কিছু_ইশারাতে
পর্ব_০২
_____________
কুয়াশামাখা ভোর। ঘটির কাটা ছয়টার ঘরে টিক টিক শব্দ তুলছে। আর নিজের রুমে ব্যাগপত্র গোছাচ্ছে জাবীন। ব্যাগপত্র গোছানো শেষ হতেই কালো রঙের বোরখাটা পড়ে নিলো। আয়নার সামনে দাঁটিয়ে হিজাবটা পড়ে নিলো। ফর্সা আদলে কালো হিজাবটায় যেন রূপ কিছুটা বৃদ্ধি পেলো জাবীনের। দরজায় টোকা পড়তেই ব্যাগটা হাতে নিয়ে দরজা খুললো জাবীন। তার বাবা দাঁড়িয়ে৷
‘ জাবীন মা, হয়েছে তোর? ’
জাবীন মাথা দুলিয়ে বলল,
‘ হ্যা বাবা। যাওয়া যাক। ’
মইনুল ইসলাম সামনে ঘুরে হাঁটলেন। ভাই আর ভাবী এখনও ওঠেন নি। উঠলে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দেবেন। তাই নিঃশব্দে বাপ মেয়ে বের হলো বাসা থেকে।
জাবীনদের বাসা গাজীপুরে। এই সকালে গাজীপুর থেকে কয়েকটা বাস ঢাকা যায়। তাই বাইপাস মোড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন মইনুল ইসলাম৷ রাস্তার সামনে যেতেই রিকশার জন্য অপেক্ষা করলেন। কুয়াশা থাকায় কিছু টের পাওয়া যাচ্ছে না ভালোভাবে। জাবীনও রাস্তায় মাথা এদিকে ওদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে রিকশা আসছে কিনা!
‘ বাবা আমরা ঢাকা কোন জায়গায় যাবো এখন? ’
মইনুল ইসলাম রাস্তায় চোখ রেখেই বললেন,
‘ উত্তরা যাবো। সেখানে আমার এক বন্ধুর বাসায় নাকি ঘর খালি রয়েছে। আমি সেখানে থাকবো। আর তুই তো হলেই থাকবি। ’
‘ তুমি একা থাকবে কিভাবে? আমিও থাকবো। এমনিতেও হলে আমারও খুব একটা ভালো লাগে না বাবা। ’
মইনুল ইসলাম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ ঠিক আছে। তবে তোর চলাচলে কষ্ট হয়ে পড়বে। ’
‘ সমস্যা নেই বাবা। ’
একটা রিকশা এলো তখন সেখানে। মইলুন ইসলাম থামালেন সেই রিকশা। জাবীন উঠে পড়লো ব্যাগ হাতে নিয়ে। মইনুল ইসলাম যেই উঠতে যাবেন সেমুহুর্তে একজন লোক এসে বললেন,
‘ আরেহ মইনুল ভাই না? কই যান? ’
বলে রিকশার দিকে তাকালেন লোকটা। জাবীনকে দেখে আবারও বললেন,
‘ ভেতরে কি মেহজাবীন নাকি? ’
বলেই কেমন বিশ্রি হাসলেন। আর পুনরায় বললেন,
‘ আপনার মেয়ে যা করছে মইনুল ভাই, এমন মেয়ের বিয়ে দিতে পারবেন না। এক কাজ করেন, আমার বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। আমরা তো ভালো মানুষ….. ’
‘ আর একটাও বাজে কথা বলবেন না আপনি। চলে যান এখান থেকে। ’
‘ এইজন্যই তো বলে চোরের মায়ের বড় গলা।আপনি তো আবার পুরুষ। ’
মইনুল ইসলাম রিকশায় উঠে পড়লেন। কোনোকিছু না বলে রিকশাওয়ালাকে বললেন,
‘ চলেন আপনি। ’
রিকশা চলা শুরু করলো। লোকটা তখনও নানা কিছু বলে যাচ্ছেন। কুয়াশার মাঝে রিকশাটা নিজ গতিতে চলছে। কয়েক মিনিট বাদে হঠাৎ একটা মাইক্রোর সাথে গিয়ে এক্সিডেন্ট করলো জাবীনদের রিকশাটা।
এই কুয়াশার মাঝে হয়তোবা মাইক্রোর ড্রাইভারও কিছু বোঝেনি আর এদিকে রিকশাওয়ালাও ঠাওর করতে পারে নি। রিকশার পেছনে ধাক্কা দিয়েছে গাড়িটা। আর এই ধাক্কা লাগায় জাবীন মইনুল ইসলামসহ রিকশাওয়ালাও রিকশা থেকে পড়ে গেলো মাটিতে। জাবীন হাতের কনুইয়ে আঘাত পেলো। মইনুল ইসলামও আঘাত পেলেন। জাবীন রেগে লাল মাইক্রোটার দিকে তাকালো। গাড়িটা থেকে ঢিমে আওয়াজে গান ভেসে আসছে। গান শুনে শুনে কান হয়তোবা খেয়ে ফেলেছিলো সাথে চোখও। এটাই মনে হলো জাবীনের। ফ্রন্ট সিট হতে একটা ছেলে বের হলো। মইনুল ইসলামের নিকটে গিয়ে তুললো সে।
‘ আপনি ঠিক আছেন তো? ’
বলে উঠতে সাহায্য করলো। মইনুল ইসলাম অতোটা আঘাত পাননি। বললেন,
‘ ঠিক আছি আমি। ’
মইনুল ইসলাম উঠে আগে রিকশাওয়ালাকে দাঁড় করালেন। তারপর জাবীনের দিকে তাকিয়ে জাবীনের কাছে এসে উঠতে সাহায্য করলেন মইনুল ইসলাম।
‘ ব্যথা পেয়েছিস মা? ’
‘ বেশি নয় বাবা। ঠিক আছি আমি। ’
সেই ছেলেটা আবারও এগিয়ে এলো তাদের দিকে। জাবীনের দিকে তাকালো। জাবীনও তাকালো। চোখাচোখি হলো দুজনের। চোখ নামিয়ে নিলো জাবীন। ছেলেটা ক্ষমার চেয়ে বললেন,
‘ ক্ষমা করবেন। আসলে আমরা বুঝতে পারি নি। ’
মইনুল ইসলাম নরম মনের মানুষ। তাইতো নরম গলায় বললেন,
‘ ঠিক আছে বাবা, সমস্যা নেই। ’
জাবীন তেঁতে উঠলো। তার বাবা মাটির মানুষ। কিছুই বলবেন না তিনি। তাই জাবীন রাগী গলায় বলল,
‘ ঠিক আছে মানে বাবা? যদি আজ কিছু একটা হয়ে যেতো? উনি কি দেখে গাড়ি চালাতে পারেন না? ’
সেই ছেলেটা জাবীনকে বলল,
‘ আসলে আপু…..’
‘ হাসান! ’
কেউ গাড়ির ভেতর হতে ডেকে উঠলো এই নামে। আহির নামক ছেলেটা গাড়ির দিকে তাকালো। ড্রাইভিং সিটে কেউ একজন বসে আছে। ভেতর থেকেই বলল,
‘ তাড়াতাড়ি আয়, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। ’
‘ ব্রো উনারা আঘাতপ্রাপ্ত। ’
আহিরের কথা শুনে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে থাকা যুবক কিছু বললো না। আহির আবারও কিছু জিজ্ঞাসা করবে তার আগেই জাবীন বলল,
‘ আপনি যেতে পারেন। ’
‘ কিন্তু আপ…..’
‘ যেতে বলেছি। ’
আবারও ভেসে এলো সেই যুবকের আওয়াজ,
‘ সাহায্য যখন লাগবে না তাহলে চলে আয়। ’
মইনুল ইসলাম, জাবীন দুজনে তাকিয়ে রইলো। আহির একবার তাদের দিকে তাকিয়ে বড় ভাইয়ের কথায় গাড়িতে গিয়ে উঠে পড়লো। জাবীন দাতে দাত চেপে তাকিয়ে রইলো শুধু। গাড়িটা পাশ কেটে যাওয়ার সময় ড্রাইভিং সিটে বসা যুবকটিকে দেখতে পেলো জাবীন। চোখে কালো চশমা আর মুখের সেই বিরক্তি ভাবটাই দেখতে পেলো জাবীন।
‘ ব্রো উনারা বেশ আঘাত পেয়েছে। এভাবে আসা উচিত হয় নি। ’
হাসানের কথাটা শুনেও ড্রাইভিং করতে থাকা যুবকের কোনো হেলদোল হলো না। অথচ সেই এই এক্সিডেন্ট করেছে। হোক ভুলবশত। তবুও যুবকের মাঝে মাঝে নেই কোনো অনুতপ্ত আর না অনুশোচনা। বরং আরও বলল,
‘ মরে তো নি। ’
হাসানের পছন্দ হলো না কথাটা,
‘ কেন তুই কি মারতে চেয়েছিলি? ’
হেসে উঠলো সেই যুবক। বলল,
‘ শেখ শাহীরের কাজ মানুষ বাঁচানো, মারা নয়। ’
হাসান বলল,
‘ তুই ডাক্তার না হয়ে জল্লাদ হলে ভালো হতো। ’
‘ তাহলে তোকেই আগে মারতাম। ’
হাসান ভ্রু কুঁচকে তাকালো। শাহীর শুধুই হাসলো। হাসান বলল,
‘ ভাই খারাপ লাগছে ওই আঙ্কেল আর মেয়েটার জন্য। আমাদের জন্য কত কষ্ট পেলো! ’
‘ আঙ্কেল বলছিস কেন? বল শুধু মেয়েটার জন্য। অমেয়েটাকে পছন্দ করে ফেললি নাকি? ’
হাসান বিরক্ত হলো,
‘ বাজে বকিস না। ’
‘ তাহলে তারা মরুক আর বাঁচুক আমাদের কি? ’
হাসান আর কথা বাড়ালো না। অন্য প্রশ্ন করলো,
‘ তোর জন্য নাকি পাত্রী দেখতে যাবে আজ। ’
‘ তো! ’
‘ বিয়ে করে ফেল। ’
‘ হঠাৎ আমার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিস? ’
‘ তোর ভালোর জন্যই বলছি। ’
‘ বিয়ে করলে কি এমন ভালো হবে? বোঝা আমায়। ’
হাসান শাহীরের দিকে তাকালো। আর বলল,
‘ তোর একাকিত্ব কমবে। ’
‘ কি বলতে চাইছিস? এই শেখ শাহীর নিঃসঙ্গতায় ভুগছে? ’
‘ এমন কিছুই বলি নি আমি। ’
‘ তাহলে বাদ দে। ’
— — — — —
বাসে চুপচাপ বসে বসে জাবীন ভাবছিলো আসলে তারা এখন কোথায় গিয়ে থাকবে। তার বাবার সেই বন্ধুটা কে? আর কি করে? তাদের বাসা আছে নাকি? এসব কেমন কথা ভাবছে জাবীন? এটা নিয়ে নিজেও বিরক্ত হলো।
‘ কি ভাবছিস মা? ’
বাবার কথা কানে যেতেই জাবীন বাবার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,
‘ তোমার সেই বন্ধুর বাসাটা কোথায় আর তারা কি করে? নাম কি? ’
‘ আমার কলেজ লাইফের বন্ধু। একসাথেই একই স্কুল থেকে একই কলেজে পড়াশোনা করেছি। নাম হলো আব্বাস উদ্দীন। ’
‘ ওহ আচ্ছা। ’
জাবীন ভাবলো তার একটা জব করা জরুরি এখন। জব নাহোক টিউশনি করাটা অন্তত জরুরি। শুধু বাবার পেনশনের টাকায় ঘর ভাড়া সহ তো মাসের খরচপাতি চলবে না। আগে তো জাবীন হলে থাকতো। আর ভাড়াও থাকতে হতো না। তাই অনায়াসেই চলে যেতো। আর এখন! এসব ভাবতে ভাবতেই উত্তরায় পৌঁছালো তারা। বাস থেকে নামতেই জাবীন বাস স্ট্যান্ডে একজনকে দেখে চমকে গেলো।
চলবে?
( আপনাদের এতো রেসপন্স আমার প্রত্যাশায় ছিলো না। এটা আমার প্রথম গল্প। নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে লেখার চেষ্টা করবো। আজকের পর্ব কেমন হয়েছে সবাই জানাবেন।)
Next please
উত্তরমুছুনKhub sunder
উত্তরমুছুন