মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

গল্প আংটি - চতুর্থ পর্ব লেখকঃ- মতিউর_মিয়াজী

 আংটি - চতুর্থ পর্ব

লেখকঃ- মতিউর_মিয়াজী



তানিয়ার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বানানো ডাক্তার মিজানুর রহমানের বাড়িতে আসলাম। রাস্তার সাথে বিশাল বাড়ি। বাড়ির চারপাশে পাথর দিয়ে ঢালাই করা উঁচু দেয়াল। দেয়াল উঁচু হওয়ায় বাড়িটা স্পষ্ট দেখার জন্য গেইটের সামনে থেকে একটু পেছনের দিকে গেলাম।
বাড়ির গেইটের সামনে একটা বিশাল নেইমপ্লেট লাগানো। লেখা- স্বপ্নচারিতা হাউজ। বাড়ির নামটা একটু ভিন্ন ধর্মী দেখে সামান্য চমকালাম। এই নামের বাড়ি এই শহরে আগে কখনো দেখিনি।
গেইটের ঠিক সামনে দু'জন দারোয়ান বসা। দু'জনের মধ্যে থেকে আমাকে দেখে একজন উঠে দাঁড়ালো। সহজ গলায় বললো,
- জরুরী কোন প্রয়োজন ছাড়া ডাক্তার স্যারের বাড়িতে প্রবেশ নিষেধ।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম,
- নিষেধ বলেই তো তোমাদের দু'জনকে এখানে বসিয়েছে। এসেছি পোস্টমর্টেম সম্পর্কিত ঝামেলা নিয়ে।
দারোয়ান আগ্রহ নিয়ে বললো,
- তাহলে অবশ্যই যেতে পারেন। স্যারকে দু'তালায় পাবেন। যদি দেখেন দু'তালায় রুম তালা বদ্ধ তাহলে ছাঁদে পাবেন। স্যার এই সময়টা ছাঁদে কাটাতে পছন্দ করে।
- তোমার স্যার কি একা মানুষ ?
- একা নয়, পরিবারের সবাই বেড়াতে গেছে। ডাক্তারদের ব্যস্ততা খুব বেশি, চাইলে ও বেড়ানোর সময় বের করা কঠিন।
দরজায় টোকা দিতেই মিজানুর রহমান প্রায় সাথে সাথে দরজা খুললেন। তার হাতে একটি ছোট খরগোশের বাচ্চা, মনে হলো তিনি বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে দরজা খোলার জন্য দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিছু বলার আগেই আমাকে বললেন,
- একটু বারান্দায় গিয়েছি, গিয়ে দেখি তুমি বাড়ির ভেতরে আসছো। বিশেষ কোন প্রয়োজনে এসেছ ?
আমি সোফায় বসলাম। মাথার উপর পাখা ঘুরছে, তবু ও আমার গরম লাগছে। বললাম,
- তানিয়া নামের একটা লাশের পোস্টমর্টেম করেছিলেন মাত্র কয়েকদিন আগে, মনে আছে আপনার ?
কথা শুনে মিজানুর রহমান চুপচাপ ভাবতে লাগলেন। বুঝা যাচ্ছে তিনি কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করছেন। মনে করতে পারলেন না। বললেন,
- আমাকে দু'এক দিন পর পরই নতুন নতুন লাশের পোস্টমর্টেম করাতে হয়। তুমি যেই নামটি বলেছ এই নামের কারো কথা ঠিক মনে করতে পারছি না।
আমি ডাক্তারের দিকে হতাশ চোখে তাকালাম। তাকিয়ে থেকে বললাম,
- তানিয়া নামের লাশটা মারা যায় আত্মহত্যা করে, বিয়ের তিন দিনের মাথায় ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করে মারা যাওয়া মেয়েটা ড্রাগ এডিক্টেট ছিল।
আমার কথা শুনে সাথে সাথে আমার দিকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকালেন। কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
- ওহ হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। আচ্ছা তুমি মেয়েটার কে হও ?
- মেয়েটার বড় ভাই, যে ভাই আত্মহত্যা করে মারা যাওয়া বোনের আংটি হাতে নিয়ে ছুটাছুটি করছে।
মিজানুর রহমান আমার দিকে বিভ্রান্তি কর দৃষ্টিতে তাকালেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন,
- ভাই হয়ে বোনের মৃত্যু মেনে নেওয়াটা খুবই কষ্টকর।
আমি বললাম,
- মেনে নেওয়াটা আমার জন্য বেশি কষ্টকর। কারণ তানিয়ার মৃত্যুটা আত্মহত্যা ছিল না, আপনি রিপোর্টে লিখেছেন ড্রাগ এডিক্টেট। সত্যি করে বলবেন, রিপোর্টে বোনটার নামে এই মিথ্যাটা কেন লিখেছেন ?
মিজানুর রহমান আমার কথা শুনে পুরোপুরি বিস্মিত হলেন। কঠিন গলায় বললেন,
- আবেগ নিয়ে আমরা অনেক কিছুই বলতে পারি, আমার ডাক্তারি জীবনে অনেকের মুখেই এমন সব কথা শুনেছি। একটা কাজ করো, দয়া করে এসব অভিযোগ থানায় কিংবা কোন আদালতে গিয়ে জানাও। এটা আমার নিজস্ব বাসা, নিশ্চয় বুঝতে পারছো কারো ব্যক্তিগত বাসায় এসে এসব আলোচনা করা ঠিক নয়।
আমি সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। কপাল থেকে ফোটা ফোটা ঘাম পড়ছে। পকেট থেকে হাত দিয়ে টিস্যু দিয়ে কপালের ঘাম মুছলাম। মিজানুর রহমান আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন,
- লাশ পোস্টমর্টেম করানোর আগে তুমি কি জানতে পোস্টমর্টেম করানো ব্যক্তিটা আমি হবো ? নিশ্চয় জানতে না, যদি নাই জেনে থাকো তাহলে আমি তোমার বোনের ক্ষেত্রে ভুল রিপোর্ট কেন লিখবো ? একটা লাশকে পোস্টমর্টেম করানোর সময় সম্পর্কটা থাকে শুধুমাত্র লাশের সাথেই। মারা যাওয়া মানুষটার স্বজনদের সাথে নয়!
আমি মিজানুর রহমানের দিকে অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকালাম। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে পা বাড়ালাম। যাওয়ার সময় তিনি বললেন,
- একটা কাজ করলে পারো, লাশটা তুলে আরো একবার পোস্টমর্টেম করানোর ব্যবস্থা করো। তাহলে কমপক্ষে নিজের মনের অস্বস্তি টা দূর হবে। সাময়িক সময়ের জন্য মস্তিষ্কে যে আবেগ প্রবণতা এসেছে, তা পুরোপুরি কেটে যাবে।
আমি জবাব না দিয়ে বাসা থেকে বের হলাম। গেইটের কাছে আসতেই দারোয়ান দু'জন আমাকে দিকে তাকালো। ভেবেছিল তাদেরকে কিছু একটা বলবো। আমি না বলেই রাস্তা পেরিয়ে গাড়িতে উঠলাম।
টানা কয়েক দিনের চেষ্টার পর একদম হতাশ হলাম। কয়েকবার থানার ওসির সাথে কথা বলেছি, সাথে আইনজীবী ও নিয়ে গেলাম। তাতে ও লাশ তোলায় এগিয়ে যেতে পারলাম না। তানিয়ার লাশ কবর থেকে তোলার অনুমতি পেলাম না।
তানিয়ার স্বামী ফয়সাল রিপোর্ট দেখার পর আমাকে কয়েকবার ফোন দিয়েছে। আমি ইচ্ছে করেই ফোন রিসিভ করলাম না। গিয়ে সরাসরি ফয়সালের বাসায় উঠলাম।
ফয়সাল এখনো অফিস থেকে ফিরে নাই। বিকেল পাঁচটা বাজলো। এই সময়ে ফয়সাল অফিস শেষ করে বাসায় ফেরার কথা, আজ এখনো আসছে না কেন ?
কিছুক্ষণ পরেই ফয়সালকে দেখলাম। বাড়িতে ঢুকে আমাকে দেখে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো। হাত থেকে অফিসের ব্যাগটা রেখে বললো,
- আত্মবিশ্বাস ভালো, তবে অতিরিক্ত নয়। একটা কথা মনে রাখবেন, একমাত্র নিজেকে ছাড়া পৃথিবীর কাউকে বিশ্বাস করা খুব কঠিন।
আমি বললাম,
- ফয়সাল তুমি শান্ত হও, কি বলছো এসব ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
- কেন ? ভুলে গেলেন! বলেছিলেন আপনার বোন তানিয়া সুস্থ মস্তিষ্কের, একটা ড্রাগ এডিক্টেট মেয়ে কিভাবে সুস্থ মস্তিষ্কের হয়। বিয়ে দেওয়ার আগে কমপক্ষে আমাকে এটা জানানো উচিত ছিল।
আমি কঠিন গলায় বললাম,
- তানিয়া ড্রাগ এডিক্টেট নয়, এই রিপোর্টটা ভুল ছিল। অনেক চেষ্টা করে ও লাশটা আবার তোলার অনুমতি আনতে পারলাম না। যদি পারতাম তাহলে আসল সত্যিটা বের হতো।
ফয়সাল চোখ বড় করে আমার দিকে তাকালো। কিছু একটা বলতে চাইলো। আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম, দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে বললাম,
- ভেবেছিলাম তোমার সাথে একটা আংটির পুরো ঘটনাটা শেয়ার করবো। সামান্য একটা রিপোর্ট পেয়ে তুমি তানিয়াকে নিয়ে যে নিচু মানসিকতার চিন্তা তৈরি করেছ। শুনে কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না।
ফয়সাল চুপ করে রইলো। আমি মাথা নিচু করে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলাম।
বোনটা মৃত্যুর পর বেঁচে থাকা মানুষের কাছে অপবাদ আর চরিত্রহীন হিসেবে হৃদয়ে জায়গা করেছে। এটা ভাবতেই হৃদয়টা যন্ত্রণায় অস্থির করে তুললো।
আজ অনেকদিন পর আবারো মায়ের পাশে বসে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেললাম। মা ডান হাত দিয়ে পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। মাকে বললাম,
- মা আমি আবারো পোস্টমর্টেম করানো ডাক্তারের কাছে যাবো।
মা বললো,
- তুই আগে ও একবার গিয়েছিস ?
- হ্যাঁ মা, গিয়েছি। যে কারণে গিয়েছি তার সমাধান এখনো পাইনি, তাই তোমাকে এর উত্তর ও শোনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বিশ্বাস করো মা, সেদিন তানিয়া আমার কাছে সত্যিই এসেছিল।
আনিকা টানা কয়েকদিন ধরে ফোন দিয়ে যাচ্ছে। ফোন রিসিভ করে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। পুরো সময়টা অস্থিরতায় কাটে। আজকে রাতে শুয়ার পর পরই আনিকার ফোন আসলো। ফোনটা রিসিভ করতেই বললো,
- রাকিব আজকে কতোদিন হয়ে গেলো তুই ভার্সিটিতে আসছিস না। এভাবে আর কতোদিন ?
আমি হতাশ গলায় বললাম,
- খুব বেশি নয়, আর মাত্র একটা দিন। একদিন পরই ভার্সিটিতে আসবো। একটা আংটি আমাকে স্বাভাবিক জীবনে আসতে দিচ্ছে না, আগামীকাল সন্ধ্যায় এটা ছুঁড়ে ফেলে দেবো।
আনিকা আগ্রহ নিয়ে বললো,
- আংটি ? কিসের আংটি ?
আমি জবাব না দিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কিছু না খেয়েই বাইরে বের হলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর গাড়িতে উঠেই চলে আসলাম ডাক্তার মিজানুর রহমানের বাড়িতে।
মিজানুর রহমানকে ছাদে পাওয়া গেলো। তিনি ছাদে দ্রুত পায়ে একবার এদিকে যাচ্ছেন আরেকবার ওইদিকে। আমাকে দেখে বিরক্তকর দৃষ্টিতে তাকালেন। এগিয়ে এসে বললেন,
- সমস্যাটা কি তোমার ? তুমি আবার এসেছ কেন ?
আমি আন্তরিক গলায় বললাম,
- আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছি। সেদিন আপনার সাথে কথা বলার পর বুঝতে পেরেছি আমি আসলে আবেগ প্রবণতা নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছি, এই আবেগ আমাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। এখন যন্ত্রণা কেটেছে। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।
মিজানুর রহমান মুচকি হাসলো। হাসিমুখে বললো,
- প্রিয় মানুষদের মৃত্যু যেমনি প্রিয়জনেরা মেনে নিতে পারে না। তেমনি পারে না প্রিয় মানুষদের ভুলগুলো। তোমার এখন ক্যারিয়ার গঠন করার সময়, মৃত্যু শোক ভুলে নিজের ক্যারিয়ারে সময় দাও, আশা করি তাহলে খুব ভালো কিছু করতে পারবে।
- তানিয়া আমার একমাত্র ছোট বোন, বোনটা খুব আদরের ছিল। এমন আদরের বোনটার মৃত্যুতে একদমই ভেঙ্গে পরেছিলাম। আমার সাথে সাথে মা নিজে ও কঠিন পরিস্থিতি পার করছে। আপনার সাথে আমার মা কথা বলতে চায়, যদি একটু সময় দিয়ে কথা বলতেন তাহলে মায়ের দুশ্চিন্তা কেটে যেত।
মিজানুর রহমান সহজ গলায় বললেন,
- কিভাবে কথা বলতে চায় ? দেখা করতে হবে ?
- না, ফোনে কথা বললে ও হবে। আমি এখনি মায়ের নাম্বারে ফোন দিচ্ছি।
- ঠিক আছে দাও।
আমি পকেট থেকে মোবাইলটা করলাম, মায়ের নাম্বারটা বের করে ফোন দিলাম। মোবাইলে টাকা নেই, তাই ফোন ঢুকছে না। সকালে ইচ্ছে করেই টাকা ঢুকাইনি।
মিজানুর রহমানকে বললাম,
- মোবাইলে একটা টাকা ও নেই, যদি আপনার হাতের মোবাইলটাতে টাকা থাকে একটু দিবেন ?
মিজানুর রহমান তার হাতের মোবাইলটা এগিয়ে দিলেন। আমি মোবাইলটা হাতে নিয়েই সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মুখস্থ করা ফয়সালের নাম্বারটা তুলতে শুরু করলাম।
মাত্র পাঁচটা ডিজিট তুলতেই দেখলাম মোবাইলটাতে আমার মুখস্থ করা পুরো নাম্বারটা 'ফয়সাল' লিখে সেইভ করা। মিজানুর রহমানের মোবাইলে ফয়সালের নাম্বার সেইভ থাকবে কেন ? ভাবতে গিয়ে আমার পুরো শরীরটা কেঁপে উঠলো।
আমি মিজানুর রহমানের সামনে বিস্ময় লুকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে ভাবছি - আংটিটা ফেলে দেওয়া যাবে না। আংটিটা সাথে নিয়েই বের করতে হবে আসল সত্যিটা। আমাকে জানতেই হবে সেদিন রাতে কি ঘটেছিল তানিয়ার সাথে!
( চলবে ... )

৫ম পর্ব পড়ার জন্য এইখানে ক্লিক করুন।

গল্পঃ আংটি - তৃতীয় পর্ব লেখকঃ- মতিউর_মিয়াজী

গল্পঃ আংটি - তৃতীয় পর্ব

লেখকঃ- মতিউর_মিয়াজী



তানিয়ার লাশ পোস্টমর্টেম করতে নিয়ে যাওয়া হলো। মা ফ্লোরে বসে আছে, একটু দূরে বসে আছে আনিকা। আমি বসা থেকে উঠে ফয়সালের কাছে গেলাম।
ফয়সালকে এবার ওয়াশ রুমে পেলাম না। সে ওসি'র রুমে বসে আছে। ভেতরে ঢুকে দেখলাম ওসি শফিকুর রহমান রুমে নেই। আমি ভেতরে ঢুকে পাশে রাখা চেয়ারটাতে বসলাম না। ফয়সালকে বললাম,
- তানিয়ার মৃত্যুটা আত্মহত্যা ছিল না।
আমার কথা শুনে ফয়সাল চমকালো। প্রথমে জোর গলায় কিছু একটা বলতে গিয়ে ও বললো না। গলার স্বর স্বাভাবিক করে বললো,
- এসব আপনি কি বলছেন ? দরজা বন্ধ করে গলায় ফাঁস লাগিয়ে মারা যাওয়া মানুষটাকে বলছেন আত্মহত্যা ছিল না ?
- না, এটা কোন ভাবেই আত্মহত্যা হতে পারে না। তানিয়া আমার বোন, ছোট বোনটাকে ভাই হিসেবে ভালো করেই চেনা আছে আমার। বোনটা আমার এতটা অসুস্থ মস্তিষ্কের নয়, যতটা হলে আত্মহত্যা করতে হবে।
ফয়সাল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। এবার উচ্চস্বরে বললো,
- আপনি তাহলে কি বোঝাতে চাচ্ছেন ? আপনার বোনকে আমাদের বাড়িতে খুন করা হয়েছে ?
আমি একদম চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। পুরো মাথাটা অস্থিরতায় এলোমেলো লাগলো। ফয়সালকে কি বলবো বুঝে উঠতে পারলাম না।
ফয়সাল আমার হাতটি ধরে নরম গলায় বললো,
- তানিয়া শুধুই কি আপনার বোন ? আমার কিছু নয় ? তানিয়া আমার বিবাহিত স্ত্রী, নিজের স্ত্রীর এমন মৃত্যুটা মেনে নিতে কতোটা কষ্ট হচ্ছে বলে বোঝাতে পারবো না। আর শুনুন, আপনি হয়তো ভুল কিছু ভাবছেন। তানিয়া সুস্থ মস্তিষ্কের তা আমি মানছি, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষেরাই সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা প্রবণ রোগে ভোগে। এই প্রবণতা সুস্থ মানুষকে অসুস্থ বানিয়ে দেয়।
আমি থানা থেকে বিষণ্ণতা নিয়ে বের হলাম। পোস্টমর্টেম শেষ হওয়ার পর পরদিন সকালে তানিয়ার লাশের সাথে ফয়সালের বাড়িতে গেলাম।
আমার সাথে মা এসেছে। বড় মামা খবর পেয়ে দেশের বাইরে থেকে জরুরী টিকেটে দেশে আসতে চাইলো। মামাকে বোঝালাম, পোস্টমর্টেম করা লাশ কবর দিতে দেরি করা যাবে না। ইচ্ছে করলে ও অপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
মায়ের সাথে ছোট মামা রয়েছে। খবর পেয়ে রাতের ট্রেনে ছুটে এসেছে। ছোট মামা এসে মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বললো,
- তিন দিন আগে ভাগ্নী টার বিয়ে খেয়ে গেলাম। তিন দিনের মাথায় এই ভাগ্নী টার লাশ দেখতে হবে কখনো ভাবিনি। পৃথিবীটা এতো কঠিন কেন ? কেন এমনটা হলো ?
পৃথিবীর কঠিন নির্মম সত্যিটা ছোট মামার মতো আমার ও মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তানিয়ার নামটা মুখে নেওয়ার সাথে সাথে যখন মনে হয় বোনটা আর বেঁচে নেই চারপাশটা একদমই ফাঁকা মনে হয়, মনে হয় সামনে বিশাল গর্ত, পা বাড়ালেই গর্তে আটকে যাবো।
মা চাইলো তানিয়ার লাশ যেন আমাদের বাড়ির কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়। বিয়ের পর মেয়েদের কিছু অধিকার চিরদিনের জন্য পরিবর্তন হয়ে যায়। এই সত্যিটা মাকে বোঝাতে গিয়ে বললাম,
- বোনের লাশটা এই বাড়িতে কবর দেওয়ার কথাটা তাদেরকে কিভাবে বলবো, মা তুমিই বলো ? বিয়ের দিনই যে মেয়ের বাবা-মা সেই অধিকারটা হারিয়ে ফেলে।
আমার কথা শুনে মা নির্বাক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। ফয়সালের বাড়িতে এসে শুনলাম কবরস্থানে কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছে। আমি ছোট মামাকে সাথে নিয়ে কবরটা দেখতে গেলাম।
শুনেছি আত্মহত্যা করে মারা যাওয়া মানুষদের কবর দিতে সবাই ছুটে আসে না। কথাটা কিছু সময়ের জন্য মিথ্যা মনে হলো। মুরুব্বী থেকে শুরু করে সবাই এসেছে, খবর পেয়ে বিবাহিত অনেক মহিলারা ও ফয়সালের বাড়িতে আসলো, এসেছে কবরে নিয়ে যাওয়ার আগে তানিয়ার চেহারাটা এক নজর দেখতে।
তানিয়ার লাশ কবরে নামিয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেললাম। সবাই কবরে মাটি ফেলছে, ছোট মামা এক মুঠো মাটি হাতে নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। আমি ছুটে গিয়ে মামাকে জড়িয়ে ধরলাম। এভাবে কতক্ষণ জড়িয়ে ধরেছিলাম ঠিক জানা নেই।
বোনকে কবর দিয়ে ফয়সালের ঘরে ঢুকলাম। দৌড়ে গেলাম ফয়সালের রুমে, ফয়সালের রুমের দরজাটা ভাঙ্গা। ভাঙ্গা দরজাটা ভালো করে দেখলাম। আমাকে দেখে ফয়সাল এগিয়ে আসলো। এসে বললো,
- দরজাটা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কাঠের এতো মজবুত দরজা ভেঙ্গে ফেলা কি এতটা সহজ ?
আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম,
- দরজা বন্ধ করে গলায় ফাঁস দেওয়ার কতক্ষণ পরে টের পেয়েছিলে ?
- প্রথমে আমি টের পাইনি। অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। তাই গোসলে গেলাম। জানেনই তো, বাড়িতে আমার মা ছাড়া কেউ নেই। মা তানিয়াকে ডাকতে আমার রুমের দিকে গেলো, গিয়ে দেখে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, তাড়পড় বাহির থেকে কয়েকবার উচ্চ স্বরে ডাকলো। ভেতর থেকে শব্দ না পেয়ে পাশের জানালাটা একটু ফাঁক করতেই দেখে তানিয়া ফাঁসিতে ঝুলে আছে। মা দেখেছে ঝুলে থাকা অবস্থায় তানিয়ার পা নড়াচড়া করছে। দেখেই আমাকে ডেকে নিয়ে আসলো।
বিকেলে ছোট মামাকে রেল স্টেশনে গিয়ে এগিয়ে দিলাম। স্টেশনে মানুষজনের তেমন একটা ভিড় নেই। এগিয়ে দিয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মে বসলাম। দক্ষিণার খোলা জায়গা থেকে শীতল বাতাস এসে শরীরে লাগলো। অনেক সময়ের পর শরীরে শীতল বাতাসের স্পর্শতা অনুভব করতে পারলাম।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, রেল স্টেশনে রাত কাটানো ছোট ছোট ছেলেরা চলন্ত অবস্থান ট্রেনের ভেতর থেকে লাফিয়ে নামতে শুরু করলো। তাদের বয়স দশ থেকে বারো হবে, কিংবা তার চেয়ে ও কম। এতো কম বয়সী ছেলে হয়ে তাদের মনে বিন্দুমাত্র ভয় নেই। তারা সবাই চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নামার আনন্দে আনন্দিত।
স্টেশন থেকে বাড়িতে এসে দেখলাম মা ঘরে নেই। ছাঁদে গিয়ে দেখি মা বেলীফুল গাছটার কাছে দাঁড়িয়ে। এই ফুল গাছটা তানিয়া লাগিয়েছে। এটা তার প্রিয় ফুল। যখন এই গাছে ফুল ফুটে তানিয়া গাছটির কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। দীর্ঘ সময় মুগ্ধ হয়ে গাছটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
সন্ধ্যার একটু পরেই দারোয়ান হাতে টিফিন নিয়ে রুমে ঢুকলো। হাতে এতো বড় টিফিন বক্স দেখে অবাক হয়ে বললাম,
- এতো বড় টিফিনে করে কি নিয়ে এসেছেন ?
- একজন আপা এসে খাবারের টিফিনটা দিয়ে গেলো।
- দিয়ে গেলো, আর নিয়ে নিলেন ?
দারোয়ান বললো,
- আপাটার নাম আনিকা, আমাকে বললো আপনাদেরকে নামটা শুনালেই চিনবেন।
মাকে ডাকতেই রুম থেকে বের হলো। আনিকা টিফিন দিয়ে গেছে শুনে বক্স গুলো খুললাম। বক্সে বোয়াল মাছ রান্না করা আছে, পেঁয়াজ দিয়ে ভুনা করে সুন্দর করে রেঁধেছে। তরকারীর চমৎকার কালার দেখে বুঝা যাচ্ছে অনেক সময় নিয়ে যত্ন করে রেঁধেছে।
রাত প্রায় বারোটার মতো বাজে, কখনো এতো রাত পর্যন্ত সজাগ থাকা হয় না। দশটার পর পরই চোখে ঘুম চলে আসে। আজ চোখে ঘুম নেই, দশটার পর থেকেই বিছানায় গড়াগড়ি করছি, ঘুম আসছে না। ভার্সিটিতে পড়া ছেলে-মেয়েরা এতো তাড়াতাড়ি ঘুমায় না। আনিকা কি ঘুমিয়ে গেছে ?
আনিকার সাথে যেদিন রাতে কথা হয় দশটার আগে হয়, বেশিরভাগ সময় প্রয়োজনে ফোন দেওয়া হয়। আজ প্রয়োজন ছাড়া এতো রাতে ফোন দেওয়া কি ঠিক হবে ? কিছু সময় ভাবনার পর ফোন দিলাম। আনিকা সাথে সাথে ফোনটা রিসিভ করে বললো,
- আন্টি কেমন আছে ?
- এখন অনেকটা ভালো। তুই এখনো ঘুমিয়ে যাস নাই ?
- না, ভেবেছিলাম এখনি শুয়ে পড়বো। এর মধ্যে তোর ফোন পেলাম।
আমি আন্তরিক গলায় বললাম,
- তোরে হসপিটালে আসতে বলার পর থেকেই অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। দাঁড় করেয়েছি একটা করুণ পরিস্থিতির মুখোমুখি। বোনের মৃত্যু, তার মধ্যে মায়ের অসুস্থতা কোন কিছুই সামলে উঠতে পারছিলাম না।
- আরে তুই এসব কি বলছিস ? যদি সেদিন তোর ফোন পেয়ে না যেতাম তাহলে পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারতাম না।
- কে বলেছে তোরে টিফিনে করে তরকারি দিয়ে যেতে। আমার জন্য তোরে অনেক ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে।
আনিকা সহজ গলায় বললো,
- একটা জিনিস তোর কাছে চাইবো বলেই এতো ঝামেলা করছি ?
- আমার কাছে কি এমন আছে যেটা তোর প্রয়োজন ?
আনিকা গলার স্বর পাল্টে বললো,
- আছে, যেদিন চাইবো সেদিনই বুঝতে পারবি।
কিছুক্ষণ কথা বলার পর আনিকা ঘুমিয়ে পড়লো। আমার চোখে ঘুম এখনো আসছে না। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছি আর ভাবছি, আমার কাছে এমন কি আছে, যেটা আনিকার প্রয়োজন ?
পোস্টমর্টেম রিপোর্টের কপি হাতে আসতে কয়েক দিন লাগলো। রিপোর্ট হাতে পেয়ে পুরোপুরি বিস্মিত হলাম। রিপোর্টে বলা হলো, তানিয়া একজন ড্রাগ এডিক্টেট। ফাঁসিতে ঝুলেই তার মৃত্যু হয়েছে, এই মৃত্যুটা আত্মহত্যাই ছিল।
রিপোর্ট দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। নিয়মিত নেশার সাথে জড়িত থাকলে পরিবারের কেউ না কেউ তো জানতে পারতাম! একটা মেয়ে হয়ে নিয়মিত নেশা করে যাবে আর কেউ জানবো না ?
তানিয়ার এমন রিপোর্ট দেখে মায়ের কাছে বলার সাহস করতে পারলাম না। মাকে বললে কথাটা শুনে আবার যদি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ? এতো আদরের মেয়ের নামে রিপোর্টে এমন লিখা দেখলে মেনে নেওয়াটা কঠিন যন্ত্রণাদায়ক।
রিপোর্ট হাতে নিয়ে থানায় ছুটলাম। আমার ধারণা এই রিপোর্টে ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে, গভীর ষড়যন্ত্র। আমার ধারণা কখনোই মিথ্যা হতে পারে না। যে করেই হউক আমাকে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তৈরি করা ডাক্তারটাকে খুঁজে বের করতে হবে। প্রয়োজনে পরীক্ষার মাধ্যমে সত্যিটা বের করতে কবর থেকে তানিয়ার লাশ আবার তুলবো।

সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

আংটি - দ্বিতীয় পর্ব লেখকঃ- মতিউর_মিয়াজী

 আংটি - দ্বিতীয় পর্ব

লেখকঃ- মতিউর_মিয়াজী

তানিয়ার মৃত্যুর খবর সবকিছু এলোমেলো করে দিলো। হঠাৎ করেই মায়ের হাত থেকে ফোনটা মাটিতে পরে গেলো। ফোনটা হাত দিয়ে ধরে রাখার শক্তিটুকু ও মা হারিয়ে ফেলেছে। আমি কথা বলার চেষ্টা করে ও বলতে পারছি না, ইচ্ছে করছে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদি।

আমার চোখ দিয়ে ফোটা ফোটা জল পড়ছে। আমি চোখের পানি মুছার চেষ্টা করলাম না, জানি এই জল মুছে শেষ করতে পারবো না।

গেইটের দারোয়ান নির্বাক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার মায়ের দিকে। সে চিৎকারের কারণ জানতে চাচ্ছে। বার বার মাকে বলে যাচ্ছে,

- আমগো তানিয়া আপার কি হয়েছে ?

মা কোন জবাব দিচ্ছে না। মায়ের চোখে এক ফোটা ও পানি নেই। মা চোখ বড় বড় করে দারোয়ানের দিকে তাকাল।

ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে মায়ের শীর্ণ শরীর। মা কিছু একটা বলতে চেয়ে বলতে পারছেন না। আমি শীতল গলায় দারোয়ানকে বললাম,

- আপনার তানিয়া আপু আর বেঁচে নেই।

- কি হইছে আপার ?

কথার জবাব দিতে পারছি না। পুরো শরীর হিমশীতল বরফ হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে শব্দনালীতে সব কথা আটকে গেছে। চেষ্টা করে ও মুখ দিয়ে বের করতে পারবো না।
গেইটের সামনেই মা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। দাঁড়ানো থেকেই মাটিতে পরে যেতেই ভয় পেলাম, খুব ভয়। দারোয়ান চারদিকে ছুটাছুটি করছে। আমি মায়ের পাশে বসে আছি।
জ্ঞান হারিয়ে ফেলা মানুষের শরীর এতটা ঠাণ্ডা হয়ে যায় জানা ছিলো না। আমি মাকে ডাকলাম, বার বার ডেকে যাচ্ছি। দারোয়ান বালতি দিয়ে পানি নিয়ে আসলো। মায়ের হাতে চেপে ধরে বললো,

- শরীর তো খুব ঠাণ্ডা হয়ে আছে, এখুনি মাথায় পানি ঢালা যাবে না। শরীর গরম করার জন্য হাতে আর পায়ের তলায় তেল গরম করে, গরম তেল মাখতে হবে।

দারোয়ান এসব কি বলছে ঠিক বুঝতে পারছি না। দু'জনে মাকে ধরে ঘরে ঢুকলাম। ছুটে গেলাম আমার রুমে। ফোনটা চার্জ থেকে খুলতে গিয়ে দেখি ফয়সালের নাম্বার থেকে অনেকগুলো ফোন দিয়ে রেখেছে।

জরুরী সময় কোন কিছু খুঁজে পেতে যেমন সমস্যা হয়, তেমনি জরুরী কোন সার্ভিস পেতে ও দেরি হয়। হসপিটালে ফোন দিলাম, নাম্বারটা ওয়েটিং দেখিয়ে বার বার কেটে যাচ্ছে।

এবার ফোনটা রিসিভ হলো। বাড়ির ঠিকানায় অ্যাম্বুল্যান্স পাঠাতে বললাম। ফোন রিসিভ করা মানুষটা জানালো, খুব একটা দেরি হবে না। এখুনি অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিবে।

অ্যাম্বুলেন্সে করে মাকে নিয়ে হসপিটালে আসলাম। জীবনে এই প্রথম বার এতো কঠিন পরিস্থিতিতে পরলাম। একদিকে মায়ের জ্ঞান ফিরছে না, অন্যদিকে তানিয়ার খোঁজ নিতে পারছি না। তানিয়াকে দেখতে যাওয়া প্রয়োজন, মাকে এমন অবস্থায় রেখে কিভাবে যাবো ?

মাকে কেবিনে ঢুকানোর পর পরই একজন নার্স উপরে গিয়ে ডাক্তার নিয়ে আসলো। ডাক্তার কেবিনে ঢুকেই আমার দিকে তাকালো। তাকিয়েই আমার অস্থিরতা ধরতে পারলো। আমার খুব কাছে এসে বললো,

- আরে আরে আপনি এতো চিন্তিত হচ্ছেন কেন ? রোগী সম্পর্কে আপনার কে হয় ?

- সম্পর্কে আমার মা।

ডাক্তার সাহেব হাসিমুখে বললো,

- আপনার মাকে নিয়ে কোন টেনশন করবেন না। হসপিটালে এসে পৌঁছেছেন তো, মনে করেন টেনশনের আর কোন কারণ নেই। সামান্য জ্ঞান হারানো নিয়ে এতটা চিন্তিত হতে কখনোই কাউকে দেখি নি।

আমি জবাব দিলাম না। দাঁড়িয়ে থেকে শব্দহীন মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

একটু পরেই আমার মোবাইলে ফোন বেজে উঠলো। তানিয়ার স্বামী ফয়সালের নাম্বার থেকে ফোন আসতেই ফোনটা তাড়াহুড়ো করে রিসিভ করলাম।

ফোনটা কানে নিয়ে হ্যালো হ্যালো বলেই যাচ্ছি। কারো কোন সাড়া শব্দ নেই। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে রাখলাম। রাখতেই আবারো ফোন আসলো। এবার রিসিভ করার সাথে ফয়সাল বললো,

- রাকিব তুমি এখনো আসছো না কেন ? এদিকে অনেক ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে। পুলিশ লাশ নিয়ে থানায় এসেছে। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব থানায় চলো আসো। তানিয়ার লাশের সাথে আমি ও এখন থানায় আছি।

- মাকে সাথে নিয়ে আমি হসপিটালে আছি, জ্ঞান না ফিরলে মাকে রেখে কিভাবে থানায় যাবো ?

ওপাশ থেকে কোন জবাব আসছে না। কিছুক্ষণ হ্যালো হ্যালো বলেই যাচ্ছি। ফয়সাল ফোনটা কেটে দিয়েছে।

থানায় যাওয়া খুব জরুরি হয়ে পরেছে। হসপিটালে আনিকাকে আসতে বলা দরকার। তাকে মায়ের পাশে রেখে আমাকে থানায় যেতেই হবে।

আনিকার সাথে পরিচয়টা খুব বেশি দিনের নয়। দু'জনে একই ডিপার্টমেন্টের হয়ে ও কারো সাথে তেমন কোন কথা হয় না। সামান্য কিছুদিন হলো একটু আধটু কথা হয় দু'জনের। প্রতিদিনের সামান্য সময়ের কথায় বন্ধুত্বের সম্পর্কটা যতটুকু মজবুত হয়েছে, মনে হচ্ছে আনিকাকে হসপিটালে আসতে বললে আসবে, অবশ্যই আসবে।

ফোন পেয়ে আনিকা হসপিটালে ছুটে আসলো। মায়ের এমন অবস্থা দেখে সে একদম থমকে গেলো। মায়ের হাতে স্যালাইন লাগানো দেখে মন খারাপ করে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

- রাকিব তুই আন্টিকে এমন পরিস্থিতিতে রেখে কোথায় যেতে চাচ্ছিস ?

আমি বললাম,

- একজন ভাই হয়ে তার আদরের বোনটার লাশ দেখতে থানায় যাচ্ছি।

আনিকা কিছু একটা বলতে চেয়ে ও বলতে পারছে না। বার বার কথাটা আটকে যাচ্ছে। আমি এক মুহূর্ত দেরি করলাম না। এক মুহূর্তের জন্য হলে ও বোনটার বোকাসুলভ চেহারাটা দেখতে থানায় ছুটলাম।

থানায় এসে ঢুকে দেখলাম ফয়সাল এই থানার ওসি শফিকুর রহমানের সাথে বসে আছে।

ফয়সালের সাথে শফিকুর রহমানকে ও চিন্তিত দেখাচ্ছে। ফয়সাল আমাকে ওসি'র সাথে পরিচয় করে দেওয়ার পর তিনি বললেন,

- আপনি মেয়েটার ভাই হয়ে কিভাবে এতো দেরি করলেন ? মেয়েটাকে পোস্টমর্টেম করাতে হবে। আপনি কি জানেন পোস্টমর্টেম রাতে করানো যায় না।

আমি মাথা নিচু করে বললাম,

- জ্বী, জানি।

- তাহলে আসতে এতো দেরি করেছেন কেন ? আজকের মধ্যেই মেয়েটার লাশ পোস্টমর্টেম করাতে হবে।

একজন সেন্ট্রি আমাকে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে লাশটা দেখানোর জন্য। সেন্ট্রি খুব আস্তে আস্তে হাঁটছে, তবু আমি একসাথে হাঁটতে পারছি না।

তানিয়ার শরীরের উপরে একটা সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে। শুধু মুখটি খোলা। আমি তানিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে সাথে সাথে শব্দ করে চিৎকার করলাম। তানিয়ার কপালের ঠিক বাম পাশে কালো কালো দাগ পড়ে আছে। মনে হচ্ছে এখানের রক্ত চলাচল হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চামড়ার নিচে থাকা জমাট বাধা রক্তের কালো দাগ দেখে তীক্ষ্ণ ধারালো ছুরির মতো হৃদয়ে আঘাত করলো।

আমার চিৎকার শুনে ফয়সাল দৌড়ে আসলো। আমি তানিয়ার খুব কাছে বসলাম। ফয়সালের চোখে পানি, সে তানিয়ার নাম ধরে ডেকে ডেকে কাঁদছে।

কিছুক্ষণ পরেই আনিকা মাকে সাথে নিয়ে থানায় আসলো। মায়ের জ্ঞান ফিরেছে দেখে কিছুটা স্বস্তি লাগছে। আনিকা আমাকে নরম গলায় বললো,

- ডাক্তার বলেছে আন্টিকে রেস্ট নেওয়ার জন্য। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর ডাক্তাররা এক মুহূর্ত ও আটকে রাখতে পারে নি।

তানিয়াকে পোস্টমর্টেম রুমে ঢুকানো হবে শুনে মা দুই হাত দিয়ে তানিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর কোন শক্তি নেই, মাকে তানিয়ার কাছ থেকে আলাদা করবে। মা চিৎকার করতে করতে বললো,

- আমার মেয়ের শরীর আমি পোস্টমর্টেম করতে দেবো না। মেয়েটা আমার খুব কষ্ট পেয়ে মরেছে। দয়া করে তোমারা আমার মেয়েটাকে আর কষ্ট দিও না।

ফয়সাল চোখের পানি মুছতে মুছতে রুম থেকে বের হলো। কিছুক্ষণ পর আমি মুখ ধোয়ার জন্য ওয়াশ রুমের দিকে গেলাম।

থানার এই ওয়াশ রুমটা খুব বিশাল। সিরিয়ালে কয়েকটা বেসিন বসানো। ওয়াশ রুমে ঢুকতেই দেখলাম কোনায় বসানো একটা বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ফয়সাল চোখে পানি দিচ্ছে।

ফয়সাল পকেট থেকে টিস্যু বের করে চোখ মুছে আয়নায় তাকিয়ে হাসতে শুরু করলো।

আয়নায় তাকিয়ে ফয়সালকে শব্দ করে হাসতে দেখে পুরোপুরি বিস্মিত হলাম। বিস্মিত হয়ে ভাবলাম, তানিয়ার মৃত্যুর দিনে তার মুখে হাসি আসছে কিভাবে ? একমাত্র খুনীদের দ্বারাই মৃত্যুর দিন এমন করে হাসা সম্ভব!

ওয়াশ রুমে আমার উপস্থিতি টের পাওয়ার আগেই আমি তানিয়ার লাশটির কাছে ছুটলাম।

মনে পড়লো আংটিটার কথা। আংটিটা মাকে হসপিটালে নেওয়ার সময় পকেটে রেখেছি, হাত দিয়ে দেখলাম এখনো পকেটেই আছে। আমি পকেট থেকে বের করে হাতে নিলাম।

মা তানিয়ার পাশেই বসে আছে। আমি ও তানিয়ার পাশে বসলাম। তানিয়ার হাতের আঙ্গুলটা দেখার জন্য শরীরের উপরে দিয়ে রাখা চাদরটা টান দিলাম। চাদরের কারণে এতক্ষণ গলার কাছের জায়গাটা ঢাকা ছিল, একটু সরাইতে গলার কাছে কালো দাগটি দেখে চমকে উঠলাম। গলার এই দাগটা আমি তখনো দেখেছি যখন তানিয়া বাড়িতে এসেছিল।

পুরোটা চাদর সরালাম। আশ্চর্য, তানিয়ার আঙ্গুলে কোন আংটি নেই। মাঝখানের আঙ্গুলটায় আংটি পড়ার দাগটা একটু ও মুছেনি। দাগটি দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে আমার হাতের এই আংটিটা তানিয়ার হাতেই পড়ানো ছিল।

পৃষ্ঠাসমূহ