শনিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১২

আচ্ছা দাদা, নূহের নৌকাটা কত বড় ছিল?”

- আচ্ছা দাদা, নূহের নৌকাটা কত বড় ছিল? অতগুলো মানুষ, জন্তু-জানোয়ার একটা নৌকাতে কিভাবে আঁটল? একজোড়া তিমি আর দুটো হাতি হলেই তো নৌকা ডুবু ডুবু হবে তাই নয় কি? 
- আমিও তাই ভাবতাম। সেদিন একই প্রশ্ন করেছিলাম মুন্সি কাকার কাছে। আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম এবার মুন্সি কাকা বুঝি নয়-ছয় কিছু বুঝিয়ে দিবে আর না হয় টাল-বাহানা করে আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবে। 
- মুন্সি কাকা কি বললেন... 
- যা বলেছেন তা যদি আগে জানতাম তাহলে কি এমন বোকা বোকা প্রশ্ন করে বসতাম! আমার সত্যভূটাও আমাকে কোনোদিন বলেনি... 
- কি বলেছেন... সেটা তো বল আগে... 
- মুন্সি কাকা আমার প্রশ্নটা ভালোমত না শুনেই উঠে দাঁড়ালেন। একটু বাদে সামনের দিকে হাঁটা দিলেন। আমিও কোনো কথা না বলে কাকার পিছন পিছন চলতে লাগলাম। মনে মনে ভাবলাম মুন্সি কাকা আমার অবান্তর প্রশ্নে চটে গেছেন বুঝি। আমিও নাছোড় বান্দা ছিলাম, প্রশ্নের জবাব না নিয়ে ক্ষ্যান্ত হচ্ছি না আজ। কয়েক কদম আগ বাড়িয়ে আবার মুন্সি কাকাকে একই প্রশ্ন করলাম বানিয়ে-ছানিয়ে। এবারও কাকা কিছু বললেন না। ততক্ষণে আমরা হাঁটতে হাঁটতে গুয়াবাড়ি ছেড়ে কোকতারায় পেঁৗছে গেছি। হঠাৎই কাকা আমাকে প্রশ্ন করে বসলেন- আচ্ছা অমিত, বলতে পার, পৃথিবীতে প্রথম মানুষ কখন এসেছিল? 
- আমি তো বোকা সেজে গেলাম। কাকাকে বুঝতেই দিলাম না। চট করে বলে ফেললাম- এ আবার কঠিন কি? বাইবেলর মতে ১৯৭৫ সালের হিব্রু ক্যালেন্ডার অনুসারে ৫৭৩৬ বছর আগে। 
- কাকা মৃদু হেসে বললেন, তাহলে তোমরা যে দেব-দেবীর আরাধনা কর তারা তো খুববেশি পুরাতন নয়। তাছাড়া তোমাদের শাস্ত্র অনুয়ায়ী মোট দেব-দেবীর সংখ্যা সাড়ে তেত্রিশ কোটি। ভেবে দেখ, এই সল্প সময়ে সাড়ে তেত্রিশ কোটি দেব-দেবী কিভাবে পৃথিবীতে আসবেন? প্রত্যেকদিন গড়ে ১৬০ জন করে আসলেও মোট ৫৭৩৬ বছর লাগবে। সে হিসাবে গতকালও পৃথিবীতে ১৬০ জন দেব-দেবীর আসার কথা ছিল তাই নয় কি? আর যদি বল দেব-দেবীরা এসেছিলেন পৃথিবীতে মানুষ আসার আগে? তাহলে তো পুরা ধর্মটাই পাল্টে গেল। কারণ, দেব-দেবীরা পৃথিবীতে এসেছিলেন মানুষকে পথ দেখানোর জন্য, কৃষ্ণ বল আর রামই বল; তাদরে বসবাস তো মানুষের মাঝেই ছিল? 
- তাহলে কি বাইবেলের কথাটা মিথ্যা? 
- ঠিক তাই...বাইবেলর কথাগুলো মিথ্যা ছিল না। যুগে যুগে মানুষ বাইবেলের কথাগুলো অদল-বদল করে বাইবেলের মধ্যে মিথ্যা ঢুকিয়ে দিয়েছে। মাইক্রোসফট এ্যানকার্টার লেখকবৃন্দ এবং নাসার বিজ্ঞানীদের মতে মানুষ প্রথম আগুনের ব্যবহার শিখেছে আজ থেকে আনুমানিক পাঁচ লক্ষ বছর আগে। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানও বলতে পারেনি আদৌও কখন সৃষ্টি করা হয়েছে পৃথিবী এবং কখন থেকে পৃথিবীতে মানুষ বসবাস করতে শুরু করেছে। 
- তাহলে কি মনুই পৃথিবীতে প্রথম এসেছিলেন? আমি তো এমনটিই জানি। 
- তোমাদের শাস্ত্র অনুসারে মনু হলেন এমন একজন দেবতা যার সময় প্রবল বন্যা হয়েছি। আমাদের একজন পয়গাম্বর ছিলেন যার নাম নূহ, তাঁর সময়ে প্রবল বন্যার ঘটনা ঘটেছিল। তোমাদের কিছু গ্রন্থে পাওয়া যায় মনু বলতে নূহকেই বোঝানো হয়েছে। কিন্তু মনু বা নূহ পৃথিবীর প্রথম মানুষ ছিলেন না। 
- আমি তো মনু সংহিতায় দেখেছি 


দ্বিধা কৃত্বাত্মনো দেহমর্ধেন পুরুষোহভবৎ। 
অর্ধেন নারী তস্যাং স বিরাজমসৃজৎ প্রভুঃ \\ ৩২ \\ 


অর্থ : সেই প্রভু নিজ দেহ দ্বিধা বিভক্ত করে অর্ধভাগে পুরুষ হলেন, (অপর) অর্ধেক হল নারী; তাতে তিনি বিরাট (পুরুষকে) সৃষ্টি করলেন। \\ ৩২ \\ 


তপস্তপত্বাসৃজদযন্তু স স্বয়ং পুরুষো বিরাট্। 
তং মাং বিত্তাস্য সর্বস্য স্রষ্টারং দ্বিজসত্তমাঃ \\ ৩৩ \\ 


অর্থ : হে ব্রাহ্মণগণ, সেই বিরাট পুরুষ তপস্যা করে যাকে সৃষ্টি করেছিলেন, সকলের স্রষ্টা আমাকে (অর্থাৎ মনুকে) তিনি বলে জানুন। \\ ৩৩ \\ 
অহং প্রজাঃ সিসৃক্ষুস্তু তপস্তপত্বা সুদুশ্চরম। 
পীতন প্রজানামসৃজং মহর্ষীনাদিতো দশ \\ ৩৪ \\ 


অর্থ : আমি (মনু) লোক সৃষ্টি করতে ইচ্ছুক হয়ে অতি কঠোর তপস্যা করে প্রথম থেকে দশ জন প্রজাপতি মহর্ষিকে সৃষ্টি করেছিলাম। \\ ৩৪ \\ 
(মনুসংহিতা -প্রথম অধ্যায়, পৃষ্ঠাঃ ৪৬, মূল সংস্কৃত মনু, অনুবাদ সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়) 


- তা বেশ লিখেছে মনুসংহিতা। এখন তুমিই চিন্তা করে দেখ, প্রথমে প্রভু পুরুষ ও নারী সৃষ্টি করলেন; প্রভু যে বিরাটাকার পুরুষটা সৃষ্টি করলেন সেই পুরুষ মনুকে পয়দা করলেন, পরে সেই মনু অপর দশজন মহর্ষিকে পয়দা (পয়দা করা অর্থ জন্ম দেওয়া আর জন্ম বিস্তারের প্রথা তো কমবেশি সব জীবের মধ্যেই প্রচলিত আছে) করলেন। মনুসংহিতায় বলছে মনু প্রথম মানুষ নয়, মনুর পূর্বেও মানুষ ছিল। এবং যে মানুষটা মনুকে পয়দা করেছিলেন সেই মানুষটার সৃষ্টিকর্তা ছিলেন স্বয়ংপ্রভু। মনু বা নূহের পূর্বে যিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন তিনি ছিলেন আদম। আদম আরবি শব্দ যার অর্থ মানুষ। আর আদম হতে নূহের সময়কাল ১০৫৬ বছর (ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত রাসূল সঃ বলেছেন- আদম থেকে নূহ আঃ এর সময়ের ব্যবধান দশ শ’ বছর।- সহী বুখারী শরীফ)। আদমের মৃত্যুর ১৪৬ বছর পর নূহ বা মনু পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন (আদমের সন্তানদের থেকে, সুতরাং নূহ বা মনু ছিলেন আদমজাত সন্তান, উল্লেখ্যঃ আদম বেঁচে ছিলেন ৯১০ বছর। সুতরাং ৯১০ বছর + ১৪৬ বছর = ১০৫৬ বছর)। আগেই বলেছি পৃথিবীতে কখন মানুষ এসেছিল এখনো তা মানুষের কাছে অজানা এবং এ নিয়ে অনেক মত-বিরোধও রয়েছে। কারণ বিজ্ঞান এমনও নমুনা খুঁজে পেয়েছে যা মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পূর্বের। সুতরাং যখনই পৃথিবীতে মানুষ আসুক না কেন তা নিশ্চয় বাইবেলের দু' দশহাজার বছর আগের কথা নয়। হতে পারে সহস্র লক্ষ কিংবা কোটি অথবা মিলিয়ন-বিলিয়ন বছর আগে মানুষ পৃথিবীতে এসেছে। আর সেই অনুসারে নূহ বা মনু এসেছিল শুরুর দিকের। আর সেই সময় পৃথিবীতে মানুষও ছিল অল্প সংখ্যক। হযরত মুহাম্মদ সঃ যাকে তোমাদের ধর্ম শাস্ত্র কল্কি অবতার বলে থাকে, তিনি ব্যতীত সকল পয়গাম্বর ছিলেন তার নিজ সম্প্রদায়ের জন্য এবং তারা সকলেই ছিলেন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বিশেষের পয়গম্বর বা নেতা। তেমনি নূহ যে অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন (মতান্তরে ইরাক অথবা তার পার্শ্ববর্তী এলাকা), তিনি ছিলেন সেই নির্দিষ্ট অঞ্চলের সম্প্রদায়ের পয়গাম্বর। নূহের সম্প্রদায়ের গুটি কতক লোক নূহের অনুসারী ছিলেন। বরং তাদের অধিকাংশই ছিল নূহের প্রভুর অবাধ্য। নূহ যখন অবাধ্য সম্প্রদায়ের জন্য প্রভুর তরফ থেকে আযাবের আকাঙ্খা করলেন তখন তাঁর প্রভু নূহকে আদেশ করলেন একটি বৃহৎ আকারের জলযান তৈরি করতে এবং প্লাবনের পূর্ব মুহূর্তে তাঁর অনুসারী এবং কতিপয় জীব-জন্তু জোড়ায় জোড়ায় নৌকাতে তুলে নিতে। নূহ তাঁর প্রভুর আদেশ পালন করলেন। এ পর্যায়ে তোমার প্রশ্ন ছিল এত মানুষ, জীব-জন্তু কিভাবে নূহের নৌকাতে আঁটল? 


প্রথমতঃ নূহের নৌকা কত বড় ছিল? 
ঐতিহাসিক এবং বৈজ্ঞানিক পর্যলোচনা থেকে পাওয়া যায় নূহের নৌকার দৈর্ঘ্য ছিল ৩০০ কিউবিট (১ কিউবিট = ২২ ইঞ্চি) অর্থাৎ ৫৫০ ফুট (১৬৫ মিটার) এবং প্রস্থ ছিল ৩০ কিউবিট অর্থাৎ ৫৫ ফুট (১৬.৫ মিটার)। [সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা নূহের নৌকার নমুনা পেয়েছেন তুর্কীস্থানের জুদী বা আরারাত পর্বতের পাদদেশে।] 


দ্বিতীয়তঃ নূহের নৌকায় কত জন লোক উঠেছিল? 
নূহ তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে ৭৮ জন অনুসারী এবং তাঁর পরিবারের ৮ জন (পুত্র কেনান ব্যতিরেকে) মোট ৮৬ জন মানুষ নৌকায় উঠেছিলেন (মতান্তর)। 
তৃতীয়তঃ যে সব জীব-জন্তু পানিতে বাস করতে পারে এবং যারা উভচর প্রাণী তাদেরকে নৌকায় উঠানোর দরকার ছিল না। প্লাবনে তাদের বংশ নির্মূলের সম্ভাবনাও থাকে না। 


চতুর্থতঃ নূহ সেই সমস্ত জীব-জন্তু জোড়ায় জোড়ায় নৌকায় তুলেছিলেন যারা পানিতে বাঁচতে পারে না এবং যাদের পরবর্তী বংশ বিস্তার হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। মনে রাখা দরকার, নূহ যেসব জীব-জন্তুকে নৌকায় নিয়েছিলেন সেসব ছিল নূহের অঞ্চলভুক্ত এবং নূহের তৎকালীন সময়কার। আর নূহের যুগের যে মহাপ্লাবনের কথা বলা হয় সেটা ছিল নূহের সমপ্রদায় কেন্দ্রিক। মহাপ্লাবনেরও একটা নির্দিষ্ট অঞ্চল এবং সময়কাল ছিল। প্লাবন এতটাই মারাত্মক ছিল যে নূহের অবাধ্য সম্প্রদায়ের কেউ তা থেকে বাঁচতে পারেনি। বাঁচার তাগিদে অবাধ্যরা ঘর-বাড়ির ছাদে, গাছের উপরে অবস্থান নিতে শুরু করেছিল। কিন্তু প্লাবনের পানি সেখানেও তাদেরকে রেহাই দেয়নি। তাদের ঘর-বাড়িগুলো প্লাবিত হয়েছিল এবং তার ভয়াবহতা ছিল মৃত্যুর মতো ; তাই একে মহাপ্লাবন বলা হয়ে থাকে। 
- দাদা, তাহলে ন্যাড়াদের নূহ আর আমাদের দেবতা মনু একই ছিল... 
- নাহ্... 
- না কেন? তুমিই তো বললে... 
- বলেছি নাকি? 
- ওমা! বলতে বলতেই ভুলে গেলে... তুমিই তো বললে আমাদের মনুর সময় যেমন বন্যা হয়েছিল ন্যাড়াদের নূহের সময়ও তেমন বন্যা হয়েছিল, তাহলে এক নয় কেন? 
- কারণ, ন্যাড়াদের মতে প্লাবনের পর নূহ একাই বেঁচে ছিলেন না বরং তাঁর সঙ্গীরাও বেঁচে ছিলেন। আর আমাদের মতে, বন্যার পূর্বে মনু একাই ভগবানের আদেশে নৌকায় উঠেছিলেন এবং বন্যার পর মনু একাই জীবিত ছিলেন। এরপর তিনি পানিতে মাখন আর টক দুধ দিয়ে মানুষের জন্ম দিলেন। কিন্তু, দুধ তিনি কোথায় পেলেন? ধরে নিলাম মনু নৌকায় উঠার পূর্বে দুধ নিয়ে উঠে ছিলেন। তারপরও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। পানিতে মাখন আর টক দুধ দেওয়ার পর যে মানুষের জন্ম হল; তিনি পুরুষ না হয়ে মেয়ে হলেন কেন? পানি থেকে জন্ম নিয়ে তিনি নিজেকে মনুর কন্যা বলে ঘোষণা করলেন। এর অর্থ এই নয় যে মনু তার দাদু কিংবা কাকা। তুমি কি বলো? 
যেহেতু, বলা হয়েছে মানব জাতির বিস্তার হয়েছে তাদের দু'জনার থেকে। তাহলে নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক হয়েছে। কিন্তু, পিতা আর কন্যার মধ্যে কিভাবে সম্পর্ক হতে পারে? কোনো পিতা কি কখনো এমন করতে পেরেছে? যদি এমনটি ঘটেই থাকে; তাহলে কি ধরে নিব আমরা সকলেই "হারামজাদা"। আমার মতে মনু সম্পর্কিত প্রথম ব্যাখ্যাটা যথার্থ ছিল কিন্তু দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটা কিছুটা আষাঢ়ে গল্পের মতো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ