রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

কুয়েতে নিহত মহিদুলের মেয়ে রাজমিন: আর কেউ বাবা হারাক চাইনি, তাই ঘাতকদের ক্ষমা করে দিয়েছি


দণ্ডিত তিনজন : ইকবাল, হৃদয়, রমজান ও নিহত মহিদুলের মেয়ে রাজমিন।
'আমি বাবা হারিয়েছি। বাবার হত্যাকারী ওই তিনজনের দণ্ড কার্যকর হলে তাদের সন্তানও আমার মতো বাবাহারা হয়ে যাবে। আমার মতো আর কেউ বাবাকে হারাক, তা চাইনি। আর সে জন্যই কষ্ট বুকে চেপে খুনিদের ক্ষমা করে দিয়েছি।'
কথাগুলো কুয়েতে নির্মম হত্যার শিকার মানিকগঞ্জের মহিদুলের মেয়ে রাজমিনের। শনিবার সিঙ্গাইর উপজেলার গোপালনগর গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল রাজমিনের সঙ্গে। বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই নিজ সন্তানকে বুকে চেপে ধরে কেঁদে ফেললেন। বললেন, 'আমি যেমন বাবার জন্য কাঁদি, এই বাচ্চাটাও আমার জন্য কাঁদে। একই সঙ্গে অনুভব করি সন্তান হিসেবে বাবা আর মা হিসেবে সন্তানের প্রতি টান।'
মহিদুলের ভাই চান মিয়া ও হাবিবুলের সঙ্গে কথা হলো পূর্ব বান্দাইলে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে। হাবিবুল জানালেন, তাঁরা জানতে পেরেছেন যে ঘাতকরা হত্যার পর গাড়িতেই মহিদুলের লাশ রেখে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘাতক ইকবাল ঢালী, হৃদয় ঢালী ও রমজানের কাছে তাঁর ভাই প্রায় চার লাখ টাকা পেতেন।
কুয়েতের একটি শহরে তিনি স্কুলবাসের ড্রাইভার ছিলেন।
আর ঘাতকরা একই শহরে সবজির ব্যবসা করত। ঘটনার দিন ছিল ছুটি। টাকা দেওয়ার কথা বলে ওই তিনজন মহিদুলকে ডেকে নেয়। এরপর কুয়েত-সৌদি আরব সীমান্তের কাছে জলাভূমিতে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখে। প্রায় তিন মাস পর কুয়েতের কয়েকজন ওই জলাভূমিতে পাখি শিকারে গিয়ে পোড়া গাড়ি ও লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ তদন্ত করে তিন হত্যাকারীকে আটক করে।
হাবিবুল জানান, মহিদুল এর আগে সৌদি আরবেও চাকরি করেছেন। প্রায় ১০ বছর আগে তাঁর সঙ্গেই মহিদুল কুয়েতে চাকরি নিয়ে যান। তিনি ফিরে এলেও মহিদুল থেকে যান। মহিদুলের প্রথম স্ত্রী শুকুরী বেগমের ঘরে এক মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়ে রাজমিন ও ছেলে মজিবুর রহমান। এদের ছোট রেখেই প্রায় আট বছর আগে শুকুরী বেগম মহিদুলকে ডিভোর্স দিয়ে অন্যত্র বিয়ে করেন। হাবিবুল জানান, পত্রপত্রিকায় তাঁর ভাই দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল বলে প্রকাশ পেয়েছে। সেই দ্বিতীয় স্ত্রী আনোয়ারা বেগম মামলার বাদী হয়েছেন বলে তাঁরা শুনেছেন। কিন্তু তাঁর ভাই কোনো দিন দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলেননি। মহিদুল নিহত হওয়ার পরও আনোয়ারা বেগম তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।
মহিদুলের অন্য ভাই চান মিয়া ও মামা আবদুল হামিদ জানান, মূলত মানবিক কারণেই হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁদের পরিবার। আর টাকা-পয়সা নেওয়া হচ্ছে পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণেই। চান মিয়া জানান, বাবা-মা বেঁচে না থাকায় মহিদুলের ওয়ারিশ হিসেবে তাঁর ছেলে মজিবুর, মেয়ে রাজমিন ও অন্য তিন ভাইয়ের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। আজ রবিবারের মধ্যে হত্যাকারীদের আত্মীয়স্বজন ২১ লাখ টাকা দিলে প্রশাসনের মধ্যস্থতায় একটি চুক্তি হবে।
সিঙ্গাইরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসরিন সুলতানা জানান, মহিদুলের দ্বিতীয় স্ত্রী সম্পর্কে তাঁদের কিছু জানা নেই। যে কারণে ছেলেমেয়ে ও তিন ভাইকে মহিদুলের ওয়ারিশ করা হয়েছে। তাদের নিয়েই মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তবে মহিদুলের সন্তান ও ভাইদের পক্ষ থেকে দণ্ডিতদের ক্ষমা সংক্রান্ত চুক্তি হলেও তা পুরোপুরি ফলদায়ক হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেননা মামলার বাদী মহিদুলের দ্বিতীয় স্ত্রী আনোয়ারা বেগম এই ক্ষমা-সংক্রান্ত পুরো বিষয়টির বাইরে রয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত বাদী বেঁকে বসলে কুয়েতের আদালত বিষয়টি কিভাবে নেবেন, সে-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব মানিকগঞ্জের স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষ থেকে পাওয়া যায়নি।
রমজানের দণ্ড অপরাধীদের গাড়ি চালাতে দেওয়ায়!
দাউদকান্দি থেকে সাংবাদিক ওমর ফারুক মিয়াজী জানান, কুয়েতে মহিদুল হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে দণ্ডিতদের একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস উপজেলার উত্তর বলরামপুর গ্রামের রবিউল হোসেনের ছেলে রমজান হোসেন।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, চার ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় রমজান ২০০৭ সালে কুয়েতে গিয়ে টাইলস মিস্ত্রির কাজ নেয়। রোজগারের একটা অংশ জমিয়ে সে দুটি পিকআপ ভ্যান কিনে ভাড়ায় খাটাত। পিকআপ ভ্যানচালক হিসেবে সে চাকরি দেয় মুন্সীগঞ্জের হৃদয় ও ইকবাল নামের দুই সহোদরকে। হৃদয় ও ইকবালের সঙ্গে দ্বন্দ্বে নিহত হন মহিদুল। এ ঘটনায় দুই ভাই কুয়েত পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। যে গাড়িতে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার মালিক হিসেবে ছয় মাস পর পুলিশ রমজানকে আটক করে। দীর্ঘ তিন বছর বিচার কার্যক্রম চলার পর কুয়েতের আদালত দুই সহোদরের সঙ্গে রমজানকেও মৃত্যুদণ্ড হিসেবে শিরশ্ছেদের রায় ঘোষণা করেন। বিবাদীদের পক্ষ থেকে আইনজীবী কুয়েতের আমিরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে জানিয়ে দেওয়া হয়, নিহতের পরিবার ক্ষমা করলেই কেবল এই দণ্ড মওকুফ হতে পারে। সে অনুযায়ী কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে তাদের সব কাগজপত্র গত ২৪ জানুয়ারি ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘুরে দণ্ডিতদের পরিবারের কাছে আসে।
সর্বশেষ ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিন পরিবারের পক্ষ থেকে সাত লাখ টাকা করে ২১ লাখ টাকা নিহত মহিদুলের পরিবারকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আজ রবিবার টাকা দেওয়ার পর ক্ষমা-সংক্রান্ত চুক্তি হবে। পরে তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কুয়েতে পাঠানো হবে।
রমজানের বাবা রবিউল হোসেন এ প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, 'আমার ছেলে নিরপরাধ। অপরাধীদের নিজের গাড়ি চালাতে দেওয়ায় তাকেও একই দণ্ড দেওয়া হয়েছে। এখন দেশবাসীর মাধ্যমে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, আমার রমজানের মৃত্যুদণ্ড যেন কুয়েতের আদালত মওকুফ করে।' তার মা মনোয়ারা বেগমও তাঁর ছেলেকে নির্দোষ দাবি করেন বলেন, 'আমার ছেলে যদি জানত তারা খারাপ লোক, তাহলে তাদের গাড়ি চালাতে দিত না।'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ