বুধবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১২

দুবাইয়ে দুই বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ হতে যাচ্ছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে বাংলাদেশি তিন যুবককে হত্যার ঘটনায় ৩০ জানুয়ারির পর দুই বাংলাদেশির শিরশ্ছেদে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে যাচ্ছে। এদিকে দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে ফটিকছড়ি চট্টগ্রাম জেলা পরিষদে উভয় পরিবারের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। শোকের মাতম চলছে হত্যার শিকার ও শিরশ্ছেদের জন্য অভিযুক্তদের পরিবারে।
কর্মসংস্থান ও জনশক্তি রপ্তানিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক গতকাল বুধবার এই সমঝোতা বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। উদ্দেশ্য দুবাইতে তিন বাংলাদেশিকে জবাইয়ের দায়ে অভিযুক্ত দুই বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ রোধ করা। কিন্তু নিহত তিন বাংলাদেশির পরিবার কোনো সাড়া দেয়নি। ফলে বৈঠকটি ব্যর্থ হয়ে গেছে।
নিহত তিন যুবকের পরিবার চাচ্ছে, হত্যাকারীদের বিচার শিরশ্ছেদের মাধ্যমেই হোক। আর এ অভিযোগে
আটকদের পরিবার ক্ষমা চেয়ে শিরশ্ছেদ থেকে দুই বাংলাদেশিকে রক্ষা করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকার। সরকারিভাবে দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহাম্মদ গতকাল দুপুরে উভয় পক্ষকে নিয়ে সমঝোতা বৈঠক করেন। কিন্তু বৈঠকে নিহতের পরিবারদের পক্ষ থেকে কেউ উপস্থিত হননি। ফলে কোনো সিদ্ধান্তও নেওয়া যায়নি।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের ছোট ছিলোনিয়া গ্রামের মৃত মো. শফির দুই ছেলে আইয়ুব (২৮) ও তৈয়বকে (২৫) ২০১১ সালের ২ মে আমিরাতের রাস আল-খাইমায় কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করা হয়। এ হত্যার দায়ে চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ দায়রাপাড়ার হারুনুর রশিদকে আটক করে পুলিশ।
অপরদিকে ২০০৯ সালের ১১ নভেম্বর ঘুমন্ত অবস্থায় দুবাইতে ফটিকছড়ির রোসাংগিরি গ্রামের কামাল উদ্দিনের ছেলে জামাল উদ্দিন মো. ইউনুছকে (২৩) তিন টুকরা করা হয়। এ হত্যার দায়ে নানুপুর ইউনিয়নের মাইজভাণ্ডার গ্রামের হাজী আমির হামজার ছেলে শাহাব উদ্দিনকে পুলিশ আটক করে। বিচারে তাদের শিরশ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। আগামী ৩০ জানুয়ারি সে দেশের আদালত এ দণ্ড কার্যকরের দিন ধার্য করবেন।
বিষয়টি জেনে আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের কনস্যুলার বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষার লক্ষ্যে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিহতদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে খুনিদের ক্ষমা করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন।
এর আগে ২২ জানুয়ারি ফটিকছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ আফতাব উদ্দিন চৌধুরী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অঞ্জনা খান মজলিশ, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে উভয় পক্ষের মাঝে সমঝোতার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু নিহত আইয়ুব ও তৈয়বের মা রোকেয়া বেগম, আইয়ুবের স্ত্রী নুরসাত জাহান মুক্তা, নিহত জামাল উদ্দিনের ভাই সোহেলসহ দুই পরিবারের কোনো সদস্যই খুনিদের ক্ষমা করতে রাজি হননি। তাঁরা মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার পক্ষে কাগজে স্বাক্ষর করেন। ফলে সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পুনরায় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহামদও গতকাল সমঝোতার উদ্যোগ নেন।
কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'আইয়ুব ও তৈয়বের মা বৈঠকে উপস্থিত হননি। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হয়েছি। তাঁরা কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত নন বলে জানিয়েছেন নিহতের মামা। তবে তাঁদের আরো বোঝানোর জন্য স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব দিয়েছি।'
গতকাল মাইজভাণ্ডার গ্রামে অভিযুক্ত সাহাবুদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় কান্নার রোল। সাহাবুদ্দিনের মা মমতাজ বেগম ও বাবা আমির হামজা কাঁদছেন। অশ্রুসিক্ত স্ত্রী রিনা আকতারের কোলে নির্বাক তাকিয়ে আছে দুই বছরের শিশু শাহাদাত। সাহাবুদ্দিনের মা বলেন, 'নিহতের পরিবারের হাতেপায়ে ধরে অনেক ক্ষমা চেয়েছি। তবুও তাঁদের মন গলেনি। আমার ছেলের শিরশ্ছেদ করার আগে এখানে আরো চারটি শিরশ্ছেদ করতে বলো সরকারকে।'
আইয়ুব ও তৈয়বের মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিলাপ করে বলেন, 'তোমরা পারলে আমার ছেলেদের আমার কোলে ফিরিয়ে দাও।'
জামালের ভাই সোহেল বলেন, 'আমরা স্বজন হারিয়েছি। সে দেশের আইনে অভিযুক্তরা অভিযুক্ত। আমরা চাই ওই দেশের আইনে তাদের শাস্তি হোক।'
ফটিকছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'আমরা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি রক্ষা এবং হত্যার বদলে হত্যা নয়_এ দুটি বিষয়ে দুই পরিবারকে বোঝাতে চেয়েছি। তাঁরা মানছেন না।'
কর্মসংস্থান ও জনশক্তি রপ্তানিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহকারী পরিচালক জহিরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, 'মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের বিশাল শ্রমবাজার রয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় এই শ্রমবাজারে বিরূপ প্রভাব পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যে একেক দেশের একেক আইন এবং একেক দেশের সঙ্গে একেক রকম চুক্তি। ভারতের সঙ্গে যে চুক্তি তা আমাদের সঙ্গে নেই। তবু আমরা উভয় পরিবারের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু কোনো পরিবার তা মানেনি। সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে জেলা প্রশাসক আহূত বৈঠকেও বিষয়টির সুরাহা হলো না।'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ