বুধবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্যই আন্তর্জাতিক নদী আইনসহ সব রীতিনীতি উপেক্ষা করে ভারত আন্ত:নদীগুলোতে বাঁধ নির্মাণ ও স্লুইসগেট তৈরি করে নদীগুলোতে একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণ করছে

 দুই দেশের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে নদী। স্বাভাবিকভাবেই এই নদীর পানির সমান হিস্যা পাবে দুই দেশ। আন্তর্জাতিক যৌথ নদী আইনেও বলা আছে এমনটি। যৌথ নদীতে একটি দেশ অপর দেশের অনুমতি ব্যতিরেকে পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্থ করে, এমন স্থাপনা নির্মাণেও বিধি নিষেধ রয়েছে আইনে। কিন্তু এসব আইনের কোনো তোয়াক্কা না করেই, প্রতিবেশির প্রতি স্বাভাবিক সৌজন্যতা না দেখিয়েই পানি আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে ভারত। ভারত-বাংলাদেশের যৌথ নদীগুলোতে একের পর এক নির্মাণ করছে, বাঁধ, ড্যাম, স্লুইসগেট।
বাংলাদেশের উজানে অবস্থান ভারতের। এই ভৌগলিক সুবিধাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে নদীর পানি আটকে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে ভারত। আর ভাটিতে অবস্থান হওয়ায় ভারত যৌথ নদীতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ফলে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। ফলে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে বাংলাদেশ। বোরো ধান ও মৎস্যের আঁধার হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের হাওর ও নদীগুলো শুষ্ক মৌসুমে ভুগবে পানি সংকট ও বর্ষা মৌসুমে দেখা দিবে বন্যা।
ভারত একতরফা পানি আগ্রাসনের ফলে যৌথ নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ভারত ১২টি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি একতরফা নিয়ন্ত্রণ করছে বাঁধ ও স্লুইসগেট দিয়ে। যার পরিণতিতে শুকনো মৌসুমে নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, দেখা দিচ্ছে পানি সঙ্কট। আর বর্ষায় নদীগুলোর দু’কূল ছাপিয়ে বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে জনপদ। ভারতের এ পানি আগ্রাসনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে সিলেটসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। বিশেষ করে নদী ও হাওর-বাওর পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকায় বিপর্যয় নেমে এসেছে। এ ১২টি নদীতে বাঁধ ও স্লুইসগেট দিয়ে যুগ যুগ ধরে ভারত পানি শাসন করলেও বিষয়টি আলোচনায় আসেনি। সম্প্রতি টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ চুক্তি হওয়ার পর ভারতের কয়েকটি রাজ্যে ব্যাপক হৈ চৈ ও তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। ভারতীয় মিডিয়ায় উঠে ভারতের পানি শাসনের এ উদ্বেগজনক খবরটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্যই আন্তর্জাতিক নদী আইনসহ সব রীতিনীতি উপেক্ষা করে ভারত আন্ত:নদীগুলোতে বাঁধ নির্মাণ ও স্লুইসগেট তৈরি করে নদীগুলোতে একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণ করছে। শুকনো মৌসুম এলেই ভারত এগুলোতে মাটি দিয়ে বাঁধ দিয়ে সেচ কাজে পানি ব্যবহার করে, আর বর্ষায় খুলে দেয়। ফলে আমাদের হাওর-বাঁওড় শুকিয়ে যায়। আমরা প্রয়োজনে পানি পাওয়া যায় না। এ কারণে বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানির ঢল এবং শীতকালে পানি আটকে রাখার কারণে বাংলাদেশ মহাবিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পানি পাওয়ার নিশ্চয়তার জন্য মেকং রিভার কমিশনের মতো নদীর অববাহিকা ভিত্তিক আঞ্চলিক কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।
এদিকে সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্তের সারি নদীর উৎসস্থল মেঘালয় রাজ্যে মাইনথ্রু নদীর উজানে ১শ’ ২৬ মেগাওয়াট পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধ নির্মাণ করেছে ভারত। এই বাঁধ দিয়ে পানি মাইনথ্রু নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশে। গত বর্ষা মৌসুমে সারি নদীতে উজানের ঢল নামেনি। বাঁধে স্লুইসগেট দিয়ে পানি সরিয়ে নেওয়ায় শুকনো মৌসুম শুরুর আগেই নদীটি শুকিয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে চাহিদামত পানির অভাবে ইরি সেচ হুমকির মুখে পড়তে পারে বলেও স্থানীয়দের আশঙ্কা।
অপরদিকে দেশ-বিদেশে আলোচিত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ হলে এ জনপদে ভয়াবহ প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের আন্তঃসীমান্ত নদী সুরমা ও কুশিয়ারা মরে যাবে। বৃহত্তর সিলেটসহ দেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। পাশাপাশি আপার সুরমা-কুশিয়ারা রিভার প্রজেক্ট, সুরমা রাইট ব্যাংক প্রজেক্ট, সুরমা-কুশিয়ারা-বাউলাই বেসিন প্রজেক্ট এবং কুশিয়ারা বিঝনা ইন্টারবেসিন প্রজেক্ট চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্র জানায়, সুরমা ও কুশিয়ারা ছাড়াও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে ১২টি। এগুলো হচ্ছে- পিয়াইন, সারি, গোয়াইন, সোনাই, বড়দল, মনু, ধলাই, জুরি, লংলা, খোয়াই ও সুতাং নদী। এ নদীগুলোর উৎপত্তি মূলত ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের খাসিয়া জয়ন্তিয়া পাহাড়ে। এরই মধ্যে ধনু, মনু, ধলা, পিয়াইন, খোয়াই ও ধলাই নদীতে বাঁধ ও স্লুইসগেট নির্মাণ করে শুকনো মৌসুমে একতরফা পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত। বহু আগেই মনু নদীর উজানে ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলা শহরের কাছে কাঞ্চনবাড়িতে একটি বাঁধ নির্মাণ করে ভারত। ওই বাঁধ থেকে তারা মনু নদীর পানি একতরফা নিয়ন্ত্রণ করছে। ধলা উজানে ত্রিপুরার কুলাইয়ে একটি বাঁধ নির্মাণের ফলে মনু ও ধলা শুকনো মৌসুমে থাকে পানিশূন্য। পিয়াইন নদীর মাতৃনদী ডাউকির পশ্চিম তীরে ভারত ৪৩ মিটার লম্বা, ৯ মিটার চওড়া ও ৯ মিটার উঁচু গ্রোয়েন নির্মাণ করেছে।
এ গ্রোয়েনের কারণে জাফলং কোয়ারিতে পাথর আসার পরিমাণ কমে গেছে। খোয়াই নদীর উজানে ত্রিপুরা রাজ্যের চাকমাঘাটে ও কল্যাণপুরে দুটি বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। খোয়াইর ভারতীয় অংশে শহর প্রতিরক্ষার নামে স্পার নির্মাণ করে নদীকে বাংলাদেশ ভূখন্ডের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। কুশিয়ারায় গ্রোয়েন নির্মাণ করে এর স্রোত ঠেলে দিয়েছে বাংলাদেশের দিকে।
সীমান্ত নদী সারি বা সারি গোয়াইনের মাইনথ্রু ও লিমরিয়াং। মাইনথ্রু এবং লিমরিয়াং নদীর মিলিত স্রোত সারি গোয়াইন নদীর নাম নিয়ে সিলেটের জৈন্তাপুরের লালাখাল নামক স্থান দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মাইনথ্রু-লেসকা ড্যামটি ওমশাকিন, মাইনথ্রু এবং লামু নদীর সংযোগস্থল লেসকার ১শ’ মিটার উজানে অবস্থিত। এটি জৈন্তিয়া হিলস জেলার আমলারেম ব্লকের দেংশাকাপ গ্রামের কাছে তৈরি হয়েছে। মেঘালয় রাজ্য বিদ্যুৎ বোর্ড এ প্রকল্পের ৩টি ইউনিট থেকে ৪২ মেগাওয়াট করে মোট ১২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ করার জন্য বাঁধ নির্মাণ করেছে। ড্যামটির উচ্চতা ৫৯ মিটার। ড্যামের স্থাপনার মধ্যে রয়েছে লেসকা পয়েন্টে জলাধার এবং এর সঙ্গে ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ কন্ডাক্টর সিস্টেম। যাতে আছে প্রেসার টানেল এবং পেনস্টেক পাইপ। এ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আজ উদ্বোধনের কথা রয়েছে। এই বাঁধ দিয়ে পানি মাইনথ্রু নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশে। চলতি বর্ষা মৌসুমে সারি নদীতে উজানের ঢল নামেনি। ফলে সীমান্তবর্তী তিন উপজেলা জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের হাওর-বাওর, বিল-ঝিল ও খালে পর্যাপ্ত পানি নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বাঁধের জলাধারে তারা ইচ্ছামত পানি ধরে রাখতে পারবে এবং প্রয়োজনে ছেড়ে দিতেও পারবে। ফলে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের সারি নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব দেখা দেবে এবং বর্ষাকালে ভাটির দেশ বাংলাদেশ অতিপ্লাবনের মুখে পড়বে।
এ প্রসঙ্গে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান জায়দা শারমিন জানান, যে কোনো নদীর উৎসমুখে বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহ বন্ধ করলে পরিবেশে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এ বাঁধের ফলে সিলেট তথা সমগ্র দেশে কৃষি, মৎস্য ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অপরদিকে বাংলাদেশ ও ভারতের কয়েকটি রাজ্যের প্রবল আপত্তির পর আন্তর্জাতিক নদী শাসন আইন উপেক্ষা করে দেশ-বিদেশে আলোচিত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করতে যাচ্ছে ভারত। সিলেটের সীমান্ত থেকে প্রায় ১শ’ কিলোমিটার দূরে টিপাই বাঁধ নির্মাণ হলে এদেশের ৪টি বড় প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হবে। শুধু ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশই নয় বরং এ প্রকল্পের ফলে খোদ ভারতে ২৭ হাজার ২৪২ হেক্টর বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা আসাম, মণিপুর ও মিজোরামের ৩শ’ ১১ বর্গ কিলোমিটার ভূমি প্লাবিত হয়ে যাবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্যমতে, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ হলে আপার সুরমা-কুশিয়ারা রিভার প্রজেক্ট, সুরমা রাইট ব্যাংক প্রজেক্ট, সুরমা-কুশিয়ারা-বাউলাই বেসিন প্রজেক্ট এবং কুশিয়ারা বিঝনা ইন্টার বেসিন প্রজেক্ট চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিশ্বের অন্যতম বড় হাওর হাকালুকি এবং দেশের অন্যতম মুড়িয়া হাওর জীববৈচিত্র্য হারাবে। এছাড়াও রহিমপুরী খাল, মরইখাল, ছাগলীখাল, সেনাপতিরখাল, মান্দিখাল, তেলিখাল, দাসের খাল, নাপিতখাল, বালাইর হাওর, ফুলতলী হাওর, মজুমদারী হাওর, ডুবাই হাওর, লাসাইতলা হাওর, মইলাইট বিশাল হাওরসহ ছোট বড় খাল ও হাওর অস্তিত্ব হারাবে। বরাক প্রপাতের মতো অনেক ধর্মীয় তীর্থস্থান তলিয়ে যাবে। আর ভারতের ৩টি রাজ্যের যেসব ক্ষতি হবে তার সবকিছুই জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী অধিকার স্বার্থপরিপন্থী।
সূত্র জানায়, প্রায় ৮ বছর থেকে থেমে আছে আপার সুরমা-কুশিয়ারা প্রকল্পের কাজ। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নদী তীরের বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।
এ প্রসঙ্গে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখতারুল ইসলাম চৌধুরী জানান, টিপাইমুখ ড্যাম ইউরেশিয়ান ইন্ডিয়ান এবং মিয়ানমার টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থিত। যা বিশ্বের অন্যতম প্রধান ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। এ অঞ্চলে গত ১০০ বছরে ১৬টি বড় ধরনের ভূমিকম্প ৭ মাত্রার উপরে হয়েছে। তার মধ্যে একটি ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপুত্র নদের গতি পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান যমুনা নদী সৃষ্টি হয়। অপর ভূমিকম্পটি ১৯৫০ সালে হয় যার মাত্রা ছিল ৮.৩। এ ধরনের ৮ মাত্রার স্কেলের কোনো ভূমিকম্প হলে ১৭৩ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট ১৬ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন টিপাইমুখ ড্যাম সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ