আপনি অনিচ্ছাসত্ত্বেও কেন আমাকে বিয়ে করলেন?
মায়ের ইচ্ছায়?
আমি শুধু বললাম -হু।
আসমা এবার বলল- ও আচ্ছা, আমিও এটাই ভেবেছিলাম,
আপনার মা বাবা খুব ভাল মানুষ তাই উনারা অন্য একটা মেয়েকে হাত ধরে টেনে তুলতে গিয়ে আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
জয় সাহেব – আপনার কোন প্রেমিকা থাকলে আপনি তার সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যেতে পারেন, আমি কিছুই বলব না। শুধু স্ত্রী হিসেবে একটু সামাজিক মর্যাদা দিলেই হবে। আপনার বাবা, মা আর বোনের সাথে আমি খুব ভাল থাকতে পারব। আপনার যেন কোন কষ্ট না পেতে হয় আমি সেই কাজটাই করব। বাইরে থাকবেন না এমনিতেই শীতের রাত তার উপরে ঠান্ডা বাতাস।
মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে, আমিও শুয়ে পড়লাম ওর পাশে।
ভোর সাড়ে চারটেয় আমার ফোন বাজছে, রিসিভ করে জানতে পারলাম বন্ধু রাফসানের বাবা হাসপাতালে, ও নেগেটিভ রক্ত লাগবে কিন্তু পাচ্ছেনা।
আমার রক্ত ও নেগেটিভ হওয়ায় আমাকেই যেতে হবে।
বিছানা থেকে নেমে দেখি, আসমা নামাজ পড়ছে।
আমি ওয়াশরুমে যেয়ে হাতমুখ ধুয়ে এসে যখন বের হতে যাচ্ছি তখন ই সে তিনটে বিস্কুট আর এক গ্লাস পানি বাড়িয়ে দেয়। ইচ্ছে করছিল গ্লাসটা ছুড়ে ফেলে দিতে কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই মায়া লেগে গেল, বিস্কুট খেয়ে বের হয়ে পড়লাম।
আমি ঘোরে ছিলাম, আসমার মায়ার ঘোরে তাই ও যা বলছিল আমি তাই করছিলাম। রক্ত দিয়ে বাসায় ফিরে দেখি টেবিল ভর্তি নানা পদের তরকারি রান্না করা।
অন্যদিন শুধু রুটি চললেও আজ ভাত রান্না হয়েছে।
গরুর মাংসটা মুখে দিয়েই অবাক হয়ে গেলাম!
কি দারুন খেতে! বাবা আমার দিকে চেয়ে বলল- আসমার রান্না কেমন?
আমি কিছু না বলে খেয়ে উঠে আসলাম।
কয়েকদিন পর লক্ষ্য করলাম ছোট বোনটা ভাবী বলতে অজ্ঞান!
উঠতে বসতে ভাবী, ভাবী ভাবী!
এই আসমা যে মানুষকে বশ করতে জানে সে ব্যাপারে অনেকটা পরিষ্কার ধারনা পাওয়া গেল।
এই কয়েকদিনে আসমার সাথে কোন কথা বলিনি আমি, শুধু উত্তর দিয়েছি দিতে ইচ্ছে করলে।
বিকেলে অফিস থেকে ফিরে অফিসের কাজ করার জন্য ইমেইলে লগ ইন করে দেখি অফিসের ইমেইল আ্যড্রেস থেকে আমাকে জানানো হয়েছে সাত দিনের জন্য আমার ছুটি কনফার্ম করা হয়েছে!
আরে বাবা,আমি তো ছুটির ই আবেদন করিনি ।
সবটা পরিষ্কার হল যখন ছোট বোন কক্সবাজার যাবার দুটো টিকিট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল- যা ভাইয়া, হানিমুনটা সেরে আয়!
কি যন্ত্রনারে বাবা! বিয়ে করলাম মায়ের ইচ্ছায়, বাসর করলাম বাড়ির কাজের লোকের সাজানো বাসরে, হানিমুন করতে হবে বোনের কথায়!
আর হানিমুনটা করব কার সাথে?
যে কিনা আগেও ঐখানে গিয়েছিল অন্য একজনের সাথে!
যাদের গন্ধ মিশে আছে কক্সবাজারের ঐ হোটেলে!
যেখানে কিনা এই মেয়েটাই অন্য একজনের সাথে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করেছিল তার সাথেই আমার হানিমুন!
যে মেয়েটার আমাকে দেবার কিছুই নেই তাকেই বুকে জড়িয়ে হারাতে হবে আমাকে!
নো ওয়ে। এটা সম্ভব না।
মাকে যখন বলতে যাচ্ছিলাম যে আমি হানিমুনে যাব না তখন ই মায়ে ঘরে ঢোকার আগে শুনলাম মা বাবাকে বলছেন –
শোন..জয় আমার ছেলে তাকে আমি চিনি।
সে কখনোই আসমাকে কষ্ট দেবেনা, সে জানে একটা মেয়েকে কিভাবে সম্মান করতে হয়।
হোক না মেয়েটা আগে বিবাহিত কিন্তু মেয়েটা তো আর খারাপ না যাকে নিয়ে সংসার করা যাবেনা, আর বিধবা সে তো নিজে থেকে হতে চায়নি।
জয় অনেক বোঝে, ও জানে একটা মেয়ের অতীতের চেয়ে তার ব্যবহার কতটা জরুরি।
তুমি দেখো সামনের বছর ই আমাদের নাতি নাতনি আসবে, আসমার কষ্টটাও থাকবে না আর।
মেয়েটা প্রায় রোজা রাখে, নামাজ তো নিয়মিত পড়ে।
আমি সেদিন আসমাকে জিজ্ঞেস করলাম কিরে আসমা তুই মোনাজাতে কী কী চাস রে আল্লাহর কাছে।
সে কি বলে জানো!
সে বলে- জয় সব সময় ভাল থাকুক, আমাদের পরিবারের সবাই ভাল থাকুক সে এটাই চায় শুধু।
সকাল দুপুর রাত তিন বেলায় মেয়েটা রান্না থেকে শুরু করে সব কাজ করছে ঘরের যাতে আমার একটু কষ্ট না করতে হয়।
জয় কি এসব দেখেনা?
এসব কি ও বোঝেনা! অবশ্যই বোঝে।
দেখো ও হানিমুনে যাবেই, আমি বলে দিলাম।
না, আর কিছু বলা সম্ভব না।
গাড়ি চিটাগাং এর হাইওয়েতে দ্রুত গতিতে চলেছে।
দুজন ই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম একজন আরেকজনের মাথায় হেলান দিয়ে।
ঘুম ভেঙে দেখি আসমার মাথাটা আমার কাধে। হাতের আঙুলটা খানিকটা কাটা, সেদিন তরকারি কাটতে গিয়েই এমন বাজেভাবে কেটে গিয়েছে।
এই প্রথম আসমার গায়ের গন্ধটা নাকে আসল আমার, কোন পারফিউমেই এত মিস্টি গন্ধ পাইনি আমি, মাদকতায় ভরা এক গন্ধ।
হোটেলে উঠেই সে ব্যাগ থেকে জায়নামাজ বের করে নামাজ পড়ে নিল।
এই মেয়ের স্বভাব, কাজকর্ম অনেকটা আমার মায়ের মতই। সবকিছুই কত গোছালো।
বাসে আসার পথে টুকটাক কথা হয়েছিল প্রথমবারের মত।
বাস থেকে নামার সময় একটা রিক্সার চাকা পায়ের উপর উঠে গিয়েছিল আমার, পা টা অনেকটা থেঁতলে গেছে। আমি পায়ের ব্যথা আর ক্লান্তিতে শোবার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম কেউ একজন আমার পা টা ধরে তাতে গরম তেলতেলে কিছু লাগিয়ে দিচ্ছে আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, চোখের পানি পায়ের উপর এসে পড়ছে।
চোখ মেলে দেখি আসমা। আমাকে উঠতে দেখেই সে বারান্দায় চলে গেল।
বাহ! ব্যথা তো অনেকটায় কমে গেছে।
হোটেলে ওঠার পর থেকে কিছু খাওয়া হয়নি।
দুজন মিলে এই প্রথম একসাথে খেলাম, শুধু খাইনি গল্পও করেছি।
আসমা ঠোট টিপে টিপে হাসতে জানে, মুক্তোর মত দাতগুলোতে তখন চুমু খেতে ইচ্ছে করবে যে কারোর ই।
দুদিন বেশ ঘুরে বেড়লাম।
আসমার ভিতরে যে চঞ্চল একটা আত্না থাকে সেটা এই দুদিনে বেশ বুঝে গিয়েছি।
ইদানীং রাতে ঘুমাবার আগ পর্যন্ত দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে গল্প করি,
আমিই আগে ঘুমিয়ে যায় তবে কখন ঘুমিয়ে পড়ি সেটা মনে থাকেনা।
বিচের পাশে এই ভোরবেলায় দুজন বসে আছি, আসমা আমাকে গান শোনাচ্ছে :-
যদি মন কাদে তবে চলে এসো এক বর্ষায়..
ভোরের এই নিস্তব্ধতা,
ফুরফুরে বাতাস,
আসমার ভরাট কন্ঠ আর সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে পুরোটা জুড়ে আসমাতে যেন ডুবে গেছি আমি কেউ নেই হাত ধরে তোলার।
বুঝতে পারলাম – ভালবাসার কাছে পতিতা, গরীব, ধনী, ডিভোর্সি, বিবাহিত, বিধবা, অন্ধ কোন ব্যাপার ই না।
হোক আসমা কারো স্ত্রী, হোক সে বিবাহিতা, হোক তার ভালবাসার ভাগ কেউ পেয়েছে আগে।
তাতে কী আসে যায়!
আমি তো তাকে ভালবাসি!
তার শরীরের উপর কেউ কতৃত্ব খাটিয়েছে তাতে কি!
তাকে জড়িয়ে ধরে সারাটা রাত কেউ গল্প করেছে তাতে কি!
আসমা তো এখন আমাকে ভালবাসে বা ভালবাসতে চাচ্ছে!
কেউ যখন নিখাদ ভালবাসা নিয়ে সামনে দাঁড়ায় তখন তার অতীত ঘেটে ছোটলোকের পরিচয় দেয়েটা বড় মূর্খামি।
একটা মানুষের আত্নার চেয়ে তার শরীরটা বড় হতে পারেনা কখনোই।
এই শরীরটার মালিক, অনুভুতির মালিক হয়তো পূর্বে কেউ ছিল তাতে আমার প্রতি আসমার ভালবাসা তো মিথ্যা হয়ে যায়না।
কোন পতিতা যদি এই মুহুর্তে আমার সামনে নিখাদ ভালবাসা নিয়ে দাঁড়ায় তাহলে তাকে উপেক্ষা করার শক্তি আমি এই কয়দিনে হারিয়ে ফেলেছি আর সেখানে আসমা তো পবিত্র একটা মুখ, এক ব্রক্ষ্মান্ড ভালবাসার এক মহাকাব্য এই আসমা।
আসমার গা থেকে সেই মাতাল করা গন্ধটা আসছে, আসমার চোখের গাঢ় কাজল আর খোলা চুলে আসমাকে দারুন দেখাচ্ছে।
তার মুখের দিকে এখন বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারিনা, এত্ত মায়াভরা মুখে তাকিয়ে থাকলে আবার বশ হয়ে যায় এই ভয়ে।
আসমা আমার খুব কাছে এখন, তার দিকে এগিয়ে তার ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেলাম।
আসমা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, সে বুঝে উঠতে পারছেনা আমাকে তাই বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে আছে।
এবার হ্যাচকা টান দিয়ে খুব কাছে নিয়ে আসলাম তাকে, সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে না পেরে আমার লোমেভরা বুকে মুখ লুকাবার বৃথা চেষ্টা করতে লাগল।
সকাল হচ্ছে দুটো নতুন প্রান আজ ভোর দেখছে অন্য চোখে।
আজ বুঝতে পারছি এতদিনে মাথাটা কার বিগড়ে ছিল আমার নাকি আমার মায়ের।
বাবা,মা সত্যিই চান না তার সন্তান ঠকে যাক, কষ্টে থাকুক তারা চায় তাদের সন্তান ভালবাসায় বেচে থাকুক।
যে মানুষটা নিখাদভাবে ভালবাসতে চায় শুধু একটু ভালবাসার সুযোগ করে দিলেই আমাদের জীবনে ভালবাসার অভাব হয়না এটা এখন বুঝেছি।
তোমার,গটনা
উত্তরমুছুন