শুক্রবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

দুর্নীতির পাকে পাকে বিশ্ব ব্যাংক’ সংস্কার চাইল বাংলাদেশ! ঃ হবে কি?

ওয়াশিংটনে এখন প্রেসিডেন্টের অভিষেক সময়। আমেরিকান প্রেসিডেন্টের কথা বলা হচ্ছে না; বলা হচ্ছে ড. জিম ইয়ং কিমের কথা। যিনি আরো বিপর্যস্ত এবং অনেক কম দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখা একটি প্রতিষ্ঠানের হাল ধরবেন। যার নাম বিশ্ব ব্যাংক।

১৮৮টি সদস্য দেশ এবং প্রায় ৯ হাজার কর্মী ও পরামর্শকের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটির নেতৃত্ব দেবেন কিম।


প্রতিষ্ঠানটি ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে অতিরাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী এক ভার্চুয়াল জাতিরাষ্ট্রে । ২০১১ সালে এর তহবিলের পরিমাণ ছিল ৫৭ বিলিয়ন ডলার, যার ওপর যোগানদাতা সরকারগুলোর কোনো নজরদারি নেই বললেই চলে।


গত ৫ বছরে শত শত সাক্ষাতকারের বাইরেও গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ডজন ডজন সাক্ষাতকার এবং অভ্যন্তরীণ নথিপত্রের হাজার হাজার পাতা পর্যালোচনার পর দেখা যাচ্ছে, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নানা সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার পরও বিশ্বব্যাংকের সমস্যাগুলো আরও প্রকট হয়েছে।


ভেতরের সূত্রগুলো বলছে,
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মনোনীত কিম চলমান প্রক্রিয়া নতুন করে সাজানোর জন্য প্রস্তুত না থাকলে এ সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে না।

বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক এক পরিচালক প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান অবস্থার বর্ণনায় বলেছেন, “যেন জেলখানা চালাচ্ছে আসামীরা।”

ব্যাংকের সমস্যার একটা অংশ হচ্ছে দর্শনগত: একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব ব্যাংকের ভূমিকা আসলে কী হবে তার ছক কাটতে পারেননি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রবার্ট জেলিক থেকে শুরু করে অন্যরাও। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্যাংকের কাছে অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনের গ্রাহক হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্ব পাওয়াটাকে। চীন উল্টো অন্যান্য দেশগুলোকে উন্নয়নের অর্থ বিতরণ করে।

আবার দুর্নীতি নিয়ে বেশি তদন্ত না করতে বিশ্ব ব্যাংককে শাসায়। এর পরও ব্যাংকের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে গুরুত্ব পাওয়া গ্রাহক হিসেবে রয়ে গেছে চীন।


সমস্যার একটা অংশ কাঠামোগত : ফোর্বস কিছু অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখেছে, জেলিক বাজেট কাটছাঁট করার পরও কিছু কর্মকর্তা বাজেটের বাইরেই কাজ চালিয়েছে যা ব্যয় সংকোচন করতে দিচ্ছে না। আর অন্যরা প্রক্রিয়ার ভেতর নিজেদের পদ ঘন ঘন পরিবর্তন করে পয়সা কামিয়েছেন অথবা পদ মর্যাদা বাড়িয়েছেন। কিন্তু এসব অর্থের খোঁজ পাওয়া গেল না কেন? সৌভাগ্য: ব্যাংকের সূত্রগুলো জানিয়েছে, স¤প্রতি কম্পিউটারে গোলোযোগের কারণে ২০০ কোটি ডলারের হিসাব হারিয়ে গেছে।


দুঃখের কারণটা হল, সমস্যার শেষ অংশটা সাংস্কৃতিক: ভেতরের এবং বাইরের সবাই বলে, বিশ্বব্যাংক তার সুখ্যাতির ঝুঁকি নিয়ে এতটাই আচ্ছন্ন যে নেতিবাচক কোনো কিছু এলে তাকে মোকাবেলা না করে কোনো বিচার বিবেচনা ছাড়াই চেপে যায়।


যাদের সতর্ক করে দেবার কথা, তারা সমস্যা দূর করার সঠিক পন্থায় এগোয় না। ওয়াশিংটনের সদরদপ্তরের ভীত এবং জি হুজুর মার্কা কর্মকর্তারা নিজেদের দেশে ফেরত যাওয়ার আশংকায় তাদের সত্যিকারের মতামত কদাচিৎই জানায়।


এ প্রতিবেদনটি তৈরির সময় জেলিক ফোর্বসের সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকার করেন। অবশ্য এটা মোটেই আশ্চর্যজনক নয়। আমি গত ৫ বছর ধরে বিশ্ব ব্যাংকের খবরাখবর সংগ্রহে কাজ করি। এ সময় মধ্য থেকে উচ্চ পদের কারো সঙ্গে কথা বলতে রীতিমতো বাধার মুখে পড়েছি।


নিয়ন্ত্রণহীন বেশিরভাগ আমলাতন্ত্রের মতোই বিশ্ব ব্যাংকেরও যাত্রা শুরু হয়েছিল মহৎ ও আদর্শগত লক্ষ্য নিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে বিশ্ব ব্যাংক তৈরি করা হয় পশ্চিমা অর্থনীতিবিদদের এক সম্মেলনে। তারা চাচ্ছিলেন, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা মোকাবেলা করার উপায় খুঁজতে। তারা বিশ্বাস করতেন, এ থেকেই যুদ্ধের সূচনা হয়েছে যা ভবিষ্যতে আর দেখতে চাননি তারা।


ইউরোপ ও জাপানকে আবার গড়তে সফলভাবে সহায়তার পর বিশ্বব্যাংক বি¯তৃত হয়ে সত্যিকারের একটি বৈশ্বিক সংস্থায় পরিণত হয়। বিশেষ করে এটি ঘটে ১৯৭০ সালে, রবার্ট ম্যাকনামারার নেতৃত্বে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে তার ভূমিকার দায়মোচন করতেই হতো দারিদ্রমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্য স্থির করেন তিনি। দাতা সংস্থাগুলো প্রতিবছর বিশ্ব ব্যাংককে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দেওয়া শুরু করে যা বিশ্বব্যাপী দারিদ্র দূরীকরণে বিতরণ করা হয়।


পরিচালনার দিক থেকে বিশ্ব ব্যাংকের সবচেয়ে বড় শেয়ারহোল্ডার যুক্তরাষ্ট্র যার আছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ১৬ শতাংশ ভোট। অন্য ১৮৭ জন সদস্য দেশ ঠাঁই পায় ২৫ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে। ব্যাংকের অর্থায়ন, অনুদান ও ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল যা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়।


বিশ্বব্যাংক অর্থ পায় দাতা দেশগুলো থেকে। একই সঙ্গে বন্ড বিক্রি করেও তারা আয় করে। বিশ্ব ব্যাংকের ভূমিকা হওয়া কথা ছিল কেবল উন্নয়ন প্রকল্প যেমন ভবন, বাঁধ, রাস্তা, স্কুল এমনকি মৎস্য খামার উন্নয়নে। তবে ব্যাংকের প্রকল্পের সংখ্যা ও অর্থ বাড়তে থাকায় সমস্যা ও দুর্নীতি বাড়তেই থাকে কারণ তাদের নিরীক্ষা করার সুযোগ কোনো সংস্থারই নেই।


সংকট থেকে উত্তরণের জন্য জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০৫ সালে নিয়োগ করেন পল উলফোভিৎসকে। দুর্নীতির মূলোৎপাটনই প্রাথমিক লক্ষ্য ঠিক করেন তিনি। কিন্তু সাবেক এই পেন্টাগন কর্মকর্তাও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেছেন। ফোর্বসের হাতে আসা নথিপত্র অনুযায়ী পরিচালনা পর্ষদ ও উলফোভিৎস এমনই যুদ্ধে নেমেছিল যে পরিচালনা পর্ষদের সভার সিদ্ধান্তগুলো এমনভাবে নথিভূক্ত করা হতো যাতে বিশ্ব না জানে আসলেই কি হয়েছে সভায়।


যাই হোক, উলফোভিৎস আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু তিনিও সংকীর্ণ স্বার্থের বশে তার বান্ধবীকে বিশেষ সুবিধা করে দিয়েছেন যা তার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করেছে। পরে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।


এর পরই এলেন জেলিক। তার যোগ্যতাও কম নয়, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে কাজ করেছেন, সহকারি ট্রেজারি সেক্রেটারি ও উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন। ২০০৭ সালে ব্যাংকে যোগ দিয়েই পরিস্থিতি শান্ত করেন তিনি। বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকটের পর পরই খাদ্য সংকটের সময় তিনি রেকর্ড পরিমাণ ঋণ দিয়ে বিশ্বের দরিদ্রতমদের রক্ষা করলেন। এরপর তিনি মনোযোগ দেন সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে তহবিল বাড়ানোর দিকে।


ব্যাংকে যোগ দিয়ে উচ্চ পদগুলোয় নারীদের জন্য প্রতিবন্ধকতা দেখে জেলিক বিস্মিত হয়েছেন। পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি শীর্ষ পদগুলোর প্রায় অর্ধেকেই বসান নারীদের। ব্যাংকের ৫০ বছরের পুরোনো উপাত্ত ভান্ডার থেকে গ্রাহকদের উপাত্ত ও জরিপ প্রতিবেদন কিনতে হয় জেনেও তিনি অবাক হয়েছিলেন। তাই তিনি ওপেন ডাটা প্রোগ্রামের আওতায় স্পর্শকাতর উপাত্ত ছাড়া সব উপাত্ত বিনামূল্যে সবার জন্য খুলে দিতে নির্দেশ দেন।


কিন্তু ব্যাংকের মূল সমস্যা বাড়তেই থাকে। প্রথমে মনে হতে থাকে যে, জেলিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে উলফোভিৎসের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ব্যাংকের দুর্নীতি প্রতিরোধ শাখার বাজেট ও জনবল বাড়িয়ে দেন। তারা দুর্নীতি ও ঘুষ কেলেংকারির দায়ে জার্মিানির সিমেন্স ও ব্রিটেনের ম্যাকমিলান পাবলিশার্সসহ অসংখ্য কোম্পানিকে চিহ্নিত ও কালো তালিকাভুক্ত করে।


কিন্তু আমি অসংখ্য ব্যবস্থাপক ও ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলেছি যারা বলেছেন, দুর্নীতি বেড়েছেই। পাঁচ বছর আগে পল ভলকারের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন দুর্নীতিকে বিশাল সমস্যা বলে অভিহিত করে। তিনি ব্যাংকের দুর্নীতি প্রতিরোধী শাখাটিকে নতুন কাঠামোতে সাজানোরও সুপারিশ করেন। জেলিক ভলকারের সুপারিশের প্রতিটিই বাস্তবায়ন করেন। কিন্তু একটা বড় প্রশ্ন ওঠে, আদতেই এটার কোনো বড় প্রভাব পড়েছিল কিনা।


গত বছর ব্যাংকের দুর্নীতি বিরোধী প্রচেষ্টার কার্যকারিতা নিয়ে একটা অর্ভন্তরীণ মূল্যায়ন হয়েছিল। প্রতিবেদনটির মূল লেখক নবীন গিরিশংকরের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রথম দিকে জেলিকের দল মূল্যায়নকারীদের ভলকারের পুনর্কাঠামোর ওপর মূল্যায়ন না করতে বলে। কারণ হিসেবে তারা কার্যকারিতা বোঝার জন্য আরও সময় চান। তদন্তকারীরা এতে রাজি হয়ে ‘ব্যাংকের পরিচালনার মান’ এর ওপরই গুরুত্ব দিয়েছে।


তাদের প্রাতিবেদন বিশ্ব ব্যাংকে একটা আলোড়ন তোলে। জেলিকের দল এ প্রতিবেদনের অসারতা প্রমাণ করতে অনেক চেষ্টা চালায়। গিরিশংকর বলেন,
“প্রথম দিকে এমন সব দেশে তারা আমাদের পাঠাতে চাইত যেখানে সাফল্য এসেছে বলে তারা মনে করেছে। তারপর যখন বের হত যে ব্যাংক দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে এবং দেশগুলোর সরকারের মান উন্নয়নে ব্যাংকের ভূমিকা সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তখন তারা আমাদের নমুনায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকল।”

আরেকজন অভ্যন্তরীণ তদন্তকারী আনিস দানিরও একই ধরণের প্রতিবেদনকে ব্যাংক অগ্রাহ্য করেছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকের পাঁচ বছরের প্রকল্পের কার্যকারিতা, প্রভাব ও ফল-সব মিলিয়ে মানের
‘নাটকীয় পতন’ হয়েছে। তিনি আরও দেখতে পেরেছেন ব্যাংকের সব প্রকল্প নিয়ে কাজ করা একমাত্র ‘হুইসেল ব্লোয়ার’ কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স গ্র“পকে পরিকল্পিতভাবে সরানোর চেষ্টা করা হয়েছে। জেলিকের দল ২০১০ সালে গ্র“পটিকে বিলুপ্ত করে দেয় এই দাবি করে যে, এটিকে অন্য কিছু দিয়ে পাল্টানো হবে। দানি বিশ্বব্যাংকের এ দাবিকে বলেছেন ‘ফালতু’।

দানির প্রতিবেদন ফেব্রুয়ারিতে বোর্ডে উপস্থাপন করা হয় যার বিরোধিতা করে ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপকেরা। তারা আগেভাগেই তাদের নিজস্ব পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনা পেশ করে যাতে দানির বের করা অনেক সমস্যাই থাকে। দানির প্রতিবেদনটা তাই আর প্রকাশিত হয়নি।


২০১০ সাল থেকে জাতিসংঘের প্রধান অভ্যন্তরীণ ‘ওয়াচডগ’ বা পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করা কারম্যান এল লাপয়েন্ত এর আগে কাজ করেছেন বিশ্ব ব্যাংকের অডিটর জেনারেল হিসেবে। তখন তার দল প্রতিষ্ঠানের ভেতরে কি হচ্ছে তা নিয়ে প্রতি বছর ৬০টি অভ্যান্তরীণ প্রতিবেদন ইস্যু করে। ব্যাংকে কারম্যানের কাজের সমর্থক একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, “কারম্যানের প্রতিবেদন ছিল অনেকটা খোলামেলা।”


কিন্তু এর কারণে ২০০৯ সালের শেষের দিকে ল্যাপয়েন্তকে ব্যাংক থেকে বের হয়ে যেতে হয়। ফোর্বসকে লাপয়েন্ত বলেন, “আমরা যা বলার সরাসরি বলেছি। ব্যাংকের শীর্ষ পদগুলোতে যারা আছেন তারা যেভাবে চান সেভাবে বলিনি। তারা কঠিন কোনো বার্তা শুনতে চায় না। তারা কোনো কিছুর দায় নিতে খুবই অনিচ্ছুক।”


ব্যাংক এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে ল্যাপয়েন্ত জানান, বিশ্ব ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি জেলিকের মুখোমুখি হয়েছিলেন। জেলিক তখন তাকে বলেছিলেন, তিনি তার শীর্ষ ব্যবস্থাপকদের কাজে অবাক হয়েছেন।


বিশ্ব ব্যাংকের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে ম্যানডেট সমস্যা। বিশ্ব ব্যাংকের দীর্ঘদিনের সমালোচক অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম লেরিক অভিযোগ করেন, মধ্য আয়ের দেশ যেমন ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের মতো দেশগুলো, যাদের ব্যাংকের অর্থের প্রয়োজন নেই, তাদের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে মাপকাঠি হারিয়েছে ব্যাংক। বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোতে উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে যা হচ্ছে না।

তবে বিশ্ব ব্যাংক যুক্তি দেখায় যে, তারা মধ্য আয়ের এই চারটি দেশকে ঋণ দিয়ে মুনাফা করে, যা থেকে তারা আরও অর্থ দরিদ্রতম দেশগুলোকে দিতে পারছে। কিন্তু ২০০৬ সালে এক গবেষণায় লেরিক ব্যাংকের হিসাব পত্র ঘেঁটে দেখান প্রতিবছর ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকের প্রতি বছর ১০০ মিলিয়ন থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত লোকসান হয়েছে। কিন্তু কাগজপত্রে এর আর্থিক অবস্থার ভালো চিত্র দেখানো হয়েছে। গত কয়েক বছর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এ অবস্থার যে উন্নতি হয়েছে তা বিশ্বাস করা কঠিন।

লেরিক বলেন, “বিশ্বে ব্যাংকের উন্নয়নের কাজ করা উচিত, অর্থ ধার দেওয়ার ব্যবসা নয়। দাতাদের কাছ থেকে সংগৃহীত তহবিল এমন সব দেশে পাঠানো উচিত যাদের বেসরকারি খাতের মূলধন নেই।”


মেক্সিকোর পর বিশ্ব ব্যাংকের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রাহক এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন গত কয়েক দশকে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ নিয়েছে। ২০০৭ সালে চীন যখন ব্যাংকের নতুন দুর্নীতি বিরোধী পরিকল্পনা নমনীয় না করলে অর্থ ঋণ না নেওয়ার হুমকি দেয় তখন ব্যাংকের শীর্ষ ব্যবস্থাপকেরা আতংকিত হয়ে পড়ে এবং নীরবে এ দাবি মেনে নেয়। ফোর্বসের হাতে এ নিয়ে একটি গোপন অর্ভন্তরীণ ব্যাংক মেমো এসেছে।


লেরিক বলেন, “বিশ্ব ব্যাংক তার সেরা গ্রাহককে ধরে রাখতে মরিয়া ছিল।”


ব্যাংকের ভেতর তখন একটি সিদ্ধান্ত হয়, একটি বৈশ্বিক মানদণ্ড ব্যবহার না করে যে দুর্নীতি মাপার জন্য প্রত্যেক দেশের জন্য পৃথক মানদণ্ড ব্যবহার করা হবে। এর উদ্দেশ্য হল, চীনের মতো দেশের জন্য নিয়মগুলো কিছুটা শিথিল করা।


চীনের নেতাদের সঙ্গে নিজের সুসম্পর্কের বাহ্বা নেওয়া জেলিক এটা বদলাতে কোনোকিছুই করতে পারেননি। আসলে গত বছর গিরিশংকরের প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিনি নিশ্চিত করেছিলেন যে, এরকমটাই ঘটছিলো। প্রতিবেদনে তিনি বলেন, “বৃহৎ ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে প্রভাবশালী ও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একটি শক্তিশালী দেশসহ এমন কতগুলো দেশ আছে এবিষয়টির সমাধানে যাদের কাছে বিশ্বব্যাংককে দ্বারস্থ হতে হয়।”


পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। মাস পার হওয়ার আগেই ঘোষণা ছাড়াই চীনের একটি দূষিত হ্রদ পরিস্কার করার জন্য বিশ্বব্যাংক চীনকে আনুমানিক ৩০০ মিলিয়ন ডলারের স্বল্প সুদের একটি বড় অংকের ঋণ দিতে যাচ্ছে। কয়েকদিন পরই দেখা গেল চীন আফ্রিকা অঞ্চলের (সাব-সাহারান) একটি দরিদ্র রাষ্ট্রক একই পরিমাণ বিনাসুদে ঋণ বা অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বৈশ্বিক পর্যায়ে আরো প্রভাব বাড়ালো।


ইতিমধ্যেই ব্যাংকের ওয়াশিংটন সদর দপ্তরের ভেতরে পরিচালনা পর্ষদ পর্যায়ে চীন আরো প্রভাব অর্জন করছে যখন ব্যাংকের ব্যবস্থাপকরা চীনের কাছে নতি স্বীকার করছে।


পাঁচ বছর আগে জেলিক দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রশাসনিক শীর্ষ কর্মকর্তাদের জন্য প্রায় বার্ষিক ২ বিলিয়ন ডলারের একটি একক বাজেট গঠন করে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা আসবে এটা ভেবে তিনি এ বরাদ্দ দেন। সততার সঙ্গেই তিনি অনুভব করেন যে, বৈশ্বিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভালো কাজ করবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ফোর্বস জানতে পেরেছে যে, কর্মকর্তারা ফাঁকিই দিয়েছেন।


একজন জ্যেষ্ঠ ভাইস-প্রেসিডেন্ট হাসতে হাসতে বলেন, “আমাদের একটি একক বাজেট ছিল এটা তিনি ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করবে না। আমরা ট্রাস্ট তহবিল থেকে এমনভাবে ব্যয় করেছি যেন আগামীকাল বলে কিছু নেই। তাহলে কোথায় ছিল একক বাজেট? প্রত্যেকেই নানা উপায়ে ব্যাংকের মালিকদের কাছ থেকে অর্থ পেয়েছে।”


‘ট্রাস্ট তহবিল’ হল বিশ্বব্যংকের নোংরা গোপনীয় বিষয়, এটা কংগ্রেসের মত একটি রূপ যাতে তহবিল খরচের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়। সেখানে কয়েক ডজন দেশের অর্থায়ন করা এরকম শত শত তহবিল আছে। আপনার মনে হবে এগুলো প্রায় দরিদ্র-ধরণের প্রতি প্রকল্পের জন্য রাখা হয়। এগুলো এত উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে যে, তারা এখন বছরে ৬০০ মিলিয়ন ব্যাংকের সার্বিক প্রশাসনিক বাজেটের ৩০ শতাংশ প্রদান করছে।


অনেক দাতা দেশ এটা করছে কারণ তারা চায় না তাদের অর্থ সাধারণ কোনো ব্যাংকে বসিয়ে রাখতে। অন্য ব্যাংক অর্থ নিজেদের ইচ্ছেমত খরচ করে থাকে। ওই সমস্ত ট্রাস্ট তহবিল সাধারণভাবে প্রশাসনিক কাজে ব্যয় করার কথা না থাকলেও ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তাদের মতে দাতা দেশগুলোর অজান্তেই তহবিলগুলো ওই কাজেই খরচ হচ্ছে।


ফোর্বসের অনুসন্ধানে আরো প্রকাশিত হয়েছে,
ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পুরো একটি চক্র ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়া শিখেছে বা পথ ঘুরিয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তৃত করেছে। মার্কিন কর্মকর্তারা যেমন অবসরের পর চাকুরিতে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের জন্য কাজ করা শুরু করেন সেরকম।

একটি উদাহরণ হলো- ‘প্রধান শিক্ষা বিশেষজ্ঞ’ লুইস ক্রাউচ। ব্যাংক পরিচালিত কয়েক বিলিয়ন ডলারের গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর এডুকেশন প্রকল্প পরিচালনায় সহায়তা দেন। ক্রাউচ গত ১০ বছরে বিশ্বব্যাংক ও রিসার্চ ট্রায়াঙ্গল ইনস্টিটিউটের (আরটিআই) মধ্যে আসা যাওয়া করেছেন। আরটিআই একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান যার কাজ হলো বিশ্বব্যাংক ও ইউএসএআইডির কাছে শিক্ষা বিষয়ক প্রতিবেদন বিক্রি করা। একাজের সঙ্গে যুক্ত ইউএসএআইডির একজন পরামশর্কের মতে, ক্রাউচ ধারাবাহিকভাবে আরটিআইকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এবিষয়ে তার স্বার্থসংশ্লিস্টতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি এবং ব্যাংকের মুখপাত্ররাও কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান।


হিসাবের বাইরে এধরনের অনিয়ম যখন চলমান তখন এটি খুব একটা আশ্চর্যজনক বিষয় না নিশ্চয়। বাজেটর দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের মতে, গত ডিসেম্বরে বিশ্বজুড়ে ব্যাংকের শাখাগুলোর অনলাইন বাজেট হিসাবে (এবং কম্পিউটারের পর্দায়) হঠাৎ করে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ দৃশ্যমান হওয়া শুরু করে, আবার অদৃশ্য হয়ে যায় এবং আবার দৃশ্যমান হয়। কতগুলো হিসাবে তার ব্যাপক ঘাটতি দেখিয়েছে। আবার অনেকগুলোতে হঠাৎ করেই উদ্বৃত্ত দেখা যায়। এটা ব্যাংকের কম্পিউটার নেটওয়ার্কজুড়ে দৃশ্যমান হতে শুরে করে এবং পাগল হয়ে সবাই কি ঘটছে তা খুঁজতে থাকে। ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা এটাকে একটা খেলার সঙ্গে তুলনা করেছেন- যাতে কোন স্থানে শত শত ডলার দৃশ্যমান হচ্ছিল আবার কোথাও থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল।

অন্যতম সম্ভাবনা হতে পারে যে, ব্যাংকে চলমান নিরন্তর সমস্যার অংশ হিসেব এখানে ব্যাপক হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। অন্য ব্যাখ্যা হতে পারে- এটা একেবারেই ‘কম্পিউটারের মাথা বিগড়ে যাওয়া’র ঘটনা- সম্ভবত আইটি নেটওয়ার্ক নিজেই এ খেলা খেলছে। অনেকেই এর ব্যাখ্যা আরো খারাপ হতে পারে বলে মনে সন্দেহ করছেন। একটা বিষয় নিশ্চিত: এটা বিশ্বব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের উপর আস্থাহীনতা তৈরি করেছে।


জেলিকের দূরবর্তী ব্যবস্থাপনার ধরণও কাজে আসেনি। তিনি অধিকাংশ দৈনন্দিন কাজের ভার দিতেন তার সহকারি ক্যারোলিন এনস্টি’র উপর। এছাড়াও তার উপর ও তার অন্য দুজন সহকারীর উপর তিনি পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে সভাপতিত্ব করার ভার দিতেন- সাধারণত যা ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব। পরিচালনা পর্ষদ সপ্তাহে দুবার বৈঠক করতো, তবে জেলিক হয়তো মাসে একবার দেখা দিতেন। শুরুতে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা এ বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। পরে তিনি তাদের অজান্তে তাদের উর্ধ্বতনদের (দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী) কাছ থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করেন।


আসলে জেলিককে দেখে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়ার চেয়ে বেশি রাষ্ট্রনায়কের মতো মনে হতো। বাজারে চালু আছে, তিনি আগামী মিট রমনির সরকারের উচ্চপদের আশায় আছেন।
এমতাবস্থায়, ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, মনের গভীরে ভালো ক্যারিয়ারের আশা নিয়ে জেলিকের লক্ষ্য ছিল শুধুমাত্র সংস্থার এতটুকু ব্যবস্থাপনা করা যাতে এমন কোন গণ্ডগোল বা অভিযোগ তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে না যায়।

অর্থাৎ তিনি বড় কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। ২০০৮ সালে জেলিক বিশ্বব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তুলনামূলক ছোট ও দরিদ্র দেশগুলোর জন্য আরো বেশি আসন দেওয়ার বিষয় সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য একটি স্বতন্ত্র কমিশন গঠন করে সাবেক মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট এর্নেস্তো জেডিলোকে এর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। অনুসন্ধান শেষে প্রতিবেদনটি গত বছর জেলিকের কাছে দেওয়া হয়। কিন্তু, প্রতিবেদনে উল্লেখিত মতামত তার নয় উল্লেখ করে জেলিক একটি চিঠিসহ ওই প্রতিবদেন পরিচালনা পর্ষদের কাছে হস্তান্তর করেন।


জেডিলোর ফোবর্সকে প্রশ্ন করেন, “কেন তিনি এটা করেছিলেন? এটা খুবই স্পষ্ট যে ওটা ছিল একটা স্বাধীন প্রতিবেদন। তার এভাবে না বললেও চলতো। তিনি মোটেই ওই প্রতিবেদনের লেখক ছিলেন না। আমার ধারণা, কিছু সদস্য দেশ ওই প্রতিবেদনের অভিযোগ তার ঘাড়ে দিতে পারে এ ভয়ে তিনি ওই কথা বলেছেন। তারা এটা পছন্দ না করলে আমাকে অভিযোগ করত।”


জেডিলো কমিশনের সবচেয়ে উপসংহার ছিল, “পর্ষদের সত্যিকারের অর্থেই একটি পরিচালনা পর্ষদ হওয়া উচিৎ, নির্বাহী পরিষদ নয়।”


জেডিলো বলেন, “বোর্ডের উচিৎ কৌশলগত বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা এবং ব্যাংকের কার্যক্রম গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা। বর্তমানে এখানে স্বার্থের সংঘাত বিরাজ করছে।”


তিনি হেসে বলেন, “আপনি একই সঙ্গে তত্ত্বাবধানকারী এবং কর্মকাণ্ডের অনুমোদনদাতা হতে পারেন না। কিন্তু, বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ ধারা চলছে।.... তারা কি আসলেই চিন্তা করে যে, এখন যেভাবে চলছে তা অব্যাহত থাকলে আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের কোন প্রাসঙ্গিকতা থাকবে? এর উত্তর হলো না।”


সব চুপচাপ


বিশ্ব ব্যাংক এমন একটা জায়গা যেখানে হুইসেল-ব্লোয়ার বা সতর্ক করে দেওয়া ব্যক্তিদের উপেক্ষা করা হয়, তাদের সঙ্গে অন্যায় করা হয় এমনকি দমিয়ে রাখা হয়।


ধরা যাক জন কিমের কথা, যিনি ব্যাংকের আইটি বিভাগের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা। ২০০৭ সালে তিনি ব্যাংকের ভেতর অনিয়মের সৎ উপায়ে কোনো প্রতিকার হবে না জেনে আমার কাছে কিছু নথি ফাঁস করেন। ব্যাংকের তদন্ত কর্মকর্তারা তার ফোন রেকর্ড ও ই-মেইল খতিয়ে দেখেন। অভিযোগ ওঠে যে, তারা কিমের ব্যক্তিগত এওএল ই-মেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে। তিনিই তথ্য ফাঁস করেছেন প্রমাণ হওয়ার পরে ব্যাংক তাকে দুই বছরের প্রশাসনিক ছুটিতে পাঠায় এবং শেষে ২০১০ সালের বড়দিনের আগে বরখাস্ত করে।


কিম পরে ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক গভর্নমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটি প্রজেক্টে কাজ নেন যেখানে সরকারি খাতের বিভিন্ন তথ্য ফাঁস করা হয়। গ্র“পটির নির্বাহী পরিচালক বিয়েট্রিস এডওয়ার্ড বলেন, “হুইসেল ব্লোয়াররা নিয়ন্ত্রকদের শেষ ভরসা।” এডওয়ার্ড কিমকে তাকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করার জন্য অভ্যন্তরীণ মামলা দায়ের করতে সহায়তা করেন। শেষে এক ঐতিহাসিক রায়ে ৫ জন বিচারকের একটি ট্রাইবুন্যাল বিশ্ব ব্যাংককে গত মে মাসে কিমকে চাকরিতে নিতে আদেশ দেয়। এই রায় সত্ত্বেও ব্যাংক তাকে ২৯ বছরের চাকরি শেষে অবসরে পাঠায়।


তবে যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে নজর দিতে শুরু করেছে। ২০১১ সালে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জেলিক ব্যাংকের মূলধন বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব করলে সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি ‘হুইসেল-ব্লোয়িং’ এর শর্ত জুড়তে বলে। তবে বিশ্ব ব্যাংকের অতিরাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাঠামোর কারণে সিনেটের এ দাবি ধোপে টেকেনি।


সিনেটের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা বিশ্ব ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমরা কেবল বলতে পারি। তোমরা এটা করলে (হুইসেল ব্লোয়ারদের রক্ষা) আমরা তোমাদের এই অর্থ দেব। কিন্তু তারা বলে, তোমরা আমাদের দিয়ে এটা করাতে পার না কারণ আমরা ১৮৮টি পৃথক রাষ্ট্রের কাছে জবাব দিতে পারব না।”



বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফসহ বহুজাতিক দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।


পদ্মা সেতু নিয়ে বহুজাতিক দাতা বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের টানাপড়েন শেষে আপসরফার পর প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে ভাষণে বৃহস্পতিবার এ আহবান জানান।


তিনি বলেন, “আমি জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্য রাষ্ট্রের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে জাতিসংঘ, ব্রেটন উডস্ ইনস্টিটিউশনস্ ও অন্যান্য বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংস্কারের বিষয়ে পুনরায় গুরুত্ব আরোপ করছি।”


চীন, ভারত, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ গত কয়েক বছর ধরেই জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার এবং এসব প্রতিষ্ঠানে তাদের ভোটের ক্ষমতা বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছে।


ব্রেটন উডস কনফারেন্স নামে পরিচিত এক সম্মেলন থেকে ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ গঠন করা হয়।


সংস্কারের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “এসব প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ৬০ বছরের পুরোনো ক্ষমতার সমীকরণের প্রতিফলন।”


বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন, “(এতে) অধিকাংশ দেশের স্বার্থ উপেক্ষিত থাকে এবং কয়েকটি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের স্বার্থ রক্ষা হয়।”


তিনি ব্রেটন উডসসহ অন্যান্য বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুষম অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিও তোলেন।


সম্প্রতি ফোর্বস সাময়িকীতে ‘বিশ্ব ব্যাংকের দুর্নীতি’ নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি করতে বাংলাদেশ সরকারের কয়েকজন ব্যক্তি চক্রান্ত করেছে অভিযোগ এনে সংস্থাটির বৃহত্তম প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করে বিশ্ব ব্যাংক। এই ঘটনার পর সরকারের সঙ্গে দাতা সংস্থাটির সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে।


শেখ হাসিনা সব দেশে শ্রমিকের অবাধ চলাচল নিশ্চিতের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার কথা বলেন।


শ্রমিক প্রেরণকারী ও গ্রহণকারী দেশগুলোর সুবিধা নিশ্চিতে ডব্লিউটিও’র চুক্তি জিএটিএস দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদও দেন তিনি।


তিনি বলেন, নিরাপদ অভিবাসন এবং নারীসহ অভিবাসী কর্মজীবীদের অধিকার সংরক্ষণে অভিবাসী প্রেরণকারী ও গ্রহণকারী দেশগুলোর যৌথ দায়িত্ব ডব্লিউটিও নীতির অংশ করা উচিত।


শেখ হাসিনা মনে করেন, নতুন সহস্্রাব্দে বেশকিছু রাষ্ট্র এবং বিশ্বায়ন একটি পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ার সুযোগ এনে দিয়েছে।


জাতিসংঘে উপস্থিত বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশে বাংলাদেশের সরকার প্রধান বলেন, “আজ আমরা ন্যায়বিচার, সমতা, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মানবাধিকার, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কথা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারছি। এ সবই আমাদের অগ্রাধিকার।”


এজন্য ‘অতীতের অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা’ ভুলে সবাইকে এক লক্ষ্যে কাজ করার ও ‘শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তি’র আহ্বান জানান তিনি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ