শুক্রবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১২

বোরকা নিয়ে বেগম রোকেয়ার একটি লিখনী...

আমি অনেক বার শুনিয়াছি যে, আমাদের ‘জঘন্য অবরোধ প্রথা’ই নাকি আমাদের উন্নতির অন্তরায়। উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত ভগ্নীদের সহিত দেখা সাক্ষাৎ হইলে তাঁহারা প্রায়ই আমাকে ‘বোরকা’ ছাড়িতে বলেন। বলি, উন্নতি জিনিসটা কি? তাহা কি কেবল বোরকার বাহিরেই থাকে? যদি তাই হয়, তবে কি বুঝিব যে, জেলেনী, চামারনী, ডুমুনী প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা আমাদের অপেক্ষা অধিক উন্নতি লাভ করিয়াছে?
আমাদের তো বিশ্বাস যে, অবরোধের সহিত উন্নতির বেশি বিরোধ নাই। উন্নতির জন্য অবশ্য উচ্চশিক্ষা চাই। কেহ কেহ বলেন যে, ঐ উচ্চশিক্ষা লাভ করিতে হইলে এমএ/বিএ পরীক্ষার জন্য পর্দা ছাড়িয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হইতে হইবে। এ যুক্তি মন্দ নহে! কেন? আমাদের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া এবং পরীক্ষক স্ত্রীলোক হওয়া কি অসম্ভব? যতদিন এইরূপ বন্দোবস্ত না হয়, ততদিন আমাদের পাস করা বিদ্যা না হইলেও চলিবে।
অবরোধ-প্রথা স্বাভাবিক নহে- নৈতিক। কেননা, পশুদের মধ্যে এ নিয়ম নাই। মনুষ্য ক্রমে সভ্য হইয়া অনেক অস্বাভাবিক কাজ করিতে শিখিয়াছে। যথা পদব্রজে ভ্রমণ করা স্বাভাবিক, কিন্তু মানের সুবিধার জন্য গাড়ী, পালকী প্রভৃতি নানাপ্রকার যানবাহন প্রস্তুত করিয়াছে। সাঁতার দিয়া জলাশয় পার হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু মানুষের নানাবিধ জলযান প্রস্তুত করিয়াছে। তাহার সাহায্যে সাঁতার না জানিলেও অনায়াসে সমুদ্র পার হওয়া যায়। ঐরূপ মানুষের ‘অস্বাভাবিক’ সভ্যতার ফলেই অন্তঃপুরের সৃষ্টি।
পৃথিবীর অসভ্য জাতিরা অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় থাকে। ইতিহাসে জানা যায়, পূর্বে অসভ্য ব্রিটেনেরা অর্ধনগ্ন থাকিত। ঐ অর্ধনগ্ন অবস্থার পূর্বে গায়ে রঙ মাখিতো। ক্রমে সভ্য হইয়া তাহারা পোশাক ব্যবহার করিতে শিখিয়াছে।
এই সভ্যতাভিমানিনী ইউরোপীয়া এবং ব্রাহ্মসমাজের ভগ্নীগণ মুখ ব্যতীত সর্বাঙ্গ আবৃত করিয়া হাটে মাঠে বাহির হন। আর অন্যান্য দেশের মুসলমানেরা (ঘরের বাহির হইবার সময়) মহিলাদের মুখের উপর আরও একখ- বস্ত্রাবরণ (বোরকা) দিয়া ঐ অঙ্গাবরণকে সম্পূর্ণ উন্নত করিয়াছেন। যাহারা বোরকা ব্যবহার করেন না, তাহারা অবগুন্ঠনে মুখ ঢাকেন,
কেউ কেউ বোরকা ভারী বলিয়া আপত্তি করেন। কিন্তু তুলনায় দেখা গিয়াছে, ইংরেজ মহিলাদের প্রকা- প্রকা- হ্যাট অপেক্ষা আমাদের বোরকা অধিক ভারী নহে।
পর্দা অর্থে তো আমরা বুঝি গোপন করা বা হওয়া, শরীর ঢাকা ইত্যাদি। কেবল অন্তঃপুরের চারি-প্রাচীরের ভিতর থাকা নহে। এবং ভালমতো শরীর আবৃত না করাকেই বেপর্দা বলি। যাহারা ঘরের ভিতর চাকরদের সম্মুর্খে অর্ধনগ্ন অবস্থায় থাকেন তাহাদের অপেক্ষা যাহারা ভালমতে পোশাক পরিয়া মাঠে বাজারে বাহির হন, তাহাদের পর্দা বেশি রক্ষা পায়।
বর্তমান যুগে ইউরোপীয় ভগ্নীগণ সভ্যতার চরম সীমায় উঠিয়াছেন; তাহাদের পর্দা নাই কে বলে? তাহাদের শয়নকক্ষে, এমনকি বসিবার ঘরেও কেহ বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করেন না। এ প্রথা কী দোষণীয়? অবশ্য নহে। কিন্তু এদেশের যে ভগ্নীরা বিলাতী সভ্যতার অনুকরণ করিতে যাইয়া পর্দা ছাড়িয়াছেন, তাহাদের না আছে ইউরোপীয়দের মত শয়নকক্ষের স্বাতন্ত্রতা না আছে আমাদের মত বোরকা।
কেহ বলিয়াছেন যে, ‘সুন্দর দেহকে বোরকা জাতীয় এক কদর্য্য ঘোমটা দিয়া আপাদমস্তক ঢাকিয়া এক কি¤ভুত কিমাকার জীব সাজা যে কী হাস্যকর ব্যাপার যাহারা দেখিয়াছেন, তাহারাই বুঝিতে পারিয়াছেন’- ইত্যাদি। তাহা ঠিক। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস যে রেলওয়ে প্লাটফরমে দাঁড়াইয়া কোন সম্ভ্রান্ত মহিলাই ইচ্ছা করেন না যে, তাহার প্রতি দর্শকবৃন্দ আকৃষ্ট হয়। সুতরাং ঐরূপ কুৎসিত জীব সাজিয়া দর্শকের ঘৃণা উদ্রেক করিলে কোন ক্ষতি নাই। বরং কুলকামিনীগণ মুখম-লের সৌন্দর্য দেখাইয়া সাধারণ দর্শকমন্ডলীকে আকর্ষণ করাই দোষণীয় মনে করিবেন।
ইংরেজি আদব কায়দা আমাদিগকে এই শিক্ষা দেয় যে, ভদ্রমহিলাগণ আড়ম্বররহিত পোশাক ব্যবহার করিবেন, বিশেষত পদব্রজে ভ্রমণকালে চাকচিক্যময় বা জাঁকজমক বিশিষ্ট কিছু ব্যবহার করা তাহাদের উচিত নহে।
নিমন্ত্রণ ইত্যাদি রক্ষা করিতে যাইলে মহিলাগণ সচরাচর উৎকৃষ্ট পরিচ্ছদ ও বহুমূল্য অলঙ্কার ব্যবহার করিয়া থাকেন। গাড়ী হইতে নামিবার সময় ঐ পরিচ্ছদ রূপ আভরণ কোচম্যান, দ্বারবান প্রভৃতির দৃষ্টি হইতে গোপন করিবার জন্য একটি সাদাসিধা বোরকার আবশ্যক হয়। রেলওয়ে ভ্রমণকালে সাধারণের দৃষ্টি হইতে রক্ষা পাইবার জন্য ঘোমটা কিম্বা বোরকার দরকার হয়।
সময় সময় ইউরোপীয় ভগ্নীগণও বলিয়া থাকেন, “আপনি কেন পর্দা ছাড়েন না।” কি জ্বালা! মানুষে নাকি পর্দা ছাড়িতে পারে। ইহাদের মতে পর্দা অর্থে কেবল অন্তঃপরে থাকা বুঝায়। নচেৎ তাহারা যদি বুঝিতেন যে, তাহারা নিজেও পর্দার হাত এড়াইতে পারেন না, তবে ওরূপ বলিতেন না। যদিও তাহাদের পোশাকেও সম্পূর্ণ পর্দা রক্ষা হয় না, বিশেষত সান্ধ্য পরিধেয় তা নিতান্তই আপত্তিজনক। তবু তাহা বহু কামিনীর একহারা মিহি শাড়ী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
তারপর অন্তঃপুর ত্যাগের কথা- অন্তঃপুর ছাড়িলে যে কি উন্নতি হয়, তাহা আমরা তো বুঝি না। প্রকারান্তরে উক্ত স্বাধীনা রমণীদেরও তো শয়নকক্ষরূপ অন্তঃপুর আছে।
মোটের উপর আমরা দেখিতে পাই সকল সভ্যজাতিদেরই কোন না কোন রূপ অবরোধ প্রথা আছে। এই অবরোধ-প্রথা না থাকিলে মানুষ ও পশুতে প্রভেদ কি থাকে? এমন পবিত্র অবরোধ-প্রথাকে যিনি ‘জঘন্য’ বলেন, তাহার কথার ভাব আমরা বুঝিতে অক্ষম।
সভ্যতাই জগতে পর্দা বৃদ্ধি করিতেছে। যেমন পূর্বে লোকে চিঠিপত্র কেবল ভাঁজ করিয়া পাঠাইত, এখন সভ্য লোকে চিঠির উপর লেফাফার আবরণ দেন। চাষারা ভাতের থালা ঢাকে না, অপেক্ষাকৃত সভ্য লোকে খাদ্য সামগ্রীর তিন চারি পত্র একখানা বড় থালায় রাখিয়া উপরে একটা খানপোষ বা সরপোষ ঢাকা দেন; যারা আরও বেশি সভ্য তাহাদের খাদ্যবস্তুর প্রত্যেক পাত্রের স্বতন্ত্র আবরণ থাকে। এইরূপ আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যাইতে পারে, যেমন টেবিলের আবরণ, বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়- ইত্যাদি।
আজকাল যে সকল ভগ্নী নগ্নপদে বেড়াইয়া থাকেন, তাহাদেরই আত্মীয়া সুশিক্ষিতা ভগ্নীগণ আবার সভ্যতার পরিচায়ক মোজা জুতার ভিতর পদযুগল আবৃত করেন। ক্রমে হাত ঢাকিবার জন্য দস্তানার সৃষ্টি হইয়াছে। তবেই দেখা যায়, সভ্যতার সহিত অবরোধ-প্রথার বিরোধ নাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ