শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

নজরদারিতে ব্লগ ফেসবুক টুইটার ইউটিউব

সরকারি নজরদারিতে রয়েছে মতামতধর্মী ওয়েবসাইট ব্লগ, সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুক, টুইটার ও ভিডিও আপলোডিং সাইট ইউটিউব। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকারের এ উদ্যোগকে অনেকে ভিন্নভাবে দেখছেন। এ নিয়ে ব্লগ ও ফেসবুকে গতকাল নানা সমালোচনা হয়েছে। সামহয়্যারইন ব্লগ নিজেদের স্বাধীন মতের পক্ষে বলে একটি নোটিশ তুলে ধরেছে। সেখানে অন্তত দুই শতাধিক ব্লগার তাদের মতামত দিয়েছেন।
তবে সাইবার ক্রাইমের নামে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) যে আনুষ্ঠানিক নজরদারি করছে, এটাকে তারা স্বাধীন মতের জন্য হুমকি মনে করছেন না। বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব:) জিয়া আহমেদ বলেছেন, তারা অপরাধমূলক বিষয়ের দিকে নজর দিচ্ছেন।
বিটিআরসি সূত্র মতে, আনুষ্ঠানিকভাবে বিটিআরসি এটি দেখভাল করলেও এসব ওয়েবসাইটের ওপর সরকারের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। সরকারের বিশেষ শাখা, জাতীয় নিরাপত্তা শাখা, সেনা গোয়েন্দা সংস'া এসব মনিটর করছে। রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগও মনিটর করছে। এ জন্য আওয়ামী লীগে একটি মনিটরিং সেল গঠন করেছে বলে দলীয় সূত্র থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে।
বিটিআরসির সেল : বাংলাদেশ কম্পিউটার সিকিউরিটি ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম (সিএসআইআরটি) নামে বিটিআরসি গত বুধবার থেকে সাইবার ক্রাইম শনাক্তে কাজ শুরু করেছে। বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, আগে অভিযোগ পেলে ব্যবস'া নিত বিটিআরসি। তবে এখন সিএসআইআরটি কাজ শুরু করায় সাইবার ক্রাইমের বিষয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি চলবে।
রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ায়- ওয়েবসাইটগুলোতে এমন বিষয় শনাক্ত করে ব্যবস'া নেয়াই হবে এই দলের মূল কাজ।
কমিশনের বিশেষ সভায় সিএসআইআরটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান, বিটিআরসি চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এই উদ্যোগ।
বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্যের এই দল গঠন করা হয়েছে। কমিশনের সদস্য, মোবাইল ফোন অপারেটর, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার, পিএসটিএন, ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে ও সাইবার ক্যাফের প্রতিনিধিদের এই দলে রাখা হয়েছে। মোবাইল অপারেটর ও অন্যরা এ বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে বলে জানান বিটিআরসি চেয়ারম্যান। সমপ্রতি কিছু সেনাসদস্যের অভ্যুত্থান চেষ্টা নস্যাতের পরপরই সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে বিশেষ দল গঠনের কথা জানাল বিটিআরসি। গত ১৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনী জানায়, অভ্যুত্থান চেষ্টাকারী ওই সৈন্যরা ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা এবং অন্যকে প্ররোচিত করার কাজটি করেন। এর আগে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু কামনা করে মন্তব্য করার ঘটনা ঘটে, যা আদালত পর্যন- গড়িয়েছে।
সিএসআইআরটি কার্যপরিধি : বিটিআরসি মহাপরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড লাইসেন্স) এ কে এম শহিদুজ্জামান জানান, অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপরাধীকে দুই থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সাজা এবং পাঁচ লাখ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হতে পারে। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৬৯ ধারা অনুযায়ী এই শাসি- দেয়া হতে পারে বলে জানান তিনি। কোনো ওয়েবসাইটে ক্ষতিকর কিছু থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে তা বন্ধ না-ও করা হতে পারে জানিয়ে বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, অপরাধীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসাই এই টিমের মূল লক্ষ্য। তবে গুরুতর কোনো অপরাধ বা এমন কোনো ব্যাপারে যাতে দ্রুত সিদ্ধান- নেয়া উচিত, সে ক্ষেত্রে এ টিম কমিশনকে জানিয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস'া নিতে পারবে বলে জানান তিনি। সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে বিটিআরসির তিনজন সাইবার ক্রাইম (বিটিআরসি সহকারী পরিচালক পদমর্যাদা) বিশেষজ্ঞ পুরোদমে কাজ শুরু করেছেন। বিটিআরসি ভবনে একটি কক্ষে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সর্বক্ষণ এ নজরদারি করা হবে বলে জানান বিটিআরসি চেয়ারম্যান। সহকারী পরিচালক পদের এই তিনজন বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বলে বিটিআরসি চেয়ারম্যান জানান। তিনি বলেন, সন্দেহজনক কিছু পেলেই সে বিষয়ে ব্যবস'া নেবেন তারা।
সামহয়্যারইন সবসময়ই বাকস্বাধীনতার পক্ষে : গত বুধবার রাতে ব্লগটির নোটিশে বলা হয়, অত্যন- হতাশার সাথে লক্ষ করা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা অদূরদর্শী এবং অবিবেচনাপ্রসূত একটি পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করবে। সাইবার ক্রাইমের মতো জটিল এবং বহুমাত্রিক বিষয়টি কেবল অস্পষ্ট নীতিমালা ও এক পক্ষীয় সিদ্ধানে-র মাধ্যমে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বিদ্যমান মিথস্ক্রিয়াকে বিবেচনা এবং সমঝোতার মাধ্যমেই বাকস্বাধীনতা ও সাইবার ক্রাইমের মধ্যকার জটিল ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব।
সামহয়্যার ইন সবসময়ই বাক স্বাধীনতার পক্ষে- এর ওপর মন্তব্য করেছেন অনেক ব্লগার। একজন ছেলে বলেছেন, মুখবন্ধ আইন মানুম না। ঘুণেপোকা বলেছেন : এইটাই ভালো। বাকস্বাধীনতার পক্ষে থাকাই উত্তম। তাসবীর আহমাদ বলেছেন, স্বাধীনতার যথেচ্ছ অপব্যবহার রোধে নিয়ন্ত্রণ কাম্য।
তানভীর সজিব বলেছেন, সরকারের সিদ্ধানে-র বিরুদ্ধে আছি। এটা না হোক তা চাই। কৌশিক বলেছেন, এই সংবাদ পড়ে দেখলাম তারা নিজেদের মতো একটা মৌখিক নীতিমালা তৈরি করে নিয়েছে এবং তারা সাইবার অপরাধী ধরবে। এটা কোনো আইন না, আর আইন তৈরি করতে তাদের বাকি দুই বছর পার হয়ে যাবে। আমরা ছয় বছর পর্যন- ব্লগে, সোশ্যাল মিডিয়াতে থেকে একজনকে শনাক্ত করতে হিমশিম খেয়ে যাই, আর তারা মোবাইল ট্রেস করে শনাক্ত করবে? কোথায় আছে বাংলাদেশ?
জিয়া চৌধুরী বলেছেন, এই ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান- নেয়ার আগে সরকারের উচিত সংশ্লিষ্টদের আলোচনা করার। পাকা খোকা বলেছেন, স্বাধীনতার যথেচ্ছ অপব্যবহার রোধে নিয়ন্ত্রণ কাম্য। নেক্সাস বলেছেন, সামু বাকস্বাধীনতার পক্ষে!
বিডি আইডল বলেছেন, এমনিতেই এত দিন ডিজিএফআইআর-এর যা-ই উৎপাত ছিল, অনলাইনে যারা সরকারের বিরোধিতা করে, তাদের খুঁজে বের করতো... সাথে এইটা যোগ হওয়াতে এখন থেকে কোনো কোনো সাইটের লালবাতি জ্বলে দেখার বিষয়।
নাহিয়ান বিন হোসেন বলেছেন, মোটেই অবাক হচ্ছি না! কারণ ডিজিটাল বাকশাল যে দেখতে হবে তা নিয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হলাম! এখন শুধু বাস-বে পরিণত হচ্ছে তা! যাক, সরকার এবার বাঁচল! এখন থেকে কেউ আর শেখ হাসিনা বা সরকারের সমালোচনা করে, ইন্ডিয়ার আগ্রাসনের প্রতিবাদ করে কিংবা শেয়ারবাজার কেন লুটপাট হচ্ছে তা নিয়ে কোনো কথা বলতে পারবে না! দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে বিটিভির রাত ৮টার খবরের মতো শানি-ধারা! মুঝে বহুত আচ্ছা লাগতা হ্যায়! (হিন্দিটা ঠিকমতো হইল তো? নাহলে আমাকে আবার আদালত হয়তো ধরবে হিন্দি অবমাননার অভিযোগে!
রাতুল রেজা বলেছেন, হুম তার মানে এই হলো যে এখন থেকে সরকারের কাজের সমালোচনা করলে সেটা রাষ্ট্রীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে এবং পাঁচ লাখ থেকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন- জরিমানা করা হবে। নাইস স্টেপ, তাহলে নাগরিকদের গলা টিপে ধরাই হলো শেষ পর্যন-। ক্ষুধিত পাষাণ বলেছেন, বাকশাল কায়েম হইল ভিন্ন আঙ্গিকে। আহমদ শরীফ বলেছেন, ব্লগে আর স্বনামে স্বাধীন মতামত দেয়া যাবে না। লেখাজোকা শামীম বলেছেন, যত গর্জে তত বর্ষে না। শিক কাবাব বলেছেন, বাকস্বাধীনতা কাকে বলে তা আমি এখনো জানলাম না। বাকস্বাধীনতার প্রকৃত সংজ্ঞা কী? দাসত্ব বলেছেন, সমস্যাটা অন্য জায়গায়... সামু অতি সমপ্রতি বিএসএফের বর্ডার কিলিং এবং টর্চারের ওপর পোস্ট স্টিকি করেছে। সেই স্টিকি পোস্টে ভারতীয় দূতাবাস ঘেরাও এবং ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
এর আগে শুনছিলাম জানাকে নাকি ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসি ভিসা দেয়নি- এই অজুহাতে যে সামুতে ভারতবিরোধী প্রচারণা চালানো হয়। বিষয়টা কেউ লক্ষ করেছেন কি না জানি না- ভারতীয় পণ্য বর্জন এবং দূতাবাস ঘেরাও এর পোস্টটা এখন আর স্টিকিতে নেই।
মাইন রানা বলেছেন, আমাদের হাত বাঁধা নেই, আমাদের চোখ খোলা, আমরা বলতে চাই। প্লিজ আমাদের বলতে দিন। আমাদের স্বাধীনতা হরণ করবেন না প্লিজ!
মুখচোরা বলেছেন, সরকারের নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে সন্দেহের চোখে দেখার যথেষ্ট কারণ আছে। রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যেই সরকার (এবং পরবর্তী সরকারগুলো) এই আইনকে ব্যবহার করতে চাইবে। কাজেই আমাদের সবার এই আইনের বিরোধিতা করা উচিত। সামু নোটিশটি আরো বিস-ারিত হতে পারতো অর্থাৎ কেন ব্লগারদের এর প্রতিবাদ করা উচিত। এই আইনের মাধ্যমে বাকস্বাধীনতার ওপর বা স্বাধীন ব্লগিংয়ের ওপর বা সরকারবিরোধীদের বক্তব্যের ওপর কত প্রকারে আঘাত আসতে পারে তার আলোচনা করা দরকার ছিল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ