শনিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১২

ভেন্ট্রিলোকুইজম এর ইতিহাস ও কৌশল


ভেন্ট্রিলোকুইজম এর ইতিহাস ও কৌশল

ঝলমলে রোদ। পাশে পেকটোলাস নদীর কুল কুল স্রোত বয়ে চলেছে। লিডিয়া নগরবাসীর উত্তেজনার শেষ নেই। জনারণ্যে ভেঙে পড়ছে সবুজ উপত্যকা। সামনে দেবতার মূর্তি। দেবতা আজ নাম উচ্চারণ করবে ঘৃণ্য চোরদের, যারা তার অনুমতি না নিয়ে স্বর্ণ চুরি করেছে। সন্দেহভাজন কয়েকজনকে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে উইলো গাছের সাথে নারকেলের ছোবড়ার শক্ত দড়ি দিয়ে। স্পষ্ট ভয় তাদের চোখে। গুঞ্জন বাড়ছে ক্রমেই। 
হঠাৎ থেমে গেল কোলাহল। গুরু গম্ভীর স্বরে মন্ত্র আবৃত্তি শুরু করলেন পুরোহিত, ছিটিয়ে দিলেন দেবতার গায়ে মস্ত্রঃপূত জল । প্রার্থনা করলেন অপরাধীদের নাম উচ্চারণ করতে। ধীরে ধীরে যেন শব্দ ভেসে এল দেবতার গলা থেকে। একে একে দোষীদের নাম বলে গেলেন নিশ্চল প্রাণহীন দেবতা। সেই সাথে যোগ করলেন তাদের শাস্তি। সামনের শনিবার আগুনে পুড়িয়ে মারতে হবে এদের। থামলেন দেবতা, ভক্তিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সাধারণ জনগণ, এমনকি দেশের রাজাও। ধন্য রব উঠল সারাদেশে। পুরোহিতের জয়জয়কার শুরু হলো চারদিকে। যার পুণ্যের কারনে দেবতার স্বর তারা শুনেছে। আরও দৃঢ় হলো সমাজে তার অবস্থান ।
এই সত্য ঘটনাটি ঘটে আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে গ্রীসের লিডিয়া নগরে। দেবতার মুখনিঃসৃত অমিয় বাণী আর কিছুই নয়, পুরোহিত এখানে ভেন্ট্রিলোকুইজম করেছে শব্দবিজ্ঞানের ( Accoustics ) সাধারণ কিছু সূত্র প্রয়োগ করে। অতি প্রাচীনকাল থেকে পুরোহিত ও যাদুকররা এর চর্চা করত সমাজে তাদের প্রতিপত্তি বাড়াবার ও শত্র“কে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। কারন দেবতার মুখ থেকে কোন খারাপ লোকের নাম ও কীর্তি বের হলে তাকে ঠেকাতে পারে সাধ্য কার । 
ভেন্ট্রিলোকুইজম শব্দটি এসেছে ল্যাটিন থেকে। এর অর্থ পেটের সাহায্যে কথা বলা। হিব্র“ ও মিশরীয় সভ্যতায় এ বিদ্যার সূত্রপাত। এথেন্সের ইউরিকাইস ভেন্ট্রিলোকুইজমের নামকরা শিক ছিলেন। তিনি এবং তার শিষ্যদের নাম হয়েছিল Belly Prophet । চীনের মহান দার্শনিক কনফুসিয়াস পর্যন্ত বলেছিলেন যে এদের ঐশ্বরিক মতা বিদ্যমান। সভ্য জগতের ইতিহাসে প্রথম ভেন্ট্রিলোকুইস্টের সন্ধান পাওয়া যায় ষোড়শ শতকে ফ্রান্সে। তার নাম লুইস ব্রেবেন্ট। তিনি রাজা প্রথম ফ্রান্সের ভৃত্য ছিলেন। পরে রাজদরবারে প্রায়ই এ বিদ্যায় পারদর্শী কোন লোক দেখা যেত। 
ভেন্ট্রিলোকুইজমের কলাকৌশল বেশ জটিল ও অত্যন্ত সময় সাপে। খুব দ কোন ম্যাজিশিয়ান ছাড়া এর চর্চা আজকাল দেখাই যায় না। ম্যাজিশিয়ান যখন ভেন্ট্রিলোকুইজম দেখান তখন মনে হয় অনেক দূরের অন্য কোন উৎস থেকে শব্দ ভেসে আসছে। এ কাজে সাধারণত তিনি একটি পুতুল বা ডামি ব্যবহার করেন। মুখে স্মিত হাসি, হাঁটুর উপর রাখা ডামির সাথে মৃদু খুনসুটি, এই ফাঁকে ম্যাজিশিয়ান ভেন্ট্রিলোকুইজম করেন নিঃশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ আর জিহ্বার নিয়মিত সঞ্চালন দ্বারা। 
গভীর ভাবে শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে শব্দের উচ্চারণ করা ভেন্ট্রিলোকুইজমের জন্য অত্যাবশ্যক। জিহ্বার অগ্রভাগ নড়াচড়া করে বাকি অংশটুকু গুটিয়ে রাখতে হয়। এর পরে গলার ল্যারিংস সংকুচিত হয় এবং গ্লান্টসকে ( ভোকাল কর্ডগুলোর মধ্যকার ছিদ্র ) সংকীর্ণ করে কর্ডে চাপ সৃষ্টি করে। ফলে শব্দ ঢাকা পড়ে এবং বাতাসে পরিব্যাপ্ত হয়ে মনে হয় অন্য কোন উৎস থেকে তা আসছে। সমস্ত ব্যাপারটির সময় ম্যাজিশিয়ানের ঠোঁটে কোন নড়াচড়া হয় না। 
দর্শকদের মনোযোগ অন্যদিকে ধাবিত করার জন্য ভেন্ট্রিলোকুইস্ট লুকিয়ে রাখা দড়ি ও লিভারের ( চাপ দেয়ার কাজে ব্যবহৃত এক প্রকার সরল যন্ত্র। যেমন: ঢেঁকি এক ধরনের লিভার ) সাহায্যে পুতুলটিকে নড়াচড়া করান। পুতুলের অঙ্গভঙ্গির প্রত্যুত্তরে তিনি মুখে ধরে রাখেন আকর্ণ বিস্মৃত হাসি। ফলে ঠোঁটে যথেষ্ট ফাঁক থাকে, এতে ঠোঁটের নড়াচড়া ছাড়াই শব্দ বেরোতে পারে ভেতর থেকে। 
ভেন্ট্রিলোকুইস্টকে শব্দ উচ্চারণের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। স্বরবর্ণগুলো ঠোঁটের নড়াচড়া ছাড়াই উচ্চারণ করা যায় । কিন্তু তিনি কখনই ( ব, ম, প ) এ তিনটি ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারেন না। ফলে বাবা, মামা, পেপার ইত্যাদি শব্দ তার পে সাধারণত উচ্চারণ করা সম্ভব হয় না। এখানেও তাকে বুদ্ধির আশ্রয় নিতে হয় । তিনি একারনে ছোট শিশুর ডামি ব্যবহার করেন। যেন মনে হয় শিশুটি সব কথা এখনও উচ্চারণ করতে শেখেনি । তাই তাদের মুখে আধো আধো বোলকেই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। দর্শকবৃন্দও ভেন্ট্রিলোকুইস্টের উচ্চারণজনিত অসুবিধাকে শিশুদের সাধারন স্বরজড়তা বলে মনে করেন। 
একটু বেশি দূর থেকে শব্দ ভাসিয়ে আনার জন্য জিহ্বার অগ্রভাগ দিয়ে মুখের তালুতে জোরে আঘাত করা হয়। অনেক সময় শব্দকে কোন আবদ্ধ জায়গা, যেমন কফিনের ভেতর থেকে আনার জন্য ইচ্ছে করেই গভীর ও খসখসে শব্দ উচ্চারণ করা হয়। তাদের এ বিদ্যা এতই চমকপ্রদ যে, অত্যন্ত দ কুকুরকে দিয়ে পরীা করে দেখা গেছে যে, কুকুর শব্দ উৎস সন্ধানে ম্যাজিশিয়ানের কাছে না গিয়ে ডামি কিংবা কফিনের কাছে গিয়ে গন্ধ শুঁকছে। 
প্রাণীজগতেও ভেন্ট্রিলোকুইজমের প্রয়োগ দেখা যায়। কানাডাতে একশ্রেণীর খরগোশ আছে যারা শিকারী দেখলে এ কাজ করে দূরের খরগোশকে সতর্ক করে দেয়। এছাড়া সকলে একত্রিত হয়ে ভেন্ট্রিলোকুইজমের সাহায্যে শব্দকে অন্যদিক থেকে ভাসিয়ে এনে শিকারীকে ভুল পথে পরিচালিত করে। আত্মরার জন্য এ দৃষ্টান্ত আরও কিছু প্রাণীর মধ্যে দেখা যায়।
এককালে গ্রীস ও মিশর ছাড়া ভারত ও চীনে এটা অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু আজ মুষ্টিমেয় কিছু যাদুকর ছাড়া এ বিদ্যার চর্চা প্রায় কেউই করে না। তবে এখনও নিউজিল্যান্ডের মাওরি, দণি আফ্রিকার জুলু ও উত্তর আমেরিকার এস্কিমোদের মাধ্যমে এ অসাধারণ বিদ্যা চর্চার ধারা টিকে আছে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ