রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

অর্থায়নের টানাপোড়েনে পদ্মা সেতুর পরিবেশগত ঝুঁকি আড়াল


দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ইনডিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে স্থলপথে যুক্ত করে ওই অঞ্চলে বাজার সম্প্রসারণে পদ্মা নদীর ওপর বহুমুখী সেতু তৈরি হবার কথা। প্রকল্পের মূল প্রস্তাবক ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এ সেতুটির অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পাশাপাশি এর পরিবেশগত ও মানবিকভাবে ‘নজিরবিহীন’ বিপর্যয়কর হওয়ার বিবরণও জানিয়েছিল। কিন্তু প্রকল্পের অর্থায়নকে কেন্দ্র করে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সঙ্গে সরকারের টানাপোড়েনের মধ্যে আড়ালে চলে যাচ্ছে এটার বিপর্যয়কর দিকগুলো।

ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের নিজস্ব সমীক্ষাতেই জানা গেছে, সেতু সংলগ্ন অঞ্চলে ‘নজিরবিহীন’ পরিবেশগত বিপর্যয় তৈরি হবে। সমীক্ষা অনুযায়ী পরিবেশগতভাবে সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এ প্রকল্পের সুরক্ষা উদ্যোগগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না-সরকার এ বিষয়ে কিছুই জানায়নি।

দেশে এর আগে নানা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার অর্থায়নে বাস্তবায়িত হওয়া নানা প্রকল্পের পরিবেশগত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। বিশেষত পরিবেশগত, মানবিক ও সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনা দূরের কথা, এসব বিষয়ে উন্নয়ন সংস্থাগুলোর নিজেদের যেসব নীতি আছে- সে সব বাস্তবায়নও করাতে পারেনি সরকার।

এখন পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিবেশগত, মানবিক ও সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের নিজস্ব নীতিমালার পদক্ষেপগুলো নেয়া হচ্ছে কি না; সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।

ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের পরিবেশগত সমীক্ষা (এনভায়রনমেন্টাল অ্যাসেসমেন্ট) অনুযায়ী পদ্মা সেতু প্রকল্পটি পরিবেশগত ঝুঁকির দিক থেকে ‘এ’ শ্রেণীভুক্ত প্রকল্প। পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করে ব্যাংকটি তার প্রকল্পগুলোর পরিবেশগত ঝুঁকির কথা জানান দেয়। তার মধ্যে ‘এ’ শ্রেণী হলো সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ।

 ব্যাংকটির নিজস্ব সমীক্ষায় নির্ধারণ করা হয়েছে যে;

এক. সেতু প্রকল্পের জন্য ওই অঞ্চলে ব্যাপক বৃক্ষ নিধন করতে হবে। যা আবার বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে যার পূরণ করা সম্ভব নয়। প্রকল্পের জন্য প্রায় ২,০০,০০০ গাছ কাটতে হবে। পুরো বসতি এলাকার বাশঝাড় ও কলাগাছ ইত্যাদি সব কাটতে হবে।

দুই. চরাঞ্চলের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেতু প্রকল্পটি গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র-যমুনার প্লাবন সমভূমিতে অবস্থিত। প্লাবন সমভূমির স্বাভাবিক প্রতিবেশ বিঘ্নিত হলে সে অঞ্চলে জলজীবন ও প্রাণিজীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে। ভাঙন বেড়ে যাবে।

তিন. গঙ্গার বাংলাদেশ অংশ, পদ্মা নদী ইলিশ মাছের অন্যতম প্রধান প্রজননক্ষেত্র। তাছাড়া গাঙ্গেয় ঘড়িয়াল এবং ডলফিনের চারণ এলাকা এখানকার পদ্মানদী। এ কথা সমীক্ষায় উল্লেখ করা হলেও ইলিশের প্রজননক্ষেত্রসহ বঙ্গোপসাগর থেকে আসা ও যাওয়ার পথ এবং ঘড়িয়াল ও ডলফিনের ওপর এর কি প্রভাব পড়বে- সে বিষয়টি সমীক্ষায় স্রেফ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

চার. এসব পরিবেশগত, মানবিক ও সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি বিষয়ে ব্যাংকটি তার সমীক্ষায় বলছে, ‘‘এ প্রকল্পের কারণে সমাজের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব পরতে পারে’’। সমীক্ষায় ‘তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব’ এর বিবরণ এ রকম; ১৩,৫৭৮ টি পরিবার এবং ৭৬,৬৩৭ জন ব্যক্তি এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এদের মধ্যে ৪৭,৬৩৭ জন হারাবে কৃষি জমি,২০,৯৭২ জন হারাবে বসতবাড়ি, ৫,১৭৯ জন ব্যবসা হারাবে। জীবিকার জন্য সরাসরি নদীর ওপর নির্ভরশীল ২,৮৮২ জন দিনমজুর কাজ হারাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ