বৃহস্পতিবার, ৮ আগস্ট, ২০১৩

তোমার 'ঈদের' অপেক্ষায় থাকে কিছু মানুষ....তুমি কি জানো বন্ধু??

বেতনের টাকা হাতে পেয়েই উৎ্ফুল্ল শা্হেদ পা বাড়ালো শপিংয়ের জন্য।
বাসা থেকে বের হয়ে তিন রাস্তার মাথায় এসে দাড়ালো।
রিকসার কোনো খবর নেই।
অনেক্ষন অপেক্ষার পর দূরে একটা রিকসা দেখে ইশারা করলো।
কাছে আসতেই দেখল বয়স্ক চালক।
শাহেদ বললো: চাচা আপনি পারবেননা। লাগবেনা চলে যান।
বৃদ্ধ চালক খুব মন খারাপ করে বললো: বাজান আমি বুড়া দেইখা আপনারা যদি আমার রিকশায় কেউ না উঠেন তাইলে আমি প্যাট চালামু ক্যমনে
কথাটা শাহেদের অন্তরে গিয়ে লাগলো………………. ইফতারির সময় ও ঘনিয়ে আসছে।ভাড়া ঠিক না করেই উঠে পড়লো শাহেদ।

চলতে শুরু করল……..রিকশার চাকা ঘুরছে, সাথে সাথে শাহেদের মাথায় ও বিভিন্ন চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খাচেছ। কার জন্য কী কেনা যায়। বরাবরের চেয়ে একটু আলাদা হতে হবে এবার। ঈদের শপিং - একটু চমক থাকা চাই। ইত্যাদি ইত্যাদি ………..


রিকশা এগিয়ে চললো

গোধূলির আলো ছড়িয়ে ধীরে ধীরে আকাশের আডালে চলে যাচেছ দিনের সূর্য।আগত সন্ধ্যার মগ্নতায় নীরব হবে যাচেছ দিগন্ত বিস্তারী প্রকৃতি।
অন্যদিকে ছোট্ট একটা দৃশ্যপট শাহেদের মনটাকে অফুরন্ত ভালোলগায় ভরিয়ে দিচ্ছে মূহুর্মহু……পরিবারের সবাই তার দেওয়া উপহারে সজ্জিত। সবার মুখে অনাবিল হাসি।
মগ্ন শাহেদের হৃদয় উপছে উঠছে আননদ শিহরনে।

হঠাৎ খটখট আওয়াজে মগ্নতা ভাংলো শা্হেদের। দেখলো বৃদ্ধ চালক রিকশা থেকে নেমে ঠেলে ব্রীজের উপরে উঠানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ব্রীজটা বেশ উচু হওয়ায় অনেক চেষ্টা করেও পেরে উঠছেনা। অগত্যা শাহেদ নেমে পড়লো। পিছন দিক থেকে সে ও ঠেলে ঠেলে রিকসা ব্রীজের উপরে উঠালো।

বেশ হাপিয়ে উঠেছে চাচা বোঝা যাচ্ছে, বুক বড় করে ঘন ঘন দম নিচেছ।
গলায় প্যাচানো গামছা দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখমন্ডল মুছল।

গভীরভাবে শাহেদ দেখলো রিকশাওয়ালাকে।

খেয়াল করলো….সাদা দাড়ি
চোখ দুটো গর্তে ঢোকানো
শরীরের চামড়া ঝুলে গেছে
রিকসায় যখন পেডেল মারছে বুক ভেংগে শ্বাস বের হচ্ছে তার…..বুঝি এখনি পিঠ আর পেট এক হয়ে যাবে। সম্ভবত মারাত্নক হাপানীতে আক্রান্ত। নি:শেষিত শরীরে কখানা হাড় কোনরকমে দেহের কাঠামো ধরে রেখেছে।
দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত রিকশাওয়ালার সাক্ষাৎ হয়। কে কার খবর রাখে তার…..গভীরভাবে তো দূরে তো থাক, কখনো দ্বিতীয়বার ফিরে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি শাহেদ….যদি না ২/১ টাকা ভাড়া কমবেশি নিয়ে বাতচিৎ হয়। অথচ অতি সাধারন এই ঘটনা আজকে অজানা কারনে শাহেদের হৃদয়তন্ত্রীতে এক গভীর রেখা টেনে দিল।

রিকসা ছুটৈ চলল আবার

শাহেদের চোখে বিস্ময়ের অন্ত নেই। এই লোক এই বয়সে
এই শরীরে বাইরে আসার সাহস করলো কি করে?

-চাচা আপনার বাড়ি কোথায়?

-ক্যন্টনমেন্টের পশ্চিমপার্শ্বে
-আপনার ছেলেমেয়ে নাই?
-আল্লায় ছেলে দেয়নাই বাজান, খালি তিনডা মাইয়া।
-আপনারে দেখলেতো অসুস্হ মনে হয়…..এই অবস্হায় আপনি রিক্সা নিয়ে বের হলেন যে?
-হ বাজান শরীলডা ভালানা, তিনদিন জ্বরে পইডা আছিলাম, মালিক আইসা কইলো “তিনদিনের ভাড়া জমছে আইজ ভাড়া দিবার না পারলে রিক্সা লইয়া যামু।" অবস্হা ভালানা, খাওন দাওনের অভাব,……..উপাই অন্তর না দেইখা আইজ বাইর হইলাম।

শাহেদ খেয়াল করলো লোকটা কথা বলছে আর গলায় গরগর আওয়াজ হচ্ছে। এই বুঝি মানুষের নিয়তি!

একটা বৃদ্ধ যার কোন ছেলে নেই …..শুধু তিনটা মেয়ে
সংগ্রাম করছে নিরন্তর…..গাড়ি,বাড়ি ব্যবসা, বউয়ের জন্য ইন্ডিয়ান শাড়ি, ঈদের শপিং, বাহারি খাওয়া-দাওয়া এসবের জন্য নয়
শুধু একবেলা ভাত,
অথবা নিদেন পক্ষে মালিক এসে রিক্সাটা যেন নিয়ে না যায় শুধু সেই টাকাটা যোগাড় করা
অথবা আরেকটা দিন কোনরকমে একটু বেচে থাকার জন্য।
কিন্তু কীভাবে বাচবে এই বৃদ্ধ?
হয়ত কোন একদিন রিক্সা ঠেলতে ঠেলতে রাস্তার পাশে মরে পড়ে থাকবে জানতেও পারবেনা কেউ।

বাজারের মধ্যে ঢুকছে রিক্সা

-চাচ ভাড়া কতো পেলেন আজকে?
-বিকাল থাইক্যা অ্হন পর্যন্ত ৩০ টাহা পাইছি
-এত অল্প কেন?
-কি কমু বাজান বুড়া মানুষ দেইখলে আর কেই উঠবার চায়না।

ঠনক নড়লো শাহেদের। কারনটা খুবই স্পষ্ট …..প্রথমে সে নিজে ও উঠতে চায়নি।

প্রত্যেকটা বৃদ্ধ রিক্সা চালকের এই বয়সে রিক্সা চালানোর পিছনে হয়তো একটা করে মর্মান্তিক গল্প আছে।নাহলে এই বয়সে কারো রিক্সা নিয়ে বের হওয়ার কথা না।
গল্পটা তখন আরো ব্যাথাতুরা হয়ে উঠে যখন বয়সের ভারে নুয়ে আসা চালকের শরীর দেখে কেউ তার রিক্সায় উঠতে চায়না। সবাই এড়িয়ে চলে।
শাহেদ ভাবলো…. কিছু করতে পারি বা না পারি এখন থেকে অন্তত বৃদ্ধ চালকদের রিক্সাই উঠবো।

চাচা রিক্সার পেডেল মারে , শাহেদ চেয়ে থাকে অপলক।

-চাচা হোটেল আলামিনের সামনে নিয়ে যান।
রিক্সা থেকে নামলো শাহেদ…ঈফতারির সময় হয়ে আসলো।
- চাচা চলেন একসাথে ইফতারি করব।
-না বাবা আমি রোজা আছিলামনা, দেহি দুই একটা খ্প্যা পাওন যায় নাকি।
-রোজা রাখেননি তাতে কি? চলেন একসাথে ইফতারি করবো্। - - -জোর করেই চাচাকে সাথে নিয়ে পাশে বসালো। রকমারি ইফতারি সাজানো সামনে। সময় হল।
শাহেদ খেয়াল করলো চাচা ইফতারির ফাকে ফাকে কিছু ইফতারি পকেটে ঢুকাচ্ছে। কারণটা বুঝতে পেরে বড় একটা প্যাকেট ভরে ইফতারি দিয়ে দিল চাচাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য।

শাহেদের ঈদ শপিংয়ে ছেদ ঘটালো অন্যরকম কিছু ভাবনা।

কত মানুষ আছে আমাদের চারপাশে………ঈদের অপেক্ষা করেনা তারা।বরং ঈদ কত তাড়তাড়ি চলে যাবে সেই প্রহর গুনে ক্ষনে ক্ষনে।
ঈদ তাদের কাছে সূখের নয় যণ্ত্রনার
আনন্দের নয় আহাজারির
ঈদ থেকে পালিয়ে বাচতে চায় তারা কিন্তু সচ্ছল মানুষেরা চারিদিকে ঈদ আনন্দের তুফান বইয়ে দেয় আর সে আনন্দে খড় কুটোর মতো হাওয়ায় হাওয়ায় উড়তে থাকে ওইসব সর্বহারা মানুষের দল।আমরা কেউ তা আর তলিয়ে দেখিনা ভয়ে…………………….

ইফতারি শেষ। আজ শপিংয়ে আর মন নেই শাহেদের। চাচাকে বললো রিক্সা ঘুরান।

আবার রিক্সা ছোটে..।
চাচার দিকে তাকিয়ে অকৃত্রিম শ্রদ্ধায়, ভালবাসায় নুয়ে আসে শাহেদের মাথা
এই বয়সে যে অভাবী মানুষটার ভিক্ষের থালা নিয়ে রাস্তায় বসার কথা, সে তা না করে রিক্সার পেডেল মারে সর্বশক্তি দিয়ে। মাঝে মাঝে চাচার দু পায়ের শিরা স্টিলের তারের মত টান টান হয়ে যায়। মনে হয় এইবুঝি ঠাস করে ছিড়ে যাবে।কদমবুচি করতে ইচ্ছা করে শাশ্বত জীবন সংগ্রামে বিপ্লবী ঐ পা দুটি ছুয়ে।
জট পাকিয়ে যায় শাহেদের চিন্তা-ভাবনা। ক্রোধের আগুনে জলে যেতে চায় শরীর মন সবকিছু।সভ্যতার এই নির্মোহ নির্মান শ্রমিকেরা পুড়ে পুড়ে কাঠকয়লা হবে আর আমরা সেই কয়লায় আমাদের অফুরন্ত ক্ষুধা আর সীমাহীন বিলাসিতাকে শাণিত করবো অহর্নিশ। জগৎ জুড়ে এ কী এক মহা সার্কাস! এটাই নাকি জীবনের বৈচিত্র?
রিক্সা এসে পড়ল বাসার কাছাকাছি
শাহেদ নেমে রিক্সার হ্যান্ডেলে হাত রেখে চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে অপলক জীবনের মানচিত্র পাঠ করে খুটেখুটে।
অস্ফুট স্বরে বলে উঠে “গাহি তোমাদের গান”।
শা্হেদ পকেটে হাত দিয়ে যা আছে সবই দিয়ে দিল।
শুধু রইল জীবনের একখানা দর্পন আর
হৃদয় ভাংগার কিছু শব্দ। তাই নিয়ে শাহেদ পা বাড়ালো বাসার পথে……………

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ