রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১১

সাঈদীর মানবাতবিরোধী অপরাধ সমূহ




মানবাতবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর কথা থাকলেও তা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামী ২০ নভেম্বর বিচার কাজ শুরু হবে।
সাঈদীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের মধ্যে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, হিন্দুদের জোর করে ধর্মান্তর করানো, লুটতরাজসহ ২০টি মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়।
সে অনুযায়ী ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি) এবং ৩(২) (এইচ) ধারার শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে অভিযোগগুলো আমলে নেন আদালত।
গত ১৪ জুলাই ট্রাইব্যুনাল সাঈদীর বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আমলে নেয়।
এর আগে ১১ জুলাই ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উত্থাপন করা হয়।
৩১ মে মঙ্গলবার সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ৪ হাজার ৭৪ পৃষ্ঠার ১৫ খ-ের তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন শাখায় জমা দেওয়া হয়।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার এক মামলায় সাঈদীকে গত বছর ২৯ জুন গ্রেপ্তার করা হয়।
এরপর তাকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
ট্রাইব্যুনালে তদন্ত সংস্থার সদস্যরা সাঈদীর নিজ এলাকা পিরোজপুরে তদন্ত চালিয়ে যুদ্ধাপরাধে তার জড়িত থাকার প্রমাণ সংগ্রহ করেন। এছাড়া গত ১২ মে ধানমণ্ডিির সেফ হোমে নিয়ে তাকে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০ অভিযোগ:
১. পিরোজপুরের পাড়েরহাট বন্দরে ১৯৭১ সালের ৩ মে ২৬ জন পাক হানাদারের প্রথম দলকে সাঈদী স্বাগতম জানিয়ে বন্দরে নিয়ে যায়। ৪ মে মাছিমপুর বাসস্ট্যান্ডের পেছনে জমায়েত হওয়া ২০ জন বেসামরিক বাঙালির জড়ো হওয়ার খবর পাকিস্তানী বাহিনীকে জানান সাঈদী।
জড়ো হওয়া বাঙালিদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা ও লুটতরাজ চালানো হয়।

২.একইদিন পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় মাছিমপুর হিন্দুপাড়ায় আক্রমণ চালিয়ে বিজয় কৃষ্ণ মিস্ত্রী, উপেন্দ্রনাথ মিস্ত্রী, সুরেন্দ্রনাথ মিস্ত্রী, মতিলাল মিস্ত্রী, যজ্ঞেশ্বর ম-ল, সুরেন ম-লসহ ১৩ ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

৩.এই দিনই সদর থানার এলজিইডি ভবন ধোপাবাড়ির সামনে দেবেন্দ্রনাথ ম-ল, খগেন্দ্রনাথ, পুলিন বিহারী, মুকুন্দ বালাকেও হত্যা করা হয়।

৪. এছাড়া এইদিন মাছিমপুর হিন্দু পাড়ায় মনীন্দ্র পসারীর ও সুরেশচন্দ্র ম-লের বাড়ি ধ্বংস এবং কালিবাড়ি, মাছিমপুর, পালপাড়া, শিকারপুর, রাজারহাট, ডুমুরতলা, কালামতোলা, নওয়াবপুর, আলমকুঠি, ডুকিগাথি, পারেরহাট ও চিংড়াখালিতে হামলা চালায় সাঈদী।

৫. পরদিন পূর্ব পরিকল্পিতভাবে পিরোজপুরের এসডিও ফয়জুর রহমান আহমেদ, এসডিও মোঃ আব্দুর রাজ্জাক, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাঈফ মিজানুর রহমানসহ কয়েকজনকে ধরে নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ নদীতের ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় সাঈদী ঘটনাস্থলে উপস্তিত ছিলেন।

৬. পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ৭ মে পাড়ের হাট বাজারে আওয়ামী লীগ নেতা, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এবং স্বাধীনতার সমর্থকদের দোকান এবং বাড়িতে হামলা চালায়। এখানে মাখন লাল সাহার দোকান থেকে বাইশ সের স্বর্ণ ও রৌপ্য লুট করা হয়।
এই অপরাধের সঙ্গে সাঈদী সরাসরি জড়িত ছিলো।

৭. পরদিন দুপুরে পিরোজপুরের ভাদুরিয়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তার পিতা নুরুল ইসলাম খানকে ধরে নিয়ে পাকিস্তান আর্মির হাতে তুলে দেন সাঈদী।
এ সময় তার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে ধ্বংস করা হয়।

৮. একইদিন বেলা তিনটায় রাজাকার বাহিনী সাঈদীর নেতৃত্বে ও পাক বাহিনীর সহায়তায় চিতলিয়া গ্রামের মানিক পসারীর ও তার ভাইয়ের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে পাঁচটি বাড়িতে আগুনে জ্বালিয়ে দেয়।
সাঈদী চিনিয়ে দেওয়ায় পাক বাহিনী ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করে।

৯. সাঈদীর নেতৃত্বে একদল রাজাকার ২ জুন সকাল নয়টায় নলবুনিয়ায় আব্দুল হালিম বাবুলের বাড়িতে হামলা চালায় ও বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

১০. একইদিন সকাল ১০টায় তার নেতৃত্বে উমেদপুর হিন্দু পাড়ায় চিত্তরঞ্জন তালুকদার, জহর তালুকদার, হারেন ঠাকুর, অনীল মন্ডল, বিসাবালী, সুকাবালী, সতিশবালার বাড়িসহ ২৫টি বাড়িতে হামলা চালান হয়। বিসবালীকে নারিকেল গাছের সঙ্গে বেধে হত্যা করা হয়।
সাঈদী এই হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশ নেয়।

১১. এইদিন টেংরাখালির মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুল আলম হাওলাদারের বাড়িতে হানা দিয়ে তার ছোট ভাই আব্দুল মজিদ হাওলাদারকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।
এ সময় নগদ অর্থ, স্বর্ণালঙ্কারসহ মূল্যবান সম্পদ লুণ্ঠন করা হয়।

১২. স্বাধীনতা যুদ্ধচলাকালে পাড়ের হাট বাজারের হিন্দুপাড়ায় হামলা চালিয়ে হরলাল মালাকার, অরো কুমার মির্জা, তরনিকান্ত শিকদার, নন্দকুমার শিকদারসহ ১৪ হিন্দুকে ধরে নিয়ে একরশিতে বেঁধে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেন সাঈদী।

১৩. স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর দুই তিন মাস পর নলবুনিয়ায় আজহার আলীর বাড়িতে হানা দিয়ে তাকে ও তার ছেলে সাহেব আলীকে ধরে এনে নির্যাতন এবং সাহেব আলীকে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

১৪. যুদ্ধের শেষ দিকে সাঈদীর নেতৃত্ব ৫০ থেকে ৬০ জন রাজাকার হোগলাবুনিয়ায় হিন্দুপাড়ায় হামলা চালায়। সেখানে ১ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে হোগলাবুনিয়া গ্রামের মধুসুধন ঘরামীর স্ত্রী শেফালী ঘরামীকে আটক করে ধর্ষণ করা হয়।
এছাড়া হিন্দুপাড়ায় আগুন দেয় রাজাকাররা।

১৫. তার নেতৃত্বে যুদ্ধের শেষ দিকে ১৫-২০ জনের একটি দল হোগলাবুনিয়া গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে তরণী সিকদার ও তার ছেলে নির্মল সিকদার, শ্যামকান্ত সিকদার, বানীকান্ত সিকদার, হরলাল শিকদার ও প্রকাশ সিকদারসহ ১০ জনকে বেঁধে গুলি করে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেয়।

১৬. পাড়েরহাট বন্দরের উমেদপুর গৌরাঙ্গ সাহার বাড়িতে হামলা চালিয়ে তার তিন বোন মহামায়া, অন্যরাণী ও কমলা রাণীকে পাক হানাদারদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তাদের টানা তিনদিন ধর্ষণ করা হয়।
এই অপরাধের সঙ্গে সাঈদী জড়িত।

১৭. সাঈদী ও তার সহযোগীরা স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে বিপদ সাহার মেয়ে ভানু সাহাকে নিজ বাড়িতে আটকে রেখে নিয়মিত ধর্ষণ করে।

১৮. মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দেওয়ার অভিযোগে পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে কর্মরত ভাগিরথি নামে এক নারীকে আটক করে নির্যাতন করে সাঈদী।
পরে তাকে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়।

১৯. স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মধুসুদন ঘরামী, কৃষ্ট সাহা, ডা. গণেশ সাহা, অজিত কুমার শীল, বিপদ সাহা, নারায়ণ সাহা, গৌরাঙ্গ পাল, সুনীল পাল, নারায়ণ পাল, অমূল্য হালদার, শান্তি রায়, হরি রায় জুরান, ফকির দাস, টোনা দাস, গৌরাঙ্গ সাহা, হরিদাস, গৌরাঙ্গ সাহার মা ও তিন বোন মহামায়া, অন্যরাণী ও কামাল রাণীসহ ১০০/১৫০ জন হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্ত করান তিনি।

২০. নভেম্বর মাসে ইন্দুরকানি গ্রামের তালুকদার বাড়িতে হামলা করে ৮৫ ব্যক্তিকে আটক করে পুরুষদের নির্যাতন এবং খগেন্দ্রনাথ সাহার মেয়ে দীপালি, স্ত্রী নিভারাণী ও রাজবল্লভ সাহার মেয়ে মায়ারাণীকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। তারা সেখানে ধর্ষণের শিকার হন।

৬৮ সাক্ষীর মধ্যে ১৮ জন সাক্ষী সাঈদী রাজাকার বাহিনী গঠনে ভূমিকা পালন করেছেন বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষীদের মধ্যে শাহরিয়ার কবির, ড. জাফর ইকবাল ও যাদু শিল্পী জুয়েল আইচও রয়েছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ