মঙ্গলবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১২

৩ বোনের ধর্ষণের বর্ণনা, ট্রাইব্যুনালে সাক্ষীর কান্না

গৌরাঙ্গ চন্দ্র সাহা। একাত্তরে যার যুবতী তিন বোনকে ধরে নিয়ে যান দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। তুলে দেন পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্যাম্পে। সেখানে তিন দিন ধর্ষণের পরে ছেড়ে দেয় তারা। নিজের বোনদের ধর্ষণের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে ট্রাইব্যুনালের ডকে কেঁদে উঠলেন ওই সময়ের ২৭ বছরের এই হতভাগা ভাইটি। তিনি বলেন, সাঈদী আমাদেরকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে। হাতে দেয় তসবি, মাথায় টুপি পরে মসজিদে গিয়ে নামাজে বাধ্য করে। গৌরাঙ্গের এ বক্তব্যের সময় পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে ট্রাইব্যুনালে। গতকাল বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই ১৩তম সাক্ষীর এ জবানবন্দি গ্রহণ করেন। পরে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা সাক্ষীকে জেরা করেন। জেরায় তিনি জানান, নিজের বোনদের ধর্ষণ ও পরিবারের সদস্যদের ধর্মান্তরের ওই ঘটনা এলাকার অন্য লোকজন জেনেছিল কিনা তা তিনি বলতে পারবেন না। গৌরাঙ্গ জানান, তার বয়স ৬৭ বছর। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী কিছু রাজাকার নিয়ে আমাদের বাড়িতে গিয়ে লুটপাট করে। পরে আমার তিন বোনকে ধরে পিরোজপুরের পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে তুলে দেয়। সেখানে তাদের জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হয়। তিন দিন পরে তাদের বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়। তিনি আরও বলেন, এর কিছু দিন পরে কলেমা পড়িয়ে সাঈদী আমাদের বাড়ির সবাইকে মুসলমান বানায়। লজ্জায় আমার বাবা-মা, ভাইবোনরা ভারতে চলে যায়। তবে আমি একা দেশে থেকে যাই। এ সময় ‘আমি আর কিছু বলতে পারব না’ বলে সাক্ষী ডুকরে কেঁদে ওঠেন। ট্রাইব্যুনালের ডকে উঠে দাঁড়ান। বলেন, আমি এর বিচার চাই। পরে আবার বলেন, নারায়ণ সাহা, নিখিল পাল, গৌরাঙ্গ পাল, সুনীল পাল, হারান ভৌমিকসহ আরও ১ দেড়শ’ লোককে ধর্মান্তরিত করে। ধর্মান্তরের পর আমাকে আবদুল গণি নাম দেয়া হয়। তবে স্বাধীনতার পরে আমি নিজ ধর্মে ফিরে আসি। সাক্ষী বলেন, আমি আর কিছু বলতে পারছি না। আর কি কমু, ৪০ বছর আগের ঘটনা কত মনে থাকে? পরে আসামির পক্ষে জেরা করেন এডভোকেট মিজানুল ইসলাম ও এডভোকেট মঞ্জুর আহসান আনসারী। আইনজীবী বলেন, মাহবুবুল আলম হাওলাদার, রুহুল আমিন নবীন, মোস্তফা হাওলাদার, সুলতান আহমেদ হাওলাদার, মিজানুর রহমান তালুকদার, মাহতাব উদ্দিন হাওলাদার, মানিক পসারি, বাসু দেব মিস্ত্রি, জলিল শেখ ও আলতাফ হোসেন হাওলাদার কি আপনার তিন বোনের ধর্ষণ এবং আপনাদের ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনা জানতেন। সাক্ষী বলেন, বলতে পারবো না। আইনজীবী বলেন, মাহবুব ও মানিক পসারি পিরোজপুর আদালতে মামলার আগে আপনার সঙ্গে কি যোগাযোগ করেছিলেন। সাক্ষী বলেন, না। আইনজীবী বলেন, পাকিস্তানি বাহিনী আসার কত দিন পরে আপনার বোনদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সাক্ষী বলেন, ১০/১৫ দিন পরে। আইনজীবী বলেন, পাকিস্তানিরা আসার কত দিন পরে অপনাদেরকে মুসলমান বানানো হয়। সাক্ষী বলেন, মাস দুয়েক। আইনজীবী বলেন, একাত্তরে মুসলমান বানিয়ে আপনাকে যে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে বাধ্য করা হয়, সে মসজিদের ইমাম বা মুয়াজ্জিন সাহেবের নাম বলতে পারবেন। সাক্ষী বলেন, বলতে পারবো না। আইনজীবী বলেন, প্রায়শ্চিত্ত করে নিজ ধর্মে ফিরে এসেছিলেন। সাক্ষী বলেন, জান বাঁচানোর জন্য মুসলমান হয়েছিলাম। জান বাঁচানো ফরজ। তাই প্রায়শ্চিত্তের দরকার হয় না। আইনজীবী বলেন, চরখালীর পীর ইয়াসিন মাওলানাকে চিনতেন। সাক্ষী বলেন, জি। আইনজীবী বলেন, স্বাধীনতার আগে কি করতেন। সাক্ষী বলেন, মুদির দোকান দিতাম। এখনও মুদির ব্যবসা করি। একাত্তরে স্থায়ী দোকান ছিল আর এখন ফুটপাতে দোকান দেই। আইনজীবী বলেন, দোকানের হিসাব কি নিজেই রাখেন। সাক্ষী বলেন, হ্যাঁ। আইনজীবী বলেন, ধর্ষণের কত দিন পরে আপনার বোনেরা ভারতে চলে যান। সাক্ষী বলেন, মুসলমান হবার পরে। আইনজীবী বলেন, পাড়েরহাটের অতুল পোদ্দারের ছেলে লক্ষ্মী পোদ্দারকে চেনেন। সাক্ষী বলেন, না। আইনজীবী বলেন, আপনার ধর্ষিতা তিন বোনই কি বিবাহিতা ছিল। সাক্ষী বলেন, বিয়ের উপযুক্ত ছিল। কিন্তু বিবাহিতা ছিল না। আইনজীবী বলেন, ওই তিন বোনের তো ভারতে বিয়ে হয়েছে। সাক্ষী বলেন, বিয়ে হয়েছে কি না বলতে পারবো না। তারা কোথায় কিভাবে আছে বলতে পারব না। বাবা-মা মারা যাওয়ার পরে ভাই টেলিগ্রাম করেছিল। আইনজীবী বলেন, আপনার বাবা-মা ভাই-বোনকে কার মাধ্যমে ভারতে পাঠিয়েছিলেন। সাক্ষী বলেন, সইজউদ্দিন নাইয়া। আইনজীবী বলেন, বাবা-মা’র মৃত্যু সংবাদ পাওয়া ছাড়া পরিবারের সঙ্গে আপনার আর কোন যোগাযোগ নেই। সাক্ষী বলেন, না। আইনজীবী বলেন, স্বাধীনতার বহু পরে বাংলাদেশে আপনার বোন মহামায়ার সঙ্গে অতুল পোদ্দারের ছেলে লক্ষ্মীকান্ত পোদ্দারের বিয়ে হয়। সাক্ষী বলেন, সত্য নয়। আইনজীবী বলেন, সাঈদী ছাড়া পাড়েরহাটের অন্য রাজাকারদের নাম বলুন। সাক্ষী বলেন, অন্য রাজাকারদের নাম জানি না। আইনজীবী বলেন, পাড়েরহাটের শান্তি কমিটির সভাপতি-সেক্রেটারির নাম বলুন। সাক্ষী বলেন, কারও নাম মনে নেই। আইনজীবী বলেন, পাড়েরহাটের মোসলেম মাওলানাকে চেনেন। সাক্ষী বলেন, দেখলে চিনতে পারি, নাম জানি না। আইনজীবী বলেন, সাঈদীকে মুক্তিযুদ্ধের কত আগে থেকে চিনতেন। সাক্ষী বলেন, এক বছর। আইনজীবী বলেন, ওই সময় সাঈদীর সন্তান ছিল। সাক্ষী বলেন, খেয়াল নেই। আইনজীবী বলেন, আপনার বাড়ি থেকে সাঈদীর বাড়ি কত দূরে ছিল। সাক্ষী বলেন, মাঝখানে ৩/৪টা ঘর। আইনজীবী বলেন, ২০০৮ সালে ভোটার  হয়েছেন তো। সাক্ষী বলেন, হ্যাঁ। আইনজীবী বলেন, ভোটার তালিকা করার সময় আপনার জন্মতারিখ লিখেছিলেন- ৮ জুলাই ১৯৬৩। সাক্ষী বলেন, ভুল বলেছি, না হয় ভুল লিখেছি। আইনজীবী বলেন, সঠিক জন্মতারিখ দিয়েই আপনি জাতীয় পরিচয়পত্র করেছেন। সাক্ষী বলেন, সত্য নয়। আইনজীবী বলেন, পরিচয়পত্রে  উল্লেখিত বয়স-তারিখ সংশোধনের জন্য আবেদন করেছিলেন। সাক্ষী বলেন, না। আইনজীবী বলেন, আপনার ওই তিন বোন ওই সময় খুব ছোট ছিল। সাক্ষী বলেন, সত্য নয়। আইনজীবী বলেন, আপনার ওই তিন বোনসহ একাত্তরে বর্তমান জিয়ানগরের কোন মহিলাই ধর্ষণের শিকার হয়নি। সাক্ষী বলেন, আমার তিন বোন ধর্ষিত হয়েছিল। আইনজীবী বলেন, শাসকদলের আনুকূল্য পেয়ে এবং আরও পাওয়ার আশায় নিজের তিন বোনের ধর্ষণ এবং ধর্মান্তরের কথা বলেছেন। সাক্ষী বলেন, সত্য নয়।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ