শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১২

রাবার গাছের বুক চিরে জন্ম নেয় 'সাদা সোনা'


শীতের ভোরে কলসিভরা খেজুর রস নিয়ে গেঁয়ো গাছাদের ছন্দময় হেঁটে চলার মতোই দুধ-সাদা কষ এনে ঢালা হচ্ছে বড় বড় প্লাস্টিক ট্রেতে। পাহাড়ের বুকে বেড়ে ওঠা রাবার গাছের দেহ নিংড়ানো কষ, তরল 'সাদা সোনা' নামেই শ্রমিকরা এটিকে চেনে। পাশেই চলছে হাতে চালানো লোহার মেশিন। প্লাস্টিক ট্রেতে জমানো সাদা সাদা পাতকে রোলারের সাহায্যে আরো চ্যাপ্টা করছেন শ্রমিকরা। ব্যবসায়িক ভাষায় এর নাম রাবার শিট।
দেশের দক্ষিণ-পূর্ব ভাগের প্রান্তিক জেলা বান্দরবানের পাহাড়ি সীমানা ছাড়িয়ে এ শিট চলে যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে। 
যাচ্ছে দেশের বাইরেও। এখন বছরে প্রায় তিন হাজার টন রাবার রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশ রাবার বাগান মালিক সমিতির প্রত্যাশা, দু-এক বছর পরই বান্দরবানের রাবার বাগানগুলো থেকে বছরে ৪০ হাজার টন রাবার শিট উৎপন্ন হবে। এর অর্ধেকটাই যাবে রপ্তানি খাতে। চিংড়ি, চা ও চামড়ার পাশাপাশি বান্দরবান পার্বত্য জেলার পতিত পাহাড়ে উৎপাদিত রাবার অন্যতম রপ্তানি পণ্যের তালিকায় যুক্ত হয়ে দেশের অর্থনীতিতে যোগ করবে নতুন মাত্রা।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বান্দরবানে বর্তমানে বছরে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার আদা-হলুদ চাষ হয়। মালিক সমিতির দাবি, রাবার চাষ থেকে আসবে আরো এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। কয়েক যুগ ধরে সরকারি-বেসরকারি বনজ সম্পদ খাতে আসছে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ। উপযুক্ত পরিকল্পনা নিয়ে এসব সম্ভাবনাময় খাতের সমন্বয় ঘটানো গেলে সম্মিলিত উৎপাদন এ অঞ্চলের জীবনযাত্রার মান পাল্টে দিতে পারে দ্রুতই।
সরকারি খাসজমি লিজ নিয়ে ব্যক্তি মালিকানা ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাবার চাষ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের উঁচু ভূমি বন্দোবস্তীকরণ প্রকল্পের আওতায় রাবার উৎপাদন এবং ক্ষুদ্রায়তনের রাবার চাষের মাধ্যমে প্রান্তিক চাষিরা দেশের কৃষি খাতে এই দিনবদলের সূত্রপাত ঘটাতে যাচ্ছেন। 
রাবার বাগান মালিক সমিতির উপদেষ্টা কাজী শাহাদাত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন রাবার চাষ শুরু করি, তখন দেশের চাহিদা মেটানোই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। এখন অভ্যন্তরীণ শিল্পে কাঁচামালের চাহিদা মিটিয়ে আমাদের দৃষ্টি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দিকে।'
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যক্তি মালিকানা ও প্রাতিষ্ঠানিক খাতে ৭০০ রাবার বাগানের আংশিক উৎপাদন থেকে বর্তমানে বছরে প্রায় ২৫ হাজার টন রাবার শিট উৎপাদিত হচ্ছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ক্ষুদ্রায়তনের রাবার চাষ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের উৎপাদনকে যোগ করলে মোট উৎপাদন ৪০ হাজার টন ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী এর মূল্য এক হাজার ২০০ কোটি টাকারও বেশি। 
রাবার বাগান মালিক এ কে এম জাহাঙ্গির জানান, গাজী ট্যাংক কর্তৃপক্ষ নিজস্ব প্রয়োজনে বছরে ২৫০ টন প্রক্রিয়াকৃত রাবার আমদানি করে থাকে। পণ্য উৎপাদনের জন্য এমন আরো অনেক কম্পানিই বিদেশ থেকে রাবার আমদানি করে আসছিল। বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের চাহিদার প্রায় পুরোটাই দেশীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করছে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, কল-কারখানায় আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে শুধু রাবার খাত থেকেই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। এর জন্য দ্রুত নীতি প্রণয়ন এবং সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার বলে মনে করেন এ কে এম জাহাঙ্গির।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অনাবাদি পাহাড়ি ভূমিকে চাষের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছর থেকে রাবার চাষের জন্য ৪০ বছর মেয়াদি লিজ দেওয়া শুরু হয়। এরই মধ্যে পিএইচপি, ডানকান, মোস্তফা গ্রুপসহ দেশের খ্যাতনামা কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সাধারণ উদ্যোক্তার অনুকূলে বান্দরবানে প্রতিটি ২৫ একর ভূমিবিশিষ্ট ৮৭৩টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। 
শুরুতে আন্তর্জাতিক বাজারে রাবারের দাম কম থাকায় উৎপাদন খরচ মেটাতে না পেরে থমকে যায় এই নতুন সম্ভাবনার চলার গতি। বছর কয়েক আগেও প্রতি কেজি রাবার শিটের পাইকারি মূল্য ৮৩ থেকে ৯০ টাকায় ওঠানামা করছিল। বর্তমানে গ্রেড অনুযায়ী প্রতি কেজি রাবার শিটের দাম ২৫০ থেকে ৩৪০ টাকায় ওঠার পর বাজারের সুবাতাস পেয়ে হতাশ বাগান মালিকরা আবারও ফিরে এসেছেন রাবার উৎপাদনে। 
এ কে এম জাহাঙ্গির জানান, ২৫ একরের একটি বাগান থেকে প্রতিদিন গড়ে ১০০ কেজি প্রক্রিয়াকৃত শিট রাবার উৎপাদিত হচ্ছে। এ হিসাবে বাগানপ্রতি বার্ষিক উৎপাদন গড়ে ৩৬ টন। এর বাজারদর এক কোটি টাকারও বেশি। তিনি জানান, ২৫ একর জায়গার বাগানের জন্য গড়ে আট হাজার রাবার চারা ক্রয় ও রোপণ, প্রাথমিক পরিচর্যা ও সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণ মিলিয়ে উৎপাদন পর্যায়ে যেতে প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়। চারা লাগানোর সাত বছর পর থেকে প্রতিবছর কোটি টাকার রাবার বিক্রি করে যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান লাভবান হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান ও রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে। 
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বান্দরবান পার্বত্য জেলার সদর উপজেলা, লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় সারি সারি রাবার বাগান গড়ে উঠেছে। নাইক্ষ্যংছড়িতেই সাড়ে ১০ হাজার একর জমি রাবার চাষের আওতায় এসেছে। উপজেলার বাইশারি, তব্রু, আলেক্ষ্যং, ঈদগড়, নাইক্ষ্যংছড়ি, দোছড়ি, বাঁকখালি, রেজু, ঘুমধুম, জারুলিয়া, ভালুকখাইয়া, খোয়াই ঝিরি ও পাগলী মৌজায় ইতিমধ্যে ৪৩১টি বাগান গড়ে উঠেছে।
বান্দরবান-রাঙামাটি আঞ্চলিক মহাসড়কের গলাচিপা এলাকার রাস্তার দুই ধারে সারি সারি রাবার বাগান। নামকরা রাজনৈতিক নেতা, সংসদ সদস্য, ব্যাংকার এবং নবীন কয়েকজন উদ্যোক্তা নব্বইয়ের দশকে এসব বাগান গড়ে তোলেন। এখন এসব বাগান প্রায় পুরো উৎপাদন পর্যায়ে চলে এসেছে।
বান্দরবানের সংসদ সদস্য বীর বাহাদুর নিজেও একজন উদ্যোক্তা। ২৫ একরের তিনটি প্লট নিয়ে চেমি এলাকায় রাবার বাগান প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। তাঁর বাগান ঘুরে দেখা গেছে, বাগানের এক পাশে মাঝারি আকৃতির হস্তচালিত দুটি মেশিন বসিয়ে রাবার কস বা লেটেক্স থেকে রাবার শিট তৈরি করা হচ্ছে। 
বাগানের ম্যানেজার উ নি মং জানান, কস প্রক্রিয়াকরণ করে রাবার শিট তৈরি করা সম্ভব হলেও এখনো তাঁরা রাবার শিট শুকানোর সমস্যায় ভুগছেন। তিনি জানান, রোদনির্ভর শিট শুকানোর পরিবর্তে বিকল্প কোনো পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা করছেন তাঁরা। এটি করা গেলে তাঁদের বাগানে উৎপাদিত রাবার শিটের পণ্যমান বাড়ানো সম্ভব হয়ে উঠবে। এতে তাঁরা ভালো মূল্যও পাবেন।
এ কে এম জাহাঙ্গিরের বাগানে টেপার (রাবার গাছের বাকল কেটে কস সংগ্রহকারী) রুবেল মারমা জানান, প্রতিদিন তিনি ২২০ থেকে ২৫০টি গাছ টেপিং করেন। পরের দিন সকালে রাবার কস সংগ্রহ এবং থিতানোর পর হস্তচালিত মেশিনে রাবার শিট তৈরি করেন। এ বাবদ তাঁকে মাসে চার হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়।
রুবেল জানান, তাঁর মতো আরো দুজন টেপার ও সুপারভাইজার জসিমসহ এ বাগানের নিয়মিত দক্ষ শ্রমিক চারজন। প্রতিদিন গড়ে তিন ঘণ্টা কাজ করে বাকিটা সময় বিশ্রাম ও বিনোদনে কাটিয়ে দেন তাঁরা। বাগানে উৎপাদন বাড়লে আরো শ্রমিক লাগবে এবং তাঁদের পারিশ্রমিকও বাড়বে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ রাবার বাগান মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামকে রাবার চাষ উপযোগী ঘোষণা করে মধ্যমেয়াদি লিজ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলেও বান্দরবান বাদে অন্য দুটি জেলায় বেসরকারি উদ্যোগে রাবার বাগান কাঙ্ক্ষিত সংখ্যায় সৃজিত হয়নি। বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ছোট-বড় ৮৭৩টি বাগান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ৭০০ বাগানে উৎপাদন শুরু হয়েছে। 
সূত্র জানায়, বড় ব্যবসায়ীর পাশাপাশি বান্দরবানের প্রান্তিক কিছু চাষী তাঁদের নামে বরাদ্দ পাঁচ একর পাহাড়ি ভূমিকেও রাবার চাষের আওতায় নিয়ে এসেছেন। সাদা তরল সোনা বা রাবার উৎপাদনে তাঁরাও রাখছেন খানিকটা অবদান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ