সোমবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১২

ইসলামের দৃষ্টিতে কর্ম ও শ্রম


প্রথম পর্ব
ইরানের বিখ্যাত কবি নেজামে গাঞ্জাবি লিখেছেনঃ
পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণা, প্রতিটি অণু পরমাণু
ধূলি-ধূসর যদিও তা
রাষ্ট্রের বিচিত্র কাজে পরোক্ষে ব্যতিব্যস্ত সকলেই
নিজ নিজ কাজে সর্বদা
আমরা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সৃষ্টিজগতের বিচিত্র কর্মতৎপরতা এবং মানুষের কর্মময় জীবনের দায়িত্ব-কর্তব্য ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে এখানে আলোচনা করবো।
আসলে সৃষ্টি জগতের প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুই অত্যন্ত সুন্দর এবং সুশৃঙ্খলভাবে যে যার কাজে বা দায়িত্বে সর্বদা নিয়োজিত রয়েছে।এই সৃষ্টি জগত আল্লাহর ইচ্ছা ও শক্তির এক অনন্য প্রকাশ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আকাশমণ্ডলী আর ভূপৃষ্ঠকে সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে এবং বাহ্যিক কোনো খুঁটি বা পিলার ছাড়াই নভোমণ্ডলীকে উর্ধ্বে স্থাপন করেছেন। ভূপৃষ্ঠকে সৃষ্টিরাজির জন্যে দোলনার মতো করে তৈরি করেছেন। আকাশ ছোঁয়া বিশাল বিশাল পাহাড়-পর্বতকে স্থাপন করে ভূপৃষ্ঠকে কম্পন থেকে সুরক্ষা করেছেন। এই ভূপৃষ্ঠকে আলোকিত করার জন্যে উজ্জ্বল জ্যোৎস্নাময় চাঁদ আর রঞ্জনরশ্মিময় সূর্যকে স্থান করেছেন। এই ভূপৃষ্ঠ বা পৃথিবী নামক গ্রহটিকে তার নিজস্ব কক্ষপথে পরিচালিত করেছেন যাতে রাত এবং দিনের সৃষ্টি হয়। একইভাবে বাতাসকে পাঠিয়েছেন যাতে মেঘকে এদিক ওদিক সঞ্চালিত করা যায় এবং উপযুক্ত অঞ্চলে খরা জর্জরিত তৃষিত ভূমির ওপর প্রাণসঞ্চারী বৃষ্টি বর্ষণ করে উদ্ভিদের চারা রোপনের ব্যবস্থা করা যায়।
আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পানি এবং মাটি থেকে। তারপর তিনি মাটি দিয়ে সৃষ্ট ঐ বস্তুর ভেতর রূহের সঞ্চার করেছেন। আকাশ এবং যমিনকে মানুষের সেবায় সৃষ্টি করেছেন যাতে মানুষ তার কাজকর্ম এবং সৎ কর্মতৎপরতার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠের ওপর আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে অধিষ্ঠিত হতে পারে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী প্রতিনিয়ত কর্মতৎপর। সূরা আররাহমানের উনত্রিশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সবাই তাঁর কাছে প্রার্থী। তিনি সর্বদাই কোনো না কোন কাজে রত আছেন।' একইভাবে সৃষ্টিজগতের কোত্থাও বেকারত্ব কিংবা লক্ষ্য উদ্দেশ্যহীনতার কোনো স্থান নেই। প্রতিটি অণু পরমাণু থেকে শুরু করে গ্রহ নক্ষত্ররাজি সবাই যার যার নির্দিষ্ট পথে সুনিপুণ শৃঙ্খলার সাথে আপন আপন লক্ষ্যপানে সদা ধাবমান। বিরাম কিংবা একঘেঁয়েমির কোনো সুযোগ বা স্থান সৃষ্টিরাজ্যে নেই।
সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তাই মানুষেরও উচিত সৃশৃঙ্খল এই ব্যবস্থাকে অনুসরণ করা। সৃষ্টি জগতের ছন্দ সুরের সাথে তাল মিলিয়ে এমন সমন্বিত জীবনের সুর তৈরি করা যাতে সৃষ্টিজগতের সকল বস্তুই সেই ছন্দ সুরে আপ্লুত হয়। এদিক থেকে চিন্তা করলে কাজ, চেষ্টা প্রচেষ্টা তথা কর্মতৎপরতা মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে এবং বেকারত্ব ও বিশ্রামের মানে হলো সৃষ্টিজগত ও জীবনের প্রবাহ থেকে ছিটকে পড়া। এজন্যেই লক্ষ্য করা যায় মানবজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন এবং স্থায়ী পরিবতর্ন এখন অনস্বীকার্য একটি বাস্তবতা। উন্নত এবং জটিল এই মানব সমাজে তাই জীবনের সকল কোণেই বা সকল পর্যায়েই কাজের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। এমনকি বলা যেতে পারে কাজ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে আত্মা এবং মনের ওপর, চিন্তাপদ্ধতির ওপর, মানুষের মূল্যবোধের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
চলমান জীবন প্রবাহের গতিশীলতার জন্যে বা জীবন ধারণের জন্যে মানব সমাজকে অবশ্যই কাজ বা চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। মানুষের বড়ো বড়ো আশা আকাঙ্ক্ষা বা বৃহৎ মূল্যবোধগুলো অর্জন করার জন্যে নিরন্তর উদ্যম ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবার কোনো বিকল্প নেই। যেকোনো দেশ বা জাতি উন্নতির শিখরে আরোহন করতে চাইলে অবশ্যই সেই জাতিকে কর্মতৎপর হতে হবে, অলসতা পরিহার করে চলতে হবে। যুগে যুগে যারাই বড়ো বড়ো সভ্যতার জন্ম দিয়েছেন তারা নিরলস পরিশ্রমী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁরা নিজেদের খোদাপ্রদত্ত মেধাকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি জগতে অনন্য অবদান রেখে গেছেন। বিশাল বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ যেমন ইরানের ঐতিহাসিক পার্সেপোলিস প্রাসাদ, মিশরের বিশাল বিশাল পিরামিড কিংবা অধুনালুপ্ত চীনের প্রাচীর ইত্যাদি মানুষের এই সৃষ্টিশীল চিন্তারই ফল। আধুনিক কালের গগণচুম্বি অট্টালিকা বা টাওয়ার নির্মাণ, মহাশূণ্য জয় কিংবা আকাশে মানুষের উড্ডয়ন, দূরারোগ্য রোগের চিকিৎসা, মহাসড়ক, টানেল, বিশাল বিশাল শিল্প কারখানা নির্মাণ, যোগাযোগের জন্যে বিস্ময়কর ডিজিটাল সিস্টেম প্রভৃতি মানুষেরই সৃজনশীল চিন্তা আর নিরলস কর্মপ্রচেষ্টার উপহার। এগুলোকে তাই সুন্দর অর্থাৎ ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা উচিত।
কর্ম প্রচেষ্টার কল্যাণে মানুষের জীবন নামক বৃক্ষটি ফলে ফুলে সুশোভিত হতে পেরেছে, মানুষের অন্তরাত্মা ও দেহ থেকে দুর্বলতা আর বিরক্তি বিদূরিত হয়। মানব জীবন থেকে যদি কর্ম তৎপরতা লোপ পায়, তাহলে তার পতনের ধারার সূচনা হবে। ‘সভ্যতার ইতিহাস' নামক গ্রন্থের লেখক বিল ডুরান্ট লিখেছেন ‘সুস্থতা কাজের মাঝে নিহিত। মানব জীবনের সুখ সমৃদ্ধি আর সন্তুষ্টির মূল রহস্যগুলোর একটি হলো পেশা বা কাজ। আমার দৃষ্টিতে আল্লাহর কাছে ধন সম্পদ না চেয়ে কাজ এবং আমলের তৌফিক চাওয়াটাই উত্তম।' মানুষের জন্যে পানাহার যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি কাজও অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু কেন? মানুষ কি তার বস্তুগত প্রয়োজনে কিংবা উত্তম জীবনযাপনের জন্যে কাজ করবে? মানুষ কি কেবল খাবার দাবারের সংস্থানের জন্যেই কাজ করবে? এ প্রশ্নের জবাবে বিভিন্ন মতবাদে বিভিন্ন রকম দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কেউ কেউ কর্মপ্রচেষ্টাকে কেবল দুনিয়াবি স্বার্থ সিদ্ধি বা মানুষের বস্তুতান্ত্রিক জীবনের প্রয়োজনীয়তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করেছেন,যদিও আরো অনেক মতবাদ ও চিন্তাধারায় ভিন্নরকম দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা হয়েছে।
ইসলাম কাজকে একটু বিস্তৃত পরিসরে চিন্তা করে। মানুষের সাথে সৃষ্টিজগতের অন্যান্য সম্পর্কের মতোই কাজও পার্থিব এবং আধ্যাত্মিক উভয় দিক থেকেই প্রয়োজনীয় বলে ইসলাম মনে করে। আমরা পরবর্তী আসরগুলোতে ইসলামী চিন্তাদর্শ ও সংস্কৃতিতে কাজের অবস্থান ও গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলার চেষ্টা করবো। কাজের সংজ্ঞা, ইসলামে এর সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক ব্যাখ্যা কীরকম, সেগুলো নিয়েও আলোচনা করা ইচ্ছে রইলো। নবী করিম (সা) এবং তাঁর আহলে বাইতের জীবন চরিতে কাজ কীরকম গুরুত্ব পেয়েছে সেদিকেও নজর দেওয়ার চেষ্টা করবো। মানুষের অন্তরাত্মার ওপর কাজের ইতিবাচক প্রভাব, কাজের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক গুরুত্ব, ইসলামে কাজের শিষ্টাচার ও চরিত্র ইত্যাদি বিষয়েও আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
দ্বিতীয় পর্ব
কাজের সামর্থ থেকে মানুষ যদি উপকৃত না হতো কিংবা সবচেয়ে কম কাজ করেই যদি মানুষ সকল নিয়ামতের অধিকারী হয়ে যেত, তাহলে তাদের জীবন হয়ে যেত আনন্দ উল্লাসহীন। জীবনের অর্থ বা মজাই হারিয়ে যেত। এ সম্পর্কে ইমাম সাদেক (আ) এর বক্তব্যের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করবো আজকের আলোচনা।
নবীজীর আহলে বাইতের মহান উত্তরপুরুষ ইমাম জাফর সাদেক (আ) মানুষের আত্মার ওপরে কাজের ইতিবাচক প্রভাব এবং কাজের মানসিক স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে বলেছেনঃ ‘মানুষের সকল প্রয়োজনীয়তা যদি কোনোরকম কাজকর্ম ছাড়াই পূরণ হয়ে যেত তাহলে কক্ষণো তাদের জীবন স্বাস্থ্যকর হতো না এবং জীবন উপভোগ্য হয়ে উঠতো না। ধরা যাক কোনো এক লোক এমন একদল মেহমানের সাথে যোগ দিলো যাদের খাওয়া পরার সকল দায় দায়িত্বসহ সব ধরনের সেবারই নিশ্চয়তা রয়েছে। একটা সময় পর বেকার বসে খাবার দাবার করতে করতে ঐ লোকটা ক্লান্ত হয়ে যায় এবং অবশেষে কাজের সন্ধানে যায় যাতে তার বেকারত্বের অবসান হয়। এখন ভাবুন যদি সারাটি জীবন মানুষের সকল প্রয়োজনীয়তা, সকল চাহিদা আপনা আপনি মিটে যেত তাহলে মানুষের অনুভূতিটা কীরকম হতো।' তাঁর এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে কাজ কেবল মাত্র আয়রোজগারের জন্যেই নয় বরং সুস্থ থাকা এবং ব্যক্তিত্ববান হবারও গোপন রহস্য। অগাধ অর্থ সম্পদের মালিক হবার পরও তাই কাজের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
বিখ্যাত ফরাশি লেখক ও কবি ফ্রাঁসোয়া ভলতেয়ার বলেছেন, ‘যখনি অনুভব করি কষ্ট, ক্লান্তি আর রোগব্যাধি আমাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে তখন কাজের আশ্রয় নিই, কেননা আমার ভেতরের যন্ত্রণার সবচেয়ে উত্তম প্রতিষেধক হচ্ছে কাজ। সেজন্যেই কাজের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয়বিধ ফায়দা বা উপকারিতা রয়েছে। তাছাড়া মানুষের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবন কাজ এবং দায়িত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষের সফলতার রহস্য এই কর্মতৎপরতার পরিমাণের ওপর নির্ভরশীল। যিনি ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে যতো বেশি কর্মতৎপর হবেন, তিনি ততো বেশি সফল হবেন এটাই স্বাভাবিক। সাধারণত যে কোনো কাজেরই একটা নির্দিষ্ট চিন্তাদর্শ ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি থাকে। যারা কাজকে কেবলমাত্র বস্তুগত লক্ষ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায় তারা ইহজাগতিক চাহিদা মেটানোকেই কাজের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে মনে করে। কিন্তু যারা তাকে বস্তুজাগতিক চাহিদার অনেক উর্ধ্বে বলে মনে করে তারা কাজকে একটা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে এবং কাজকে তারা অনেক বড়ো উদ্দেশ্য তথা মানবীয় পূর্ণতা অর্জনের উপায় হিসেবে বিবেচনা করে।
ইসলামে মানুষের অস্তিত্বটা দ্বিমাত্রিক। একটি হলো আধ্যাত্মিক এবং অপরটি বস্তুতান্ত্রিক। আল্লাহ পাক মানুষের সৃষ্টির সেরা হিসেবে মর্যাদাবান করেছেন এবং আকাশ ও যমিনের সকল বস্তুকেই মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছেন। পবিত্র কোরআনের সূরা লোকমানের ২০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘তোমরা কি দেখ না আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে যাকিছু আছে,সবই তোমাদের কাজে নিয়োজিত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেয়ামতসমূহ পরিপূর্ন করে দিয়েছেন'? এ থেকে বোঝা যায় মানুষকে শ্রেষ্ঠ করে সৃষ্টি করার পেছনে আল্লাহর কোনো একটা উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই রয়েছে। যেমনটি বলা হয়েছে সূরায়ে জারিয়াতের ৫৬ নম্বর আয়াতেঃ ‘আমার এবাদত করা ছাড়া আর কোনো কাজের জন্যে আমি মানব ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করি নি।' ফলে মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যটা পরিস্কার, তাহলো আল্লাহর ইবাদাত করা। এজন্যে মুমিন যে, তার কোনো একটি কাজও সেই উন্নত ও বৃহৎ লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত থাকতে পারে না। তার প্রতিটি কাজেরই লক্ষ্য হবে ইবাদাত তথা আল্লাহর আনুগত্য। আর এই ইবাদাতের পথ ধরে আত্মিক এবং আধ্যাত্মিক পূর্ণতায় পৌঁছানোটাই মূল লক্ষ্য।
আল্লাহ মানুষকে যেসব নিয়ামতের অধিকারী করেছেন ধন সম্পদ সেগুলোর একটি। সেজন্যে কোনো মুসলমানের ধন সম্পদ কেবল তার একারই নয় বরং তার মধ্যে অন্যদেরও অধিকার রয়েছে। যাকাত বা খুমুস প্রদান সেই অধিকারেরই অংশ। এটা কোনো দান নয় কিংবা খয়রাতও নয় এটা বাধ্যতামূলক প্রদেয়। ফলে যাকাত খুমুস প্রদান আল্লাহর ইবাদাতের শামিল। যাকাত খুমুস প্রদান আল্লাহর কাছে গৃহীত হবার জন্যে শর্ত হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে আন্তরিকতার সাথে প্রদান করা। এজন্যে সম্পদ অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করাটাও আধ্যাত্মিকতার প্রবাহে মিলিত হবার শামিল বলে এটা ইবাদাত হিসেবে গণ্য। কোনো ব্যক্তি যদি নিজের এবং পরিবারের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে কিংবা জনকল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করে তাহলে তা ইবাদাত। অবশ্য তা হতে হবে আল্লাহর আদেশ নিষেধের মানদণ্ডের ভিত্তিতে। আর সেই অনুযায়ী যদি কর্মকাণ্ড চলে তাহলে পরকালেও তার পুরস্কার রয়েছে। এজন্যেই রাসূলে খোদা (সা) বলেছেন ‘দুনিয়া হচ্ছে আখেরাতের কৃষিক্ষেত্র'। পার্থিব জগতের সকল সুযোগ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁরই প্রদর্শিত পথে চলা যায়, তাঁরই নির্দেশনা অনুযায়ী কর্মতৎপরতা চালানো যায় তাহলে পার্থিব স্বার্থ হাসিলের পাশাপাশি পরকালীন স্বার্থও অর্জিত হয়।
ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিটা হলো একজন মুসলমান যেহেতু নিজে আল্লাহর অফুরন্ত নিয়ামতের অধিকারী হয় সেহেতু অন্যান্যদেরকেও আল্লাহর সেই নিয়ামতের অধিকারী হতে সহযোগিতা করা তার কর্তব্য। আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ থেকে একজন মুসলমান যথার্থ পন্থায় উপকৃত হয় এবং সেই অনুগ্রহের ব্যাপারে অকৃতজ্ঞতা পোষণ করে না।ইসলামের অর্থণৈতিক ব্যবস্থায় বস্তুগত ধন সম্পদ হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া আমানত। নিজের এবং সমাজের আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের জন্যে এইসব নিয়ামতকে কাজে লাগানো উচিত। এইদিক থেকে বিবেচনা করলে একজন মুসলমান বিশ্বকে গড়া এবং সংস্কার করার জন্যে একজন দায়িত্বশীল হিসেবে নিজেকে মনে করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা হুদের একষট্টি নম্বর আয়াতে বলেছেনঃ ‘তিনিই যমিন হতে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে আবাদ করার জন্যে তোমাদের ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন'। এই দায়িত্ব পালনের জন্যে যেই তৎপরতা, তাই কাজ। মানুষ তার মেধা ও মনন দিয়ে কাজ করার ফলেই নতুন নতুন প্রযুক্তি ও বিভিন্ন জিনিস আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে।
তৃতীয় পর্ব
কাজের গুরুত্ব এবং এ সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম। বিশেষ করে ইসলামের দৃষ্টিতে কাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য এবং এ সংক্রান্ত দর্শন নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করছিলাম। আজকের আসরে আমরা এ সংক্রান্ত আরেকটি দিক নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো।
ইসলামসহ বিশ্বের প্রতিটি অর্থব্যবস্থারই নিজস্ব দর্শন এবং বিশ্বদৃষ্টি রয়েছে। যেমনটি গত আসরে বলেছিলাম ইসলামী চিন্তাদর্শনে মানুষের জীবনের ওপর তার বোধ ও বিশ্বাসের কেন্দ্রিয় ভূমিকা রয়েছে। সেজন্যে একজন মুসলমানের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে তার বিশ্বাসের সম্পর্ক খুবই নিবীড়।অন্যভাবে বলা যেতে পারে ইসলামে একজন মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ জীবনের প্রত্যেকটি বিষয় ধর্মীয় বিশ্বাস ও শিক্ষার কাঠামো অনুযায়ী সম্পাদিত হয়। ইসলামী চিন্তাদর্শ অনুযায়ী একজন মানুষের জীবন বা অস্তিত্বের দুটি দিক রয়েছে। একটি তার বস্তুগত জীবন অপরটি তার আধ্যাত্মিক জীবন। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টিকূলের সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন এবং অপরাপর সকল সৃষ্টির ওপর মানুষকে মর্যাদাবান করেছেন। তাই মানুষের কর্তব্য হলো তার অভ্যন্তরীণ মেধা ও সৃজনশীলতা এবং তার বোধ ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে মানবীয় তথা তার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক পূর্ণতায় পৌঁছার জন্যে চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ সুবিধা সকল পন্থা ও উপায় উপকরণ দিয়ে দিয়েছেন,যাতে মানুষ তার বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক চাহিদাগুলো সহজেই মেটাতে পারে। মানুষ তার প্রয়োজন মেটানোর জন্যে কাজ করতে বাধ্য। এদিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে ইসলামের দৃষ্টিতে এ বিষয়টির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কর্মতৎপরতা ইহকাল এবং পরকালীন জগতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণী একটি উপায়। কোরআনে কারিম আশিটিরও বেশি আয়াতে মানুষের সৌভাগ্যের শর্ত হিসেবে দুটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছে। একটি হলো ইমান এবং অপরটি সৎ কাজ। সাংসারিক বা পারিবারিক ব্যয় নির্বাহ করার জন্যে সময় দেওয়া এবং পরিশ্রম করাটা সৎ কাজের অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য ইসলামে সৎ লক্ষ্য উদ্দেশ্যে পৌঁছার জন্যে যে কাজই করা হোক না কেন সেই কাজ অত্যন্ত মূল্যবান হিসেবে পরিগণিত।
যেই প্রকৌশলী বিশাল কোনো ভবনের নকশা তৈরির জন্যে কাগজের ওপর রেখাচিত্র আঁকেন, যেই আর্টিস্ট তাঁর সময় এবং মেধাকে কাজে লাগিয়ে ক্যানভাসে প্রকৃতির বিচিত্র ছবি আঁকেন, যেই শিক্ষক স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের পড়ান কিংবা যেই মালি বাগানের কাজ করেন বা যেই কৃষক কৃষিকাজে ব্যস্ত সময় কাটান, তাঁরা সকলেই সামাজিক উন্নয়ন ও বিকাশের ক্ষেত্রে অবদান রেখে যাচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে ধর্মীয় দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারেঃ ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং বিধি বিধানের আলোকে জনকল্যাণ ও সামাজিক মর্যাদাকে রেো উন্নত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সেবামূলক কাজকর্ম কিংবা পণ্য উৎপাদন করার জন্যে যেসব তৎপরতা চালানো হয়, সেইসব তৎপরতাকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য করা হয়।'
আয় উপার্জনের মৌলিক পন্থাই হলো কর্ম তৎপরতা। পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে মানুষের জীবিকার প্রয়োজন মেটানোর জন্যে আল্লাহর দেওয়া বিচিত্র রহমত ও অনুগ্রহের খোজেঁ মানুষকে যমিনে চাষাবাদ করার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। কেবল অনুপ্রাণিতই নয় বরং বহুভাবে তার গুরুত্বও তুলে ধরা হয়েছে। বহু আয়াতে আসমান এবং যমিনকে মানুষের বশীভূত করার কথা, দিবারাত্রি সৃষ্টির কথা, বাতাস এবং বৃষ্টিকে পাঠানোর কথা, নৌকা চালানোর কথা ইত্যাদির উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর রহমত ও কল্যাণ কামনা এবং রুটিরুজির অনুসন্ধান প্রসঙ্গেই এসবের উল্লেখ করা হয়েছে। আর আল্লাহও তাঁর প্রাকৃতিক নিয়ামতগুলোকে খুজেঁ বের করার দায়িত্ব মানুষের ওপরই অর্পন করেছেন। মানুষের একান্ত নিজস্ব দায়িত্ব হলো দিবারাত্রি পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তাদের জ্ঞান বুদ্ধি বিবেককে কাজে লাগিয়ে নিজেদের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ ও উন্নতি বিধান করা। কোরআনে পাকে আমরা লক্ষ্য করবো সূরা হুদের ৬১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ মানুষকে যমিনে চাষাবাদ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষের জন্যে সর্বপ্রকার সুযোগ সুবিধাকে প্রস্তুত করে রেখেছেন, এখন মানুষের কাজ হলো সেগুলোকে খুঁজে বের করা এবং সেগুলোর সাহায্যে নিজেদের সার্বিক অভাব ও দৈন্যতা দূর করা।
কোরআনের অসংখ্য আয়াতে মানুষের জন্যে দেওয়া আল্লাহর বিচিত্র নিয়ামতের কথা বলা হয়েছে। সূরায়ে লোকমানের বিশ নম্বর আয়াতে এই নিয়ামতের কথা বলা হয়েছে এভাবেঃ তোমরা কি দেখ না আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে যা কিছু আছে,সবই তোমাদের কাজে নিয়োজিত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেয়ামতসমূহ পরিপূর্ন করে দিয়েছেন? আল্লাহ রাব্বুল অপর একটি আয়াতে বলেছেনঃ ‘আকাশ, যমিন, সমুদ্রগুলো, পাহাড় পর্বতরাজি, নদীসমূহ এবং সর্বপ্রকার প্রাণীকে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন যাতে তা থেকে তাঁর বান্দারা উপকৃত হতে পারে।' একইভাবে সূরায়ে কাসাসের সাতাত্তর নম্বর আয়াতে আল্লাহর দেওয়া সেইসব নিয়ামতকে আখেরাত তথা পরকালীন জীবনের পাথেয় সঞ্চয়ের কাজে ব্যবহার করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছেঃ আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন,তা দিয়ে পরকালের গৃহ অনুসন্ধান কর,এবং ইহকাল থেকে তোমার লাভবান হবার কথা ভুলে যেয়ো না। তুমি অনুগ্রহ কর,যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।' প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতিকে জয় করে আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতগুলো অর্জন করতে হলে শ্রম বা কাজের কোনো বিকল্প নেই। অলসতা বা কর্মহীন জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে সেসব অর্জন করার কোনো সুযোগ নেই।
এখানে প্রকৃতিকে জয় করার মানে হলো ব্যবসা-বাণিজ্য , পশুপালন, কৃষিকাজ, খনিজ সম্পদ উত্তোলনসহ বিচিত্র পণ্য উৎপাদনের মতো কাজ করার মধ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা। আর এসব কাজ করতে গেলে মেধা খাটাতে হয়, পরিশ্রম করতে হয়। এই পরিশ্রমই উন্নতি ও সৌভাগ্যের মূল চাবিকাঠি। আল্লাহ পাক মানুষের আয় রোজগারের জন্যে যেসব ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছেন, সেগুলোকে রহমত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সূরা কাসাসের তিয়াত্তর নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘তিনিই স্বীয় রহমতে তোমাদের জন্যে রাত ও দিন করেছেন,যাতে তোমরা তাতে বিশ্রাম গ্রহণ কর ও তাঁর অনুগ্রহ অন্বেষণ কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।' আল্লাহ পাক কাজ করার ওপর এতো গুরুত্ব দেওয়া সত্ত্বেও অনেকে মনে করেন জীবন-জীবিকার জন্যে এতো কাজ করা দুনিয়া পূজার শামিল। তাদের বক্তব্য হচ্ছে রুটি রুজির বিষয়টি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয়েই আছে ফলে কাজের মাঝে তার কোনো লাভ-ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। অথচ সকল নবী রাসূলই পৃথিবীতে এসে ব্যাপক পরিশ্রম করেছেন এবং অন্যান্যদেরকেও সৎ পথে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। আল্লাহ আমাদের সৎ পথে থেকে কাজ কর্ম করার তৌফিক দিন।
চতুর্থ পর্ব
গত পর্বে আমরা পবিত্র কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলাম যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষের জন্যে সর্বপ্রকার সুযোগ সুবিধা প্রস্তুত করে রেখেছেন, এখন মানুষের কাজ হলো কর্ম ও শ্রমের মাধ্যমে সেগুলোকে খুঁজে বের করা এবং সেগুলোর সাহায্যে নিজেদের সার্বিক অভাব ও দৈন্যতা দূর করা। এ পর্বে আমরা নবীজীবনে তথা ইসলামের শিক্ষায় কাজের অবস্থান ও গুরুত্ব নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো।
বিশ্ব প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই মানুষের ওপর কাজের একটি গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে যাতে মানুষ তাদের চেষ্টা ও শ্রম দিয়ে প্রকৃতি থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদাগুলো মেটাতে পারে। হযরত আদম (আ) পৃথিবীতে আসার প্রথম দিন থেকেই জীবন যাপনের জন্যে চেষ্টা প্রচেষ্টা শুরু করেন। অবশ্য এই চেষ্টা প্রচেষ্টার বিষয়টি কেবল মানুষের জন্যেই নয় বরং সকল প্রাণীকূলের জন্যেই সমানভাবে প্রযোজ্য। বেঁচে থাকার তাগিদে সবাই নিজ নিজ জীবিকার প্রয়োজনে কর্মতৎপর। যেমনটি আগেই বলেছি যে, ইসলামী চিন্তাদর্শে কর্মপ্রচেষ্টার বিশেষ একটি স্থান রয়েছে। কেননা এতে রয়েছে মানুষের জন্যে পার্থিব ও আধ্যাত্মিক অগণিত কল্যাণ। কোরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং ধর্মীয় শিক্ষাগুলো মানুষকে কর্মচাঞ্চল্যের পক্ষে অনুপ্রাণিত করে। ইসলামের শিক্ষা হলো মানুষের উচিত জ্ঞান ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে এবং চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়ে আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া। জীবিকার জন্যে চেষ্টা শ্রম দিলে মানুষের মাঝ থেকে যেমন নিষ্প্রাণ আলস্য দূর হয়ে যায় তেমনি মনের ভেতরে এক ধরনের প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা দেয়।

দৈহিক এবং মানসিক সুস্থতার জন্যে কাজ সবোর্ত্তম একটি উপায় বা উপকরণ। মানুষের সাফল্য বা বিজয়ের নেপথ্যে রয়েছে এই কর্মপ্রচেষ্টা। যারা ব্যাপক পরিশ্রমী তাদের সাফল্য ব্যাপক আর যারা অপেক্ষাকৃত অলস তারা সফলতা থেকেও তুলনামূলকভাবে বঞ্চিত। বিবেক তাড়িত মানুষের উচিত দারিদ্র থেকে মুক্তি লাভ করার জন্যে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকা এবং সম্মান ও মর্যাদার সাথে জীবনযাপন করার জন্যে কাজ করা যাতে অপরের কাছে হাত বাড়াতে না হয়। তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ যে দিকটি ইসলামের স্বাতন্ত্রের কথাটি তুলে ধরছে তাহলো কর্মপ্রচেষ্টার পাশাপাশি ইসলাম তাকওয়ার প্রতি বিশেষভাবে জোর দিয়েছে। পবিত্র কোরআনের সূরা নূরের সাইত্রিশ নম্বর আয়াতে তাকওয়াবান লোকদের পরিচয় সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘তাঁরা এমন যে, অর্থনৈতিক কাজকর্ম তাঁদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে অর্থাৎ নামায কায়েম করা থেকে এবং যাকাত প্রদান করা ইত্যাদি থেকে বিরত রাখে না।' অন্যভাবে বলা যায় জীবনে আল্লাহ কেন্দ্রিকতা এমন একটি মৌলিক বিষয় যাকে বস্তুগত ও অর্থনৈতিক সকল কাজকর্মের মাঝেও ভোলা যাবে না। তাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ জীবনের সকল কাজ হতে হবে তাকওয়া ও আল্লাহ কেন্দ্রিক।
সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার পরিবশে যদি এরকম পরহেজগারীপূর্ণ হয় তাহলে ঐ সমাজের প্রতিটি সদস্যের মাঝে সুস্থ ও যথাযথ একটি সম্পর্ক বিরাজ করবে। কেননা মানুষ যখন তাকওয়া ও পরহেজগারীর মধ্য দিয়ে হারাম বা আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজকর্ম থেকে দূরে থাকে তাহলে ঐ সমাজের ওপর আল্লাহর রহমত ও বরকতের বৃষ্টি বর্ষিত হবে। সূরা তালাকের দুই ও তিন নম্বর আয়াতে এসেছেঃ ‘আর যে তাকওয়াবান অর্থাৎ আল্লাহকে ভয় করে,আল্লাহ তার জন্যে নিস্কৃতির পথ করে দেবেন...এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিযিক দেবেন।' আল্লাহর পূণ্যবান বান্দারা যে যে কাজই করুন না কেন তাঁর শুরুতেই আল্লাহর সন্তুষ্টির বিষয়টিকে মাথায় রাখেন এবং আল্লাহ তাঁর সকল কাজই দেখছেন এই বিশ্বাস সবসময় মনে লালন করে কাজ করেন। রাসূলে খোদা (সা) থেকে ইমাম বাকের (আ) বর্ণনা করেছেনঃ ইবাদাতের সত্তুরটি অংশ রয়েছে,তার মধ্যে সবচেয়ে উত্তম অংশটি হলো হালাল উপায়ে রুযির জন্যে চেষ্টা প্রচেষ্টা চালানো।
তো হালাল উপায়ে রুটি রুযির মধ্যে আল্লাহ যে বরকত রেখেছেন সেই বরকতের কল্যাণেই যে ব্যক্তি তার পরিবার পরিজনের জীবন জীবিকার প্রয়োজনে গঠনমূলক ও ইতিবাচক চেষ্টা প্রচেষ্টা চালায়,সে ব্যক্তি পার্থিব জীবনের উন্নতির পাশাপাশি পরকালীন জীবনের জন্যেও ব্যাপক কল্যাণ ও সওয়াব অর্জন করে। এ কারণেই ইসলামের বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে ‘এই পার্থিব জগত হচ্ছে পরকালীন জীবনের কৃষিক্ষেত্র'। আর এই কৃষিক্ষেত কেবলমাত্র সঠিক বা ন্যায় পন্থা অর্থাৎ তাকওয়াময় কাজ কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমেই চাষাবাদ করা যায়।

আল্লাহর নবী রাসূলগণের জীবন কিংবা আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ববর্গের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তাঁদের জীবন ছিল কর্মমুখর। নবুয়্যত কিংবা আধ্যাত্ম চেতনা তাঁদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন জীবিকা অর্জনের জন্যে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সম্পাদনের পথ থেকে বিরত রাখেনি। ইমাম সাদেক (আ) বলেছেনঃ যেদিন মানব জাতির আদি পিতা আদম (আ) বেহেশত থেকে পৃথিবীতে এসেছেন,সেদিন থেকেই তাঁর পানাহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তিনি তখন জিব্রাইল (আ) এর সাথে পরামর্শ করলেন এবং তাঁর সাহায্য চাইলেন। জিব্রাইল (আ) তখন আদশ (আ)কে পরামর্শ দিয়েছিলেন এভাবেঃ হে আদম! তুমি যদি নিজস্ব চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তাগুলো মেটাতে চাও তাহলে কৃষিবিদ হও এবং কৃষিকাজে নিয়োজিত হও!হযরত নূহ (আ) এর ক্ষেত্রেও বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি কাঠমিস্ত্রির পেশায় নিয়োজিত থেকেই নয়শ' পঞ্চাশ বছর তাঁর কওমের লোকদের মাঝে দাওয়াতি কাজ করেন।
তারপরও কওমের লোকজন যখন ঈমান আনলো না তখন আল্লাহ তাঁকে আদেশ দিলেন খুরমা গাছ লাগাও। তিনি তাই করলেন। কওমের লোকেরা তাঁকে খুরমা গাছ লাগাতে দেখে উপহাস করলো। কিন্তু নূহ (আ) দমলেন না। খুরমা গাছগুলো যখন ফলবতী হয়ে উঠলো তখন আল্লাহর আদেশে সেগুলোকে কেটে ফেললেন এবং নৌকা বানালেন।
একইভাবে দাউদ (আ)কে একদিন আল্লাহ বললেনঃ হে দাউদ! তুমি একজন নেককার বান্দা! কিন্তু নিজ হাতে কাজকর্ম না করে নাবায়তুল মালের টাকা গ্রহণ করো!দাউদ (আ) একথা শুনে চল্লিশ দিন কাঁদলেন এবং আল্লাহ তাঁর জন্যে লোহাকে নরম করে দিলেন। তারপর দাউদ (আ) কাজ করতে শুরু করেন। নিজ হাতে তিনি তিনশ' ষাটটি লোহার বর্ম তৈরি করলেন এবং সেগুলো বিক্রি করে টাকা উপার্জন করে বায়তুল মালের টাকার প্রয়োজনীয়তা দূর করলেন। তিনি খুরমা খেজুর গাছের পাতা দিয়ে জাম্বিল বানিয়েও বিক্রি করতেন এবং পরিবারের খাদ্যের জোগান দিতেন।
হযরত শোয়াইব (আ) যখন মূসা (আ) এর কাছে মেয়ে বিয়ে দিলেন তখন তিনি মূসাকে আট বছর তাঁর জন্যে কাজ করার শর্ত দিয়েছিলেন। মূসা (আ) তাই করলেন,আট বছরের স্থলে দশ বছর রাখালবৃত্তি করলেন। ঈসা (আ) কে একজন জিজ্ঞেস করেছিল-আমাদের মাঝে কে সবচেয়ে উত্তম। ঈসা (আ) জবাবে বলেছিলেনঃ যে তার নিজ হাতে কাজ করে এবং নিজের রুযির টাকায় খাবার গ্রহণ করে। স্বয়ং রাসূলে খোদা (সা) কর্মকঠোর হাতে চুম্বন দিয়ে বলেছিলেন-‘এটা সেই হাত যে হাত দোযখের আগুণে পুড়বে না'।
পঞ্চম পর্ব
মানুষসহ সকল প্রাণীরই অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হলো জীবনকে সচল রাখার জন্যে চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু চেষ্টা প্রচেষ্টা সম্পর্কে মানুষের রয়েছে বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গি। কেউ কেউ মনে করেন মানুষের জীবন এই পার্থিব জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেজন্যে তাদের সকল চেষ্টা বা কর্মতৎপরতা এই দুনিয়া কেন্দ্রিক। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করেন পার্থিব এই জগতেই মানব জীবন সমাপ্ত নয় বরং পরবর্তীকালে রয়েছে অনন্ত আরেক জীবন। সেজন্যে তাঁরা পরবর্তী পৃথিবীর অনন্ত জীবনের সুখ শান্তির স্বার্থে পার্থিব এই পৃথিবীর সকল সুযোগ সুবিধাকে কাজে লাগান। এই দ্বিবিধ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কর্মপ্রচেষ্টা নিয়ে আরো কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো।

কাজ মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রয়োজনীয়তা। তাছাড়া ধর্ম এবং ধর্মীয় শিক্ষাগুলোও মানুষকে কাজের প্রতি উৎসাহিত করে। ধর্ম প্রাকৃতিক একটি বিষয়। এ কথার মানে হলো ধর্মের নিয়মনীতি আর প্রকৃতির নিয়মকানুন পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পরিপূরক। এর কারণটা হলো উভয়ই এক এবং অভিন্ন শক্তি থেকে উৎসারিত, সেই শক্তি হলো ‘খোদা'। প্রকৃতির বিধান অনুযায়ী কাজ হলো প্রাকৃতিক বিচিত্র সম্পদ ও সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে তা থেকে উপকৃত হবার জন্যে মানবজাতির তৎপরতা। কর্মপ্রচেষ্টা মানুষের অভ্যন্তরীণ মেধা ও প্রতিভা বিকাশের অন্যতম একটি উপায়ও বটে। আর এই পন্থাটি ধর্মই মানুষের জন্যে প্রদর্শন করেছে যাতে কর্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মানুষ তার আত্মিক এবং আধ্যাত্মিক পূর্ণতায় পৌঁছার সুযোগ পায়।
যেমনটি বলেছিলাম যে ইসলামের বিশ্বদর্শন অনুযায়ী মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো আল্লাহর নৈকট্য ও আনুগত্য লাভ করা। তাই যা কিছুই মানুষকে তার এই লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করবে তা-ই মানুষের কাছে বাঞ্ছনীয়। ইসলামের দৃষ্টিতে জীবনজীবিকা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্য হলো তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের পথে অগ্রসর হবার শক্তি লাভ করা। মানুষ সুখ শান্তিতে বাস করার জন্যে এবং আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল থাকার জন্যেও খাওয়া পরার প্রয়াজন রয়েছে, ঘরবাড়িসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধারও প্রয়োজন রয়েছে। আর এসবই নিশ্চিত হবে কেবল কাজ ও শ্রমের মধ্য দিয়ে। তাই মানুষের অকাট্য অধিকার হচ্ছে বস্তুগত চাহিদাগুলো মেটানোর জন্যে কর্মপ্রচেষ্টা চালানো। তবে শর্ত হলো ঐ কর্মপ্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে কোনোভাবেই আধ্যাত্মিক পূর্ণতার পথকে বন্ধ করা যাবে না, বরং বলা ভালো ঐ কর্মপ্রচেষ্টাকেই আধ্যাত্মিকতার শীর্ষে পৌঁছার সোপান হিসেবে গ্রহণ করা সঙ্গত, কেননা এটাই হতে পারে তাকওয়া অর্জনের অন্যতম পন্থা। ইমাম বাকের (আ) একটি দোয়ায় বলেছেনঃ ‘হে খোদা!যতোদিন বেঁচে আছি তোমার কাছে কল্যাণময় জীবন কামনা করছি। তোমার কাছে সেরকম জীবন চাই যে রকম জীবন যাপন করলে তোমার আনুগত্যের শক্তি অর্জিত হবে এবং তোমার বেহেশতের জন্যে উপযুক্ততা অর্জিত হবে'।
গত আসরে আমরা নবীজী এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইতসহ অন্যান্য নবীরাসূল ও আধ্যাত্মিক মহান ব্যক্তিত্ববর্গের জীবন পর্যালোচনা করে দেখিয়েছিলাম যে তাঁরা কাজ করার প্রতি কতোটা গুরুত্ব দিয়েছেন। নবীদের বেশিরভাগই কৃষিকাজ, পশুর রাখাল, কাঠ মিস্ত্রি, ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ইসলামী দর্শনে কাজ করাটা ইবাদাত। জীবন জীবিকার প্রয়োজনীয় অর্থ যদি হালাল রুযির মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় তাহলে আল্লাহর পথে জেহাদ করার সওয়াব অর্জিত হবে। মহানবী (সা) বক্তব্যে এবং বাস্তবে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং বেকার থাকার ব্যাপারে নিষেধ করেছেন। আমরা আজকের আসরের পরবর্তী পর্যায়ের আলোচনায় কাজের গুরুত্ব ও মূল্যায়ন সম্পর্কে নবীজীর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
একটি হাদিস দিয়ে শুরু করা যাক। নবী করিম (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তার পরিবারের জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে শ্রম দেয়, কষ্ট করে, সে ব্যক্তি আল্লাহর পথে জেহাদকারী মুজাহিদের মতো....আমি আমার উম্মাতের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি যে যে বিষয়ে উদ্বিগ্ন ও ভীত তাহলো উদরপূজা, বেশি ঘুম এবং বেকারত্ব...যে বা যারা নিজের জীবনের দায়িত্বভার জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয় সে বা তারা আল্লাহর রহমত থেকে দূরে অবস্থান করে। রাসূলে খোদা (সা) সেই শৈশবকাল থেকেই বিচিত্র কাজকর্মে ব্যস্ত ছিলেন। শৈশব এবং কৈশোরে তিনি রাখালবৃত্তি করেছেন এবং যুবক বয়সে ব্যবসা বাণিজ্যের কাজ করেছেন। নবুয়্যতের দায়িত্ব পাবার পরও তিনি তাঁর কাজকর্ম থেকে বিরত ছিলেন না এবং কখনোই তিনি রাজা বাদশাদের মতো শাহী জীবনযাপন করেন নি।
নবুয়্যতির দায়িত্ব ছিল কর্মব্যস্ততাপূর্ণ। মদিনায় নবীজীবনের বৃহৎ এবং গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টিতে দাওয়াতী এবং প্রতিরক্ষামূলক কাজে ব্যয় হয়েছে। তারপরও তিনি ন্যুনতম সুযোগকেও কাজ করার ক্ষেত্রে ব্যয় করতে ভোলেন নি। তিনি সবসময় বলতেনঃ ‘আল্লাহ চান তাঁর বান্দারা হালাল রুযি অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ুক'। নবীজী তাঁর দোয়ার একটা অংশে প্রায়ই বলতেনঃ ‘হে খোদা! আমি বেকারত্ব ও অলসতার ব্যাপারে তোমার কাছে মুক্তি চাই'।তিনি আরো বলেছেনঃ ‘যার পানি এবং মাটি রয়েছে অথচ কর্মপ্রচেষ্টার অভাবে দারিদ্র্যক্লিষ্ট,সে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে।' নবীজীর জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ‘কুবা' মসজিদ নির্মাণ করার সময় নবীজী নিজেও মুসলমানদের সাথে কাধেঁ কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন, শ্রম দিয়েছেন,তাদেঁর সাথে ছোটো বড়ো পাথর টেনে মসজিদের স্থানে নিয়ে গেছেন।যখনি তাঁর কোনো সাহাবি তাঁর কাছে আসতেন এবং বিনয়ের সাথে তাঁর জায়গায় কাজ করতে বলতেন,নবীজী কিছুতেই অনুমতি দিতেন না,বরং বলতেনঃ ‘তুমি যাও,আরো তো পাথর আছে,নিয়ে আসো'।
নবী করিম (সা)একদিন দেখলেন শক্তিমান এক যুবক সেই সকাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। তাঁর সঙ্গীদের কেউ কেউ বললেন,এই যুবক যদি নিজের যৌবনটাকে আল্লাহর রাস্তায় কাজে লাগাতো তাহলে তা কতোই না প্রশংসনীয় হতো। নবীজী বললেনঃ ‘এভাবে বলো না, এই যুবক যদি নিজের চাহিদা মেটানোর জন্যে এবং অপরের কাছে সাহায্য চাওয়া থেকে মুক্তি পাবার জন্যে কাজ করে থাকে, তাহলে তার শ্রম আল্লাহর রাস্তাতেই ব্যয় হচ্ছে। একইভাবে যদি সে তার অসমর্থ বাবা-মার স্বার্থে কিংবা তার অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেপুলেকে অপরের দ্বারস্থ হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্যে কাজ করে থাকে, তাহলেও সে খোদার পথেই শ্রম দিচ্ছে'।নবীজী যেখানেই কারো প্রতি মনোনিবেশ করতেন তখনই তার পেশা সম্পর্কে জানতে চাইতেন।যদি সে বলতো যে কোনো কাজ করে না, তাহলে নবীজী রাগ করে বলতেনঃ ‘আমার আনুকূল্য হারালো। কোনো মুমিনের যদি পেশা না থাকে, তাহলে সে নিজের ধর্মকেই জীবিকার উপায় করে নেয়'।
নবীজীর একথার মানে হলো,জীবিকার ন্যূনতম জোগান না থাকলে মানুষের ধর্ম ও বিশ্বাস বিপদের মুখে পড়ে যায়। এ কারণে আমাদের সবারই এই দোয়া করা উচিতঃ ‘হে খোদা! আমাদেরকে বরকত দান করো! আমাদেরকে আর্থিক দৈন্যতার মাঝে আবদ্ধ করো না'! কেননা মানুষের রুটি রুযি নিশ্চিত না হলে ধর্মীয় কর্তব্য পালনে অমনোযোগী হয়ে পড়ে। যাই হোক আল্লাহ আমাদের সবাইকে কর্মমূখর জীবন দান করুন। এই দোয়ার মধ্য দিয়ে শেষ করছি আজকের আলোচনা।
ষষ্ঠ পর্ব
ইতোপূর্বে আমরা যেমনটি বলেছিলাম যে ইসলামের দৃষ্টিতে একজন মুসলমানের বিশ্বাস তার জীবনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ সকল ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ বিশ্বাস হচ্ছে জীবনের সকল কাজের ভিত্তিভূমি। তাই ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার লক্ষ্যও হচ্ছে মানুষ এবং সমাজকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পূর্ণতায় পৌঁছানো এবং মূল্যবোধগুলোকে শক্তিশালী করা। আর এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র তৈরির ব্যাপারে কাজের ভূমিকা অপরিসীম। কাজ মানুষকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিসহ পার্থিব জগতের উন্নতির পাশাপাশি পরকালীন জীবনের মুক্তিরও উপায়। যাই হোক এ বিষয়টি নিয়ে আজকের আসরে আমরা কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো।
আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে, ইসলামের মৌলিক একটি বিশ্বাস হচ্ছে প্রতিটি প্রাণীর রিযিকদাতা হলেন আল্লাহ, যেমনটি সূরা হুদের ছয় নম্বর আয়াতে এসেছে। তাহলে মানুষ কেন কাজ করে করে পরিশ্রান্ত হবে? কাজের প্রতি ইসলাম এতো গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারটা কি স্ববিরোধী নয়-এ রকম জিজ্ঞাসা অনেকের মনে নিশ্চয়ই জাগে। বিখ্যাত চিন্তাবিদ মরহুম আয়াতুল্লাহ মোতাহহারী এ সম্পর্কে বলেছেনঃ আল্লাহকে আমরা যদি যথার্থভাবে চিনি এবং তাঁর গুণাবলি সম্পর্কে জানি, তাহলে বুঝতে পারবো যে জীবিকার ব্যবস্থাপনা এবং মানুষের অধিকারের সাথে কোনো বিরোধ নেই। সেজন্যেই সকল অলি-আওলিয়াই কাজ করেছেন। আসলে রিযিকদাতার মানে হলো সৃষ্টিকূলের সক্ষমতাকে কাজে লাগাতে সহযোগিতা করা।
যেমন, একটি উদ্ভিদ যখন শেকড়ের সাহায্যে মাটি থেকে তার প্রয়োজনীয় খাবার গ্রহণ করে কিংবা কোনো জন্তু যখন তার দন্ত-নখরের শক্তি দিয়ে আক্রমণ চালায় তখন তারা মূলত তাদের রিযিক গ্রহণের শক্তিকেই কাজে লাগায় যা আল্লাহ তাদেরকে দিয়েছেন। এভাবে আল্লাহ তার সকল সৃষ্টিকেই রিযিক নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তবে মানুষ যেহেতু সৃষ্টির সেরা সেজন্যে মানুষকে অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন। মানুষকে দিয়েছেন বিবেক বুদ্ধির সেরা নিয়ামত। তাই মানুষ তার জীবিকা নিশ্চিত করার জন্যে নিজের মেধার শক্তিকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতে পারে। মরহুম অধ্যাপক মোতাহহারী খোদার রিযিকদাতা হবার ব্যাপারে আরো বলেনঃ মানুষ নিজেদের আয় উপার্জনের জন্যে কিংবা নিজেদের সমৃদ্ধির জন্যে যেসব চেষ্টা চালান, তাও আল্লাহর রায্যাকিয়াতেরই প্রকাশ। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন সকল প্রাণীর রিযকের দায়িত্ব তাঁর অর্থাৎ আল্লাহ যদি জীবিকার নিশ্চয়তা বিধানকারী না হতেন তাহলে সৃষ্টিকূলে না কোনো চাহিদা থাকতো না থাকতো সহজাত কোনো প্রবণতা। মানুষও নিজের অধিকার বা সম্পদ সংরক্ষণের ব্যাপারে আগ্রহী হতো না।
এদিক থেকে বলা যায় আল্লাহ হলেন রিযিক সরবরাহকারী,তবে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই সবকিছু করেন। আর প্রকৃতির একটি নিয়ম হলো চেষ্টা ও কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে বেশি সুযোগ সুবিধা মেলে। মানুষের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। মানুষেরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমৃদ্ধির বিষয়টি তার শারীরিক সক্ষমতা,চিন্তা ও বুদ্ধি-বিবেক অনুযায়ী কর্মতৎপরতার ওপর নির্ভরশীল। আর এইসব সক্ষমতা আল্লাহর জীবিকা সরবরাহকারী সত্ত্বারই প্রমাণবাহী।
আমরা আগেও বলেছি যে নবীজী এবং তাঁর আহলে বাইত কথায় এবং বাস্তবে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং নিজেরাও জীবিকা নির্বাহের কাজে তৎপর ছিলেন। একদিন ইমাম কাজেম (আ) নিজের ক্ষেতে কাজ করছিলেন। আলি বিন আবি হামযাহ নামে এক লোক তাঁর কাছে এসে বললেনঃ ‘কেন এ কাজ অন্যদেরকে করতে দিচ্ছেন না'? ইমাম বললেনঃ কেন দেবো! আমার চেয়েও উত্তম ব্যক্তি সবসময় এরকম কাজে ব্যস্ত ছিলেন। লোকটি জানতে চাইলোঃ কে? ইমাম বললেনঃ স্বয়ং রাসুলে খোদা এবং ইমাম আলী (আ)। তাঁদের সবাই আমার পূর্বপুরুষ।মূলত কাজ করাটা নবীজী এবং আল্লাহর মনোনীত বান্দাদের সুন্নাত। আলী (আ) এর জীবনীতে এসেছে তিনি সবসময় জেহাদের ময়দান থেকে ফিরে শিক্ষা ও বিচার সংক্রান্ত তাঁর নিয়মিত কাজকর্মের পাশাপাশি কৃষিকাজ করতেন।তিনি নিজ হাতে বহু খেজুর বাগান আবাদ করেছেন। তিনি মদিনার পশ্চিমের ‘ইয়াম্বা' এলাকায় নিজ হাতে একটি কূপ খনন করেছেন। প্রচণ্ড বাতাসের বেগ থাকায় এ এলাকায় কেউ কাজ করতো না। আলী (আ) ঐ সেখানে জমি কিনে নিজ হাতে বহু কূপ খনন করেন এবং বহু খেজুর বাগান করেন,কষ্ট তাঁকে কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারে নি।
আলী (আ) নিজের কর্মময় জীবনের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেনঃ ‘মদিনায় ভীষণরকম ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাজের সন্ধানে তাই ঘর থেকে বের হলাম। মদিনার উপকণ্ঠেই দেখতে পেলাম এক বুড়িকে, বেশ কিছু মাটির ঢিলা জমিয়ে রেখেছে। বুঝতে পারলাম সেগুলোকে পানি দিয়ে ভেজাতে চায়। আমি তার কাছে গিয়ে বললাম কাজটা আমি করে দিতে চাই, তবে মজুরি হিসেবে প্রতি বালতি পানি কূপ থেকে তোলার জন্যে একটি করে খুরমা দিতে হবে। আমি ষোলো বালতি পানি তুললাম।আমার হাতে ফোসকা পড়ে গিয়েছিল। ষোলোটি খুরমা নিয়ে নবীজীর কাছে গেলাম এবং দুজনে সেগুলো খেলাম'।
এরকম আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, একদিন আলী (আ) খুরমার অনেক বিচি বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো-এগুলো কী? আলী (আ) বললেনঃ ইনশাআ... খুরমা গাছ। লোকটি বললো, ইমাম ঐ খুরমা-বিচিগুলো সবই নিজ হাতে রোপন করলেন।
হযরত আলী (আ) একবার এক বক্তব্যে বলেছিলেনঃ মুমিন ব্যক্তি সবসময় কর্মব্যস্ত থাকে। যে কাজ করে তার শক্তি বেড়ে যায়। জীবিকার কার্যকারণ হলো কাজ। অর্থাৎ কাজের সাথে জীবিকার সম্পর্ক। তাই জীবিকা অর্জন করতে হলে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করতে হবে। শরীর ভালো লাগছে না-এরকম অলসতা কিংবা ফুরফুরে ভাব উভয় অবস্থাতে যারা কাজ করে তাদের প্রতি মোবারকবাদ। কেননা বিমর্ষতা এবং অলসতা পরকালকে ধ্বংস করে দেয়। এভাবে লক্ষ্য করা যাবে ন্যায়বিচার, বীরত্ব, তাকওয়া, জ্ঞানের দিক থেকে অন্যতম শীর্ষস্থানে থাকা সত্ত্বেও কাজ কর্মকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে দেখেছেন। হযরত আলী (আ) এর দৃষ্টিতে মানুষ যদি তার পেশায় ও কাজের ক্ষেত্রে আল্লাহর দেওয়া বিধান এভং মানবীয় মূল্যবোধগুলোর সীমারেখা ঠিকঠাকমতো মেনে চলে,তাহলে তা একধরনের ইবাদাত। এ ধরনের পেশাজীবী লোক আল্লাহর প্রিয়ভাজন। তিনি বলেছেনঃ ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পেশাজীবী এবং আমানতদারী ভালোবাসেন'।
সপ্তম পর্ব
ইসলামের দৃষ্টিতে কাজের গুরুত্ব এবং নবী-রাসূলগণসহ আল্লাহর প্রিয় অলি-আওলিয়াগণ যে সবসময় কাজ করেছেন এবং কাজ করাকে ইবাদাত বলে গণ্য করেছেন সে সম্পর্কে আমরা বিগত আসরগুলোতে খানিকটা কথা বলেছি। আজকের আসরে কাজ করার ক্ষেত্রে আল্লাহর ওপর নির্ভর করার গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো।
আল্লাহর ওপর নির্ভর করার মানে এই নয় যে,মানুষ তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে আল্লাহর দেওয়া শক্তিমত্তা আর বস্তুগত সুযোগ-সুবিধাগুলোকে কাজে না লাগিয়ে বসে থাকবে। বরং এর অর্থ হলো একজন মুমিন আল্লাহর ওপর নির্ভর করবে এবং তাঁর ওপর আস্থা ও ভরসাকে অন্য সবকিছুর ওপর অগ্রাধিকার দেবে। সূরা আল-ইমরানের ১৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘এবং কাজে কর্মে তাদের-অর্থাৎ মুসলমানদের-সাথে পরামর্শ করুন। এরপর যখন কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন,তখন আল্লাহ তা'আলার ওপর ভরসা করুন! কেননা আল্লাহ তাওয়াক্কুল কারীদের ভালবাসেন'। এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবীজীকে বলছেন যে, পর্যালোচনার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি প্রস্তুত করার পর আল্লাহর ওপর ভরসা করে কাজ বাস্তবায়ন করুন। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ প্রফেসর মূর্তযা মোতাহহারি এ সম্পর্কে বলেছেনঃ ‘ভরসার একটা জীবন্ত তাৎপর্য রয়েছে। তাহলো কোরআন যখনই চায় মানব জাতিকে কাজ বা আমল করার ব্যাপারে বাধ্য করতে,তখনই মানুষের মন থেকে ভয়-ভীতিগুলো দূর করার জন্যে আল্লাহর ওপর ভরসা করতে বলে। বলেঃ অগ্রসর হও! চেষ্টা করো'! তাওয়াক্কুলের প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে পরিপূর্ণ আস্থা, বিশ্বাস এবং ভরসা কেবল তার স্রষ্টার ওপরই করা উচিত। এ অবস্থায় পার্থিব জগতের সকল বস্তুরও সহায়তা নেওয়া উচিত কেননা বস্তুজগতের সকল উপায় উপকরণ আল্লাহর অধীন।একইভাবে ভরসাকারী ব্যক্তির জানা উচিত,বস্তু জগতের সকল উপায় উপকরণও আল্লাহর ইচ্ছায় নিয়ন্ত্রিত এবং সেগুলো মানুষের সেবায় নিয়োজিত। এমতাবস্থায় আল্লাহর ওপর ভরসা করার ফলে কাজকর্ম ছেড়ে অলস বেকার জীবনযাপন করার কোনো কারণ কিংবা সুযোগ নেই।
পবিত্র কোরআনে ‘জুলকারনাইনের' গল্পে আমরা লক্ষ্য করবো, তিনি আল্লাহ প্রদত্ত বস্তুজাগতিক সকল সুযোগ সুবিধার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও জুলুম নির্যাতনের মূলোৎপাটন করার কাজে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। জনগণ শত্রুদের অর্থাৎ ইয়াজুজ মাজুজের অত্যাচার নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়ে জুলকারনাইনের কাছে আবেদন জানায়।আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জুলকারনাইন শত্রুদের মোকাবেলায় শক্তিশালী একটি প্রাচীর নির্মাণ করেন। প্রাচীরটি নির্মাণ করেছিলেন লোহার টুকরো দিয়ে। এরপর ইয়াজুজ ও মাজুজ তার উপরে আর আরোহণ করতে পারল না এবং তা ভেদ করতেও সক্ষম হল না। যুলকারনাইন বস্তুজাগিতক সকল উপায় উপাদান ব্যবহার করে প্রাচীর নির্মাণ করার পরও বললেনঃ ‘এটা আমার পালনকর্তার পক্ষ থেকে একটা অনুগ্রহ'। এর মানে হলো সকল সুযোগ সুবিধা, সকল উপায় উপকরণ আল্লাহই আমাকে দিয়েছেন। সূরা কাহাফে এর বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
মানুষ প্রায়ই বিভিন্ন কাজ বাস্তবায়নের জন্যে কর্মসূচি প্রণয়ন করে বা পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনার ভেতর বাহির সুবিধা অসুবিধাগুলো ভালোভাবে পর্যালোচনা করে বাহ্যত তা বাস্তবায়নের পথে কোনোরকম বাধা বা সমস্যা না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই কাজ শুরু করে। অথচ দেখা যায় একটা সাধারণ কোনো ঘটনার কারণে তাদের সকল পরিকল্পনাই উলট পালট হয়ে যায় এবং তাদের কাজ ফলাফলশূণ্য হয়ে পড়ে। এর কারণটা হলো মানুষের জ্ঞান সীমিত, তাই সে সম্ভাব্য সমস্যা সম্পর্কে অবহিত নয়। তাছাড়া মানুষ যখন কাজ করা বা কাজ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সে ঠিক জানে না কোনটাতে তার কল্যাণ নিহিত। ধর্মীয় দৃষ্টিতে মানুষ আশাবাদী বাস্তবতার সম্মুখিন হয় এই চিন্তা করে যে সৃষ্টিজগতের একজন পালনকর্তা রয়েছেন,যার জ্ঞান,যার শক্তি এবং যার কৌশল সীমাহীন। তিনি বান্দাদের সকল কাজ আঞ্জাম দেওয়ার সামর্থ রাখেন এবং বান্দাদের প্রকৃত কল্যাণ সম্পর্কে জানেন। এরকম একজন পালনকর্তার ওপর ভরসা করে মানুষ মূলত সীমাহীন এক শক্তির সাথে সম্পর্কসূত্র নির্মাণ করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে সে তার কাজকর্মে আল্লাহর শক্তির দীপ্তি দেখতে পায়।
আল্লাহর ওপর ভরসা করার তাৎপর্য সম্পর্কে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ মরহুম আল্লামা সাইয়্যেদ হোসাইন তাবাতাবায়ি বলেছেনঃ ‘মানুষ অনেক সময় তার লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে প্রস্তুতি নেয় এবং প্রয়োজনীয় সকল শক্তি-সরঞ্জামও প্রস্তুত রাখে। কিন্তু আত্মিক বা মানসিক কিছু বিষয় যেমন ইচ্ছাশক্তির দৃঢ়তাহীনতা, ভয়ভীতি, অভিজ্ঞতার স্বল্পতা,উৎকণ্ঠা ইত্যাদি তার এবং তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে। এরকম অবস্থায় মানুষ যদি আল্লাহ সুবহানের ওপরে ভরসা করে তাহলে আর ইচ্ছা এবং সংকল্পগুলো দৃঢ় ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যারফলে মানসিক সকল বাধা-প্রতিবন্ধকতা, মানসিক সকল দুর্বলতা কেটে যায় এবং নির্ভরতার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে যোগসূত্র স্থাপিত হবার ফলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার আর কোনো কারণ থাকে না'। আল্লাহর ওপর ভরসা করলে মানুষের ভেতর পদক্ষেপ নেওয়া এবং তা বাস্তবায়ন করার একটা শক্তি-সাহস সৃষ্টি হয় যার কারণে চিন্তা-চেতনা কিংবা আচার আচরণে সর্বপ্রকার প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যায়। আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ আস্থাবান ব্যক্তি তার লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে যেসব উপায় উপকরণকে কাজে লাগায় সেসবের মাধ্যমে কিংবা অন্য কোনো পন্থায় আল্লাহ তাকে তার উদ্দেশ্য সফল করিয়ে দেবেন বলে বিশ্বাস করে।
এজন্যে তাওয়াক্কুল মানে এমনটি ভাবা ঠিক নয় যে মানুষ কেবল ইবাদাত বন্দেগিতে মশগুল থেকে আল্লাহর কাছে নিজের চাওয়া পাওয়ার কথা অভাব অভিযোগের কথা বলেই ক্ষান্ত হবে, কাজকর্ম আর করবে না। বর্ণনায় এসেছে যে পয়গাম্বর (সা) একটি দলকে দেখতে পেলেন যারা কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে বেকার বসে আছে। নবীজী তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘তোমরা তোমাদের জীবন জীবিকা কীভাবে নির্বাহ করো'? তারা বললোঃ আমরা আল্লাহর ওপর ভরসাকারী লোক। তাদের এই জবাব শুনে নবীজী বললেনঃ ‘তোমরা আল্লাহর ওপর ভরসাকারী নও বরং সমাজের বোঝা'। হিজরি দ্বিতীয় শতকে মুসলমানদের মাঝে যখন চিন্তাদর্শগত বিচ্যুতি দেখা দিয়েছিল,তখন একদল বলতো যে কাজকর্ম করাটা পার্থিব স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়, তাই তা ঈমান,তাকওয়া বা ধার্মিকতার সাথে সাংঘর্ষিক।
অথচ ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু আল্লাহর নিয়ামত এবং সেগুলো মানুষের উপকারেই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন,তাদের জন্যে হালাল করেছেন। তবে শর্ত হলো আল্লাহ প্রদর্শিত পন্থায় সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে এবং আল্লাহর পথে ব্যয়ও করতে হবে। তাহলে সেগুলো হবে নৈতিক এবং আত্মিক পূর্ণতার উপায়। নবীজী এবং তাঁর আহলে বাইত ইবাদাততুল্য কাজকর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের জন্যে তার নিদর্শন রেখে গেছেন।

অষ্টম পর্ব
সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো কাজকর্মে একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতা করা। প্রকৃতপক্ষে মানুষের জীবনচক্রের প্রবাহটাই সামষ্টিক এবং পরস্পরের প্রতি সহযোগিতামূলক। হযরত আলী (আ) মানুষের মাঝে সৃষ্টিগত তারতম্যের কারণ হিসেবে একে অপরের সেবায় এগিয়ে আসার কথা উল্লেখ করেছেন। এ বক্তব্যের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেনঃ ‘কোনো মানুষের জন্যেই স্থপতি, কাঠমিস্ত্রি, শিল্পশ্রমিক নিজের একার পক্ষে হওয়া সম্ভব নয় এবং অন্যদেরকে কাজে নিয়োজিত না করে সকল কাজ একার পক্ষে আঞ্জাম দেওয়াও অসম্ভব'। নিঃসন্দেহে যখন লোকজন একই রকম জীবন পদ্ধতি এবং একই স্তরের মেধা চর্চা করে কিংবা সামাজিক অবস্থানও যদি একই পর্যায়ের হয় তাহলে পরস্পরকে সেবা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় গোলমাল দেখা দেয়। কেননা লোকজন একইরকম যোগ্যতার অধিকারী হলে পরস্পরকে তেমন একটা প্রয়োজন পড়ে না,যারফলে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সহযোগিতার কোনো অর্থ থাকে না।
ঠিক যেমনি মানব দেহের কোষগুলো যদি নির্মাণ কাঠামো এবং কার্যদক্ষতার দিক থেকে একইরকমের হতো তাহলে মানবদেহের ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিতো। দেহকোষগুলো তাই প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন এবং নির্দিষ্ট কাজে নিয়োজিত। তেমনিভাবে মানুষের মধ্যেও প্রত্যেকটি দল একেকটি নির্দিষ্ট সুযোগ সুবিধা এবং মেধা ও যোগ্যতার অধিকারী,তাই তারা নিজেদের মেধা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে অন্যদের সহযোগিতা করতে পারেন। মানুষের মাঝে দায়িত্ব বণ্টনের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের সূরা যুখরুফের বত্রিশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ
‘তারা (অর্থাৎ কাফেররা) কি আপনার পালনকর্তার রহমত বন্টন করে? আমরা তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা পার্থিব জীবনে বন্টন করেছি এবং একের মর্যাদাকে অপরের উপর উন্নীত করেছি যাতে একে অপরের অধীনে থেকে পরস্পরকে সহযোগিতা করে। তারা যা সঞ্চয় করে,আপনার পালনকর্তার রহমত তারচেয়ে অনেক উত্তম'। তবে এই তরতম্যের কারণে মানুষকে শোষণ করার কোনো অজুহাত দাঁড় করানো ঠিক নয়। কারণ ইসলামে শ্রমিকদের অধিকার এবং তাদের নিয়োগের ব্যাপারে সামগ্রিক নীতিমালা রয়েছে।
সূরা কাসাসে বর্ণিত হয়েছে,হযরত মূসা (আ) নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে হযরত শুয়াইব (আ) এর অধীনে কাজ করতে রাজি ছিলেন। সূরা কাহাফে খিযির (আ) এর সাথে মূসা (আ) এর সঙ্গ দেওয়ার কাহিনীও বর্ণিত হয়েছে। সেখানেও তিনি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শ্রম দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। একইভাবে ‘জুলকারনাইন'কে অনেকেই প্রাচীর নির্মাণের জন্যে পারিশ্রমিক গ্রহণ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কর্মনীতির দৃষ্টিতে শ্রমিক হলো সে-ই যে নিয়োগদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শ্রম দেয়। শ্রমিকেরা হলেন সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণীর লোক, কেননা যে-কোনো দেশের অর্থনীতির চাকা শ্রমিকদের শ্রম ও শক্তির বলেই সচল থাকে।শ্রমিক শ্রেণীই তাদের বাহুবলের সাহায্যে কাজ করে অর্থনৈতিক কর্মসূচিগুলোকে বাস্তবায়ন করতে সহযোগিতা করে।
আর শ্রমিকেরা এই যে শ্রম দেয় তার কারণ হলো পারিশ্রমিক।এই পারিশ্রমিক দিয়েই তারা জীবিকা নির্বাহ করে। নিয়োগদাতাগণের দায়িত্ব হলো শ্রমিকদেরকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যাতে শ্রমিকের যথার্থ কল্যাণ হয় এবং মানসিক প্রশান্তি আসে।এটা নিশ্চিত হলে শ্রমিকেরাও ভালো এবং বেশি কাজ করবে।মানসিক প্রশান্তি সম্পর্কে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর একটি হাদিসে বর্ণিত আছে,তিনি বলেছেনঃ ‘কোনো ব্যক্তির জীবন জীবিকার উপায় উপকরণ যখন চাহিদা অনুযায়ী নিশ্চিত হয় তাহলে তার মানসিক অবস্থা প্রশান্ত হয়'।
ইসলামে একজন শ্রমিক এবং নিয়োগদাতার মধ্যে সম্পর্ক হলো সহকর্মী এবং অংশীদারিত্বের সম্পর্ক। ইসলামের দৃষ্টিতে একজন শ্রমিক এবং একজন নিয়োগদাতার মধ্যকার আচার ব্যবহার হতে হবে বিশ্বস্ততা,আন্তরিকতা ও সম্মানের ভিত্তিতে।নবী কারিম (সা), হযরত আলী (আ)সহ অন্যান্য ইমামগণ সবসময় কারিগরদের যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছেন এবং তাদের অধিকার রক্ষায় সদাসচেষ্ট ছিলেন। নবীজী বলেছিলেনঃ শ্রমিকের ব্যাপারে নিয়োগদাতার করণীয় হলো তাকে ভালো খাবার এবং পোশাক দিতে হবে এবং সাধ্যের অতীত কাজ তার ওপর চাপানো যাবে না'। নবীজী আরো বলেছেনঃ ‘তোমরা সবাই তোমাদের অধীনস্থদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। যে-ই শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দেওয়ার ব্যাপারে জুলুম করবে, আল্লাহ তার নেক আমলগুলো নষ্ট করে দেবেন এবং সে বেহেশতের মনোমুগ্ধকর সুঘ্রাণ থেকে বঞ্চিত হবে'। আহলে বাইতের মহান ইমাম হযরত সাজ্জাদ (আ)ও শ্রমিকদের ব্যাপারে সদয় এবং ন্যায়বান হওয়া এবং তাদের ভুলত্রুটিগুলোকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।একইভাবে শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার করতে নিষেধ করেছেন।
ইমাম সাজ্জাদ (আ) আরো বলেছেনঃ যে ব্যক্তিটি তোমার কাজগুলো আঞ্জাম দিচ্ছে তার অধিকারের ব্যাপারে তোমার জেনে রাখা উচিত ঐ শ্রমিকও তোমার মতোই আল্লাহর সৃষ্টি এবং প্রকৃতপক্ষে তোমার আদি পিতা-মাতা অর্থাৎ আদম এবং হাওয়া (আ) এরই উত্তরসূরি।তুমি তার স্রষ্টাও নও মালিকও নও এবং তার রুযিও তোমার হাতে নয়। তাই তুমি তার সাথে সদাচরণ করো এবং তাকে নির্যাতন করো না'। সবশেষে ইমাম রেযা (আ) এর জীবনের একটি বর্ণনা বিশেষ করে শ্রমিকদের অধিকার আদায় সংক্রান্ত একটি বর্ণনা দেওয়ার মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি টানবো আজকের আলোচনার। সোলায়মান নামের এক লোক ইমাম রেযা (আ) এর সাথে সঙ্গ দেওয়ার এক দিনের একটি স্মৃতি সম্পর্কে বলেছেনঃ
‘সেদিন আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো ইমামকে তাঁর ঘর পর্যন্ত সঙ্গ দেওয়ার। ইমাম রেযা (আ) এর ঘরের দরোজায় পৌঁছলাম। বিদায় চাইতে গেলে ইমাম তাঁর ঘরে আমাকে আমন্ত্রণ জানালো। আমি ভীষণ খুশি ও আগ্রহ ভরে ইমামের আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম এবং ঘরের ভেতর ঢুকলাম। বাসায় তখন বেশ কজন শ্রমিক কাজ করছিলো। তারা ইমামকে দেখেই কাজ রেখে তাঁর কাছে এসে সালাম করলো। ইমামের ঘর ছাড়া আর কোথাও শ্রমিকেরা তাদের নিয়োগদাতাকে দেখে এই পরিমাণ উৎফুল্ল হতো না। ইমাম রেযা (আ) মুচকি হেঁসে তাদের সালামের জবাব দেন। এমন সময় ইমামের নজর পড়ে অপরিচিত এক শ্রমিকের ওপর।ইমাম তার সম্পর্কে জানতে চাইলেন কে ও! জবাব এলো নতুন শ্রমিক, সম্প্রতি তাদের দলে ভিড়েছে।ইমাম জানতে চাইলেন তার পারিশ্রমিক ঠিক করা হয়েছে কিনা। জবাব দিলো-‘না!তাকে যা-ই দেন তা-ই নেবে'।
দেখলাম এ কথা শুনে ইমামের চেহারাটা কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গেল। মনে হলো যেন বিরক্ত হলেন এবং উঠোনের দিকে চলে গেলেন।আমি জিজ্ঞেস করলাম-হে ইমাম! কেন রাগ করলেন! ইমাম বললেনঃ বহুবার তাদেরকে বলেছি যে নতুন কোনো শ্রমিক এলে আগে তার পারিশ্রমিক ঠিক করে নেবে। চুক্তি বা কথাবার্তা ছাড়া কাজ করলে তাকে তিন গুণ বেশি পারিশ্রমিক দিলেও ভাবে কম দেওয়া হয়েছে। আর চুক্তি অনুযায়ী পারিশ্রমিক দিলে তা পেয়ে খুশি হয়ে যায়, তারচেয়ে খানিকটা বেশি দিলে বখশিস হিসেবে নিয়ে আরো খুশি হয়'।‘ তো এই হলো শ্রমিকদের ব্যাপারে ইসলামের নীতিমালা।
নবম পর্ব
নিঃসন্দেহে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ শক্তিগুলোর একটি হচ্ছে কর্মপ্রচেষ্টা। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিকাশে মানব সম্পদের অবস্থান বর্তমানে অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। মূলত বিভিন্ন দেশের সক্ষমতা বা উন্নয়নের প্রধান উপায়ই হলো কর্মপ্রচেষ্টা। যে দেশ বা জাতি যতো বেশি কর্মতৎপরতা চালাবে সে জাতি অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ততো বেশি সক্ষম হবে। হযরত আলী (আ) সুন্দর একটি বাক্যে বলেছেনঃ ‘যারা কর্মপ্রচেষ্টা চালায় তারাই উন্নতি ও অগ্রগতি লাভ করে,জ্ঞানী বেকাররা নয়'। তাঁর এ বক্তব্যের মানে হলো একটি সমাজ তখনই উন্নতি লাভ করে যখন সেই সমাজের জ্ঞানী-গুণীজনেরা আন্তরিকতার সাথে চেষ্টা প্রচেষ্টা চালায়, কাজ করে। কারণটা হলো জ্ঞান ও প্রজ্ঞাগুলোকে বাস্তবে কাজে লাগানো হলেই কেবল তা ফল দেয়।
যেমনটি বলেছিলাম যে কাজ এবং চেষ্টা প্রচেষ্টার ওপরই জীবনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত,আর ব্যক্তি ও সমাজের মনোদৈহিক সুস্থতাও নির্ভর করে সুস্থ অর্থনীতি আর জীবিকার ওপর। সেজন্যে একটি সমাজের প্রতিটি নাগরিকের উচিত সামাজিক যৌথ কর্মকাণ্ড ও সেবামূলক কাজসহ পণ্য সামগ্রী উৎপাদনের ক্ষেত্রেও গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের ভূমিকা রাখা। যে সমাজে কর্মচাঞ্চল্য যতো বেশি হবে সে সমাজে পণ্য সামগ্রী উৎপাদনের পরিমাণও ততোবেশি হবে-এটাই স্বাভাবিক,আর এই উৎপাদন প্রাচুর্যের কারণে সেই সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিও বৃদ্ধি পাবে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে ব্যক্তির খাওয়া-পরার চাহিদা যেমন মেটে তেমনি সামাজিক অবস্থানও তৈরি হয়। তবে ইসলামী সংস্কৃতির শিক্ষা হলো জনগণকে সামষ্টিক প্রচেষ্টা বা গণ অংশগ্রহণের দিকে আহ্বান জানানো। কর্মপ্রচেষ্টার ক্ষেত্রে কেবল ব্যক্তিগত স্বার্থ চিন্তা না করে সামাজিক স্বার্থ চিন্তা করার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে ইসলাম। এরকম চিন্তা করা হলে বা দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা হলে সমাজে সংহতির একটা প্রাণময় আবহ তৈরি হয়।
ইসলামের চিন্তাদর্শ অনুযায়ী উন্নয়নের মূলে রয়েছে প্রধানত মানুষ। তাই যে সমাজের মানুষের মেধা ও প্রতিভা যতো বেশি কাজে লাগে সে সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ততো বেশি উন্নয়ন অর্জিত হয়। যেহেতু মানুষ হচ্ছে একটি সমাজের সম্পদ, তাই সমাজের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক লক্ষ্য অর্জনের জন্যে পারস্পরিক সহযোগিতার বিকল্প নেই। সবাই সবাইকে সহযোগিতা করার মধ্য দিয়ে যে পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হয় সেই পণ্যের ব্যবহার করার অধিকার তাই সবারই থাকে। মরহুম অধ্যাপক মোতাহহারী (রহ) এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘আসলে কাজ হচ্ছে একটা সামাজিক দায়িত্ব আর মানুষের ওপর সমাজের একটা অধিকার রয়েছে। একজন ব্যক্তি যতোটুকুই খরচ করেন সেটুকু অন্যদের কাজের ফসল। আমরা যেই জামাকাপড় পরি,যেসব খাদ্যখাবার খাই, যেই জুতা পায়ে দেই এবং যে বাসায় বসবাস করি-এভাবে যে দিকেই তাকাই না কেন,সবই অন্যদের কর্মপ্রচেষ্টার ফল'।
সেজন্যে সমাজের সাথে মানুষের সম্পর্ক সৃষ্টি এবং সেই বন্ধনকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে কাজের ভূমিকা অপিরসীম। সামাজিক এই সম্পর্ক হলো উন্নয়নের জন্যে সমাজের সদস্যদের চেষ্টা প্রচেষ্টার চালিকাশক্তি। সমাজের যেমন ব্যক্তিকে প্রয়োজন তেমনি ব্যক্তিরও প্রয়োজন পড়ে সমাজের। উভয়ের প্রতি উভয়ের দায়িত্ব রয়েছে। ব্যক্তির প্রয়োজনীয়তা মেটানোর দায়িত্ব যেমন সমাজ বা সামাজিক দলগুলোর রয়েছে ঠিক তেমনি ব্যক্তিরও রয়েছে সমাজের চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব। এভাবেই পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যক্তি এবং সমাজের পরস্পরের মধ্যে যোগসূত্র সৃষ্টি করে, যার ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় সামাজিক ঐক্য ও সংহতি।
সমাজের সকল শ্রেণীর জন্যে কাজ ও পেশা সৃষ্টির মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত ও বাস্তবায়িত হয়। ইসলামে ‘ন্যায়' বলতে বোঝায় সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়াকে। কাজ বা পেশা যদি যথাযোগ্য না হয়,অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের আদর্শ যদি দুর্বল এবং বেকারত্বপূর্ণ হয় অথবা কাজের স্বল্পতা থাকে, তাহলে সামাজিক ন্যায় বাস্তবায়িত হবে না। মাদকাসক্তি, অনিয়ম ও দুর্নীতি ইত্যাদি অভাব-অনটন আর বেকারত্বের সাথে সম্পৃক্ত। অগ্রগতিহীনতা আর অনুন্নতির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর একটি হলো কাজের স্বল্পতা এবং বেকারত্ব কিংবা কাজের নিম্নমান। ইসলাম অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সংরক্ষণ করা এবং কর্মতৎপরতার প্রতি উৎসাহিত করার মাধ্যমে চেষ্টা করেছে শ্রেণীগত বিভেদ দূর করতে। বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যাঁরা পরিচালনা করছেন তাঁরা এখন চাকুরি বা কর্মে নিযুক্তির ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছেন। আজকাল যদিও মানুষের কাজের স্থান বহুলাংশেই দখল করেছে উন্নত প্রযুক্তি,তবু বলতেই হবে যে এই টেকনোলজি বা প্রযুক্তিও মানুষেরই আবিষ্কার।
এখন যদি কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত না হয় তাহলে একজন সৃজনশীল ব্যক্তি তার মেধা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পাবে না। এজন্যেই উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র না থাকার ফলে স্বাভাবিকভাবেই সৃজনশীলতার চর্চা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। এরই পথ ধরে মানুষ অর্থনৈতিক কল্যাণহীন কাজে জড়িয়ে পড়ে। যেমন সুদ, ঘুষ খাওয়ার কাজ কর্মে জড়িয়ে পড়ে। এভাবে গঠনমূলক কোনো কাজ না করেও ব্যাপক অর্থ-সম্পদের মালিক হয়ে যায়, যদিও অনেক ক্ষেত্রেই তা অবৈধ। পক্ষান্তরে মানুষ যখন দলে দলে ভালো ও কল্যাণজনক কাজে নিযুক্ত হয়,সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধীরে ধীরে ঘটতে থাকে। এভাবে সমাজের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে এবং জাতীয় আয় ও উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। আর রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধি পেলে দেশের জনগণের সেবা বেশি বেশি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
একদিন ইমাম সাদেক (আ) তাঁর সঙ্গীদের একজনকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘কী এখন কাজ করো? লোকটি জবাব দিলোঃ ব্যবসা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছি। ইমাম বললেনঃ ‘এরফলে তোমার সম্পদ হাতছাড়া হয়ে যাবে। ব্যবসার কাজ ছেড়ে দিও না আর আল্লাহর রহমত কামনা করো'! ইসলামের মহান মনীষীগণ যে কৃষিকাজ,ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ইত্যাদি কাজের ওপর জোর দিয়েছেন,তা থেকেই অর্থনৈতিক উন্নয়নে কর্মপ্রচেষ্টার ভূমিকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়ে যায়। আজকের আলোচনার পরিসমাপ্তি টানবো ইমাম আলী (আ) এর একটি বক্তব্য দিয়ে। নাহজুল বালাগার ৫২ নম্বর চিঠিতে অর্থনৈতিক বিভিন্ন দলের উদ্দেশ্যে মালেক আশতারকে লক্ষ্য করে ইমাম বলেছেন ‘ব্যবসায়ীগণ এবং শিল্পপতিদের সম্পর্কে আমার উপদেশ হলো-তাদেরকে ভালো ও কল্যাণময় কাজের প্রতি উৎসাহিত করো। চাই সেসব ব্যবসায়ী শহরের অধিবাসী হোক কিংবা সদা ভ্রাম্যমান। একইভাবে যারা কায়িক শ্রম দিয়ে কাজ করে। এরা স্বার্থ-মুনাফা ও কল্যাণের মূল উৎস'। হিজরতের পর নবীজীও কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির জন্যে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। আমাদের জন্যে এর মধ্যে ব্যাপক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।
দশম পর্ব
মানসিক এবং আত্মিক বিভিন্ন দিক থেকে কাজ এবং চেষ্টা প্রচেষ্টার বহু রকম কল্যাণ রয়েছে। কাজে নিয়োজিত হওয়া এবং বিশেষ পেশা মানুষকে বস্তুগত প্রশান্তি দেওয়া ছাড়াও মানুষের আত্মাকেও প্রশান্ত করে তোলে। কাজ করার ফলে মানুষ তার বস্তুগত ও আত্মিক প্রয়েজনীয়তা মেটানোর পাশাপাশি নিজের যোগ্যতা এবং পারদর্শিতার বিষয়টিও অনুভব করে। বিশেষ করে কাজ যদি হয় সৃজনশীল বা নতুন কোনো উদ্ভাবনীমূলক-তাহলে তো আর কথাই নেই। আমাদের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে কাজ, তবে কাজ কেবল অর্থ উপার্জনের জন্যেই করা হয় না। কাজ জীবনকে অর্থবহ করে তোলে,জীবনকে লক্ষ্যমুখি করে। মানুষের পরিচয় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কাজ। যোগ্যতা আর সামর্থকে সক্রিয় করে তোলার মাধ্যম এই কাজের মধ্য দিয়েই নিজেকে মর্যাদার অধিকারী ভাবতে শেখে মানুষ। চেষ্টা-প্রচেষ্টা এমন একটি চালিকাশক্তি যা মানুষকে তার ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষাগুলো বাস্তবায়নে কিংবা নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করে।
ইমাম আলী (আ) সবাইকে কর্মপ্রচেষ্টার দিকে আহ্বান জানিয়ে বলেছেনঃ ‘কর্মপ্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই! কেননা সত্য এই চেষ্টা প্রচেষ্টা ছাড়া অর্জিত হয় না'। তিনি তাঁর সন্তান ইমাম হাসান (আ) কে উপদেশ দিতে গিয়ে আরো বলেছেনঃ ‘কাজ বা চেষ্টা প্রচেষ্টাকে চূড়ান্তভাবে জীবনের অনুষঙ্গী করো! কেননা যে কোনো কিছু করতে চায় এবং কিছু একটা করার পেছনে লেগে থাকে সে পুরো কিংবা কমপক্ষে কিছুটা হলেও তার নাগাল পায়'। বেকারত্ব কিংবা নিষ্ক্রিয় থাকা অথবা অবাঞ্ছিত কোনো চিন্তায় ডুবে থাকা-ইত্যাদি আত্মিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। যে সৃজনশীল এবং উত্তম কাজকর্ম করা থেকে বিরত থাকে সে তো নিশ্চয়ই বসে থাকে না,ফলে ক্ষতিকর সব বিনোদন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আজকাল মানসিক রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কাজকর্ম, সুস্থ বিনোদন এবং সক্রিয় হওয়াকে কাজে লাগানো হচ্ছে।কাজ যে কেবল শানসিক অশান্তিকেই রোধ করে তাই নয় বরং ব্যক্তিত্বের সঠিক বিকাশ ও প্রতিভার লালন পালনের ক্ষেত্রে কাজ অপরিহার্য একটি উপাদান।
মানুষের মানসিক সুস্থতার একটি দৃষ্টান্ত হলো পেশাগত সন্তুষ্টি। পেশাগত সন্তুষ্টি কাজের দক্ষতা এবং কাজকর্মে ভুলভ্রান্তি হ্রাস করে। কাজের ব্যাপারে সন্তুষ্টির বিষয়টি পরিচালকদের জন্যেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা যে কর্মকর্তা বা কর্মচারী তার নিজের কাজের ব্যাপারে সন্তুষ্ট থাকে সে দক্ষতার সাথে কাজ করে এবং তার কাজের ফলাফল ভালো হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, কমকর্তাদের কাজের ফলাফল এবং কাজের প্রতি তাদের সন্তুষ্টিহীনতার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। যেসব কর্মকর্তা পেশাগতভাবে অসন্তুষ্ট কিংবা যথার্থভাবে সন্তুষ্ট নন,তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মনোদৈহিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
কখনো কখনো কাজ কেবলমাত্র দায়িত্ব পালনের জন্যেই করা হয়, আবার কখনোবা ঐ কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকার কারণে কাজ করা হয়।দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে কাজ করার মূল্য যদিও ব্যাপক তবু ভালোবাসাময় কাজের সাথে তার তুলনা হয় না। যিনি আন্তরিকতার সাথে কোনো কাজ করেন তিনি ক্লান্ত হন না।এ অবস্থায় সৃজনশীলতা,নতুন উদ্ভাবনী ইত্যাদির বিকাশ ঘটে এবং কাজও সবোর্ত্তমভাবে করা হয়।‘সোনালী সড়কের প্রতিটি ফুটপাত' নামক বইয়ের লেখক উ চুং কিম লিখেছেনঃ‘এটা খুবই চিন্তার বিষয় যে মানুষেরা কাজ বা নিজস্ব পেশাকে কেবল উদরপূর্তির মাধ্যম হিসেবে মনে করে,তারচেয়ে আরো দুঃখজনক হচ্ছে উত্তাল যৌবনকালে আশা উদ্দীপনা আর মানসিক প্রফুল্লতা নিয়ে কাজ করার পরিবর্তে যুবকেরা কাজের ব্যাপারে ক্লান্তি বোধ করে। অথচ যদি পেশাগত দায়িত্ব সন্তুষ্টির সাথে পালন করা হয় তাহলে ঐ পেশা বা কাজ করার মধ্যে একধরনের আনন্দ ও প্রফুল্লতা আসবে। যিনি সবসময় চান যে তাঁর সময়টা বেকার না কাটুক এবং যিনি তাঁর কাজের সীমারেখা টানতে চান না তিনি অবশ্যই দায়িত্বের সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ ব্যক্তির চেয়ে অনেক বেশি সাফল্য অর্জন করবেন'।
কাজ যদি মজা করে অর্থাৎ আনন্দের সাথে করা হয় এবং যদি ‘কাজ করছি' এরকম ভাবা না হয়,তাহলে ঐ কাজে ক্লান্তি আসবে না। মনে করতে হবে কাজটা যেন একটা মজার এবং আনন্দের ব্যাপার। টমাস এডিসনের জীবনের গল্পে আমরা পড়েছি, তিনি একজন পত্রিকা বিক্রেতা ছিলেন। স্কুলে যেতেন না। তিনি প্রায়ই তাঁর ল্যাবরেটরিতে খাবার খেতেন এবং সেখানেই ঘুমাতেন। দৈনিক আঠারো ঘণ্টা কাজ করতেন তিনি। কিন্তু এই কাজ তাঁর জন্যে কষ্টকর কিংবা বিরক্তিকর ছিল না।এডিসন বলেছেন জীবনে একদিনও তিনি বেকার ছিলেন না। ল্যাবরেটরিতে তাঁর সারাটা দিন বেশ আনন্দের মধ্যেই কাটতো। মানুষ কাজের মধ্যে তখনই সফলতা লাভ করে যখন অপরিসীম আশা ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে কাজটি করে। ইরানের বিখ্যাত মরমী কবি মাওলানা রুমিও তাঁর এক কবিতায় ইঙ্গিতে বলেছেন,সকল মানুষ একই রকম মেধা ও প্রতিভার অধিকারী নয়,বরং একেকজন একেক ধরনের প্রতিভা ও যোগ্যতার অধিকারী। এখন যার যেই প্রতিভা রয়েছে সে সেই কাজ নিয়ে অগ্রসর হলে সাফল্য আসবে। যার যে কাজের যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা নেই,সে সেই কাজে হাত দিলে তার সফল হবার সম্ভাবনা কম।
এডিসনকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ কেন অধিকাংশ যুবক সফল হতে পারে না? জবাবে তিনি বলেছিলেন-‘কেননা নিজেদের পথ তারা চেনে না এবং যে পথে তারা অগ্রসর হয় সেটা অন্যদের। এ ধরনের লোকেরা সমাজের দুই রকম ক্ষতি করে।প্রথমত যে কাজের যোগ্যতা তাদের রয়েছে সেই কাজ তারা করে না। দ্বিতীয়ত যে কাজ তারা করে সে কাজের যোগ্যতা তাদের নেই'।
একজন বিখ্যাত শিল্পীর জীবনীতে এসেছেঃ তিনি স্কুলে খুবই অমনোযোগী ছিলেন এবং একদম পড়ালেখা করতেন না। একদিন তাঁর এক শিক্ষক এসে তাকেঁ বোঝানোর সময় খেয়াল করে দেখলেন তাঁর ছাত্রটি মাটির ওপরে কয়লা দিয়ে ছবি আঁকছে-পাতাভর্তি শাখে একটি পাখির ছবি। শিক্ষক বুঝতে পারলেন এই ছেলের মেধায় ছবি আঁকা আসে গণিতের মতো জটিল পড়ালেখা নয়। তিনি ছাত্রের অভিভাবককে বিষয়টি জানিয়ে বললেনঃ আপনার ছেলেকে আর্ট স্কুলে দিলে ও ভালো করবে। কালের পরিক্রমায় সেই ছাত্র একদিন বিখ্যাত শিল্পী হয়ে তার শিক্ষকের সম্মান রেখেছিল।
বিন্দুমুখী চিন্তাধারা এবং অস্থিরতা থেকে দূরে থাকা মানব মন ও আত্মার ওপর কাজের আরেকটি ইতিবাচক প্রভাব। মানুষ যদি ভালো কোনো বিষয় কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা করে তাহলে বাজে চিন্তা করার ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে না।এমনকি যারা অনৈতিক ও মন্দ চিন্তায় নিমজ্জিত হয়ে গেছে,তাদেরকেও সুন্দর চিন্তা ও কাজের মাধ্যমে ধ্বংসাত্মক পথ থেকে ফেরানো সম্ভব। এভাবেই কাজ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে।
এগারোতম পর্ব
ফ্রান্সের বিখ্যাত গণিতবিদ ও দার্শনিক পাসকাল বলেছেনঃ ‘চিন্তা-চেতনা ও নৈতিকতার অবক্ষয়ের মূল হলো বেকারত্ব। বিশ্বের যে দেশই সমাজ থেকে অবক্ষয়ের মতো বিশাল এই ত্রুটি দূর করতে চায় তাদেরই উচিত জনগণকে কাজ দেওয়া এবং কাজ করতে বাধ্য করা,যাতে জনগণের অন্তরে গভীর প্রশান্তি আসে এবং এর প্রভাব ব্যক্তির অস্তিত্বের ওপর পড়ে'। বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা সুদূরপ্রসারী ও দূরদর্শী পরিচালকদের উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যনীতি মেনে চলা হলে পেশাগত সন্তুষ্টি আসে এবং কাজের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়।আজকাল কর্ম ও পেশার জগতে অনেক বৈচিত্র্য এসেছে। পরিবার, সংসারের ব্যয় নির্বাহ করা তথা জীবিকার যোগান দেওয়ার জন্যে মানুষ বহুরকমের পেশার সাথে নিজেদের জড়াচ্ছে।কিন্তু তারা যে তাদের পেশার ব্যাপারে কতোটুকু সন্তুষ্ট তা তাদের কাজ থেকে উৎপন্ন পণ্যের পরিমাণ থেকেই বোঝা যায়। যে তার পেশার ব্যাপারে সন্তুষ্ট, তার কাজেকর্মে তার নিজস্ব মেধা ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে। সেইসাথে যে কাজটি করতে সে ভালোবাসে ঐ কাজটি করতে সে কোনোরকম ক্লান্তি বা বিষন্নতা বোধ করবে না।
তবে যদি কেউ তার কাজ বা পেশার ব্যাপারে সন্তুষ্ট না থাকে, তাহলে সে নিজে যেমন বিষন্নতায় ভুগবে তেমনি তার কাজের পরিমাণও খুব বেশি হবে না। এ অবস্থায় ঐ ব্যক্তির পরিবার এবং তার সমাজও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই পেশাগত সন্তুষ্টি বিধানের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে উপযুক্ত পেশা নির্বাচন করা। তবে এই নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক দিক থেকে অনেক বিষয় দেখার আছে।যেমন ব্যক্তিগত ব্যাপারে শারীরিক উপযুক্ততা,শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রত্যাশিত পেশার ব্যাপারে অভিজ্ঞতা ও সামর্থ, পেশা নির্বাচনে ব্যক্তির পছন্দ ইত্যাদি।এসব বিষয় পেশাগত সন্তুষ্টি বিধানের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।আর সামাজিক দিকের মধ্যে রয়েছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ,প্রত্যেক সমাজের নিজস্ব সুযোগ সুবিধার পরিমাণ ইত্যাদি। সেইসাথে পেশা নির্বাচন করার ক্ষেত্রে লৈঙ্গিক বা শ্রেণীগত দিক,বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বিমোচনের মতো অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি ইত্যাদিও বিবেচনায় রাখতে হবে।কেননা এগুলো পেশার ওপর প্রভাব ফেলে।
পেশা বা কাজের ধরন ছাড়াও আরো বহু বিষয় মানসিক সুস্থতার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো কাজের পরিবেশে ন্যায়ানুগ থাকা,কাজের সুস্থতা ও নিরাপত্তা, কাজের সময়সীমা,পেশাগত নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা ইত্যাদি। গবেষণায় দেখা গেছে, যেখানেই কোনো সংস্থার কর্মকর্তাগণ নিজেদের পেশাগত সন্তুষ্টির কথা বলেছেন,সেখানেই দেখা গেছে কাজের ফলাফল সন্তোষজনক তথা উৎপাদনের পরিমাণ বেশি। সেইসাথে পেশাগতভাবে সন্তুষ্ট কর্মকর্তাদের শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি তাদের আয়ুও বেশি বলে পর্যালোচনায় দেখা গেছে। তাঁরা তাদেঁর পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট নতুন নতুন দায়িত্বগুলো খুব দ্রুত আয়ত্ত্ব করেন এবং পেশাগত বিপদ বা হুমকির সম্মুখিন হন কম। মোটকথা একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী যতো বেশি পরিমাণ শক্তিমান হবেন তাঁর পেশার প্রতি নিজস্ব দৃষ্টি ততোই ইতিবাচক হবে এবং তাঁর কাজের ফলাফলও হবে উচ্চমানের।
কর্মকর্তা কর্মচারীদের মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে আরেকটি বিষয় হুমকির সৃষ্টি করে তাহলো কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ এবং টেনশন। মানসিক চাপ বৃদ্ধির ফলে অবসাদগ্রস্ততা বা বিষন্নতা দেখা দেয়, মানসিক অশান্তি দেখা দেয়, উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। আর এসবের ফলে চিন্তাশক্তি ও মেধা যথাযথভাবে কাজ করে না। অধিকাংশ পেশাজীবীই কমবেশি কাজের ক্ষেত্রে মানসিক চাপের সম্মুখিন হয়েছেন। দায়িত্বের ব্যাপারে সতর্কতার জন্যে যদি এই চাপ পড়ে থাকে তাহলে তা মন্দ নয়।অনেকের ক্ষেত্রে বরং এই চাপ কাজের গতি বাড়াতে সাহায্য করে। কিন্তু কাজের আত্মিক ও মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেলে কর্মকর্তা কর্মচারীগণ বিষন্নতায় ভোগেন। কাজের চাপ কখনো কখনো মানসিক ক্লান্তি বয়ে আনে, নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয় এমনকি অন্যদের ব্যাপারেও এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে। কাজের চাপ থেকে সৃষ্ট সমস্যা রাগ, বিষন্নতা, মানসিক অস্থিরতা ইত্যাদির পাশাপাশি দেহের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এসবের ফলে কাজে ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়, যার ফলে উৎপাদনও হ্রাস পায়।
যেহেতু কর্মক্ষেত্রে লোকজনকে অনেক সময় কাটাতে হয়, সেজন্যে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ মনোদৈহিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপের প্রভাবে একজন কর্মচারী জাগ্রত অবস্থা থেকে ঘুমানো পর্যন্ত এমনকি যখন সে কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত থাকে না তখনো একরকম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভোগেন। পক্ষান্তরে কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ না থাকলে অর্থাৎ মানসিক সুস্থতা বিরাজ করলে কেউই মানসিক সমস্যায় ভোগেন না। এজন্যেই সকল পেশাজীবীকে নিজের কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে সন্তুষ্টি বোধ করতে হবে এবং কর্মক্ষেত্রের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করতে হবে। বেশ কিছু বিষয় পেশাজীবীদের মানসিক অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়,যেমন-বর্তমান পেশার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা,পারিবারিক বিচিত্র সমস্যা, পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক দূরত্ব,পেশাজীবীদের অবস্থার ব্যাপারে তাদের মায়ের উদ্বেগ,অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা, ইত্যাদি। মনোবিজ্ঞানীগণ এগুলো দূর করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কেননা এসবের ফলে স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনেও অনীহা দেখা দেয়,অনেক সময় অপারগ হয়ে পড়ে। ফলে চাকুরীজীবী এবং চাকুরীদাতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
প্রতিষ্ঠানের পরিচালকগণ সাধারণত বেশি মানসিক চাপে ভোগেন, সেজন্যে তাদেঁর উচিত নিজেদের মনোদৈহিক পরিস্থিতির ব্যাপারে বেশি বেশি সতর্ক থাকা। সেক্ষেত্রে পরিচালকদেরকে আরো বেশি ধৈর্যশীল হবার চেষ্টা করতে হবে, পেশাজীবীদেরকেও। অপ্রত্যাশিতভাবে কর্মক্ষেত্রে উত্তেজনায় যে এনার্জি ব্যয় হয় তাকে কাজের গুণগত মানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা উচিত। মানসিক স্বাস্থ্যনীতি সম্পর্কে সচেতন একজন পরিচালক জানেন যে বিষন্নতা এবং কর্মক্লান্তি কর্মচারীদের মনোযোগের পরিমাণের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। সেজন্যে একজন পরিচালকের উচিত কর্মক্ষেত্রে যেন মানসিক স্বাস্থ্যসম্মত সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকে সেই ব্যবস্থা নেওয়া। একজন পরিচালক যদি মানসিক স্বাস্থ্যনীতি মেনে চলেন তাহলে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নত হবে এবং কর্মক্ষেত্র থেকে টেনশন দূর হয়ে যাবে।
পারস্পরিক সহযোগিতা,বিশ্বস্ততা,আন্তরিকতার আবহ প্রতিষ্ঠা করা,সহকর্মীদের মাঝে পারস্পরিক সম্মান,কোনো কাজ করানোর ব্যাপারে জোর করা বা বাধ্য করার অভ্যাস ত্যাগ করা,সহকর্মীদের মেধা ও যোগ্যতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা এবং তাদের মেধা বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করা,তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে কাজে লাগানো এবং তাদেরকে অনুপ্রাণিত করা ইত্যাদি কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যসম্মত সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টিতে সাহায্য করবে। এ ব্যাপারে একজন পরিচালকের দায়িত্ব অপরিসীম। 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ