শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১২

প্রথম আলোর লাগাতার মিথ্যাচার, খবরের সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই



রাজধানীর খিলক্ষেত থানার ডুমনী মৌজার বোয়ালিয়া খাল নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো কয়েক দিন ধরে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে, তা যে ডাহা মিথ্যা, সেটা সরকারের তদন্তেই প্রমাণিত হয়েছে।
বসুন্ধরার বিরুদ্ধে বোয়ালিয়া খাল ভরাটের অভিযোগ তুলে প্রথম আলো প্রতিবেদন প্রকাশের পর ভূমি মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় তৎপর হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তেজগাঁও রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। তেজগাঁও সার্কেলের কানুনগো আবুল কালাম আজাদ ও সার্ভেয়ার শাহ আলম ঘটনাটি সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত করেন। বুধবার তাঁদের দুজনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা সরেজমিনে তদন্ত করতে গিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদনের সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে জানান।
কানুনগো আবুল কালাম আজাদ ও সার্ভেয়ার শাহ আলম জানান, তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখতে পেয়েছেন, বসুন্ধরা গ্রুপ তাদের নিজস্ব মালিকানাধীন জমিতে ভরাটকাজ করছে। সরকারি সম্পত্তি বোয়ালিয়া খালের সঙ্গে এ ভরাটকাজের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তারা দুজনই স্পষ্ট করে বলেন, `বোয়ালিয়া খাল আগের মতোই অক্ষত রয়েছে।`
অথচ প্রথম আলো বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে লাগাতার মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ মনগড়া তথ্য দিয়ে বোয়ালিয়া খাল ভরাটের কাহিনী সাজিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংবাদপত্রটি একের পর এক মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে চলেছে।
প্রথম আলোর এ মিথ্যাচার দেখে সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, এলাকার গণ্যমান্য, প্রবীণ ব্যক্তিসহ স্থানীয় বাসিন্দারাও বিস্মিত হয়েছেন। তেজগাঁও সার্কেলের কানুনগো আবুল কালাম আজাদ ও সার্ভেয়ার শাহ আলম বলেছেন, `তদন্ত করতে এসে প্রথম আলোর প্রতিবেদনের সঙ্গে বাস্তবতার আকাশ-পাতাল তফাত দেখে আমরাও অবাক। শিগগিরই এ বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হচ্ছে।`
গত ৮ জানুয়ারি `বোয়ালিয়া খাল ভরাট করে আবাসন প্রকল্প` শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রথম আলো লিখেছে, এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বোয়ালিয়া খালের প্রায় তিন কিলোমিটার অংশ ভরাট হয়ে গেছে। প্রথম আলোর এ তথ্য খোদ সরকারি তদন্তেই মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার কথা জানার পর এ প্রতিবেদক গতকাল আরো কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। সেখানে সরেজমিন খালের অবস্থান দেখে এবং এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে সবাই বিস্মিত হন এই ভেবে যে একটি জাতীয় দৈনিক কী করে এমন মিথ্যাচার করতে পারে! কারণ সবাই চাক্ষুষ দেখতে পান, খালের জায়গায় খাল ঠিকমতোই আছে। পরে সরকারের ভূমিসংক্রান্ত নথিপত্র বা নকশায় বোয়ালিয়া খালের অবস্থান ও অবস্থা ঠিক যেমনটি দেখানো আছে, খালটি এখনো ঠিক তেমনই রয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের খাল ভরাট নিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, রাজউক, গণপূর্ত বিভাগসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সম্প্রতি একটি তালিকা তৈরি করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, এসব তালিকায় বোয়ালিয়া খাল দখল বা ভরাট করা হয়েছে, এমন কথা কোথাও বলা নেই।
বুধবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বোয়ালিয়া খালের দক্ষিণে শেষ যেখানে, সেখান থেকে আরো দক্ষিণে লম্বা-সরু কমবেশি প্রায় দুই হাজার ফুট কৃত্রিম খাল কাটা হয়েছিল বোরো চাষের পানি সেচ করার জন্য। মানুষের খনন করা এ শাখা খালের শুরু থেকে কমবেশি এক হাজার ফুটের পর দক্ষিণে ৩০০ ফুট প্রশস্ত রাস্তা হচ্ছে। এ রাস্তারও দক্ষিণে রয়েছে বসুন্ধরার আবাসন প্রকল্প। এর মাঝখান দিয়ে কৃত্রিম শাখা খালটি আরো প্রায় এক হাজার ফুট গিয়ে শেষ হয়েছে। এ পর্যন্তই খনন করা হয়েছিল এই শাখা খালটি। এ কৃত্রিম শাখা খালটুকুও যেমন ছিল, এখনো তেমনই রয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ অসংখ্য মানুষ জানায়, বোয়ালিয়া খাল বা এর শাখা খাল কেউ ভরাট করেনি। খালের আশপাশের জমির মালিকরাও একই কথা বলেন। প্রথম আলোর প্রতিবেদনের কথা শুনে তাঁরাও বিস্মিত।
ডুমনী গ্রামের ৮০ বছর বয়সী হাজি আবদুল হক বলেন, এলাকার অধিকাংশ জমিই নিচু। সেসব জমিতে তাঁরা সাত পুরুষ ধরে চাষাবাদ করে আসছেন। সিএস (ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে) থেকে শুরু করে বর্তমান মহানগরীর রেকর্ডে (সিটি জরিপ) আদি বাসিন্দাদের নাম রয়েছে। পর্চা এবং সার্ভে নকশায় এর প্রমাণ আছে। কিন্তু একটি মহল সেসব ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিকে বোয়ালিয়া খাল এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত করে স্বার্থসিদ্ধি করতে তৎপরতা চালাচ্ছে। তিনি বলেন, বোয়ালিয়া খাল আগের মতোই রয়ে গেছে। এর এক ইঞ্চি জায়গাও দখল হয়নি।
ডুমনী টেকপাড়া জামে মসজিদের সভাপতি হাজি আবদুর রহিম জানান, বোয়ালিয়া খাল মূলত ডুমনী ও বরুয়া মৌজার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে শত বছর আগে থেকে। বরুয়া মৌজায় নির্মাণাধীন ৩০০ ফুট রাস্তার কাছে যেখানে সেতু তৈরি করা হচ্ছে, সেখান থেকে কমবেশি এক হাজার ফুট দক্ষিণে গিয়ে বোয়ালিয়া শাখা খালটি শেষ হয়েছে। সিএস রেকর্ড এবং পর্চায় এ কৃত্রিম খাল হালট (চলাচলের জায়গা) হিসেবে উল্লেখ করা আছে। এলাকার প্রবীণদের কাছ থেকে জানা যায়, ১৯৭০ সালের দিকে স্থানীয় লোকজন হালট কেটে কৃত্রিম খাল তৈরি করে। তাই বোয়ালিয়া খাল দখলের ঘটনাকে তিনি কাল্পনিক বলে উল্লেখ করেন।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য হাজি আবদুল গাফ্ফার বলেন, বরুয়া মৌজার সিএস দাগ নম্বর ১১৭৮ এবং আরএস দাগ নম্বর ২১৯১ পর্যন্ত খাল রয়েছে। পরবর্তী দাগের সব সম্পত্তি স্থানীয় বাসিন্দাদের পৈতৃক জমি, যা সরকারি সব রেকর্ড, পর্চা এবং নথিপত্রে রয়েছে। অথচ সরকারি সেসব রেকর্ডপত্র উপেক্ষা করে স্থানীয় কৃষকদের বিরুদ্ধে লেগেছে কিছু সংস্থা এবং পত্রপত্রিকা। তিনি প্রতিবেদককে সাম্প্রতিক সময়ে সম্পাদিত সিটি জরিপের নকশা খুলে দেখান। সেখানে স্পষ্ট করে বোয়ালিয়া খালের অবস্থান চিহ্নিত করা আছে।
এ ব্যাপারে তেজগাঁও রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার ভূমি (এসি ল্যান্ড) এস এ সফিক বলেন, কারো কথায় জমির স্বত্ব ও প্রকৃতি নির্ণয় হয় না। তা নির্ণয় করতে হলে জমির পর্চা, নকশা এবং দখলি স্বত্ব দেখতে হয়। ডুমনী ও বরুয়া মৌজায় বোয়ালিয়া খালের নির্দিষ্ট একটি গতিপথ আছে। তবে নিচু জমিকে খাল বলা ঠিক নয়। এর জন্য সেটেলমেন্ট সার্ভের প্রতিবেদন আগে তৈরি করতে হবে। এরপর বলতে হবে, কোনটি খাল আর কোনটি চাষাবাদের জমি।
সরেজমিনে গিয়ে ডুমনী ও বরুয়া মৌজার বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রথম আলো পত্রিকা সাধারণ মানুষের জমিকে বোয়ালিয়া খাল হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), পরিবেশ অধিদপ্তরসহ কিছু সংস্থা, যারা সরেজমিনে গিয়ে এলাকা না দেখেই বানোয়াট কথা তুলে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তুলছে। এতে এলাকার সাধারণ কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। স্থানীয় বাসিন্দা হাজি মোহাম্মদ সোলাইমান বলেন, বোয়ালিয়া খাল এলাকার পানি নিষ্কাশনের একমাত্র অবলম্বন। তা যদি ভরাট করে কেউ আবাসন এলাকা গড়ে তোলে, তা হলে প্রথম প্রতিরোধ করবে এলাকাবাসীই।
এলাকার বাসিন্দা হাজি গিয়াসউদ্দিন ও হাজি আহসান উল্লাহ বলেন, বোয়ালিয়া খালঘেঁষে পুলিশ প্রশাসনের একটি আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হচ্ছে এবং তার সরকারিভাবে অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকে ৯৭ একর জমি স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এ আবাসন প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। সেখানে কোনো সরকারি খাসজমি, খাল কিংবা ড্যাপের অধীন জমি থাকলে কি রাজউক থেকে তার ছাড়পত্র দেওয়া হতো? অথচ খালের অনেক দূরে থাকা বসুন্ধরা প্রকল্পের জমি নিয়ে একটি সংবাদপত্র আদাজল খেয়ে লেগেছে, যার সঙ্গে যোগ দিয়েছে সরকারি সংস্থা রাজউক। এলাকাবাসী মনে করে, রাজউক আসলে প্রথম আলো পত্রিকার ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হচ্ছে।
ডুমনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, এক শ বছর আগে জরিপ করা সিএস রেকর্ডে বোয়ালিয়া খালকে ৩০ ফুট চওড়া দেখানো হয়েছে। এত নগরায়ণের পরও বর্তমানে তার পরিধি একই রয়ে গেছে, যা সিটি জরিপের নকশা থেকে প্রমাণিত হয়। তিনি বলেন, খাল দখল করে নগরায়ণ করা হলে তো বিপদে পড়বে আবাসন কম্পানিগুলো। কারণ তাদের পানি নিষ্কাশনের জন্য তো খালের প্রয়োজন রয়েছে। বরং বসুন্ধরা কম্পানি তাদের প্রকল্পের কিছু কিছু এলাকায় সমতল মাটি কেটে কৃত্রিম খাল বানিয়েছে পানি নিষ্কাশনের জন্য।
স্থানীয় তহশিল অফিস (গুলশান থানা ভূমি অফিস) সূত্রে জানা গেছে, খালের জমি সরকারের খাস। তার নিয়ন্ত্রক হলো ভূমি মন্ত্রণালয়। স্থানীয়ভাবে এসব জমি দেখাশোনা করে থাকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)। যদি সরকারি খাল দখলের ঘটনা ঘটে, তাহলে এ অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে এসিল্যান্ড অফিস কিংবা মাঠপর্যায়ের তহশিল অফিস। কিন্তু বোয়ালিয়া খাল দখলের ঘটনা সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। তারা সরেজমিন তদন্তে গিয়ে এমন কোনো প্রমাণ পায়নি বলে একাধিক ভূমি কর্মকর্তা জানান।বোয়ালিয়া খাল দখলের কোনো অভিযোগ তাঁদের কাছে নেই বলেও তাঁরা জানান।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জমির প্রকৃত মালিক যদি তাঁর জমিতে পুকুর কাটেন কিংবা মাটি ভরাট করেন, তাহলে কারো কিছু করার থাকে না। ডুমনী ও বরুয়া এলাকার সিংহভাগ নিচু জমি রেকর্ড ও দখলিস্বত্বে ব্যক্তি মালিকানাধীন। এ ক্ষেত্রে সরকার ইচ্ছা করলেই কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে না। আর করতে গেলে আদালতের রায়ে সরকার আরো বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে। এমন অনেক নজির ঢাকায় রয়েছে বলেও তিনি জানান।
এলাকার বেশ কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বোয়ালিয়া খালটি বরুয়া থেকে শুরু করে উত্তর দিকে তালনা ঢেলনা গ্রাম সংলগ্ন বালু নদীর সঙ্গে মিশেছে। ৩০০ ফুট সড়কের দক্ষিণে কমবেশি এক হাজার ফুট পর্যন্ত এসে ২৫ থেকে ৩০ ফুট চওড়া শাখা খালটির গতিপথ শেষ হয়েছে। এ খালটি এলাকাবাসীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে আছে। চাষাবাদের জন্য এ খালের পানির কোনো বিকল্প নেই। ভবিষ্যতে এলাকায় নতুন করে ঘরবাড়ি গড়ে উঠলে সেখানে বসবাসরতদের জন্যও খালের প্রয়োজনীয়তা অসীম। তাই এলাকাবাসীর সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষার স্বার্থেই বোয়ালিয়া খাল অক্ষুণ্ন রাখা হবে বলে জানান বরুয়ার বাসিন্দা জামালউদ্দিন দেওয়ান।
সরেজমিনে বরুয়া মৌজার ৩০০ ফুট রাস্তার ওপর নির্মিতব্য ব্রিজের কাছে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় ২০০ ফুট চওড়া ব্রিজের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। ব্রিজের নিচ দিয়ে খালের পানি রয়েছে। তবে আপাতত বাঁধ দেওয়া হয়েছে। সিটি জরিপের নকশা অনুযায়ী খালের জমি বাদ দিয়েই বসুন্ধরা আবাসন প্রকল্পের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। খালের সীমানা ঠিক রাখার জন্য দুই পাশে বাঁশের প্রাচীর গড়ে তুলেছে আবাসন কম্পানিটি।
খিলক্ষেত থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হারুন অর রশিদ বলেন, ঘটনাস্থলে না এসেই বোয়ালিয়া খাল দখলের সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে, যার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ