রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

প্রবাসে প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার বিলেতের ওল্ডহ্যামে


বাংলাদেশ, মাতৃভাষার সাথে মিল রেখে দেশের নামকরণ। ভাষার প্রতি কি বিনম্র শ্রদ্ধা! নিজের ভাষায়, মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সালাম, বরকত, রফিক-জব্বারসহ নাম না জানাঅনেক ভাইয়ের প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার ইতিহাস
সবারই জানা। পৃথিবীতে এ এক বিরল দৃষ্টান্ত। আর তাইতো বাংলাদেশিরা পৃথিবীর যে যেই প্রান্তেই থাকুক না কেন ভুলতে পারে না নাড়ির টান, শেকরের টান, দেশমাতৃকার কথা। ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে সেই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলির কথা।
ইংরেজি ভাষা-ভাষীর এই দেশে সারাদিনের কর্মব্যস্ততায় একটা বাংলা শব্দও ব্যবহারের সুযোগ যেখানে কদাচিৎ, সেখানে দিন শেষে ঘরে ফিরে নিজের ছোট্ট শিশুটিকে ‘মা’ বলে ডাকার মধ্যেই যেন খুঁজে পাওয়া যায় সকল পার্থিব সুখ।
বিশ্বের যেসব দেশে বাঙালিরা অভিবাসী হিসেবে নোঙর গেড়েছে তার মধ্যে নিঃসন্দেহে বিলেত অন্যতম। বিলেতে বাঙালিদের অগ্রযাত্রা খুবই সম্ভাবনাময়। বিলেতে বাঙালির ইতিহাস শুরুর দিকে যতটা না কষ্টের আবরণে ঘেরা ছিল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ততটাই আলোকিত। বৃটেনের লন্ডন এবং বার্মিংহ্যামের পরেই যে শহরে সবচেয়ে বেশি বাঙালির বসবাস সেটা নিঃসন্দেহে ওল্ডহ্যাম। এখানে প্রায় বিশ হাজার বৃটিশ-বাংলাদেশি স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। এখানে বাংলাদেশিদের পদচারণা বেশ পুরনো। এখানকার রাস্তা-ঘাট, দোকানপাটে বাঙালিদের আনাগোনা দেখে প্রায়শঃই মনে হতে পারে এ যেন প্রবাসে একখণ্ড বাংলাদেশ। ভাগ্যান্বেষণে বাঙালিরা একদিন জাহাজে করে এখানে এসে গড়ে তুলেছেন স্থায়ী বসতি। যা ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় পেরিয়ে তৃতীয় প্রজন্মে পদার্পণ করেছে।
 
ওল্ডহ্যাম, ইংল্যান্ডের নর্থওয়েস্টের একটি ঐতিহ্যবাহী শহর। একসময় শিল্প এলাকা হিসেবে বেশ খ্যাতি ছিল এই ছোট্ট শহরটির। কিন্তু বর্তমানে সবকিছুকে ছাপিয়ে শহরটি বাংলাদেশিদের কাছে এক ঐতিহাসিক ঘটনার নীরব সাক্ষী। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য আত্মদানকারী শহীদদের স্মরণে এই ওল্ডহ্যাম শহরেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে দেশের বাইরে প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার।
 
বিলেতে নতুন প্রজন্মের বেশিরভাগ বৃটিশ-বাংলাদেশি ছেলে-মেয়ে প্রয়োজনীয় কয়েকটি শব্দ ছাড়া বাংলা যেমন বলতে পারে না, তেমনি পারে না বাংলা লিখতে। এই নতুন প্রজন্ম তথা বিলেতবাসী বাঙালিকে বাংলাভাষার ইতিহাস জানান দেওয়ার জন্যই হোক আর নাড়ির টানেই হোক- ১৯৯০ সালে ওল্ডহ্যামের কিছু যুবক স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য লোকাল কাউন্সিলে আবেদন জানান। সমসাময়িককালে ওল্ডহ্যামের বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও এ আবেদনের প্রতি একাত্মতা জানায়।
তখনকার ওল্ডহ্যাম কাউন্সিলের বাঙালি কাউন্সিলর এবং সাবেক মেয়র আব্দুল জব্বার সাহেবের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ওল্ডহ্যাম কাউন্সিল একটি স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য পঁচিশ (২৫,০০০) হাজার পাউন্ড এবং প্রয়োজনীয় স্থান বরাদ্দ করে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে নির্মিত ওল্ডহ্যামের এই স্থায়ী শহীদ মিনারটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৯৬ সালে এবং ১৯৯৭ সালে তা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। যা কিনা আমাদের জানা মতে- বাংলাদেশের বাইরে স্থায়ীভাবে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার।
দৃশ্যতঃ ব্যাপারটিকে খুব আহামরি কিছু মনে না হলেও তাৎপর্যগত দিক থেকে এটি বাঙালি জাতীয়তাবোধ এবং চেতনার ইতিহাসে একটি বড় মাইলফলক। এই স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের আগেও বিলেতের প্রবাসী বাঙালিরা ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পণ করতো কিন্তু সেটা হয়তো কোনও কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরে অস্থায়ীভাবে নির্মিত শহীদ মিনারে।
আর ’৯৭ সালে এই স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের পর থেকে ওল্ডহ্যাম ছাড়াও ম্যানচেস্টার, হাইড, বার্নলি, ব্র্যাডফোর্ড এমনকি বার্মিংহাম থেকেও বাঙালিরা একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ বেদীতে ফুল দিতে এসে জড়ো হয়। এখানকার যান্ত্রিক জীবনে কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে নিত্যদিনের জীবনযাত্রায় বাংলাভাষা ব্যবহারের সুযোগ নিতান্তই কদাচিৎ কিন্তু বাংলা যে তাদের মায়ের ভাষা তাকে তো প্রবাস জীবনের প্রতিকুল পরিবেশের পাথরে চাপা দিয়ে রাখা যায় না!
বিলেতে বসবাসরত বাঙালিরা পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি যতটা না আকৃষ্ট হয়েছে তারচেয়ে বরং নিজেদের কৃষ্টি, কালচার, ইতিহাস, ঐতিহ্যকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে এদেশের মূলধারার প্রতিটি সেক্টরে। এরই পথ ধরে আজ শাড়িপরা কোনও গ্রাম্যবধূ বৃটিশ পার্লামেন্টে, এমপি’র আসনে বসেছেন। এরই মধ্যেই বিলেতে মূলধারার রাজনীতিতে সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছেন বাংলাদেশের কোনও প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করা রোশনারা আলী এমপি বা টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাচিত প্রথম নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমানের মতো জন্মসূত্রে বাংলাদেশিরা। কিংবা চরম অর্থনৈতিক মন্দায় যেখানে বিলেতের অনেক নামীদামী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে ঠিক সেই সময়ে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে খোদ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছেন  জন্মসূত্রে আরেক বাংলাদেশি-বৃটিশ ইকবাল আহমেদ ওবিই। আরেকজন তো দস্তুর মতো বৃটিশ হয়ে এরই মধ্যেই এখানকার বাঙালি কমিউনিটিতে বৃটিশ হাইকমিশনার (বাংলাদেশেও দায়িত্ব পালন করে গেছেন) হিসেবে পরিচিত, হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী। এরকম বাংলাদেশে জন্ম নেয়া, বেড়ে উঠা আরো অসংখ্য প্রতিভাবান সুযোগের অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন।
আর বিলেতে জন্ম নেয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা সরকারি বড় অফিসার এসব তো এখন অহরহ নজরে পড়ছে। ’৫২ এর চেতনা, ’৭১ এর প্রেরণায় উজ্জীবীত হয়ে বিশ্ব দরবারে বাঙালিরা একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এমনটাই প্রত্যাশা করে বিলেতে বসবাসকারী বৃটিশ-বাংলাদেশিরা। আর সেক্ষেত্রে ওল্ডহামে নির্মিত দেশের বাইরে প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনারটি-ই হতে পারে তাদের চেতনা এবং প্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ