শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১২

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ না দেওয়ার কারণে আবাসন খাত চরম ঝুঁকিতে

দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যে বেহাল অবস্থায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সরকারেরই এক গোপন প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে চাপ ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে দেখা দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ না দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তে আবাসন খাত রয়েছে চরম ঝুঁকির মধ্যে। অল্প সময়েই এ খাতে তিন লাখ শ্রমিক বেকার হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ২৬৯ উপখাতের তিন কোটি মানুষ। পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করা টাকা পাচার হয়ে গেছে বিদেশে। আমদানি-রপ্তানিকারকরা সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে ধরনা দিয়েও ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানিপ্রক্রিয়া। স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যও এরই মধ্যে ১০ ভাগ কমে নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে। গত অর্থবছরে পোশাক শিল্পে কোনো কর্মসংস্থান হয়নি। এ শিল্পের সংকট কাটাতে না পারলে আগামী এক বছরে তিন থেকে পাঁচ লাখ লোক কর্মহীন হয়ে পড়বে। অন্যদিকে ছয় মাসে তিনবার জ্বালানি তেল ও সিএনজির মূল্য বৃদ্ধির কারণে গণপরিবহনের ভাড়া বেড়েছে। এতে জনমনে অসন্তোষ বাড়ছে। 
এসব বিষয়ে সতর্ক করে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে ১৪ দফা সুপারিশ করেছে সরকারের একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সংস্থাটির প্রতিবেদনে বিভিন্ন খাতের নানা দুর্বলতার কথা উঠে এলেও চামড়া রপ্তানিতে উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে।
সংস্থাটি বলছে, 'আবাসন শিল্পে স্থবিরতা, পুঁজিবাজারে আস্থাহীনতা ও ব্যাংকে তারল্য সংকট থাকলেও রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের হার এখনো সন্তোষজনক। সরকারের হাতে প্রায় ১৫ লাখ টন খাদ্য মজুদ আছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে আরো বাড়বে। তারল্য সংকট দূর করাসহ পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা এবং আবাসিক খাতে স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে পারলে আগামী ছয় থেকে ৯ মাসের মধ্যে অর্থনীতি স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসবে।' 
গোয়েন্দা সংস্থার এ প্রতিবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখা-২ থেকে গত ৪ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, শিল্প মন্ত্রণালয়, রেল মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও শ্রম মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। 
'আরব বিশ্বের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ইউরোপ, আমেরিকার অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রভাবের তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণের গোপনীয় প্রতিবেদন' শীর্ষক গোয়েন্দা প্রতিবেদনটিতে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সংকট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সংকট এবং ইউরোপের অর্থনৈতিক সংকটও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। 
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, 'দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে চাপ ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে দেখা দিচ্ছে। জ্বালানি তেলের অতিরিক্ত আমদানি ব্যয়ের চাপ পড়েছে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর। রেমিট্যান্স ও রিজার্ভ হ্রাস পেয়ে এ চাপ আরো ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। বৈদেশিক ঋণ ও বিদেশি বিনিয়োগেরও তেমন কোনো উন্নতি নেই। ভর্তুকি ব্যয় মেটাতে গিয়ে সরকারের ব্যাংক ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরেক দফা উসকে দিচ্ছে। এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে কমতে শুরু করেছে মানুষের সঞ্চয়। এর প্রভাবও পড়ছে ব্যাংক তারল্যে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বেসরকারি খাতের ঋণ বিতরণে। 
পুঁজিবাজার, ব্যাংকিং খাত ও তারল্য সংকট
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর পাশাপাশি ১০ শতাংশ উৎসে কর আরোপ করায় গত অর্থবছর থেকেই বিনিয়োগকারীরা এ খাত থেকে টাকা উত্তোলন করে শেয়ারবাজারসহ বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে। একই সঙ্গে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে মাত্রাতিরিক্তি বিনিয়োগ করে। এ কারণেই ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর শেয়ারবাজারের সাধারণ সূচক ৮৯১৮.৫১ পয়েন্টে দাঁড়ায়। তখন ওই সব অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী তাদের বিনিয়োগের টাকা বাজার থেকে তুলে নেয়। এ ছাড়াও পুঁজিবাজারে গুটিকয়েক জুয়াড়ি হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। শেয়ারবাজার ধসের এক বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধন কমেছে প্রায় ১১১ হাজার কোটি টাকা এবং সূচক কমেছে ৪০০০ পয়েন্ট। গত ২৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও বাজার এখনো অস্থিতিশীল। পুঁজিবাজার থেকে তুলে নেওয়া টাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভয়ে দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে পাচার করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। 
প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, ২০১০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক হঠাৎ করেই তফসিলি ব্যাংকগুলোর ক্যাশ রিজার্ভ অনুপাত শতকরা দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। এ সিদ্ধান্ত তারল্য সংকট ত্বরান্বিত করেছে বলে জানা যায়। এতে আরো বলা হয়েছে, বেঙ্মিকো গ্রুপসহ ২০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান শুধু জনতা ব্যাংক থেকেই ৯ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেনি। এতে সহজেই স্পষ্ট বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণখেলাপিরা কী পরিমাণ টাকা তুলে নিয়েছে। এসব টাকা ব্যাংকে ফেরত না আসা ব্যাংকে তারল্য সংকটের অন্যতম কারণ। ফলে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে বারবার ধরনা দিয়েও ঋণপত্র খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। আমদানি-রপ্তানিপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে চলছে মন্দা। দ্রুত কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। গত ২৪ মাসের মধ্যে রিজার্ভ এখন সবচেয়ে কম। ডলার সংকটের পাশাপাশি টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েই চলেছে। ২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ২০১১ সালের ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ৯ টাকা। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরো ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। 
স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য
গোয়েন্দা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবসায় নিয়োজিত অন্তত ৫০ জন খুচরা বিক্রেতার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালের তুলনায় গত ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত বাজার ও ব্যবসার পরিমাণ গড়ে ৫ থেকে ১০ শতাংশ কমে গেছে। এ হার ক্রমে কমছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তারল্য সংকটই এ জন্য দায়ী বলে খুচরা ব্যবসায়ীরা গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন।
আরব বিশ্বের রাজনৈতিক সংকট- বাংলাদেশে এর প্রভাব
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব বর্তমানে নিয়োগের নিশ্চয়তা ও মালয়েশিয়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের বৈধকরণের নিশ্চয়তা দেওয়ার পর ২০১০ সালে শ্রমিক রপ্তানির নিম্নমুখী হার এখন ঊর্ধ্বমুখী। তবে ওমান ও কাতারে জনশক্তি রপ্তানি প্রায় শূন্যের কোঠায়। বাংলাদেশি জনশক্তি আমদানির প্রতি এসব দেশের বিমুখতা ও সাম্প্রতিক সময়ে আরব বিশ্বের রাজনৈতিক সংকটের কারণে জনশক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না।
২০০৯ ও ২০১০ সালে শ্রমিক রপ্তানির হার দ্রুত কমে গেলেও রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধির হার ছিল সন্তোষজনক। কারণ আগের বছরগুলোতে শ্রমিক রপ্তানির হার ছিল বেশি। ২০১১ সালে শ্রমিক রপ্তানি বাড়লেও রেমিট্যান্সের হার সন্তোষজনক নয়। কারণ আগের দুই বছর শ্রমিক রপ্তানি ছিল কম। তবে ২০১২ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। 
গোয়েন্দারের সুপারিশ
প্রতিবেদনে ১৪ দফা সুপারিশে গোয়েন্দা সংস্থাটি বলেছে, অর্থনৈতিক মন্দার সময় বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের সহজেই বৈধভাবে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারলে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। এ ছাড়া অদক্ষ শ্রমিকদের প্রাতিষ্ঠানিক কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিকে রূপান্তরিত করে বিদেশে পাঠানোর সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। আর চীন, জাপান ও আশিয়ানভুক্ত দেশগুলো এখনো মন্দামুক্ত রয়েছে। এসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার পরামর্শ দিয়ে সংস্থাটি বলেছে, অস্ট্রেলিয়াসহ পূর্ব ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার তৈরি করতে হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমনিতেই মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। এ অবস্থায় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিতে থাকলে মূল্যস্ফীতির চাপ আরো বাড়বে। ব্যাংক থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ কোনোভাবেই যেন আর না বাড়ে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। জ্বালানি খাতের ভর্তুকি কমানোর পাশাপাশি কয়লা উত্তোলনের মাধ্যমে কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া, সরকারের ব্যয় সংকোচনসহ উচ্চাভিলাষী বাজেট প্রণয়ন না করার কথাও বলেছে সংস্থাটি। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপের অর্থনীতির মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক। তাই এই খাতকে উৎসাহিত করলে বছরে এক থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের নতুন বাজার সৃষ্টি হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ