বৃহস্পতিবার, ৮ আগস্ট, ২০১৩

জামায়াত হেফাজত মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র প্রসঙ্গ

প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা জোটের উদ্দেশ্য থাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আরোহণ এবং ঘোষিত নীতি, আদর্শ ও দর্শন অনুসরণে জনমানুষের কল্যাণ সাধন। সুতরাং একটি রাজনৈতিক দলের জন্য ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাজনৈতিকভাবে প্রচেষ্টা চালানো কোনো দোষের নয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম মূলমন্ত্রে বলা হয়েছে, ক্ষমতা আরোহণের প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে মৌলিক জাতীয় ইস্যুগুলোর ওপর ঐকমত্য থাকা প্রয়োজন এবং পরস্পরের প্রতি নূ্যনতম শ্রদ্ধাবোধ থাকা আবশ্যক। একইসঙ্গে ধর্মকর্মের সব ক্ষেত্রে সব মানুষের সমঅধিকার নিশ্চিত থাকতে হবে, শুধু কথার ফুলঝুরিতে নয়, রাষ্ট্রের সংবিধানে এবং রাষ্ট্রীয় কার্যকরণের সব ক্ষেত্রে। কিন্তু যে দুটি রাজনৈতিক দল বা জোট বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকার জন্য লড়াইয়ে রত, তাদের মধ্যে কি উপরোক্ত আবশ্যিক মৌলিক বিষয়ের ওপর নূ্যনতম কোনো মিল আছে? উত্তর, না।

বিশ্বের যে সব রাষ্ট্র গণতন্ত্রের পথ ধরে উন্নয়নের শিখরে উঠেছে, তাদের দিকে তাকালে দেখা যায় তারা দীর্ঘ সংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পর রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র হিসেবে যে দর্শনগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, পরবর্তীতে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার পালাবদলে ওইসব মূলমন্ত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সব রাজনৈতিক দলই ওই মূলমন্ত্রকে শিকড় বা ভিত্তিমূল ধরে দলীয় কর্মসূচি ও চিন্তাচেতনার প্রতি জনগণের সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের সংগ্রাম এবং একাত্তরের যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধ ও বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মৌলিকত্ব বা মূলমন্ত্র, যা সনি্নবেশিত হয় বাহাত্তরের সংবিধানে। প্রতিষ্ঠিত হয় গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এই মূলমন্ত্রগুলোর সাংবিধানিক ব্যাখ্যায় বলা হয়, বাংলাদেশে একটি উদার প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা থাকবে, যেখানে ধর্ম ও নারী পুরুষভেদে কোনোরকম বৈষম্য করা হবে না। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। রাষ্ট্রের সব অঙ্গনে বাঙালি সংস্কৃতির লালনপালন করা হবে এবং কিছুতেই তা কোনো ধর্ম বা বর্ণের মতাদর্শের ভিত্তিতে সংকুচিত করা যাবে না।


পঁচাত্তরের মর্মান্তিক ঘটনার কারণে আওয়ামী লীগ বা ১৪-দলীয় জোট ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে পঁচাত্তরের পর বিনষ্ট হওয়া রাষ্ট্রীয় মূলমন্ত্রগুলোকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালিয়েছে। অনেকটা সফল হয়েছে, তবে পরিপূর্ণ সফল হতে পারেনি। অন্যদিকে পঁচাত্তরের পর দুই সামরিক শাসকের পথ ধরে বিএনপি, পরে বিএনপি-জামায়াত, অধুনা এখন হেফাজত একসঙ্গে ওই রাষ্ট্রীয় মূলমন্ত্র বা ফান্ডামেন্টালগুলোর বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। ফলে অদ্ভুত এক অভিধা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজমান, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি, যা বিশ্বের কোথাও নেই। আমাদের রাজনীতির মূল সমস্যাটি এখানে। এই সমস্যার ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত চলতি কোনো সমস্যার সাময়িক কোনো সমাধানের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে আমরা সংঘাত-সাংঘর্ষিক রাজনীতি থেকে বের হতে পারব না। দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য অধরাই থেকে যাবে। বিশ্বের ইতিহাসের দিকে তাকালে এ কথার যথার্থতা পাওয়া যায়। যেহেতু একটা নির্বাচনী সংস্কৃতি মোটামুটি আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি বলা যায়। তাই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ ক্ষমতাসীনদের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে হয়তো একবার আওয়ামী লীগ, আরেকবার বিএনপি, এভাবে ক্ষমতার পেন্ডুলাম ঘোরাতে পারে; কিন্তু মানুষ যা চায়, গত ২০ বছরের ক্ষমতার পালাবদলে সে আশা তো পূর্ণ হয়নি।


বিএনপি নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক ইসলামী জোট এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক জোটের বাইরে আছে এরশাদের জাতীয় পার্টি। জিয়াউর রহমানের ধারাবাহিকতায় এরশাদ এ দেশের রাজনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে ক্ষতি করেছে, সে কথা বলে আর শেষ করা যাবে না। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিন রবিবারের পরিবর্তে শুক্রবার করে এরশাদ রাষ্ট্রের যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছে তা থেকে রাষ্ট্র এখনো বের হতে পারেনি। সবাই বলে এরশাদের মতিগতির কোনো ঠিক নেই। তবে এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়া এরশাদের পক্ষে আর সম্ভব নয় এ কথা যেমন সঠিক, তেমনি এ কথাও ঠিক যে ভোটের রাজনীতিতে জোট গঠনে এরশাদের মূল্য এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আরও একটি গ্রুপ আছে, তারা হলেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কিছু দলছুট নেতা। এরা বেশ কেতাদুরস্ত। ঢাকা নগরীর সিভিল সমাজে এদের একটি গ্রহণযোগ্যতা আছে এবং সাজিয়ে গুছিয়ে ভালো ভালো কথা বলতে পারে। তাদের কার্যক্রম ঢাকার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেমিনার কক্ষে এবং টেলিভিশনের টকশোর মধ্যে সীমাবদ্ধ। এরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে একই পাল্লায় মাপে। জনগণের কাছে এবং ভোটের রাজনীতিতে এদের খাতা এখনো শূন্য। অদূরভবিষ্যতে তা পূর্ণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সুতরাং ঘুরে ফিরে সেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এই দুই দল বা জোটই মানুষের কাছে থাকল। একদল উদার প্রগতিশীল এবং বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের পক্ষে। আরেক দল মানুষকে আস্তিক-নাস্তিক দুই ভাগে ভাগ করে নারীদের আবদ্ধ করার পক্ষে।


ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তাদের চলতি মেয়াদের প্রায় শেষ প্রান্তে। নৈরাশ্যবাদীদের কথা বাদ দিলে বলা যায়, আগামী জানুয়ারি মাসে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটের রায় সবাই মেনে নেবে সেটাই প্রত্যাশিত। এ বিষয়ে সম্প্রতি পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফল পরাজিতরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিয়ে একটা ভালো উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। পাঁচটি সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের বিগত দিনের পারফরম্যান্স এবং ব্যক্তিগত ট্র্যাক রেকর্ড সবদিক থেকে তুলনামূলকভাবে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের থেকে ভালো ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত কথা হলো, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা ভোটে হেরেছে। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে জনগণের রায় শিরোধার্য হিসেবে মেনে নিতে হবে। তবে জনগণের ভোটই যে সবক্ষেত্রে ও সব সময় চূড়ান্ত বিচারে ভালোর নির্দেশক তা বলা যাবে না। বিশ শতকের প্রথমভাগে জার্মানির হিটলার এবং ইতালির মুসলিনিকে সে দেশের মানুষ বিপুল ভোটে জয়ী করে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। তার খেসারত হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পৃথিবীর দুই কোটি মানুষকে প্রাণ দিতে হলো। হিটলার ও মুসলিনি উভয়ই ধ্বংস হলো, তাদের সব রাজনৈতিক দল চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ হলো। কিন্তু ইতোমধ্যে যে প্রাণপাত হলো এবং পৃথিবীর সম্পদ ধ্বংস হলো, তা তো আর ফিরে পাওয়া গেল না। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং একই অভিযোগে আদালতে দণ্ডায়মান মতিউর রহমান নিজামী ভোটে জিতে বিএনপির সহায়তায় ২০০১-২০০৬ মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তার ভয়ানক কুফল এ দেশের মানুষ দেখেছে। যদিও মানুষই আবার ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ভোটের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করেছে। কিন্তু ইতোমধ্যে রাষ্ট্রের জীবন থেকে পাঁচটি বছর যে ঝরে গেল তা তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। রাষ্ট্রের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তাও সহজে পূরণ হওয়ার নয়। সিটি নির্বাচনের ফলে বিএনপি শিবির উল্লসিত এবং আওয়ামী লীগ শিবির কিছুটা ম্রিয়মাণ। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক পোলারাইজেশন তত স্পষ্ট হচ্ছে। রোজার সময় ইফতার রাজনীতির চিত্র দেখে তা আরও পরিষ্কার হচ্ছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর বিএনপি ভোটের ফলে উৎসাহিত হয়ে তাদের জোটের পাঁচটি ইসলামী দলসহ জামায়াত-হেফাজতকে আরও আপন করে শক্তভাবে অাঁকড়ে ধরেছে। এখন আগামী নির্বাচনের ভোটের ফল দেখার অপেক্ষায়।


হেফাজতে ইসলাম সম্প্রতি নব্য রাজনৈতিক ইসলামের ঝাণ্ডা নিয়ে হাজির হয়েছে। গত সিটি নির্বাচনে তারা ব্যাপকভাবে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছে। হেফাজতে ইসলাম মন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগের জন্য যে উদগ্রীব হয়ে আছে তা তাদের ৬ মে-এর কর্মকাণ্ড থেকে স্পষ্ট। ওইদিন তাদের আশা ছিল আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হবে। সেই আশায় তারা বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে মিলে কে কোন মন্ত্রী হবে তার ভাগবাটোয়ারাও করে রেখেছিল। এটা হলো সেই অন্ধকারে আবদ্ধ ষাড়কে হঠাৎ বাইরে ছেড়ে দিলে যা হয় আর কি, সে রকম অবস্থা। সুতরাং ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াতের নেতারা যেমন বিএনপির কাঁধে চড়ে মন্ত্রী হয়েছিল, ঠিক একইভাবে যদি এবার হেফাজতও মন্ত্রিত্ব পায় তাহলে গণতন্ত্র এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোথায় যাবে তা তো হেফাজতের ১৩ দফা এবং সম্প্রতি আহমদ শফীর নারী নীতি সম্পর্কিত বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়েছে।


নারীদের লেখাপড়া বন্ধ করে ঘরের মধ্যে পুরুষদের দাসী বানানোর যে ফতোয়া হেফাজতের নেতা দিয়েছেন তার সমর্থনে বিএনপির সদস্যরা পার্লামেন্টে বক্তৃতা দিয়েছেন। তাহলে দাঁড়ালটা কি? দাঁড়াল এই_ বিএনপি ক্ষমতায় এলে হয় হেফাজতের ১৩ দফা ও আহমদ শফীর নারী নীতি বাস্তবায়ন করবে, আর নয়তো বুঝতে হবে বিএনপি এখন রাজনৈতিক কৌশলের নামে প্রবঞ্চকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। প্রবঞ্চনার আশ্রয় নিয়ে অথবা নারীদের অন্ধ কূপে নিক্ষেপ করে, দুটোর কোনোটার দ্বারাই শুভ কিছু অর্জন করা কোনো দিন সম্ভব হয়নি, আগামীতেও হবে না। জামায়াত ও তাদের রাজনীতি সম্পর্কে এ দেশের মানুষ এখন সবই জানে। এদের নিয়ে বেশি কিছু লিখে প্রবন্ধের স্পেস নষ্ট করতে চাই না। জামায়াতের মতে গণতন্ত্র হলো কুফরি মতবাদ। আর মুক্তিযুদ্ধ তো তারা স্বীকারই করে না। তারা বলে ওটা ছিল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এর থেকে বড় অপমান আর কিছু হতে পারে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৬৮ বছর পর নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে যারা এখনো বেঁচে আছে, তাদের বিচার করার লক্ষ্যে ওদেরকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সম্প্রতি জার্মানি একটা গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, যার নাম দিয়েছে,‘Operation Last Chance|’ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এই নাৎসি যুদ্ধাপরাধীরা যে অপরাধ করেছে তা সব কালের সীমা ভেদ করে এখনো দগদগে। তাই মানবতার কল্যাণের জন্য তাদের বিচার অপরিহার্য। আর বাংলাদেশে মাত্র ৪২ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে জামায়াত-বিএনপি যা বলছে, তাকে বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী বলা যায়।


যুদ্ধাপরাধের জন্য গঠিত বিচারিক আদালত রায়ে উল্লেখ করেছে_ জামায়াতে ইসলামী যে একটা সন্ত্রাসী সংগঠন তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ সংগঠনের সদস্যদের রাষ্ট্রীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে না রাখার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আদালত। এহেন জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা অনুমান করাও ভয়ঙ্কর বিষয়। এই জামায়াতের সঙ্গে গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ কি একই কাতারে অবস্থান করতে পারবে? লেবাসধারী ধার্মিকরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বাদ পেলে ধর্ম ও ন্যায় বিচার দুটোই যে ভূলুণ্ঠিত হয়, তার উদাহরণ মধ্যযুগ থেকে চলে আসছে, এখনো চলছে। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক প্রয়াত শওকত ওসমানের 'ক্রীতদাসের হাসি' উপন্যাসে একটি সরস উদাহরণ আছে। বাগদাদের সিংহাসনে তখন আব্বাসীয় খলিফা হারুন অর রশিদ। বাদশার হেরেমখানায় তো বেগম ও বাদীর সংখ্যার কোনো লেখাজোখা ছিল না। তারপরও 'মেহেরজান' নামের এক আরমানীয় বিবাহিত বাদীর ওপর নজর পড়ে বাদশার। মেহেরজানকে শাদি করার ইচ্ছা প্রকাশ করে বাদশা তার রাজকবির মতামত জানতে চান। রাজকবি ইসহাক বলেন, 'মেহেরজান বিবাহিত স্ত্রী, আর কারও জন্য সে হারাম।' প্রত্যুত্তরে বাদশা হারুন রাজদরবারের আলেম মাওলানা আবদুল কুদ্দুসের লিখিত ফতোয়া দেখান কবিকে। ফতোয়ায় মাওলানা লিখেছেন, 'মেহেরজান কেনা বাদী, মালিকের হুকুম ছাড়া তার কোনো শাদি হতে পারে না, যদি হয়, তা না-জায়েজ।' কবি ইসহাকের উত্তর, ' জাহাপনা, আলেম আবদুল কুদ্দুস আল্লাহর কালাম বিক্রি করেছেন।' বাদশা হারুনের সর্বশেষ উত্তর ছিল, 'দুনিয়া তো কেনাবেচার জায়গা, দোকানদার-খরিদ্দারে এ রকম সম্পর্ক না থাকলে দুনিয়া চলে (ক্রীতদাসের হাসি, পৃঃ ৩৯-৪০)।


প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. কাজী মোতাহার হোসেন তার লিখিত 'বাংলা ভাষার নতুন বিন্যাস, তৃতীয় খণ্ডে উল্লেখ করেছেন, "সচরাচর আমাদের ধর্ম মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারে। অজ্ঞদের মধ্যে ধর্ম উন্মত্ততা সৃষ্টি করে তার সুযোগে মতলব হাসিল করে নেওয়ার জন্য, ভোট সংগ্রহ বা পার্টি গঠন দ্বারা প্রভুত্ব ও প্রতিপত্তি লাভ করার উদ্দেশ্যে।


আজকাল তাই দেখা যায়, ধর্ম হয়ে উঠেছে রাজনীতির প্রধান অস্ত্র। কিন্তু প্রকৃত ধর্ম যে এর থেকে স্বতন্ত্র বস্তু, এ কথা যেন আজকাল আমরা বুঝেও বুঝতে চাচ্ছি না।" ধর্মকে ব্যবহার করে সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে মানুষকে যত সহজে উত্তেজিত করা যায় এবং অন্ধের মতো অনুসরণে উদ্বুব্ধ করা যায়, কাজ করে মানুষের সন্তুষ্টিকে সম্বল করে জনগণের সমর্থন আদায় করা বহুগুণে বেশি কঠিন কাজ। তাই যারা নিজেদের কাজ বা পারফরম্যান্সের ওপর আস্থা পায় না, তারা ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করে মানুষের সমর্থন আদায় করতে চায়। এতে তাদের দুই দিক থেকেই সুবিধা, সহজে ভোট পাওয়া যায় আর কাজ না করে, বরং লুটপাট করে নিজেদের ভাগ্য গড়া সহজ হয়। মুক্তিযুদ্ধের কথা একটু জোরেশোরে বললেই বিএনপি তাকে আওয়ামী লীগার বলে অভিহিত করে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে কেউ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ দল বলে না। সুতরাং আওয়ামী লীগের বাইরেও রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তি আছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে এখনো আপসহীন। এদের লড়াকু ভূমিকার ফলেই আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। কেউ ভোলেনি ১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা এবং পঁচাত্তরের পর থেকে আজ পর্যন্ত জামায়াতকে পুনর্বাসিত করতে বিএনপির আমরণ চেষ্টার কথা। সুতরাং মুখে শেখ ফরিদ বগলে ইট, এমন ভাব প্রকাশের জন্য দু-একজন পদস্খলিত মুক্তিযোদ্ধাকে জামায়াতের সঙ্গে একই মঞ্চে বসিয়ে মানুষকে আর বিভ্রান্ত করা যাবে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ