রবিবার, ১৫ জুলাই, ২০১২

বিয়ের ফল

শালা, শ্যালিকার হৈ হুল্লায় ঘুম ভেঙে গেল। বিছানা ছেড়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখি এলাহী কারবার। মেঝেতে মৌসুমি ফলের ছড়াছড়ি। আম, তরমুজসহ অনেক রকমের ফল গ্রাম থেকে পাঠিয়েছেন শ্বশুরমশাই। কাজের বুয়াকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় যত আত্মীয়স্বজন আছে সবার জন্য আলাদা প্যাকেট করতে করতে বউ আদেশের সুরে বলল, জলদি ফ্রেশ হয়ে নাও। এরপর সব আত্মীয়ের বাসায় দিয়ে বাজার করে আনবে। কত দিন পর ওরা বেড়াতে এলো।
মনে মনে বললাম, এক মাসও হয়নি ওরা ১০ দিন থেকে গেল! কিন্তু মনের কথা মনেই থেকে গেল। শালা-শ্যালিকার সঙ্গে হালকা রসিকতা করে ফ্রেশ হয়ে বাসা থেকে বের হলাম। সারা দুপুর ঢাকার যানজটের সঙ্গে যুদ্ধ করে আত্মীয়স্বজনের বাসায় ফল বিতরণ শেষে কাঁচাবাজারে ঢুকে তেল, মসল্লা, গরুর মাংস কিনে মুরগির দোকানে গিয়ে মিজাজ চরমে উঠল। গেল সপ্তাহে কিনেছি ১৭০ টাকা দিয়ে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২০০ টাকা! বউকে এসএমএস দিলাম ‘গরুর মাংস কিনেছি মুরগি না এনে ডিম আনলে চলবে না!’ মিনিট খানেক না যেতেই বউয়ের ফিরতি এসএমএস ‘গর্দভ কোথাকার, রুমা গরুর মাংস খায় না জান না?’ শ্যালিকার জন্য মুরগি কিনে কাঁচা মরিচের কথা মনে পড়তেই মরিচ বিক্রেতার কাছে গেলাম। দাম শুনে বললাম, একটু কম হয় না? দোকানির উত্তর, কম দামে মরিচ গাছ কিনে লাগান। তাহলে ফ্রিতে খাইতারবেন।
মরিচওয়ালার কথার ঝালে আর কিছু না বলে মানিব্যাগ বের করে দেখি ২০ টাকা আছে। ২০ টাকার মরিচ নিয়ে দুই হাতে দুই ব্যাগ নিয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় পৌঁছালাম বিকাল ৫টায়। ড্রয়িং রুমের সোফায় শরীর এলিয়ে বসতেই বউ গ্লাসে করে শরবত নিয়ে এলো। বলল জানু, নতুন একটা রেসিপি পেয়েছি পত্রিকায়। তরমুজ, পাকা আম আর কাঁচা মরিচ মিকশ্চার মেশিনে দিয়ে তোমার জন্য নিজ হাতে নতুন রেসিপির শরবত বানিয়েছি।
মরিচের কত দাম জান? আর তুমি তো জান মরিচ আমার সহ্য হয় না। তুমি খেয়ে ফেল। এরপর শুধু আম আর তরমুজ দিয়ে শরবত বানিয়ে দাও।
মরিচের দামটাই দেখলে! তুমি আমাকে একটুও ভালোবাস না! তোমাকে ভালোবেসে এত কষ্ট করে বানিয়েছি আর তুমি মরিচের ভয়ে খাবে না। লাগবে না তোমার খাওয়া। আমিও খাব না। সব বেসিনে ফেলে দেব।
মুখে আঁচল গুঁজে অনন্যা কিচেনের দিকে হাঁটা শুরু করতেই উঠে গিয়ে আঁচল ধরে সোহাগ ভরা কণ্ঠে বললাম, আরে তোমাকে একটু ক্ষেপাচ্ছিলাম। এত ভালোবেসে আমার জন্য বানিয়েছ, খাব না কি করে ভাবলে? দাও দেখি, মজা করে খেয়ে নেই!
পলকেই অনন্যার মুখে হাসি ফুটে উঠল! বউয়ের ভালোবাসা মেশানো অদ্ভুত রেসিপির ঝাল শরবত দম বন্ধ করে খেয়ে ফেলার ঘণ্টাখানেক পর থেকেই টয়লেটের সঙ্গে সম্পর্ক হয়ে গেল। ফলাফল, মৌসুমি ফলের ঝাল শরবত খেয়ে ভালোবাসার পরীক্ষা দিতে গিয়ে ২ দিন অফিসেও যাওয়া হলো না। প্রিয় বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থাকতে পারলাম না।
বিয়ের অনুষ্ঠানে থাকতে পারিনি। তাই ব্যস্ততা সত্ত্বেও অনন্যাকে সঙ্গে নিয়ে বউভাত অনুষ্ঠানে গেলাম। 
লক্ষ্য করলাম অনন্যা আমাকে চোখে চোখে রাখছে। সুন্দরী কোনো মেয়ের দিকে দ্বিতীয়বার তাকালেই অনন্যার মুখের ভাব পাল্টে যাচ্ছে। বউকে কীভাবে বোঝাই যে চারপাশে এত সুন্দরীর আনাগোনা থাকলে চোখের আর কী দোষ!
—অ্যাই, অ্যাই তুমি ওই মেয়েটার দিকে একটু পর পর তাকাচ্ছ কেন?
—আমার কী মাথা খারাপ নাকি যে তুমি পাশে থাকতে অন্য মেয়ের দিকে তাকাব?
—কী বললা, কী বললা? এর মানে আমি পাশে না থাকলে তুমি অন্য মেয়েদের ড্যাব ড্যাব করে দেখ? তাই তো বলি তোমার মাঝারি সাইজের চোখ দিন দিন এত বড় হয়ে যাচ্ছে কী করে!
—কী বলছ এসব! ভালো করে দেখ। আমার চোখ আগের মতোই আছে।
—যে চোখ ঘরের বউ রেখে রাস্তাঘাটে অন্য মেয়েদের দেখে পরান জুড়ায়, তাকাব না ওই বেহায়া চোখের দিকে।
—শোন, রাস্তায় বেরুলে পকেটমার, ছিনতাইকারী, মলম পার্টি, চকোলেট পার্টি, কখন না আবার গাড়ি গায়ের ওপর উঠে যায় ইত্যাদি আতঙ্কে এতটাই আতঙ্কিত থাকতে হয় যে কোনো মেয়ের দিকে তাকানোর সময় কোথায়?
—এই তো ধরা খেলে। পকেটমার, ছিনতাইকারীদের ভয়ের কারণেই তাকানোর সময় পাও না। যদি এসব ভয় না থাকত, তাহলে তুমি ঠিকই তাকাই তা। এখানে তো আর ভয় নেই। তাই সুযোগ পেয়েই তাকানো শুরু করে দিয়েছ। ভণ্ড কোথাকার!
—আরে এটা তো কথার কথা। তোমাকে বোঝানোর জন্য উদাহরণ অর্থে বলেছি। শোন, অনুষ্ঠান শেষে তোমাকে নিয়ে শপিংয়ে যাব!
—বুঝি, আমি সবই বুঝি। আমাকে ঘুষ দিতে চাচ্ছ! যেন আমি এ বিষয় ভুলে যাই! গুষ্টি কিলাই বউ ভাতের, শপিংয়ের। বাসায় চলো। আজকে তুমি আমাকে রান্না করে খাওয়াবা। এটাই তোমার শাস্তি।
অনন্যার চেহারার দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলার সাহস পেলাম না। কত সহজেই না বুঝে ফেলল ঘুষ হিসেবে শপিংয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছি। আফসোস, বউ জাতির মাথার ঘিলু বেশ কাজ করলেও বাঙালি জাতির মাথার ঘিলু কাজ করে না। তাই তো নিজেরা ঘুষ দেয়, ঘুষখোর নেতাদেরও ভোট দেয়। এ জাতির যুবকরা ভর্তি ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে গাড়ি ভাংচুর করতে পারে, চাকরি নেয়ার সময় লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে পারে। পারে না শুধু ঘুষখোর নেতা ও তাদের পদলেহীদের পা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিতে। এই দেশের মন্ত্রী নামে আবুল হলেও ঘুষ কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দিয়ে দেয় জনগণকে আবুল বানিয়ে।
—এমন করে কী ভাবছ? কী বলেছি কানে যায়নি?
অনন্যার গলার স্বর আরও একটু উঁচু হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে রিপনের কাছে গিয়ে চলে যাচ্ছি বলতেই অবাক হয়ে বলল, তোর সমস্যা কিরে? বিয়েতে আসিসনি, অসুস্থ ছিলি। এখন তো সুস্থ। চলে যাচ্ছিস কেন?
—সবই বিয়ের ফল দোস্ত। এখন আমি বললেও বিশ্বাস করবি না। এক বছর সংসার কর, তখন বুঝবি দিল্লিকা লাড্ডু যে খায়নি সে পস্তাতে পারে, কিন্তু যে খেয়েছে সে কেন পস্তায়!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ