বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

মানুষ মানুষই।কখনও সে শুধু পুরুষ।

বৃষ্টির দিনগুলোতে ভয়াবহ একরকমের নিঃসঙ্গতা ঘিরে থাকে।বৃষ্টি নিজেই তার নিঃসঙ্গতা অবিরাম ধারায় বিষাদের সাথে প্রকাশ করে।পৃথিবীতে অমূলক ছন্দের জের তো সে নয়!হারিয়ে জয়ী হবার মানুসিকতাও তার নাই।তারপরও যেন কেউ বলতে থাকে কানের কাছে মৃদুলয়ে-থাম না একটু!কান পেতে শুন!বাস্তব জীবনকে দাও একটু বিশ্রাম!জিরিয়ে নাও মঙ্গল ধারায়।-নিতান্তই কাজ না থাকলে কেউ বের হতে চায় না এমন দিনে।স্থবির অলস সময়ের সাথে যোগ হয় আহার বিলাসিতার দুর্দান্ত সব আটপৌড়ে রেসিপি।সবকিছুর মধ্যেই খুঁজতে থাকি কাব্যিক ভিন্নতা।মন ভিজিয়ে শুধু সময়ের রস আস্বাদন করা।চোখ বুজলে অপূর্ব মহিমায় শুভ্র হয়ে যেতে থাকে ভেতরের যত কালিময় ঘুলঘুলি।

কয়েক দিন ধরে ঢাকায় বৃষ্টিপাত হচ্ছে।থেমে থেমে কখনও বা অবিরাম।কাজে কর্মে বেরও হতে হচ্ছে তার মধ্যে।হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল অনেকদিন আগের এক বৃষ্টিস্নাত রাতের কথা।বেশ কয়েক বছর আগের এক বিকালে মন ভিষন খারাপ হয়ে গেল।আমি রাজশাহীতে।তারিখটা ১৪ আগস্ট।তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়ি যাব।বৃষ্টির মধ্যে রাজশাহী থেকে ডাইরেক্ট বগুড়ার বাসে উঠে পড়লাম।মুষল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে যার কারণে বাসও ঢিমে তালে সাবধানেই চলছে।যখন নাটোর পৌঁছালাম তখন দেখি রাত সাড়ে নয়টা বাজে।এমন সময় বাস ড্রাইভার ঘোষনা দিলেন বাস আর যাবে না কারণ অধিকাংশ যাত্রি নাটোরের যারা নেমে গেছেন।অতিরিক্ত ৫/৭ জন যাত্রি বহন করে তিনি গাড়ি চালাতে চান না।মাথায় রীতিমত বাজ পড়ল।নাটোর থেকে আরও ৪০ কি.মি গেলে তবেই আমার বাড়ি।বগুড়াগামী কয়েকজন যাত্রী নেমে গেল বাস থেকে।জিজ্ঞাসা করলাম- এখন কি করবেন?হোটেলে থাকতে হবে উপায় নাই।কোন গাড়িও তো চলছে না।আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ফুপুর বাসায় গিয়ে উঠব।বাস থেকে নেমে দেখি কোন রিক্সা নেই।দুই একটা যা আছে তারা আমার গন্তব্যে যেতে কেউ রাজি না।এখন সবারই বাড়ি ফেরার সময়।এই গোলযোগপূর্ণ আবহাওয়ায় প্যাসেঞ্জারের কাছ থেকে বাড়তি খসিয়ে উপার্জনের চিন্তা কোন রিক্সাওয়ালার মধ্যে দেখতে পাচ্ছি না।খেয়াল করলাম বাসের পড়ে থাকা যাত্রীদের মধ্যে আমি বাদে বাকি কয়েকজন যাত্রী একে ওপরের আত্মীয়।তিনজন মেয়ে দুইজন ছেলে।দুই ছেলে দৌঁড়াদৌঁড়ি করে দুইটা রিক্সা ঠিক করে ফেলল।আর আমি!ওপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়,পাড়ে লয়ে যাও আমায়--এই ভঙ্গিতে কি করি কারে বলি- শুধু ভাবছি। বাক্স পেটরা নিয়ে দৌঁড়াদৌঁড়িও করতে পারছি না।মোবাইল ফোন তখন অভিজাত শ্রেণীর পয়সাওয়ালারা ব্যবহার করে।আমাদের নাগালের বাইরে।সুতরাং ফোন করে কাউকে বিপদের কথা জানাতেও পারছি না আবার সাহায্যও চাইতে পারছি না।দুই ছেলের একজন আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল--আমরা হোটেলে গিয়ে থাকব।সাথে আমার তিন ভাগ্নি আছে।ওদেরকে রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়াতে নিয়ে এসেছিলাম।আপনি ইচ্ছে করলে ওদের সাথে আজ থাকতে পারেন।আমি তড়িঘড়ি করে বললাম-ভাইয়া এখানে আমার ফুপুর বাসা আছে।উনি উত্তর করলেন- তাহলে তো খুব ভাল হল আপনার জন্য।একটা রিক্সা ধরে চলে যান যত তাড়াতাড়ি পারেন।বাসস্ট্যান্ড একদম ফাঁকা।বিপদে পড়তে পারেন।আমার তখন দিশেহারা অবস্থা।উনারা চলে গেলে আমি পুরো একা এই এলাকায়।ওই বৃষ্টির ভেতর হেঁটে হেঁটে যে রওনা দেব সে রকম সাহসী যোগ্যতাও আমার নাই।নিরুপায় হয়ে বললাম ভাইয়া আমাকে একটু পৌঁছে দেবেন আমার ফুপুর বাসায়।তার রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে।ভাগ্নিরা ডাকাডাকি করছে-মামা তাড়াতাড়ি আস কাকভেজা হয়ে গেলাম।উনি আমাকে অভয় দিয়ে বললেন ঠিক আছে আমি তাহলে ওদের সাথে কথা বলে আসি।আমি তাকিয়ে আছি উনার প্রস্থানের দিকে।আমার থেকে বিশ গজ দুরে রিক্সায় বসা ভাগ্নিদের সাথে কথা বলছেন।এমন সময় একটা লোক কোথায় থেকে উদয় হল টের পাইনি,আমার সামনে এসে দাঁড়াল।আমার উদ্দেশ্যে বলল-কত টাকা?আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম -কিসের কত টাকা?সে আবার জিজ্ঞাসা করল -কত টাকায় যাবেন?আমি এবার বুঝে তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম -আপনিই কত টাকা নেবেন বলেন।আমি শুকুলপট্টি যাব।আপনার রিক্সা কোথায়?আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম কোন রিক্সা চোখে পড়ল না।এমন সময় আমার সেই হিতৈশী জোড়ে কথা বলে উঠল আগন্তক ব্যক্তির উদ্দেশ্যে।।এই কে তুমি?কি করছো এখানে?আগন্তক চোখের নিমেষে উধাও হয়ে গেল।আমি বললাম উনি টাকার কথা বলছেন অথচ দেখেন সাথে রিক্সা নেই।তারপর উনি পুরো ঘটনাটা শুনলেন।শুনে আমাকে বললেন- ভাই আপনি তো দেখি কিছুই বুঝেননি!অর্থটা আপনাকে বুঝানো আমার পক্ষে সম্ভব না।তাহলে যে পুরুষ হিসাবে আমাকেও দোষী সাব্যাস্ত করবেন আপনি!

যা বুঝার বাকি ছিল বুঝে গেলাম।বৃষ্টির ভেতর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল লবনাক্ত বৃষ্টি।নিজেকে কি যে হীনমন্য লাগছিল-বোঝাতে পারব না!ওই বয়সে এরকম অসম্মানজনক পরিস্থিতি আমাকে মোকাবেলা করতে হয়নি।এই নির্দিষ্ট শ্রেণীর পেশাজীবিদের উপর আমার প্রচন্ড ঘৃনা কাজ করত।মুরব্বীদের কাছে শুনে এই নিকৃষ্ট পেশার মানুষদের প্রতি ঘৃনাটা তৈরী হয়েছিল।তাদের এই পেশায় আসার পেছনের বৃত্তান্ত নিয়ে ওই বয়সে কখনও চিন্তা করিনি তাই সমবেদনাও নাই এতটুকু।
আপনার কি মন খারাপ হল?প্রশ্ন শুনে ধরা গলায় বললাম-নাহ্।ভাল যে বৃষ্টি হচ্ছিল তাই কান্নাটা লুকানোর চেষ্টা করতে হল না।
চলুন রিক্সায় উঠুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।উনি আরেকবার ভাগ্নিদের রিক্সার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললেন -তোমরা ওই হোটেলে যাও(কোন একটা হোটেলের নাম উল্লেখ করে ,হোটেলের নাম মনে নেই),আমি ৩০ মিনিটের মধ্যে চলে আসব।উনি পরম স্নেহে আমাকে আমার ফুপুর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেলেন।আমাকে ওত রাত্রে এই অবস্থায় দেখে ফুপুর বাড়ির সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন।এই ফাঁকে আমার সেই হিতৈশী বিদায় নিলেন।কথা বলার কোন সুযোগ হল না।তাকে ধন্যবাদ বলতে ভুলে গেলাম সবার ভীড়ে। কিছুক্ষন পর আমার মনে পড়ল আমি রিক্সা ভাড়াটা দেইনি এমনকি তার নামটাও একবারের জন্য জানতে চাইনি।নাম ঠিকানা টা জানা খুবই উচিত ছিল।চিঠি লিখে ধন্যবাদ টা জানাতে পারতাম।

কিছুটা প্রাসঙ্গিক আরেকটা ঘটনা মনে পড়ে গেল।আমি কৈশোরে যে মফশ্বল শহরে বসবাস করতাম সেখানে আমার উপরিল্লিখিত ঘৃনিত পেশাজীবির একজনকে চিনতাম।সবার কাছেই সে ওই নিকৃষ্ট পরিচয়েই পরিচিত।একই এলাকায় বসবাসের কারণে বিভিন্ন সময়ে সে সাহায্যের জন্য এ বাড়ি সে বাড়ি যেত তাই দেখাও হয়ে যেত তার সাথে মাঝে সাঝে।তাকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে সে সব খোলাখুলি বলত।এভাবেই আমি তার এই জীবনে আসার কাহিনী জানতে পারি।তারপর থেকে মানুষের জীবনের বিভিন্ন টানাপোড়েন,ঘাত প্রতিঘাত,অপারগতা,দায়বদ্ধতা সম্মন্ধে জানতে আগ্রহী হয়েছি,হয়ত কিছুটা বুঝতেও শিখেছি। সমাজের চোখে ঘৃনিত সেই মানুষটির নাম ছিল মোনো।স্কুল কলেজে যাতায়াত কালে প্রায়ই তাকে চোখে পড়ত।আমরা সবাই চোখ সরিয়ে চলতাম।সেই মানুষটি কোন অজানা কারণে আমাকে খুব পছন্দ করত।আমাকে মা সম্মোধনে ডাকতো। আমার মাকে বলতো ভাবী আপনার এই মেয়েটিকে আমার খুব ভাল লাগে।ভাবী কাল একটা সিনেমা দেখলাম-পড়ে না চোখের পলক,কি তোমার রুপের ঝলক-একটা গান আছে সিনেমায়।নায়িকা আপনার মেয়ের মত দেখতে।আমার অপরিপক্ক বয়সকালে তার মুখে এই স্তুতিবাক্য শুনে নিজের প্রতি খুব রাগ হত।মনে হত দুনিয়ার আর কারও ভাল লাগলো না ওই বদটার চোখে আমাকে নায়িকা লাগলো!ধিক্কার দিতাম ওকে।আহা!অন্য কেউ বললে প্রতিক্রিয়া টা কতই না মহিমামন্ডিত হত!

একদিন সন্ধ্যে বেলায় মামা বাড়ি যাওয়ার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি।আব্বু রিক্সা ডাকতে একটু সামনে গেছেন।আর আমি রাস্তা থেকে নেমে একটু অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছি।বিষয়টা আসলে এরকম-স্ট্রীটলাইটের আলোয় দাঁড়িয়ে আছি,কেমন বোকা বোকা লাগছে।যে-ই পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সে-ই তাকিয়ে দেখছে।পরিচিত ছোট্ট মফশ্বল এলাকা।মোটামুটি সবাই কমবেশি চেনে।মা ভাল আছ?কোথায় যাও?সাথে কে আছে?এই জাতীয় প্রশ্নের হাত থেকে বাঁচার জন্যে আলো থেকে সরে দাঁড়িয়েছি।হঠাৎ কে যেন হাতের কব্জি ধরে এক ঝটকা দিয়ে টেনে সামনে আলোতে এনে দাঁড় করালো।আমি স্তম্ভিত ঘটনার আকস্মিকতায়।মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি মোনো।আমাকে তখন সে বলছে- শোন্ মা আর কখনও অন্ধকারে দাঁড়াবু না।অন্ধকারে কেডা দাঁড়ায় জানিস!এই আমার মত ঘরছাড়া রাস্তার মানুষ।এরপর থেকে রাস্তায় দাঁড়ালে কখনও অন্ধকারে দাঁড়াতে পারিনি।মোনোর কথাটা মনে হয়ে যেত।এটা হয়ত একশ্রেণীর পুরুষদের প্রতি বীতশ্রদ্ধা থেকেও হবে ।যে বীতশ্রদ্ধাটা মনের ভেতরে ঘৃনাভরে মোনোও লালন করত।
আমি মানুষকে মানুষ ভাবতে পছন্দ করি।তারপরও মানুষের পুরুষ রুপ দেখতে হয় খুব হীনভাবে।লজ্জা পাই শ্রদ্ধা করতে না পেরে।লজ্জার দায়ভার নিশ্চয়ই আমার না!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ