সোমবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১২

ছাত্ররাজনীতি নিয়ে কিছু ভাবনা

আমেরিকার এক কৃষক বলেছিল,"আর্মি যদি আজ ক্ষমতা দখল করে নেয় তাহলে কাল থেকে আমি আর খামারে কাজ করব না।"। ভেবে লজ্জা পাই,একজন আমেরিকান কৃষকের যেই রাজনীতি সচেতনতা তা আমাদের সুশিক্ষিত মানুষদের মধ্যেও দেখা যায় না। একজন আর্মি জেনারেল যে জনগনের সেবায় নিয়োজিত একজন উচ্চদায়িত্বশীল কেরানী সে কথা আমাদের বোধে আসে না। বাঙ্গালির ইতিহাসে বাঙালি কখনো শাসন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়ার স্বাদ পায় নি,কখনো পাল,কখনো তুর্কী,কখনো মুঘল,কখনো ব্রিটিশরা শাসন করেছে। পাকিস্তান আমলে তবু কিছু অভিজাত বাঙালি সেই স্বাদ পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা এতটাই অভিজাত ছিলেন যে তাঁদের মাতৃভাষা ছিল উর্দু(অনেকেই নিশ্চয় জানেন,হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মাতৃভাষা উর্দু,বাংলা নয়)।একাত্তরে পতাকা আমরা পেয়েছি বটে, তবে আমাদের হৃদয়ের সেই দীনতা আজও কাটে নি। বিশজনের একটা সংগঠনে সভা ডাকা হলে ১৮ জনকেই ডেকে আনতে হয়,১০ জন শেষপর্যন্ত উপস্থিত থাকেনই না। আমরা গনতন্ত্র চাই, অথচ গনতন্ত্রের মূলসূতিকাগার যে গ্রীসের নগররাষ্ট্র ব্যবস্থা,সে ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের কোন চিন্তন আসে না। আমাদের সবার ধারনা, কেউ না কেউ আমাদের সুশাসন উপহার দেবে, আর আমরা টাকা কামাব, খেলা দেখব,মুভি দেখব, গান শুনব,হৈ হুল্লোড় করব, বউ-বাচ্চা-বাবা-মা নিয়ে সংসার করব।অনেক টাকা কামাবো,শেষ বয়সে এসে নির্বাচন করব-এমন ভাবনাও আমাদের মধ্যে বিরল নয়!! আরেকশ্রেনী রাজনীতি করে,তবে কোনভাবেই শাসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না,সে কেবল কতিপয় লোকের চামচামি করে এবং এরই বদৌলতে প্রচুর লোকের উপর গুন্ডামির সুবিধা ভোগ করে। ছাত্ররাজনীতির মূল উদ্দেশ্য,রাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় গোষ্ঠী যেন রাষ্ট্রের শাসন প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকে,তাঁদের নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা বিকশিত হয়। কিন্তু ভুলে ভরা শিক্ষাব্যবস্থা(আশার কথা, এখন প্রাইমারী স্কুলেও ছাত্র সংসদ চালু হয়েছে) আর আদর্শহীন পরিবার-সমাজের কারণে তরুনদের কাছে সে ম্যাসেজ পৌছায় না,সবাই স্মার্ট উপায়ে টাকা কামাইয়ে দক্ষ হওয়ার স্বপ্ন দেখায় তরুনদের। ফলে ভালো ছেলেরা রাজনীতিতে আসছে না, আর যারা আসছে তাঁরা স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে আসছে। অথচ এমনটা হবার কথা ছিল না। 

অনেকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সব রক্তারক্তি দেখতে এসেছি? বাবার কোলে যে শিশুটি গুলি খেয়ে মরেছে সে কি মরবার সাধে বাবার কোলে উঠেছিল? পেট্রোল বোমার আগুনে পুড়ে ছাই হবার জন্য নিশ্চয় বাসে উঠেননি সিলেটের কাজী নাসির? কুয়েটে দেখেছি, পাশের গ্রাম খানাবাড়িতে যখন লোডশেডিং চলছে তখন ছাত্ররা ফ্লাডলাইটের আলোয় সারারাত ধরে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলেছে।পুরোদেশ যেখানে অনিরাপদ সেখানে নিজে নিজে ভালো থাকবার খায়েশ ভালো না। গান্ধীজী যে সাতটি ভয়ানক পাপের কথা বলেছেন, তার অন্যতম 'বিবেকহীন উপভোগ'।

অনেকেই বলে থাকেন,ছাত্ররাজনীতি আমাদের কিছুই দেয় নি। তাঁরা আসলে ইতিহাসের অআকখ ও জানে না, নিজের চোখে যতটুকু দেখেছে ততটুকুই তাঁদের জ্ঞান। আজকের জাতীয় রাজনীতিতে যতটুকু শুভশক্তি পুরোটাই ছাত্ররাজনীতির ফসল। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আর কৃষিমন্ত্রী মতিয়া দুজনেই ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে উঠে এসেছেন। এছাড়াও অনেকেই আছেন, দেশের জন্য তাঁদের শুভচেষ্টা আমাদের চোখে পড়ে না কিন্তু তাঁরা না থাকলে বুঝা যেত তাঁদের উপস্থিতি কতটা গুরুত্বপূর্ন, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কাদম্বিনীকে মরিয়াই প্রমান করিতে হইবে কাদম্বিনী মরে নাই। আর ছাত্ররাজনীতির ফসল শুধু রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না,এদেশেও থাকে নি, সাংবাদিকতা,শিক্ষকতা,বিচারবিভাগ সবক্ষেত্রে তা ছড়িয়ে পরেছে,বিশ্বাস না হলে সমসাময়িক ইতিহাস ঘেটে দেখুন। 

আইনত কুমিল্লা ভার্সিটি,বেগম রোকেয়া ভার্সিটিতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ,তাই বলে কি সেখানে সরকারী গুন্ডাদের গুণ্ডামি থেমে আছে? ’৭৩ এ ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ যখন বামফ্রন্টের কাছে হারতে হারতেও চুরি করে জিতে যায়,তখনোই এদেশে ছাত্ররাজনীতির শুভশক্তি পরীক্ষিত হয়ে গিয়েছিল।এরপর রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাত্ররাজনীতির স্বাধীন বিকাশ মেনে নেয় নি, ছাত্র সংসদগুলোকে অকার্যকর করে তাঁরা অনুগত কর্মীবাহিনী গড়ে তুলেছে। তাই যারা ছাত্ররাজনীতিকে ক্ষমতাধরদের হাতিয়ার মনে করেন,তারা ভুল জানেন। ছাত্ররাজনীতি সব সময়ই রাজনৈতিক নেতৃত্বের জবাবদিহিতা চেয়েছে,চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। 

সিরিয়ায় রাজনীতি নিষিদ্ধ নয় তবে ১৯৬৪ সালের পর থেকে সেখানে কোন নির্বাচন হয় নি।মিশরেও একই অবস্থা ছিল।এদেশের ভার্সিটিগুলোতে ছাত্ররাজনীতির সেই অবস্থা। আমাদের সব ভার্সিটিতে ছাত্ররাজনীতি সিরিয়ার রাজনীতির মত রুদ্ধ হয়েই আছে। আইনত নিষিদ্ধ না হলেও ছাত্র সংসদ অকার্যকর। গনতন্ত্রের স্বার্থে কি আমরা নির্বাচন কমিশন বন্ধের দাবি জানিয়েছি,সে যতই দলীয়করন করা হয়ে থাকুক?সুপ্রীমকোর্টে দলীয়করন হয়েছে তাই বলে কি আমরা সুপ্রীমকোর্ট বন্ধের কথা বলি? বলিনা,আমরা এদের সংস্কারের কথা বলি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সংস্কার প্রয়োজন। আমরা কেন স্বাধীনভাবে ভিসি নিয়োগের কথা বলি না?স্বাধীনভাবে রেজিস্ট্রার নিয়োগের কথা বলি না?

বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয় এরপর ছাত্রভর্তি করা হয়।বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির অশুভ প্রভাব ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে শুরু হয় না, দলীয় প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ভিসি নিয়োগের মাধ্যমে শুরু হয়।দুঃখজনক হলেও সত্যি,এই সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলি আমাদের চোখে পড়ে না। বিশ্ববিদ্যালয়কে দলীয়রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখতে হলে এইধরনের রাজনৈতিক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে। অসুখ যখন শেকড়ে, ডালপালার শত চিকিৎসাতেও কোন সুফল আসবে না। 

প্রকৃতি কখনো শুন্যস্থান সহ্য করে না। ছাত্ররাজনীতি না থাকলে কি হবে? দেশে তো রাজনীতি বন্ধ থাকবে না। তাহলে রাজনীতি করবে কে?মন্ত্রী হবে কে? মন্ত্রী হবে শাহজান খানের মত পরিবহন শ্রমিক নেতারা,আবুল হোসেনের মত ব্যবসায়ীরা,গওহর রিজভীর মত বিদেশী দালালরা । আর এদের দেশ পরিচালনা যখন মানুষের পছন্দ হবে না তখন ঘটবে সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জনগন যাদের নিয়োগ দিয়েছে, সেই জেনারেলরা চলে আসবে নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বে,বুটের তলায় পিষ্ট হবে গনতন্ত্র।তাই গনতন্ত্রই যদি আমাদের বাসনা হয় তাহলে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের কথা না বলে এর সুস্থ চর্চার কথা ভাবা উচিত। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ