছ।

তখন সালাবা (রা.) বিনীত কণ্ঠে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতামাতা আপনার উপর কুরবান হোক। আমি আমার মুহাজির ভাইয়ের স্ত্রীর হস্ত স্পর্শ করেছি। এ জন্য আমি অনুতপ্ত । চরমভাবে লজ্জিত। আমি তওবা করতে চাই। আমার তওবার কোনো ব্যবস্থা আছে কি?

সালাবা (রা.)-এর গুরুতর অপরাধের কথা শুনে রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সীমাহীন বিস্মিত হলেন। তাঁর চোখে মুখে ফুটে উঠে ক্রুদ্ধভাব। তিনি কঠিন কণ্ঠে বললেন-সালাবা। এখান থেকে বেরিয়ে যাও । তোমার জন্য তওবা নেই ৷

সর্বশেষ আশ্রয়স্থল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবার থেকে নিরাশ হয়ে সালাবা (রা.) আরও বেশি অস্থির হয়ে পড়লেন। মনের অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে মুখভাবে। এবার কি করবেন তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। চরম পর্যায়ের পেরেশান হয়ে কখনও মাথার চুল টানছেন, কখনো বা অধর দংশন করে চলছেন।

এ অবস্থায় চলে গেল বেশ সময়। অতঃপর এক পর্যায়ে তিনি কি যেন ভেবে পাহাড়ের দিকে দৌড়ে পালালেন। তারপর উচ্চঃস্বরে বলতে লাগলেন-

হে দয়াময় প্রভু! আমি ওমরের নিকট হাজির হয়েছি, তিনি আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি আবূ বকর ও আলীর নিকট উপস্থিত হয়েছি, তারাও আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সর্বশেষ আমি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে বড় আশা নিয়ে হাজির হয়েছি, কিন্তু তিনিও আমাকে নিরাশ করেছেন।

কিন্তু হে দীন দুনিয়ার প্রভু! তুমি আমার মালিক, আর আমি তোমার গোলাম । তোমার সুমহান-সুউচ্চ দরবারে তোমার গোলাম হাজির হয়েছে। যদি তুমি আমাকে ক্ষমা কর, তবে আমার খুশির সীমা থাকবে না । আর যদি তুমিও আমাকে নিরাশ কর, তবে আমার ন্যায় হতভাগা আর কেউ নেই ৷

এসব কথা বলে তিনি জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন এবং ছোট্ট শিশুটির মতো আকুলভাবে ডুকরে ডুকরে কেঁদে ফিরতেন ।
একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে একজন ফেরেশ্তা হাজির হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ পাক আপনাকে জিজ্ঞেস করেছেন, এই বিশ্ব জগত ও সমগ্র মানব জাতিকে কি তিনি সৃষ্টি করেছেন না আপনি?

রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, নিঃসন্দেহে সব কিছুর স্রষ্টা আল্লাহ্ তা’আলা। এরপর ফেরেশ্তা বললেন, আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন- আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করেছি, এ সংবাদ তাঁকে পৌঁছে দিন।

ক্ষমার ঘোষণায় অপরিসীম এক আনন্দ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর মনে দোলা দিয়ে যায়। তাঁর চোখে মুখে ফুটে উঠে একটা অনাবিল মধুর হাসি । তিনি বললেন, এমন কে আছ, যে সালাবাকে আমার নিকট নিয়ে আসবে?

হযরত আবূ বকর ও উমর (রা.) সেখানেই ছিলেন। তাঁরা তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা তাঁকে নিয়ে আসি।

এমন সময় হযরত আলী ও হযরত সালমান ফারসী (রা.) বলে উঠলেন, হে আল্লাহর নবী! সালাবাকে আমরা নিয়ে আসি।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে অনুমতি দিলেন। অনুমতি পেয়ে হযরত আলী ও হযরত সালমান ফারসী (রা.) দেরি করলেন না। তারা সালাবা (রা.)-এর খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। তালাশ করলেন, মদীনার পথে-প্রান্তরে, অলিতে-গলিতে। কিন্তু না, তাঁকে কোথাও পাওয়া গেল না। অবশেষে মদীনার উপকণ্ঠে কৃষি কর্মে লিপ্ত লোকদেরকে তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে কৃষকরা বলল, আপনারা কি জাহান্নাম থেকে পলায়নকারী ব্যক্তির সন্ধান করছেন?

তাঁরা বললেন, হ্যাঁ।

তখন কৃষকদের একজন বলল, তিনি রাত্রি কালে এখানে আসেন । এ বৃক্ষতলে উপস্থিত হয়ে উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। দু’চোখ থেকে দরদর করে ঝরে পড়ে অশ্রুধারা ।

হযরত আলী ও সালমান ফারসী (রা.) তাই নির্দিষ্ট সময়ের অপেক্ষা করতে লাগলেন। যখন রাত হলো, তখন সালাবা (রা.) সেই বৃক্ষের নিচে উপস্থিত হলেন। তারপর মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে আঝোরে কাঁদতে লাগলেন।

রাতের নিকষ কালো গাঢ় অন্ধকারে এতক্ষণ তারা সালাবা (রা.)- কে দেখতে পাননি। যখন তিনি ভূপৃষ্ঠের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন, তখন তারা কান্নার আওয়াজে বুঝতে পারলেন যে, নিশ্চয়ই সালাবা এসেছেন; আর কান্নার এ করুণ সূর তাঁর হৃদয়ের গভীর থেকেই উৎসারিত হচ্ছে।

তারা দ্রুতপদে সেদিকে গেলেন, যেদিক থেকে মর্মস্পর্শী কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল।

নিকটে গিয়ে তারা ডাকলেন-সালাবা! মস্তক উত্তোলন কর। কান্না থামাও ৷ চল । আল্লাহ পাক তোমাকে ক্ষমা করেছেন।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন- আল্লাহর পেয়ারা হাবীব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আপনারা কি অবস্থায় দেখে এসেছেন?

তাঁরা বললেন- আমরা তাঁকে এমন অবস্থায় দেখে এসেছি, যেমন আল্লাহ পাকের পছন্দ ও তোমার আন্তরিক কামনা।

তারপর তাঁকে নিয়ে তাঁরা মসজিদে নববীতে হাজির হলেন। তখন রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। হযরত বিলাল (রা.) ইকামত বলছেন। এখনই রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকবীরে তাহরীমা বেঁধে নামাজ শুরু করবেন । তাঁরা তিনজন সর্বশেষ কাতারে শরিক হলেন।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন সূরা ফাতিহা শেষ করে সূরা তাকাসুর শুরু করলেন । হযরত সালাবা (রা.) সূরার প্রথম অংশটুকু শ্রবণ করতেই চিৎকার দিয়ে উঠলেন। যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘হাতা-যুরতুমুল মাকাবির’ পর্যন্ত পৌঁছলেন, তখন তিনি আরো একটি বিকট চিৎকার দিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন।

নামাজ শেষে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাবা (রা.)-এর নিকট এলেন। হযরত সালমান ফারসী (রা.)- কে বললেন, তার মুখে একটু পানির ছিটা দাও।

সালমান (রা.) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! সালাবা আর এ জগতে নেই । সে মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছে।

এমন সময় সালবা (রা.)- এর কন্যা খামসানা এসে পিতার মৃতদেহ দেখে কাঁদতে লাগল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন-

হে খামসানা! তুমি এতে খুশি নও যে, আমি তোমার পিতা হই এবং ফাতিমা হবে তোমার বোন?

সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আমি অবশ্যই রাজি আছি ।

জানাজা শেষে সালাবা (রা.)-এর লাশ কবরস্থানে পৌঁছানো হলো। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানাজার সাথে রইলেন। কবরস্থানে গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পূর্ণ কদম মোবারক মাটিতে রাখছিলেন না, বরং পায়ের উপর ভর করেই তিনি হাঁটছিলেন ।

দাফন কার্য সমাপ্তির পর হযরত ওমর (রা.) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- কে এ অস্বাভাবিক চলার কারণ জিজ্ঞেস করলেন । জবাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- ওমর! কবর স্থানে এত অধিক পরিমাণে ফেরেশ্তা জমা হয়েছিল যে, মাটিতে পা রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না ।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! আপনারা একটু লক্ষ্য করে দেখেছেন কি ? একজন মানুষের মধ্যে কি পরিমাণ আল্লাহর ভয় থাকলে, সে একটি মাত্র গুনাহ করে এত বেশি পরিমাণে অস্থির হয়ে পড়তে পারে? বস্তুত হযরত সাহাবায়ে কেরাম আর আমাদের মাঝে মূল পার্থক্য এখানেই। তাঁরা অনিচ্ছায় কিংবা ভুলবশত কোনো পাপ করে ফেললেও তা মাফের জন্য যে কোনো ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকতেন। যে কোনো কষ্ট হাসি মুখে বরণ করে নিতেন। আর আমরা অবলীলায় হাজারো গুনাহ করে যাচ্ছি। আল্লাহ ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ অহরহ অমান্য করছি। কিন্তু কই? আমাদের মাঝে তো এমন পরিবর্তন আসে না! গুনাহ হয়েছে জানার পরও তা মাফের জন্য এতটা ব্যস্ত হয়ে পড়ি না । যেমন ধরুন আপনি হয়ত আগে জানতেন না, দাড়ি সেভ করলে, অধীনস্থ মেয়েদেরকে বেপর্দায় রাখলে, গান শুনলে, টিভি দেখলে, কবীরা বা জঘন্য রকমের গুনাহ হয়। কিন্তু যখন জানলেন যে, এসব কাজ করলে কবীরা গোনাহ হবে, সম্মুখীন হতে হবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির- তখন কি আপনি সাথে সাথে তাওবা করেন? আপনি কি তখন প্রতিজ্ঞা করেন যে, এসব কাজ আর কোন দিন করব না- দাড়ি কাট-ছাট করব না, বেপর্দায় চলব না, নামাজ ছাড়ব না, অধীনস্থ মহিলাদেরকে পর্দাহীন ভাবে ঘুরতে দেব না, টিভি, স্যাটেলাইট চ্যানেল, ভিসিডি দেখব না? ইত্যাদি । যদি এরূপ প্রতিজ্ঞা করতেন এবং সাথে সাথে তা বাস্তবায়ন করার জন্য যথাসম্ভব সবকিছুই করতেন, তবে কি আল্লাহ তাআলা আপনার উপর অধিক খুশি হতেন না? এরূপ প্রতিজ্ঞা কি আপনার দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ বয়ে আনত না? অবশ্যই । অবশ্যই ।

মুহতারাম সুধী! আমরা নিষ্পাপ নই। নিষ্পাপ থাকা সম্ভবও নয় । কারণ, আমাদের দু’টো ভয়ানক শত্রু আছে। তন্মধ্যে একটি হলো মন- রিপু, আর আরেকটি হলো খোদাদ্রোহী শয়তান। উভয়ের বিষাক্ত দংশনে মানুষ অনেক সময় মোহগ্রস্ত ও নির্বোধ হয়ে পড়ে। জৈবিক উন্মাদনায় তার মনুষ্যত্ব লোপ পায়। নেমে আসে পশুত্বের কাতারে। অতঃপর সে কখনো হিংস্র হায়েনার রূপ ধারণ করে, কখনো বিষাক্ত সাপের রূপ পরিগ্রহণ করে। তখন তার নিষ্ঠুরতম হিংস্র থাবা কিংবা বিষাক্ত ছোবলে শুধু মানুষ নয়, গোটা সৃষ্টিজগত নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে।

কিন্তু প্রকৃত মু’মিন ও আল্লাহর খাঁটি বান্দা তো তারাই যারা মোহ কেটে যাওয়ার সাথে সাথে অনুতপ্ত হয়। অনুশোচনার জ্বলন্ত অগ্নিস্ফুলিঙ্গে দগ্ধ হতে থাকে। বারবার হায় হুতাশ করে চোখের পানি ফেলে বলতে থাকে, হে করুণাময় খোদা! আমার ভুল হয়ে গেছে। এ জন্য আমি ভীষণ লজ্জিত। আমি তোমার নিকট তওবা করছি। অনুগ্রহ করে আমায় ক্ষমা করে দাও ।

তখন তার অনুশোচনা ও চোখের পানি আল্লাহর ক্রোধকে ঠাণ্ডা করে দেয়। নিভিয়ে দেয় জাহান্নামের জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। এদিকে ইঙ্গিত করেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- গুনাহ থেকে সত্যিকার তওবাকারীর উদাহরণ ঠিক তেমন যেন তার কোনো গুনাহই নেই ৷

পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, অবশ্যই আল্লাহ তা’আলা তওবাকারীকে ও পবিত্রতা অর্জনকারীকে ভালবাসেন ।

অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- আদম সন্তান সবাই ভুলকারী-গুনাহগার। কিন্তু উত্তম তারা, যারা ভুল করার পর, পাপ করার পর তাওবা করে ৷

মোটকথা, মানুষ হিসেবে কখনো কখনো হয়তো আমাদের দ্বারা ভুল-ভ্রান্তি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তখনই আমরা হযরত সাহাবায়ে কেরামের প্রকৃত অনুসারী বলে বিবেচিত হব; আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে পরিগণিত হব যখন ভুল বুঝার সাথে সাথে তওবা করে নিব ।

তওবা-ইস্তিগফার দ্বারা যেমন গুনাহ মাফ হয়, তেমনি এর দ্বারা আল্লাহর দরবারে মর্তবাও বুলন্দ হয়। তাই কোনো গুনাহ না হলেও আল্লাহ পাকের শান অনুযায়ী ইবাদতের হক পূর্ণরূপে আদায়ে অক্ষমতার কথা ভেবে সকলের সদা সর্বদা তওবা-ইস্তিগফার করা কর্তব্য । আল্লাহ পাক বান্দার তওবা ইস্তিগফারে বড়ই খুশি হন। এ জন্যই তো রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেগুনা মাসূম হওয়া সত্ত্বেও দৈনিক সত্তর বারেরও বেশি তওবা-ইস্তিগফার করতেন ।

তওবা করলে আল্লাহ পাক খুশি হওয়ার কারণ হচ্ছে, এর দ্বারা তওবাকারী নিজের ক্ষুদ্রত্ব এবং আল্লাহপাকের বড়ত্ব ও মহত্ত্ব প্রকাশ করে থাকে। আর যে ব্যক্তি নিজেকে ছোট মনে করে বিনয় এখতিয়ার করে, আল্লাহ তা’আলা তার দরজা উঁচু করে দেন। সুতরাং মনে রাখতে হবে, তওবা মু’মিনের মর্যাদার প্রতীক-সাফল্যের সোপান ।

আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে উপরোক্ত ঘটনা ও বর্ণিত আয়াত ও হাদীসসমূহ থেকে শিক্ষা নিয়ে খাঁটি মনে তওবা করার তৌফিক নসীব করুন। আমীন।

স্মরনীয় বাণী!

যে ব্যক্তি আমার দোষ ত্রুটি সম্পর্কে আমাকে অবগত করে তার উপর আল্লাহর রহমত হউক। – হযরত উমর (রাঃ)

শনিবার, ২৯ জুলাই, ২০২৩

বিধবা মেয়ে : বিধবা মেয়ের বিয়ের গল্প

আপনি অনিচ্ছাসত্ত্বেও কেন আমাকে বিয়ে করলেন? 

মায়ের ইচ্ছায়? 

আমি শুধু বললাম -হু। 

আসমা এবার বলল- ও আচ্ছা, আমিও এটাই ভেবেছিলাম, 

আপনার মা বাবা খুব ভাল মানুষ তাই উনারা অন্য একটা মেয়েকে হাত ধরে টেনে তুলতে গিয়ে আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। 


জয় সাহেব – আপনার কোন প্রেমিকা থাকলে আপনি তার সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যেতে পারেন, আমি কিছুই বলব না। শুধু স্ত্রী হিসেবে একটু সামাজিক মর্যাদা দিলেই হবে। আপনার বাবা, মা আর বোনের সাথে আমি খুব ভাল থাকতে পারব। আপনার যেন কোন কষ্ট না পেতে হয় আমি সেই কাজটাই করব। বাইরে থাকবেন না এমনিতেই শীতের রাত তার উপরে ঠান্ডা বাতাস।

মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে, আমিও শুয়ে পড়লাম ওর পাশে। 

ভোর সাড়ে চারটেয় আমার ফোন বাজছে, রিসিভ করে জানতে পারলাম বন্ধু রাফসানের বাবা হাসপাতালে, ও নেগেটিভ রক্ত লাগবে কিন্তু পাচ্ছেনা। 

আমার রক্ত ও নেগেটিভ হওয়ায় আমাকেই যেতে হবে। 

বিছানা থেকে নেমে দেখি, আসমা নামাজ পড়ছে। 

আমি ওয়াশরুমে যেয়ে হাতমুখ ধুয়ে এসে যখন বের হতে যাচ্ছি তখন ই সে তিনটে বিস্কুট আর এক গ্লাস পানি বাড়িয়ে দেয়। ইচ্ছে করছিল গ্লাসটা ছুড়ে ফেলে দিতে কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই মায়া লেগে গেল, বিস্কুট খেয়ে বের হয়ে পড়লাম। 

আমি ঘোরে ছিলাম, আসমার মায়ার ঘোরে তাই ও যা বলছিল আমি তাই করছিলাম। রক্ত দিয়ে বাসায় ফিরে দেখি টেবিল ভর্তি নানা পদের তরকারি রান্না করা। 

অন্যদিন শুধু রুটি চললেও আজ ভাত রান্না হয়েছে। 

গরুর মাংসটা মুখে দিয়েই অবাক হয়ে গেলাম! 

কি দারুন খেতে! বাবা আমার দিকে চেয়ে বলল- আসমার রান্না কেমন? 

আমি কিছু না বলে খেয়ে উঠে আসলাম। 

কয়েকদিন পর লক্ষ্য করলাম ছোট বোনটা ভাবী বলতে অজ্ঞান! 

উঠতে বসতে ভাবী, ভাবী ভাবী! 

এই আসমা যে মানুষকে বশ করতে জানে সে ব্যাপারে অনেকটা পরিষ্কার ধারনা পাওয়া গেল।

এই কয়েকদিনে আসমার সাথে কোন কথা বলিনি আমি, শুধু উত্তর দিয়েছি দিতে ইচ্ছে করলে।

বিকেলে অফিস থেকে ফিরে অফিসের কাজ করার জন্য ইমেইলে লগ ইন করে দেখি অফিসের ইমেইল আ্যড্রেস থেকে আমাকে জানানো হয়েছে সাত দিনের জন্য আমার ছুটি কনফার্ম করা হয়েছে! 

আরে বাবা,আমি তো ছুটির ই আবেদন করিনি । 

সবটা পরিষ্কার হল যখন ছোট বোন কক্সবাজার যাবার দুটো টিকিট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল- যা ভাইয়া, হানিমুনটা সেরে আয়! 

কি যন্ত্রনারে বাবা! বিয়ে করলাম মায়ের ইচ্ছায়, বাসর করলাম বাড়ির কাজের লোকের সাজানো বাসরে, হানিমুন করতে হবে বোনের কথায়! 

আর হানিমুনটা করব কার সাথে? 

যে কিনা আগেও ঐখানে গিয়েছিল অন্য একজনের সাথে! 

যাদের গন্ধ মিশে আছে কক্সবাজারের ঐ হোটেলে! 

যেখানে কিনা এই মেয়েটাই অন্য একজনের সাথে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করেছিল তার সাথেই আমার হানিমুন! 

যে মেয়েটার আমাকে দেবার কিছুই নেই তাকেই বুকে জড়িয়ে হারাতে হবে আমাকে! 

নো ওয়ে। এটা সম্ভব না। 

মাকে যখন বলতে যাচ্ছিলাম যে আমি হানিমুনে যাব না তখন ই মায়ে ঘরে ঢোকার আগে শুনলাম মা বাবাকে বলছেন –

শোন..জয় আমার ছেলে তাকে আমি চিনি। 

সে কখনোই আসমাকে কষ্ট দেবেনা, সে জানে একটা মেয়েকে কিভাবে সম্মান করতে হয়। 

হোক না মেয়েটা আগে বিবাহিত কিন্তু মেয়েটা তো আর খারাপ না যাকে নিয়ে সংসার করা যাবেনা, আর বিধবা সে তো নিজে থেকে হতে চায়নি। 

জয় অনেক বোঝে, ও জানে একটা মেয়ের অতীতের চেয়ে তার ব্যবহার কতটা জরুরি। 

তুমি দেখো সামনের বছর ই আমাদের নাতি নাতনি আসবে, আসমার কষ্টটাও থাকবে না আর। 

মেয়েটা প্রায় রোজা রাখে, নামাজ তো নিয়মিত পড়ে। 

আমি সেদিন আসমাকে জিজ্ঞেস করলাম কিরে আসমা তুই মোনাজাতে কী কী চাস রে আল্লাহর কাছে। 

সে কি বলে জানো! 

সে বলে- জয় সব সময় ভাল থাকুক, আমাদের পরিবারের সবাই ভাল থাকুক সে এটাই চায় শুধু। 

সকাল দুপুর রাত তিন বেলায় মেয়েটা রান্না থেকে শুরু করে সব কাজ করছে ঘরের যাতে আমার একটু কষ্ট না করতে হয়। 

জয় কি এসব দেখেনা? 

এসব কি ও বোঝেনা! অবশ্যই বোঝে। 

দেখো ও হানিমুনে যাবেই, আমি বলে দিলাম।

না, আর কিছু বলা সম্ভব না। 

গাড়ি চিটাগাং এর হাইওয়েতে দ্রুত গতিতে চলেছে। 

দুজন ই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম একজন আরেকজনের মাথায় হেলান দিয়ে। 

ঘুম ভেঙে দেখি আসমার মাথাটা আমার কাধে। হাতের আঙুলটা খানিকটা কাটা, সেদিন তরকারি কাটতে গিয়েই এমন বাজেভাবে কেটে গিয়েছে। 

এই প্রথম আসমার গায়ের গন্ধটা নাকে আসল আমার, কোন পারফিউমেই এত মিস্টি গন্ধ পাইনি আমি, মাদকতায় ভরা এক গন্ধ। 

হোটেলে উঠেই সে ব্যাগ থেকে জায়নামাজ বের করে নামাজ পড়ে নিল। 

এই মেয়ের স্বভাব, কাজকর্ম অনেকটা আমার মায়ের মতই। সবকিছুই কত গোছালো। 

বাসে আসার পথে টুকটাক কথা হয়েছিল প্রথমবারের মত। 

বাস থেকে নামার সময় একটা রিক্সার চাকা পায়ের উপর উঠে গিয়েছিল আমার, পা টা অনেকটা থেঁতলে গেছে। আমি পায়ের ব্যথা আর ক্লান্তিতে শোবার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম। 

হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম কেউ একজন আমার পা টা ধরে তাতে গরম তেলতেলে কিছু লাগিয়ে দিচ্ছে আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, চোখের পানি পায়ের উপর এসে পড়ছে। 

চোখ মেলে দেখি আসমা। আমাকে উঠতে দেখেই সে বারান্দায় চলে গেল। 

বাহ! ব্যথা তো অনেকটায় কমে গেছে। 

হোটেলে ওঠার পর থেকে কিছু খাওয়া হয়নি।

দুজন মিলে এই প্রথম একসাথে খেলাম, শুধু খাইনি গল্পও করেছি। 

আসমা ঠোট টিপে টিপে হাসতে জানে, মুক্তোর মত দাতগুলোতে তখন চুমু খেতে ইচ্ছে করবে যে কারোর ই। 

দুদিন বেশ ঘুরে বেড়লাম। 

আসমার ভিতরে যে চঞ্চল একটা আত্না থাকে সেটা এই দুদিনে বেশ বুঝে গিয়েছি। 

ইদানীং রাতে ঘুমাবার আগ পর্যন্ত দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে গল্প করি, 

আমিই আগে ঘুমিয়ে যায় তবে কখন ঘুমিয়ে পড়ি সেটা মনে থাকেনা।

বিচের পাশে এই ভোরবেলায় দুজন বসে আছি, আসমা আমাকে গান শোনাচ্ছে :-


যদি মন কাদে তবে চলে এসো এক বর্ষায়..

ভোরের এই নিস্তব্ধতা, 

ফুরফুরে বাতাস, 

আসমার ভরাট কন্ঠ আর সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে পুরোটা জুড়ে আসমাতে যেন ডুবে গেছি আমি কেউ নেই হাত ধরে তোলার। 

বুঝতে পারলাম – ভালবাসার কাছে পতিতা, গরীব, ধনী, ডিভোর্সি, বিবাহিত, বিধবা, অন্ধ কোন ব্যাপার ই না। 

হোক আসমা কারো স্ত্রী, হোক সে বিবাহিতা, হোক তার ভালবাসার ভাগ কেউ পেয়েছে আগে। 

তাতে কী আসে যায়! 

আমি তো তাকে ভালবাসি! 

তার শরীরের উপর কেউ কতৃত্ব খাটিয়েছে তাতে কি! 

তাকে জড়িয়ে ধরে সারাটা রাত কেউ গল্প করেছে তাতে কি! 

আসমা তো এখন আমাকে ভালবাসে বা ভালবাসতে চাচ্ছে! 

কেউ যখন নিখাদ ভালবাসা নিয়ে সামনে দাঁড়ায় তখন তার অতীত ঘেটে ছোটলোকের পরিচয় দেয়েটা বড় মূর্খামি। 

একটা মানুষের আত্নার চেয়ে তার শরীরটা বড় হতে পারেনা কখনোই। 

এই শরীরটার মালিক, অনুভুতির মালিক হয়তো পূর্বে কেউ ছিল তাতে আমার প্রতি আসমার ভালবাসা তো মিথ্যা হয়ে যায়না। 

কোন পতিতা যদি এই মুহুর্তে আমার সামনে নিখাদ ভালবাসা নিয়ে দাঁড়ায় তাহলে তাকে উপেক্ষা করার শক্তি আমি এই কয়দিনে হারিয়ে ফেলেছি আর সেখানে আসমা তো পবিত্র একটা মুখ, এক ব্রক্ষ্মান্ড ভালবাসার এক মহাকাব্য এই আসমা।


আসমার গা থেকে সেই মাতাল করা গন্ধটা আসছে, আসমার চোখের গাঢ় কাজল আর খোলা চুলে আসমাকে দারুন দেখাচ্ছে। 

তার মুখের দিকে এখন বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারিনা, এত্ত মায়াভরা মুখে তাকিয়ে থাকলে আবার বশ হয়ে যায় এই ভয়ে। 

আসমা আমার খুব কাছে এখন, তার দিকে এগিয়ে তার ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেলাম।

আসমা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, সে বুঝে উঠতে পারছেনা আমাকে তাই বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে আছে। 

এবার হ্যাচকা টান দিয়ে খুব কাছে নিয়ে আসলাম তাকে, সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে না পেরে আমার লোমেভরা বুকে মুখ লুকাবার বৃথা চেষ্টা করতে লাগল। 

সকাল হচ্ছে দুটো নতুন প্রান আজ ভোর দেখছে অন্য চোখে। 

আজ বুঝতে পারছি এতদিনে মাথাটা কার বিগড়ে ছিল আমার নাকি আমার মায়ের। 

বাবা,মা সত্যিই চান না তার সন্তান ঠকে যাক, কষ্টে থাকুক তারা চায় তাদের সন্তান ভালবাসায় বেচে থাকুক। 

যে মানুষটা নিখাদভাবে ভালবাসতে চায় শুধু একটু ভালবাসার সুযোগ করে দিলেই আমাদের জীবনে ভালবাসার অভাব হয়না এটা এখন বুঝেছি। 

সম্পর্কে কখনো অতীত টানতে হয়না, 
কারো দুর্বলতা দেখতে হয়না, 
তার অসঙ্গতি দেখতে হয়না। 
সম্পর্কে সম্মান করতে জানতে হয় শুধু, 
এটা এখন ভালভাবেই বুঝে গিয়েছি।

পৃষ্ঠাসমূহ