শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১২

প্রথম আলো নিয়ে বাংলানিউজকে কার্টুনিস্ট আরিফ আমার মায়ের কান্নাও গলাতে পারেনি পাষণ্ড মতিউরকে


মায়ের একমাত্র সন্তান আরিফুর রহমান। শৈশবেই আরিফের বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়। কীভাবে ছেলেকে মানুষ করবেন ভাবনায় পড়েন তার মা। এ অবস্থায় মামার বাড়িতেই কাটে আরিফের শৈশব-কৈশোর। ছোটবেলা থেকেই আরিফ রং পেন্সিলে তুলে ধরতো শিল্পসত্ত্বাকে।
মায়ের একমাত্র সন্তান হিসেবে আরিফকে উপার্জনের কথাও ভাবতে হয়। সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসে সে। চাচাতো ভাইয়ের মুদি দোকানে কাজ নেয়। তিন বেলা খাবার, সামান্য পকেট খরচ আর থাকার ব্যবস্থা-আরিফ তাতেই খুশী। দোকানে কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে আরিফ কার্টুন আঁকতো। বিভিন্ন ফান ম্যাগাজিনে পাঠাতো। যত্নসহকারে ছাপা হতো আরিফের কার্টুন। একপর্যায়ে আরিফ ভাবে কোনো পত্রিকায় কাজ করা যায় কি-না!
কিশোর আরিফ একপর্যায়ে প্রথম আলোকে আদর্শিক(!) পত্রিকা মনে করে সেখানে প্রদায়ক হিসেবে কাজ শুরু করে। কার্টুনের বিনিময়ে প্রতিমাসে পেতো সম্মানী।
কিশোর আরিফের ভাবনায় যা আসতো তা-ই আঁকতো। প্রথম আলোর ফান ম্যাগাজিন তা ছাপতো। আরিফের কার্টুনের প্রশংসাও করতন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানসহ সিনিয়র সাংবাদিকরা। আরিফসহ অন্যসব কার্টুনিস্ট, প্রদায়করা যা লিখতন তা সহ সম্পাদক, ফিচার সম্পাদক ও সম্পাদকের অনুমতিক্রমেই ছাপা হতো। সম্পাদকও অল্পবয়সী কার্টুনিস্ট আরিফকে কার্টুনের জন্য বাহবা দিতেন।
২০০৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর রম্য ম্যাগাজিন আলপিন (সংখ্যা-৪৩১) ‘নাম’ শিরোনামে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ব্যঙ্গ করে যে কার্টুন-কাহিনী প্রকাশ করে তাও প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের অনুমতিক্রমেই ছাপা হয়েছে।
সে কার্টুন নিয়ে একসময়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তখন তাদের সমর্থিত পত্রিকা প্রথম আলোকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। সরকারের নির্দেশে তখন মতিকে নিয়ে যাওয়া হয় বায়তুল মোকাররমের খতিবের কাছে। নির্লজ্জভাবে ক্ষমা চান, তওবা পড়েন মতি।
শুধু তাই নয়; প্রথম  আলোর প্রথম পাতায় ক্ষমা চেয়ে সম্পাদকীয় ছাপেন, আলপিন বন্ধ ও আরিফের কোনো কার্টুন না ছাপানোর প্রতিশ্রুতি দেন প্রথম আলোর সম্পাদক। পত্রিকার মাধ্যমে পাঠকদের কাছে ক্ষমা এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনে তওবা পরে দেশের মুসলমানদের কাছে ক্ষমা চেয়ে একপর্যায়ে পার পেয়ে যান মতিউর রহমান। কিন্তু পার পেলো না কিশোর আরিফ।
হায়! যে দৈনিকে কিশোর আরিফ কাজ করতো সে দৈনিকের কর্তৃপক্ষ তাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে-তুমি আমাদের কেউ না। তোমার দায় আমরা নেবো না। কি এক নির্মম প্রতারণা আরিফের সঙ্গে!
আরিফের কাছে প্রথম আলোর মুখোশ উন্মোচিত হয়। আরিফ যে দৈনিক পত্রিকাকে আদর্শ মনে করে কাজ করেছে, যে সম্পাদককে সুশীল হিসেবে শ্রদ্ধা করতো তিনিও জানিয়েছেন, আরিফকে তারা চেনে না।
অসহায় আরিফ। ছয় মাস রাষ্ট্রদ্রোহ ও ধর্ম অবমাননার দায়ে জেল খাটতে হয় তাকে। জীবনের ঝলমলে অনেকগুলো দিন কাঁদতে কাঁদতে কেটে যায় অন্ধকার কারাগারে। জেলখানায় একবারও আরিফকে দেখতে যাননি মতিউর রহমান। আরিফের মায়ের কান্নাও স্পর্শ করেনি পাষণ্ড মতিউর রহমানকে।
কার্টুন প্রকাশের কারণে প্রথম আলো সম্পাদক চাকরিচ্যুত করলো আলপিনের বিভাগীয় সম্পাদক সুমন্ত আসলামকে। চিরদিনের জন্য বহিষ্কার করলো কার্টুনিস্ট আরিফকে। কিছুই হলো না প্রথম আলোর। কিছু হয় না মতিউর রহমানের মত ব্যক্তিদের। তাদের সব অপরাধ মাফ করে দেয় রাষ্ট্র। কেবলই বলির পাঁঠা হতে হয় আরিফের মতো ব্যক্তিদের।
আরিফ দেখতে পায় প্রথম আলোর মুখ ও মুখোশ। প্রথম আলোর কারণে ক্ষোভে দু:খে আরিফ প্রিয় স্বদেশ ছাড়ে। বর্তমানে নরওয়েতে অবস্থান করছেন কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমান। অনেক চেষ্টার পর অবশেষে আরিফের খোঁজ পাওয়া যায়। শুক্রবার বিকেলে মুঠোফোনে বাংলানিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন অনেক অজানা কথা। নরওয়ে থেকে বাংলানিউজকে দেয়া সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।

প্রথম আলোর ফান ম্যাগাজিন আলপিনে কার্টুন প্রকাশের কারণে আপনাকে শেষ পর্যন্ত জেলে যেতে হয়েছে। মূল ঘটনা আপনার কাছে শুনতে চাচ্ছি...
২০০৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আমি কার্টুনটি আঁকি। আলপিনে তা ছাপা হয় ১৭ সেপ্টেম্বর। সেদিনই আমার এক সহকর্মী ফোন করে জানায় যে কার্টুনটি নিয়ে ধর্মীয় সংগঠনগুলো আন্দোলন করছে। আমি ভয় পেয়ে সাথে সাথে ফোন দিই আলপিন-এর বিভাগীয় সম্পাদক সুমন্ত আসলাম ভাইকে। উনি আমাকে বললেন, ভয় পেয়ো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। সে রাতটা যে কীভাবে আমার গিয়েছে...। পরদিন সকালে আমার এক বড় ভাইকে খুলে বললাম বিষয়টি। উনি আমাকে গা ঢাকা দিতে বললেন। কার্টুনটি ছাপা হওয়ার পরদিন প্রথম আলোর সাংবাদিক টিপু সুলতান ভাই ফোন দিয়ে বললেন, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি যেন দেখা করি...।
তারপর...
তারপর আর কি... শেষ পর্যন্ত জেল। সব দোষ যেন আমার। আমার কথা হচ্ছে, সম্পাদকের হাত দিয়ে অনুমতি পাওয়ার পরইতো কার্টুনটি ছাপা হয়েছে। এখানে দায়ভার যে শুধু আমার তা নয়। আমি যা ইচ্ছে তা লিখতে ও আঁকতে পারি না। পত্রিকার সম্পাদক ছাপানোর উপযোগী মনে করেছেন বিধায় তা ছাপিয়েছেন।
কিন্তু আপনিতো পার পেলেন না...ছয় মাস জেল খাটতে হয়েছে আপনাকে...
আমিতো মতিউর রহমান না যে কিছু করলে রাষ্ট্র আমাকে মাফ করে দেবে। আমি এক নগণ্য কার্টুনিস্ট। আমি জেলে যাওয়ার পরদিন প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা আমাকে চেনে না। তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিলো না। প্রথম আলো আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। নিজেদের গা বাঁচিয়ে আমাকে জেলে ঢুকিয়েছে। আমি সরকারের কাছে এর বিচার চাই।
আপনার মা দীর্ঘদিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। ব্লগাররা আপনার মাকে সাহায্যের জন্য মানবিক আবেদনও জানিয়েছেন। প্রথম আলো ট্রাস্ট থেকে কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন কি?
দেশে থাকতে আমার মায়ের জন্য চিকিৎসা বাবদ যে টাকা দরকার ছিলো আমি তা জোগাড় করতে পারিনি। তবে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ ব্লগার ও বন্ধুদের প্রতি। তারা যা পেরেছেন সহযোগিতা করেছেন। কার্টুনিস্ট রাইটস নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (সিআরএনবি) কার্টুন বিক্রি করে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছে। আমার মায়ের এখন সপ্তাহে ২ বার কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছে। আমি চেষ্টা করছি মাকে নরওয়েতে নিয়ে আসতে। প্রথম আলো মায়ের চিকিৎসার জন্য কোনো ধরণের সহযোগিতাই করেনি।
আপনিতো প্রথম আলোকে অনেক আদর্শিক পত্রিকা মনে করতেন। আপনার কাছের বন্ধুরাই জানিয়েছেন, আপনি প্রথম আলোর সম্পাদককে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। ভালো একজন মানুষ হিসেবেও জানতেন। পত্রিকার সম্পাদকসহ সিনিয়র সাংবাদিকরা নাকি আপনার কার্টুনের প্রশংসা করতেন। কিন্তু কার্টুন প্রকাশের পর আপনার সাথে এমন করার কী কারণ?
হ্যা, আমি স্বীকার করছি আমি তাকে শ্রদ্ধা করতাম। প্রথম আলোকেও আদর্শিক পত্রিকা মনে করতাম। আমার সে ধারণার ভুল হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ। প্রথম আলোর ভিতর আর বাহির এক নয়। ‌আমি খুব আশ্চর্য হই এ জন্য যে, যে পত্রিকায় আমি কাজ করতাম আমি বিপদে পড়ায় সে পত্রিকা বলেছে, আমাকে নাকি তারা চেনে না। সমাজকে বদলানোর কথা বলে প্রথম আলো অথচ নিজেদের বদলাতে পারেনি। তারা বায়তুল মোকাররমের খতিবের কাছে দুই হাত জোড় করে মাফ চেয়ে আমার মতো আরিফদের বাঁচার ইচ্ছে আর ক্যানভাস ছুড়ে ফেলে দেয় জেলখানার অন্ধকার কারাগারে। জানি এই এলিটদের বিচার হবে আজ নয়তো কাল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ