ইউরোপীয় দেশগুলোতে মুসলমানদের প্রতি অবিচার, বৈষম্য ও বর্ণবাদী আচরণ নতুন কোন বিষয় নয়। তবে নতুনত্ব হলো, সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কোন কোন ইউরোপীয় দেশে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের নিন্দা জানিয়ে বলেছে, মুসলমানদের ব্যাপারে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য প্রচার করে তাদের বিরুদ্ধে যে আবহ তৈরি করা হচ্ছে তা মোটেই ঠিক নয়। এখানে আমরা এ বিষয়ে আলোচনার প্রয়াস পাবো।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক প্রতিবেদনে বলেছে, মুসলমানদের সম্পর্কে যে সব নেতিবাচক ধারণা ছড়ানো হচ্ছে তা প্রতিহত করার জন্য ইউরোপীয় সরকারগুলোর আরো বেশি চেষ্টা চালানো উচিত। এ প্রতিবেদনে বিশেষভাবে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, হল্যান্ড, স্পেন ও সুইজারল্যান্ডের মুসলমানদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাটি বলেছে, এসব ইউরোপীয় দেশে মুসলমানদের মসজিদ নির্মাণের ওপর কঠোর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে এবং মুসলিম নারীদের হিজাব বা মাথায় স্কার্ফ পরতে বাধা দেয়া হচ্ছে।
অ্যামনেস্টির গবেষণা কর্মকর্তা মার্কো প্রোলিনি এ প্রতিবেদন সম্পর্কে বলেছেন, "ইউরোপের দেশগুলোতে স্কার্ফ পরিহিত মুসলিম নারীদের চাকরি দেয়া হচ্ছে না। মুসলিম মেয়েদেরকে শুধুমাত্র তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে বহু স্কুলে ভর্তি করা হচ্ছে না। যে সব মুসলিম পুরুষ দাড়ি রেখেছেন, তাদের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।" অ্যামনেস্টির এ বিশেষজ্ঞ আরো বলেছেন, "ইউরোপের সরকারগুলির পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতারা মুসলমানদের সঙ্গে এ বৈষম্যমূলক ও অন্যায় আচরণ প্রতিহত করার পরিবর্তে উগ্রপন্থী ভোটারদের কাছে টানার জন্য মুসলিম বিদ্বেষী আচরণকে প্রশ্রয় দেন।" প্রোলিনি বলেন, "ইউরোপীয় দেশগুলো বাক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার যে শ্লোগান দেয়, তারই ভিত্তিতে নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী পোশাক পরার অধিকার মুসলমানদের রয়েছে। এ ছাড়া, বিশ্বের প্রতিটি ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার রয়েছে।
অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনের একাংশে বলা হয়েছে, "বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও হল্যান্ডের মতো দেশগুলোর সরকারি অফিস-আদালত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মীয় কারণে বৈষম্যমূলক আচরণ না করার যে বিধান রয়েছে তা ঠিকভাবে মানা হয় না। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা নির্বিঘ্নে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কারণে কর্মচারীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ ও দুর্ব্যবহার করেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ইউরোপীয় দপ্তরের পরিচালক মার্কো প্রোলিনি এ সম্পর্কে বলেছেন, "এ ব্যাপারে কর্মক্ষেত্রে সবার জন্য একই রকম পোশাক বা বেশভূষার যে অজুহাত তোলা হয়, তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্ণবাদ বিরোধী আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।"
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় দেশগুলোতে বহু বছর ধরে মুসলমানদের সঙ্গে বিদ্বেষী ও সহিংস আচরণ করা হচ্ছে এবং দিন দিন এ অবিচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুঃখজনকভাবে ইউরোপের মানবাধিকার সংস্থাগুলো ওই মহাদেশের বাইরের দেশগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা খুঁজে বেড়ায়। বিশেষ করে যে সব দেশের সরকার পশ্চিমা দেশগুলোর সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরোধী সে সব দেশকে বিশেষভাবে টার্গেট করে এ সব মানবাধিকার সংস্থা। কিন্তু অ্যামনেস্টির আলোচ্য প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায়, ইউরোপীয় দেশগুলোর মুসলমানরা এত বেশি নির্যাতিত ও নিগৃহিত হচ্ছেন যে, লন্ডনভিত্তিক এ মানবাধিকার সংস্থাটি নিজের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথিত রক্ষকদের আসল চেহারা তুলে ধরতে বাধ্য হয়েছে।
ব্রিটেনের ইসলামী মানবাধিকার কমিশনের প্রধান মাসুদ শাজারেহ ইউরোপের কোন কোন দেশে মুসলমানদের সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ সংক্রান্ত অ্যামনেস্টির প্রতিবেদন সমর্থন করে বলেছেন, "মুসলমানদের পাহাড়সম সমস্যার খানিকটা হলেও তুলে ধরার জন্য আমরা এ প্রতিবেদনকে স্বাগত জানাই। সেইসঙ্গে আমরা এও মনে করি অ্যামনেস্টি অনেক দেরি করে এটি প্রকাশ করেছে এবং এর ভাষা অনেক নমনীয়।" তিনি আরো বলেন, "প্রকৃতপক্ষে ইউরোপে এর চেয়ে অনেক বেশি নির্যাতিত হচ্ছেন মুসলমানরা। চাকরির ক্ষেত্রে বর্ণবাদী আচরণ বা শিক্ষাক্ষেত্রে স্কার্ফ পরা মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ না দেয়া এখন মুসলমানদের জন্য মামুলি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তারা এর চেয়ে অনেক ভয়ানক সমস্যার মধ্যে রয়েছেন।"
লন্ডনের ইসলামী মানবাধিকার কমিশনের প্রধান বলেন, "ইউরোপের মুসলিম জনগোষ্ঠী ও তাদের মসজিদের ওপর হামলার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। দুঃখজনকভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়ার লজ্জাজনক কাজে পশ্চিমা সরকারগুলো জড়িত রয়েছে। পশ্চিমা সরকার ও গণমাধ্যম এখন এ বিষয়টি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়ার চেষ্টা করছে যে, মুসলমানরা এসব দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক।" মাসুদ শাজারেহ যেমনটি বলেছেন, ইউরোপে ইসলাম বিদ্বেষী আচরণ বর্তমানে নিছক বৈষম্যমূলক আচরণের চেয়ে অনেক বেশী গভীরে চলে গেছে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও হিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে।"
মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের দাবানল ছড়িয়ে দেয়ার বিষয়টি সম্প্রতি আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। ফ্রান্স সরকার গত কয়েক বছর ধরে মুসলমানদের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপের বিষয়টিকে আইনি রূপ দেয়ার চেষ্টা করছে। ফ্রান্সকে অনুসরণ করে আরো কিছু ইউরোপীয় দেশ মুসলিম বিদ্বেষী আইন তৈরি করেছে। এসব দেশের ডানপন্থী ও উগ্র ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো ইসলাম বিদ্বেষী শ্লোগানের ক্ষেত্রে একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ফ্রান্সের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট নিকোলা সার্কোযি সাম্প্রতিক নির্বাচনে উগ্র ডানপন্থীদের ভোট পাওয়ার জন্য অভিবাসী ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি মুসলমানদের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে হালাল গোশতের বিস্তারে উদ্বেগ প্রকাশ করে আবারো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এ ধরনের গোশত বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রতিশ্রুতি দেন। এর অর্থ হচ্ছে, ইউরোপের মুসলমানরা এখন নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী খাবার খাওয়ার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হতে যাচ্ছেন।
ইউরোপীয় সরকারগুলোর পাশাপাশি এসব দেশের গণমাধ্যম মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসেবে তুলে ধরার মাধ্যমে এসব দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট থেকে মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। অথচ ইউরোপীয় পুলিশ সংস্থা বা ইউরো পোলের বার্ষিক প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, এ মহাদেশের সন্ত্রাসী ততপরতাগুলোতে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা মাত্র দুই ভাগ মুসলমান নামধারী। বাকি ৯৮ ভাগ অন্যান্য ধর্মের অনুসারী। এদের মধ্যে বর্ণবাদী ও মুসলিম বিদ্বেষী গোষ্ঠী রয়েছে প্রচুর। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ইউরোপ জুড়ে অপরাধী কার্যক্রমে মুসলমানরা অত্যন্ত নগণ্য সংখ্যায় জড়িত থাকার পরও এসব দেশের গণমাধ্যম এমন একটি আবহ তৈরি করেছে যে, সব অপরাধ যেন মুসলমানরাই করছে।
মাসুদ শাজারেহ এ সম্পর্কে আরো বলেছেন, "ইউরোপে যখনই কোন বিদ্বেষী ও ঘৃণা বিজড়িত প্রচারণার ঝড় উঠেছে, তখনই সেখানে পৈশাচিক গণহত্যা চালানো হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের বিরুদ্ধে এবং ১৯৯০ এর দশকে বসনিয়ার মুসলমানদের বিরুদ্ধে এ ধরনের গণহত্যা লক্ষ্য করা গেছে। বর্তমানেও মুসলমানদেরকে একটি ঘৃণিত জাতি হিসেবে তুলে ধরার জন্য পাশ্চাত্যের রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যম সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ইউরোপের বিগত দিনের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের প্রচেষ্টা সত্যিই ভয়াবহ।" লন্ডনের ইসলামী মানবাধিকার কমিশনের প্রধান আরো বলেন, 'আমরা এমন একটি পৃথিবীতে বসবাস করছি যেখানে কিছু কৃষ্ণাঙ্গ বা ইহুদি কিংবা খ্রীস্টানের সঙ্গে সামান্য দুর্ব্যবহার করা হলেই তা নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে হৈ চৈ পড়ে যায়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালানো হলেও তা নিয়ে কেউ কথা বলে না।'
তিনি আরো বলেন, 'ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর ব্যাপারে তেমন কোন হৈ চৈ হয়নি। মার্কিন পাদ্রী কর্তৃক ইসলাম অবমাননার প্রতিকার চেয়েও কোন মানবাধিকার সংস্থাকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি।' এ সবই ইউরোপের কথিত গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতার পরিপন্থী। ইউরোপীয়রা যে গণতন্ত্রের কথা বলে সেখানে মানবাধিকার ও মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন আসলে মুসলমানদের মানুষ বলেই গণ্য করা হয় না। ঠিক এ কারণেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটি অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে গেছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক প্রতিবেদনে বলেছে, মুসলমানদের সম্পর্কে যে সব নেতিবাচক ধারণা ছড়ানো হচ্ছে তা প্রতিহত করার জন্য ইউরোপীয় সরকারগুলোর আরো বেশি চেষ্টা চালানো উচিত। এ প্রতিবেদনে বিশেষভাবে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, হল্যান্ড, স্পেন ও সুইজারল্যান্ডের মুসলমানদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাটি বলেছে, এসব ইউরোপীয় দেশে মুসলমানদের মসজিদ নির্মাণের ওপর কঠোর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে এবং মুসলিম নারীদের হিজাব বা মাথায় স্কার্ফ পরতে বাধা দেয়া হচ্ছে।
অ্যামনেস্টির গবেষণা কর্মকর্তা মার্কো প্রোলিনি এ প্রতিবেদন সম্পর্কে বলেছেন, "ইউরোপের দেশগুলোতে স্কার্ফ পরিহিত মুসলিম নারীদের চাকরি দেয়া হচ্ছে না। মুসলিম মেয়েদেরকে শুধুমাত্র তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে বহু স্কুলে ভর্তি করা হচ্ছে না। যে সব মুসলিম পুরুষ দাড়ি রেখেছেন, তাদের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।" অ্যামনেস্টির এ বিশেষজ্ঞ আরো বলেছেন, "ইউরোপের সরকারগুলির পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতারা মুসলমানদের সঙ্গে এ বৈষম্যমূলক ও অন্যায় আচরণ প্রতিহত করার পরিবর্তে উগ্রপন্থী ভোটারদের কাছে টানার জন্য মুসলিম বিদ্বেষী আচরণকে প্রশ্রয় দেন।" প্রোলিনি বলেন, "ইউরোপীয় দেশগুলো বাক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার যে শ্লোগান দেয়, তারই ভিত্তিতে নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী পোশাক পরার অধিকার মুসলমানদের রয়েছে। এ ছাড়া, বিশ্বের প্রতিটি ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার রয়েছে।
অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনের একাংশে বলা হয়েছে, "বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও হল্যান্ডের মতো দেশগুলোর সরকারি অফিস-আদালত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মীয় কারণে বৈষম্যমূলক আচরণ না করার যে বিধান রয়েছে তা ঠিকভাবে মানা হয় না। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা নির্বিঘ্নে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কারণে কর্মচারীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ ও দুর্ব্যবহার করেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ইউরোপীয় দপ্তরের পরিচালক মার্কো প্রোলিনি এ সম্পর্কে বলেছেন, "এ ব্যাপারে কর্মক্ষেত্রে সবার জন্য একই রকম পোশাক বা বেশভূষার যে অজুহাত তোলা হয়, তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্ণবাদ বিরোধী আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।"
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় দেশগুলোতে বহু বছর ধরে মুসলমানদের সঙ্গে বিদ্বেষী ও সহিংস আচরণ করা হচ্ছে এবং দিন দিন এ অবিচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুঃখজনকভাবে ইউরোপের মানবাধিকার সংস্থাগুলো ওই মহাদেশের বাইরের দেশগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা খুঁজে বেড়ায়। বিশেষ করে যে সব দেশের সরকার পশ্চিমা দেশগুলোর সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরোধী সে সব দেশকে বিশেষভাবে টার্গেট করে এ সব মানবাধিকার সংস্থা। কিন্তু অ্যামনেস্টির আলোচ্য প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায়, ইউরোপীয় দেশগুলোর মুসলমানরা এত বেশি নির্যাতিত ও নিগৃহিত হচ্ছেন যে, লন্ডনভিত্তিক এ মানবাধিকার সংস্থাটি নিজের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথিত রক্ষকদের আসল চেহারা তুলে ধরতে বাধ্য হয়েছে।
ব্রিটেনের ইসলামী মানবাধিকার কমিশনের প্রধান মাসুদ শাজারেহ ইউরোপের কোন কোন দেশে মুসলমানদের সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ সংক্রান্ত অ্যামনেস্টির প্রতিবেদন সমর্থন করে বলেছেন, "মুসলমানদের পাহাড়সম সমস্যার খানিকটা হলেও তুলে ধরার জন্য আমরা এ প্রতিবেদনকে স্বাগত জানাই। সেইসঙ্গে আমরা এও মনে করি অ্যামনেস্টি অনেক দেরি করে এটি প্রকাশ করেছে এবং এর ভাষা অনেক নমনীয়।" তিনি আরো বলেন, "প্রকৃতপক্ষে ইউরোপে এর চেয়ে অনেক বেশি নির্যাতিত হচ্ছেন মুসলমানরা। চাকরির ক্ষেত্রে বর্ণবাদী আচরণ বা শিক্ষাক্ষেত্রে স্কার্ফ পরা মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ না দেয়া এখন মুসলমানদের জন্য মামুলি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তারা এর চেয়ে অনেক ভয়ানক সমস্যার মধ্যে রয়েছেন।"
লন্ডনের ইসলামী মানবাধিকার কমিশনের প্রধান বলেন, "ইউরোপের মুসলিম জনগোষ্ঠী ও তাদের মসজিদের ওপর হামলার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। দুঃখজনকভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়ার লজ্জাজনক কাজে পশ্চিমা সরকারগুলো জড়িত রয়েছে। পশ্চিমা সরকার ও গণমাধ্যম এখন এ বিষয়টি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়ার চেষ্টা করছে যে, মুসলমানরা এসব দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক।" মাসুদ শাজারেহ যেমনটি বলেছেন, ইউরোপে ইসলাম বিদ্বেষী আচরণ বর্তমানে নিছক বৈষম্যমূলক আচরণের চেয়ে অনেক বেশী গভীরে চলে গেছে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও হিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে।"
মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের দাবানল ছড়িয়ে দেয়ার বিষয়টি সম্প্রতি আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। ফ্রান্স সরকার গত কয়েক বছর ধরে মুসলমানদের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপের বিষয়টিকে আইনি রূপ দেয়ার চেষ্টা করছে। ফ্রান্সকে অনুসরণ করে আরো কিছু ইউরোপীয় দেশ মুসলিম বিদ্বেষী আইন তৈরি করেছে। এসব দেশের ডানপন্থী ও উগ্র ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো ইসলাম বিদ্বেষী শ্লোগানের ক্ষেত্রে একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ফ্রান্সের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট নিকোলা সার্কোযি সাম্প্রতিক নির্বাচনে উগ্র ডানপন্থীদের ভোট পাওয়ার জন্য অভিবাসী ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি মুসলমানদের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে হালাল গোশতের বিস্তারে উদ্বেগ প্রকাশ করে আবারো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এ ধরনের গোশত বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রতিশ্রুতি দেন। এর অর্থ হচ্ছে, ইউরোপের মুসলমানরা এখন নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী খাবার খাওয়ার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হতে যাচ্ছেন।
ইউরোপীয় সরকারগুলোর পাশাপাশি এসব দেশের গণমাধ্যম মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসেবে তুলে ধরার মাধ্যমে এসব দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট থেকে মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। অথচ ইউরোপীয় পুলিশ সংস্থা বা ইউরো পোলের বার্ষিক প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, এ মহাদেশের সন্ত্রাসী ততপরতাগুলোতে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা মাত্র দুই ভাগ মুসলমান নামধারী। বাকি ৯৮ ভাগ অন্যান্য ধর্মের অনুসারী। এদের মধ্যে বর্ণবাদী ও মুসলিম বিদ্বেষী গোষ্ঠী রয়েছে প্রচুর। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ইউরোপ জুড়ে অপরাধী কার্যক্রমে মুসলমানরা অত্যন্ত নগণ্য সংখ্যায় জড়িত থাকার পরও এসব দেশের গণমাধ্যম এমন একটি আবহ তৈরি করেছে যে, সব অপরাধ যেন মুসলমানরাই করছে।
মাসুদ শাজারেহ এ সম্পর্কে আরো বলেছেন, "ইউরোপে যখনই কোন বিদ্বেষী ও ঘৃণা বিজড়িত প্রচারণার ঝড় উঠেছে, তখনই সেখানে পৈশাচিক গণহত্যা চালানো হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের বিরুদ্ধে এবং ১৯৯০ এর দশকে বসনিয়ার মুসলমানদের বিরুদ্ধে এ ধরনের গণহত্যা লক্ষ্য করা গেছে। বর্তমানেও মুসলমানদেরকে একটি ঘৃণিত জাতি হিসেবে তুলে ধরার জন্য পাশ্চাত্যের রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যম সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ইউরোপের বিগত দিনের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের প্রচেষ্টা সত্যিই ভয়াবহ।" লন্ডনের ইসলামী মানবাধিকার কমিশনের প্রধান আরো বলেন, 'আমরা এমন একটি পৃথিবীতে বসবাস করছি যেখানে কিছু কৃষ্ণাঙ্গ বা ইহুদি কিংবা খ্রীস্টানের সঙ্গে সামান্য দুর্ব্যবহার করা হলেই তা নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে হৈ চৈ পড়ে যায়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালানো হলেও তা নিয়ে কেউ কথা বলে না।'
তিনি আরো বলেন, 'ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর ব্যাপারে তেমন কোন হৈ চৈ হয়নি। মার্কিন পাদ্রী কর্তৃক ইসলাম অবমাননার প্রতিকার চেয়েও কোন মানবাধিকার সংস্থাকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি।' এ সবই ইউরোপের কথিত গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতার পরিপন্থী। ইউরোপীয়রা যে গণতন্ত্রের কথা বলে সেখানে মানবাধিকার ও মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন আসলে মুসলমানদের মানুষ বলেই গণ্য করা হয় না। ঠিক এ কারণেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটি অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে গেছে।