বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

গল্প #কিছু_ইশারাতে #পর্ব_১ ইপ্সিতা আনন.

 কিছু_ইশারাতে

পর্ব_১
ইপ্সিতা আনন.


প্রেগন্যান্সির কিট হাতে নিয়ে নিজেরই হবু স্বামীর সাথে চাচাতো বোনের বিবাহ দেখছে মেহজাবীন। যার সাথে কিনা তারই বিবাহ হতো। যে স্থানে তার বসার কথা ছিলো। আর সেখানে এখন তার চাচাতো বোন। ঠোঁটে তার তাচ্ছিল্যের হাসি। মাথা নিচু করে আবারও সেই প্রেগন্যান্সি কিটের দিকে তাকালো। যেখানে দুটো দাগ স্পষ্ট। মাথা তুলে একবার চারপাশে বাবাকে খুঁজলো।

কিন্তু দেখতে পেলো না। হয়তোবা ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। চোখ গেলো চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু পরিচিত মুখের দিকে যারা তার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে আর কানাঘুষা করছে। আধঘণ্টা আগে কি হয়েছে? সেটা ভাবতেই হাসফাস করতে লাগলো জাবীন। মেহজাবীন ভাবতে লাগলো একজন মহিলা স্বার্থের জন্য এতো খারাপ কিভাবে হতে পারে? মেহজাবীনের কান্না পেলেও তা আটকে রাখলো বহুকষ্টে। জাবীন হাজারটা প্রতিবাদ করেও লোকসমাজের কেউই তাকে বিশ্বাস করে নি। আজকের সমাজ এমনই।

আরেকবার তাকালো চাচাতো বোন সারিকার দিকে। যে কিনা জাবীনেরই দিকে কেমন বিশ্বজয়ী হেসে তাকিয়ে আছে। তার এই হাসি দেখে জাবীনেরও হাসি পেলো ভীষণ।

ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে সেখান থেকে চলে আসলো জাবীন। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার মতো মানসিকতা তার নেই। দরজার কাছে দেখা পেলো সাইফা খাতুনকে। জাবীনের বড় চাচী।

খেয়ালে আসলো এদিকে মানুষজনও জাবীনকে নিয়ে কত কটুক্তি করছে। বাজে বাজে কথা বলছে। চরিত্র নিয়ে কথা বলছে। কিছুজন তো জাবীনের সামনে এসে বললো,

‘ ছি, তোকে কত ভালো ভাবতাম। কার সাথে ফষ্টিনষ্টি করে এই বাচ্চা বাধিয়েছিস? ’

জাবীনের দেহ ঘৃণায় গা রি রি করে উঠলো। সেখান থেকে যেতে নিবে সেসময় সাইফা খাতুন জাবীনের হাত ধরে অন্যদিকে নিয়ে গেলেন। চারপাশ একবার দেখে সাইফা খাতুন জাবীনের দিকে তাকিয়ে দুখি দুখি ভাব নিয়ে বললেন,

‘ কষ্ট পাস না মা। কার সাথে কি করেছিস ভুলে যা। আমরা আছি তোর সাথে। ’

জাবীন তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

‘ কি বলুন তো? কথায় আছে না? ‘লাভের গুড় পিঁপড়েয় খায়’; আমার অবস্থাটা ঠিক কিছুটা এমন হলেও সমস্যা নেই। শেষটা অবশ্যই সুন্দর হবে। ’

রেগে গেলেও এই খুশিক্ষণে সেটা প্রকাশ না করে গা জ্বালানো অট্টহাসিতে মেতে
পড়লেন সাইফা খাতুন। কোনোরকম নিজের হাসি থামিয়ে ব্যঙ্গ করে বললেন,

‘ তুই আর কি বা হাসবি? তুই শুধু দেখতে থাক। ’

জাবীনের হাসি পেলো খুব।

তবে হাসলো না। জাবীন বরং আল্লাহর নিকট হাজারও শুকরিয়া জানালো ওমন এক অমানুষের সাথে তার বিয়ে হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য। যেই মানুষ সত্য মিথ্যা যাচাই না করে হবু স্ত্রীকে ওভাবে চরিত্রহীনা বলতে পারে আর হবু স্ত্রীর সামনে তারই চাচাতো বোনকে বিয়ে করতে পারে সেই লোক আর যাই হোক ভালো হবে না নিশ্চয়।

জাবীন সাইফা খাতুনের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। একদম ছাদে চলে আসলো জাবীন। রেলিং ঘেষে দাঁড়াতেই নিচের দিকে একবার ভালোভাবে দেখলো। নয়তলা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে নিচের দৃশ্য দেখাটা ঠিক কেমন সেটা উপলব্ধি করলো।
কয় সেকেন্ডের মাঝে মারা যাবে সেটাও হিসেব করে নিলো মুহুর্তেই।

তারপর আবারও মাথা তুলে সামনে তাকালো। এখান থেকে রাতের গাজীপুর শহর দেখা যাচ্ছে। রাতের দৃশ্য হওয়ায় ভীষণ সুন্দর লাগছে। দিনে হলে অতোটা হয়তো ভালো লাগতো কিনা সন্দেহ।

জাবীন বুকভরে শ্বাস নিলো। প্রেগন্যান্সির কিটটা ছুড়ে মারলো অন্যদিকে। নিম্নে আঁধারের গরিষ্ঠতায় ঠিক বোঝা গেলো না কিটটা কোথায় গিয়ে পড়েছে।

সাইফা খাতুন জাবীনের নামে কি পরিমাণ ঘৃণ্যকর এক বদনাম রটিয়েছে জাবীন সেটা ভাবতেও পারছে না জাবীন।

জাবীন বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ। তবুও ভাবতে লাগলো আধঘণ্টা আগে ঘটে যাওয়া কিছু তিক্ত, বাজে, ঘৃণ্যকর মুহুর্ত।

মেহজাবীনের আজ বিয়ে ছিলো।

তার বাবা মইনুল শেখ মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভীষণ খুশি ছিলেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর মেয়েকে নিজ হাতে মানুষ করেছেন। দ্বিতীয়বারের মতো আর বিয়ে করেন নি তিনি। তাইতো মেয়েকে এতো ভালোবাসেন।

তবে জাবীনকে দু চোখে সহ্য করতে পারতেন না জাবীনের বড় চাচী।

মইনুল ইসলামরা দুই ভাই এক বোন।

বড় ভাই মাহিন ইসলামের স্ত্রী সাইফা খাতুন।

জাবীন আর উনার মেয়ে সারিকা সমবয়সী হওয়ায় আবার বাসস্থান একই জায়গায় হওয়ায় জাবীনকে প্রচুর ঘৃণা করতেন তিনি।

জাবীনের বাবা যখন অফিসের কাজে বাইরে থাকতেন জাবীনকে প্রচুর মারধোর করতেন। জীবন টু শব্দটি অবধি করতো না।

তবে বড় হওয়ার সাথে সাথে জাবীন এসব সয়ে নিলো। বাবাকেও কখনও কিছু বলে নি। এভাবে কেটে গেলো বছরকয়েক। জাবীন এখন ভার্সিটিতে পড়াশোনা করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছে। হলেই থাকে। এরই মাঝে বাবা একদিন ফোন করে জানালো উনি জাবীনের বিয়ে ঠিক করেছেন। পাত্র বনেয়াদি পরিবারের ছেলে। ছেলের বাসা মিরপুরে। জাবীনকে দেখে নাকি পছন্দ করেছে। সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে ছেলের পরিবার। ছেলের নাম রাফসান।

জাবীন খুব একটা ইচ্ছে না দেখালেও না করে নি। বাবার মান্য মেয়ে জাবীন।

তাইতো সবকিছু ঠিক করার পর আজই বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়।

তবে এটা আবার সহ্য করতে পারেন নি সাইফা খাতুন। নিজের মেয়েকে লাগিয়ে দেন রাফসানের পেছনে। বিয়ের ক্ষণে এসে বদনাম রটান জাবীন প্রেগন্যান্ট। আর বরপক্ষের পরিবারও সাইফা খাতুনের কথায় ঢেই ঢেই করে নাচা শুরু করে জাবীনকে অপমান করে।

মইনুল ইসলামকে অপমান করা শুরু করেন।

জাবীনকে বিয়ে করবে না বলে চলে যেতে নিলে মান সম্মান হানি হবে ভেবে মাহিন ইসলাম নিজের মেয়েকে রাফসানের সাথে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেওয়া মাত্রই অপরপক্ষও রাজি হয়ে যায়। এরপর বিয়েটাও সম্পন্ন হয়ে গেলো।

জাবীন হতাশার শ্বাস ফেললো। মনে মনে ঠিক করলো সে আর এই শহরে চাচা চাচীদের সাথে থাকবে না আর না তার বাবাকে রাখবে। চলে যাবে তারা। বাবাকে নিয়ে ঢাকায় ভাড়া বাসায় উঠবে।

জাবীনের বাবা সরকারি চাকরিজীবী। পেনশনের টাকায় চলে যাবে। জাবীন নিজেও টুকটাক ইনকাম শুরু করে দেবে।

জাবীন ভাবলো এই কাজটা ঠিক কতটা সহজ হবে? আর তার বাবাও কি রাজি হবে?
— — —
জাবীন বাসায় আসলো তখন যখন পুরো বাসা নিস্তব্ধ ছিলো।

বিয়ের অনুষ্ঠানের পর সবাই যখন চলে গিয়েছে তখন আসলো।

সদর দরজা খোলাই ছিলো।

এই বিল্ডিংটি মাহিন ইসলাম আর মইনুল ইসলামের টাকায় তৈরি।

তবে মাহিন ইসলাম ছোট ভাইকে কখনই মর্যাদা দেয় নি।

জাবীন নিজের রুমে যাওয়ার আগে চোখ পড়লো সারিকার রুমে। চলে গিয়েছে নিশ্চয়।

জাবীন নিজের রুমে ঢুকতেই বারান্দায় বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলো।

জাবীন মাথা নামিয়ে নিলো। বাবার সামনে যেতে লজ্জা করলেও বাবার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই মইনুল ইসলামই আগে বললেন,

‘ মা রে, আমি কিছুই করতে পারলাম না। ’

জাবীন কপাল কুঁচকে বলল,

‘ এসব কি বলছো বাবা? ’

মইনুল ইসলাম পেছনে ঘুরে তাকালেন। চোখ ছলছল করে বললেন,

‘ তোর এত বড় সম্মানহানী হলো। আর বাবা হয়ে আমি কিছুই করতে পারলাম না মা।

আমায় ক্ষমা করে দিস। ’

হাত জোর করতেই জাবীন বাবার হাত ধরে বলল,

‘ কি বাজে বলছো বাবা। বাদ দাও। আল্লাহ তায়ালা যা করেন আমাদের ভালোর জন্যই করেন। আমিই বেঁচে গিয়েছি। এমনিতেও আমার বিয়ে নিয়ে খুব একটা মত ছিলো না। ’

‘ কিন্তু মা তোকে যে সবচেয়ে বাজে একটি বদনামে অপমাম করা হলো? ’

‘ বাদ দাও বাবা। আমরা আর এখানে থাকবো না। তোমাকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাব আগামীকাল। এই অমানুষদের ভিড়ে আমাদের জায়গা এমনিতেও হবে না মনে হচ্ছে। ’
থেমে বাবার দিকে তাকিয়ে আবারও বলল,

‘ না করবে না কিন্তু। ’

মইনুল ইসলামও রাজী হলেন মেয়ের কথায়। মেয়েকে তিনি বিশ্বাস করেন। মেয়ে যে তার কোনো খারাপ কাজই করেন নি এ নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে যখন ঘটনাটা ঘটলো তখন কিছুটা মবক্ষুণ্ণ হলেও কিছুক্ষণ আগেই বড় ভাই আর বড় ভাবীর কথা শুনে ফেলেছিলেন মইনুল ইসলাম।

এরপর সমস্ত ঘটনা বুঝে তিনিও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এই অমানুষদের থেকে তিনি মেয়েকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবেন।


চলবে.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ