রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১১

সামঞ্জস্যহীন শ্রেণীস্বার্থ ধরে রাখতে জনগণের যেসব সংকট সৃষ্টি করতে হয় তার মধ্যে শিক্ষাই প্রধান ক্ষেত্র ।

সামঞ্জস্যহীন শ্রেণীস্বার্থ ধরে রাখতে জনগণের যেসব সংকট সৃষ্টি করতে হয় তার মধ্যে শিক্ষাই প্রধান ক্ষেত্র ।
ফারুক আহমেদ
জনগণের শিক্ষা নিয়ে যাঁরা ভেবেছেন ,যে শিক্ষা মানবজাতির বিকাশ ঘটায় ,সন্মুখ গতি বুঝতে সাহায্য করে এবং সন্মুখ গতি ধরে রাখে, অল্প কথায় তেমন শিক্ষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তাঁরা বলেছেন-শিখে ভুলে যাওয়ার পর যা’ অবশেষ থাকে তাকেই শিক্ষা বলে ।ছোট্ট এই বাক্যটিকে বিশ্লেষণ করলে এর মধ্য থেকে অনেক কিছুই বের হয়ে আসে ।সবচেয়ে প্রথম এবং প্রধান যে বিষয়টি এর মধ্যদিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা’ হলো শিক্ষা তাই যা’ মানুষের মধ্যে কিছু সৃষ্টি করে । কি সৃষ্টি করে ? প্রথমেই আসে দেখার দৃষ্টিভংগি ।প্রকৃতি,প্রতিবেশ , সমাজ , সম্পর্ককে দেখার দৃষ্টিভংগি । শিক্ষাই পারে জটিল ,দুর্বোধ্য ,অস্পষ্ট দৃষ্টিভংগি থেকে মানবজাতিকে সরল , বোধগম্য এবং স্পষ্ট দৃষ্টিভংগির দিকে নিয়ে যেতে ।এদিক দিয়ে বলা যায় জটিল , মানবেতর সম্পর্ক থেকে সরল মানবিক সম্পর্কের সমাজে যাওয়ার মানব সমাজের যে লাগাতার সংগ্রাম তার বাহন বা হাতিয়ার হলো শিক্ষা । 
যুক্তির তোয়াক্কা না করে প্রশ্নহীনভাবে আপ্ত বাক্যটিকে আঁকড়ে থাকার সংষ্কৃতি থেকে শিক্ষা মানুষকে এমন এক সংষ্কৃতির দিকে নিয়ে যায় যা’ হয় যুক্তির,বোধের এবং সমাজের সকল মানুষের পরষ্পরের প্রতি বিবেচনার সহজ মানুষের সংষ্কৃতি ।শিক্ষা মানুষকে সহজ মানুষে পরিণত করে ফলে সমাজে মানুষে মানুষে সম্পর্কগুলোও জটিল থাকতে পারে না ।সম্পর্কগুলো হয় সহজ , মর্যাদার এবং সন্মানের । শিক্ষা প্রশ্ন করতে শেখায় । প্রশ্ন মানেই জটিলকে সরল করার উপায় , যা’কিছু দুর্বোধ্য তাকে বোধের আওতায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা । প্রশ্নের মধ্যদিয়েই ঠিক-বেঠিক নির্ধারিত হয় এবং এর মাধ্যমেই গ্রহন-বর্জনের প্রক্রিয়া চলে । শিক্ষা পরম্পরাকে দেখার দর্পন তৈরী করে এবং এর মধ্যদিয়ে লাগাতারভাবে মার্জিত , রুচিশীল মানুষ এবং মানুষের সমাজ নির্মান করে । 
এ সবকিছুই সামঞ্জস্যহীনতার শ্রেণী স্বার্থের সমাজ টিকিয়ে রাখার জন্য বিপদজনক । তাই যেখানেই সামঞ্জস্যহীন শ্রেণী স্বার্থের প্রতিনিধিরা শিক্ষার নিয়ন্ত্রক সেখানেই তাদের নিজেদের স্বার্থেই শিক্ষার দর্শন পরিবর্তন করতে হয় , শিক্ষার সংজ্ঞা পাল্টে দিতে হয় ।প্রথমেই তাদেরকে যেটা করতে হয় তা’ হলো মানুষের দেখার স্বাভাবিক দৃষ্টিভংগিকে পাল্টে দিতে হয় । প্রকৃতি ,প্রতিবেশ , সমাজ ,সম্পর্ককে দেখার এমন দৃষ্টিভংগি তৈরী করতে হয় যার মধ্যদিয়ে এগুলো দুর্বোধ্য ,জটিল এবং অস্পষ্টতার আবরণে ক্রমশঃ ঢাকা পড়তে থাকে ।এগুলোকে যত জটিল এবং অস্পষ্ট করা যায় ততই তা ব্যাখ্যার জন্য রহস্যের আশ্রয় নেয়া সম্ভব হয় ।মানুষের এবং তার সমাজজীবনের সমস্যা-সংকটের কারণ এবং তার সমাধানের পথকে রহস্যাশ্রয়ী করে তুলতে পারার চেয়ে সুবিধাজনক আর এই শ্রণীটির কাছে কিছুই হতে পারে না । সবকিছুকে রহস্যাবৃত করে তুললে যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য সামগ্রিক থেকে বিচ্ছিন্ন এবং সমষ্টি থেকে ব্যাক্তিগত দৃষ্টিভংগি তৈরী হয় ।তাই এই শ্রণী কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষার দর্শন হলো ব্যাক্তির উৎকর্ষসাধন ।তারা প্রচার করে থাকে বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ভাবে ব্যাক্তির উৎকর্ষতার মধ্যদিয়ে গোটা সমাজ তথা মানবজাতির উৎকর্ষতায় উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব ।কিন্তু প্রকৃতি এবং বিজ্ঞান তাদের এই যুক্তিকে সমর্থন করে না ।তাই তাদেরকে প্রকৃতিকে দেখার সহজ দৃষ্টিভংগি এবং বিজ্ঞানের সংজ্ঞা পাল্টাতে হয় । 
সবকিছুকে রহস্যের মধ্যে ঠেলে দেওয়ার মধ্যদিয়ে প্রথমেই তারা যে কাজটি করতে সক্ষম হয় তা হলো সমাজের একটি বিরাট ব্যাপক অংশকে শিক্ষার আঙ্গিনায়ই প্রবেশ করতে না দেওয়া ।এরপর থাকে যারা শিক্ষার আঙ্গিনায় প্রবেশ করল তাদের নিয়ন্ত্রন করা । নিয়ন্ত্রন দুই রকমের হয় । একটি হলো সংখ্যাগত নিয়ন্ত্রন ,এই নিয়ন্ত্রন কতকগুলো প্রক্রিয়ার সমষ্টি ,এগুলো তাদের প্রয়োজনের বাইরে বিরাট একটি অংশকে আপাতঃ স্বাভাবিক নিয়মে শিক্ষাঙ্গন থেকে উচ্ছ্বেদ করার প্রক্রিয়া । অপর নিয়ন্ত্রন হলো চিন্তাগত নিয়ন্ত্রন ।এর জন্য তাদেরকে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে এমন অবস্থার সৃষ্টি করতে হয় যাতে শিক্ষার্থীদের চিন্তা এবং কর্মকে তারা তাদের মত করে নিয়ন্ত্রন করতে পারে এবং একটি অংশকে তাদের উত্তরসূরী হিসাবে তৈরী করতে পারে ।এ কাজ করার জন্য শিক্ষার অবকাঠামো এবং পদ্ধতি তাদের মত করে সাজাতে হয় ।শিক্ষার্থীদের চিন্তার জগৎকে বন্ধ এবং বদ্ধ করার প্রয়োজন পড়ে ।
মুক্ত পরিবেশ , মুক্ত আঙ্গিনা বদ্ধ চিন্তার জন্য সহায়ক নয় ,যতটা সহায়ক একদিকে জরাজীর্ণ দৈন্য পরিবেশে এবং অপরদিকে শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত গালিচা বিছানো বদ্ধ পরিবেশে ।তাই শিক্ষার অবকাঠামোর দিক দিয়ে একদিকে যেমন দেখা যায় অস্বাস্থ্যকর জরাজীর্ণ দৈন্য পরিবেশ অপরদিকে দেখা যায় বদ্ধ পরিবেশের মধ্যে নানা রঙের জেৌলুস ।এ দুই প্রকার পরিবেশের মধ্যে আপাতঃ বিপরীত চিত্র দেখা গেলেও এই বিপরীত চিত্রের নির্মাণ একই লক্ষ্যে এবং এ দুইয়ের মধ্যে একটি সাধারণ দিক হলো উভয়ক্ষেত্রে সাধারণভাবে শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত উপাদানের অনুপস্থিতি ।উভয়ক্ষেত্রে খেলার কোন মাঠ নেই ,সমষ্টিগত উন্মুক্ত বিনোদনের কোন ব্যবস্থা নেই । উভয়ক্ষেত্রে লাইব্রেরী নেই ,ক্ষেত্রবিশেষে যা’ আছে তাকে লাইব্রেরী বলা চলে না । এই শিক্ষা ব্যবস্থার যারা নীতিনির্ধারক এবং পরিচালক খেলার মাঠ , লাইব্রেরী ,সমষ্টিগত বিনোদন এগুলো নিয়ে তাদের কোন ভাবনা বা পরিকল্পনা নেই যতটা ভাবনা , পরিকল্পনা আর কথার ফুলঝুরি দেখা যায় ইন্টারনেট, ল্যাপটপ , ডিজিটালাইজেশন(?) ইত্যাদি নিয়ে ।এগুলো নিয়ে তাদের ব্যস্ততার কারণ এগুলোর মধ্যদিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে চটকদার লোলভনীয় বস্ত্তুর মুলা ঝুলিয়ে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করা যাতে শিক্ষার দর্শন শাসকশ্রেণীর মত হয় ।
শিক্ষার দর্শন তাদের মত করতে শাসকশ্রেণীকে শিক্ষার পদ্ধতিও তাদের মত করে সাজাতে হয় । এজন্য তারা শিক্ষার বিষয়বস্ত্তু ,পাঠের মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ ,পরীক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষকদের আচরণ সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রন করে থাকে । সাহিত্য, ইতিহাস , ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে পাঠের বিষয়বস্ত্তু তারা এমনভাবে নির্বাচন করে যাতে এগুলোর মধ্যদিয়ে শিক্ষার্থীদের চিন্তার যে গঠন হয় তাতে তাদের স্বার্থের জন্য বিপদজনকতো নয়ই বরং সহায়ক হয় এবং পরবর্তীতে এর মধ্য থেকেই তাদের প্রতিনিধি তৈরী হয় ।বিজ্ঞান ,গণিত এগুলোর কঙ্কাল মূলনীতিগুলোকে বদলাতে না পারলেও এগুলোর দর্শনকে খুবই বদলানো যায় এবং শাসকশ্রেণী তা করে থাকে ।ক্রিষ্টোফার কডওয়েল দেখিয়েছেন ধনিকশ্রেণীস্বার্থের রক্ষকদের হাতে পড়ে পদার্থবিজ্ঞান কিভাবে তার সামগ্রিকতা হারিয়ে নিছক কঙ্কালে পরণত হয় । গণিত , বিজ্ঞান প্রভৃতির পাঠদান পদ্ধতি এমন করা হয় যাতে শিক্ষার্থীদের কাছে এগুলোর মর্মবস্ত্তু দুর্বোধ্য এবং অস্পষ্টই থেকে যায় অথচ এগুলোর সূত্র ,ফর্মূলা মুখস্ত করে পরীক্ষায় ভাল ফল করা যায় ।এই বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে এমনটি বেশিমাত্রায় ঘটলেও সাধারণভাবে সকল বিষয়ের জন্যই একথা বলা যায় । পাঠের বিষয়বস্ত্তুকে অস্পষ্ট এবং দুর্বোধ্য রেখেও পরীক্ষায় ভাল ফল করতে পারার মধ্যদিয়ে শাসকশ্রেণীর সবচেয়ে বড় লাভটি হয় । বিরাট পরিচয়ের বুদবুদের মাঝে শিক্ষার্থীদের মনে শূন্যতার সৃষ্টি হয় , পরিচয়ের সাথে তাদের ভিতরের অবস্থা মিলে না । এ ধরনের শূন্যতা শাসকশ্রেণীর অনুগত হওয়া এবং তাদের দলে ভিঁড়ে যাওয়ার চালিকাশক্তিরূপে কাজ করে । পরিচয়ের বুদবুদে ফুলে ওঠা অথচ শূন্যতার সংকটে থাকা মস্তিষ্ক চিন্তাহীনতা , অবিবেচনা এবং স্বার্থপরতা দ্বারা দখল হয়ে যাওয়া সহজ । একারণেই মেধাবির আওয়াজের মধ্যে দখল হয়ে যাওয়া তথাকথিত ভাল ছাত্ররা স্বার্থপরতার সকল বিষয়কেই তাদের অধিকার হিসাবে মনে করাকে তাদের বুদবুদীয় শূন্য “মেধার” কাছ থেকে কোন প্রকার বাধা পায় না ।উপরন্ত্তু তারা তাদের কথিত মেধার ভার সব সময়ই খেটে খাওয়া গরীব মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়ে থাকে ।এর মধ্যদিয়ে স্বার্থপরতা এবং বিচ্ছিন্নতার শিক্ষাদর্শন কর্যকর হয় । শূন্যতা যে কিভাবে যুক্তিহীন, অবিবেচনা আর স্বার্থপরতার ভিত্তি হতে পারে তা’ পরিচয়ের বুদবুদে ফুলে থাকা প্রকান্ডদের প্রতিদিনের অসংগত আচরনের মধ্যদিয়ে বুঝা যায় ।বৈধ বা অবৈধের প্রশ্ন নয় , নিয়ম বা দুর্নিতীর প্রশ্ন নয় প্রকৃত শিক্ষা মানুষের মধ্যে যে বোধ , বিবেচনা এবং যুক্তির সংস্কৃতি সৃষ্টি করে তা কখনোই কারোর আধাঘন্টা, এক ঘন্টা বা দুই ঘন্টার শ্রমের দাম লক্ষ টাকা থেকে কয়েক লক্ষ টাকাতো দুরে থাক কয়েক হাজার টাকাও অনুমোদন করতে পারে না । পরিচয়ের বুদবুদে ফুলে থাকা শূন্য মস্তিষ্ক ছাড়া সেখান থেকে এসবের আনুমোদন আসা কঠিন ।
মস্তিষ্ক দখলের অনেক উপায়ের মধ্যে একটি হলো মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ সৃষ্টি করা । এই ভুখন্ডে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামের রাষ্ট্র ছিল ।একসময় এই নাম ছিল ইসলামী প্রজাতন্ত্র ।এখন আমাদের স্বাধীন সার্বভেৌম রাষ্ট্রটির নাম –গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ।যখন রাষ্ট্রের নাম ছিল ইসলামী প্রজাতন্ত্র তখনও বাধ্যতামূলক ধর্মশিক্ষা এবং ধর্মীয় পোষাকের বাড়াবাড়ি এত ছিল না যা’ এখন দেখা যাচ্ছে ।ঢাকা শহর থেকে শুরুকরে বাংলাদেশের সর্বত্র স্কুল ড্রেস হিসাবে টুপি অলিখিতভাবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ।গুটিকতক স্কুল ছাড়া অধিকাংশ স্কুল এবং কলেজে মেয়েদের ড্রেস হিসাবে বোরকা এবং প্রায় বোরকা অবস্থাকে অঘোষিতভাবে প্রায় নিরবে বাধ্যতামূলক করে ফেলা হয়েছে ।একথা বলার অর্থ এই নয় যে, ইসলামিক প্রজাতন্ত্র থাকলে এসব হতো না ।অবশ্যই হতো ।একথা এজন্য বলা যে , অন্য যাই হোক শ্রণী হিসাবে শাসকদের বদল হয়নি ।কাজেই যা’ ঘটছে তা ধারাবাহিকভাবেই তাদের দিক থেকে নিয়মমতই ঘটছে ।এ পর্যন্ত যা’ কিছু বলা হলো সেসব এবং আরো অনেক বিষয় আছে যা এই পরিসরে বলা সম্ভব নয় সবই শিক্ষাক্ষেত্রে জনগণের জন্য সংকট এবং নৈরাজ্য হলেও শাসকশ্রেণীর জন্য এসবই নিয়ম ।অসামঞ্জস্য শ্রেণীস্বার্থ টিকিয়ে রাখতে হলে শাসক শ্রণীকে অনিবার্যভাবেই জনগণের এসব সংকট সৃষ্টি করতে হয় । 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ