মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

ইসলামের দৃষ্টিতে হতাশা এবং প্রতিকারের উপায়






জীবনের নানা প্রাঙ্গনে আমরা হরহামেশাই নানা ধরনের হতাশায় ভুগে থাকি। এই হতাশার সৃষ্টি কিছু অজানা ভয় থেকে। বর্তমান যুগের এমন একটা মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি জীবনের কখনো না কখনো হতাশায় ভুগেননি। অন্যভাবে বলতে গেলে আমরা বিশেষ কিছু সময়ে ঈমান হারিয়ে ফেলি। কেননা কোন মুসলমানই হতাশায় ভুগতে পারেন না। হতাশ হওয়া একটা কুফরী। একথা কেন বললাম তা বুঝতে হলে নিচের আয়াতটা পড়ুন। ‍সুরা ইউসুফের ৮৭ নং আয়াতে স্পষ্টভাবেই আল্লাহপাক ঘোষনা করেছেন,

يَا بَنِيَّ اذْهَبُواْ فَتَحَسَّسُواْ مِن يُوسُفَ وَأَخِيهِ وَلاَ تَيْأَسُواْ مِن رَّوْحِ اللّهِ إِنَّهُ لاَ يَيْأَسُ مِن رَّوْحِ اللّهِ إِلاَّ الْقَوْمُ الْكَافِرُونَ

বৎসগণ! যাও, ইউসুফ ও তার ভাইকে তালাশ কর এবং আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহর রহমত থেকে কাফের সম্প্রদায়, ব্যতীত অন্য কেউ নিরাশ হয় না। (সৃরা ইউসুফ আয়াত ৮৭)

আল-কোরআনের সুরা যুমার ৫৩নং আয়াতে আল্লাহপাক আরো বলেন,

قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِن رَّحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ( সুরা যুমার, আয়াত ৫৩)

আল-কোরআনের সুরা আনকাবুতের বলা হয়েছে,
وَالَّذِينَ كَفَرُوا بِآيَاتِ اللَّهِ وَلِقَائِهِ أُوْلَئِكَ يَئِسُوا مِن رَّحْمَتِي وَأُوْلَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

যারা আল্লাহর আয়াত সমূহ ও তাঁর সাক্ষাত অস্বীকার করে, তারাই আমার রহমত থেকে নিরাশ হবে এবং তাদের জন্যেই যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। (সুরা আনকাবুত, আয়াত ২৩)

উপরোক্ত আয়াত সমূহ দ্বারা এটা সুষ্পষ্ট হয়েছে যে, হতাশ বা নিরাশ হওয়া আল্লাহর প্রতি ঈমান-এর বিপরীত।

হতাশ হওয়ার মতো কিছু এলে করণীয় কি?

জীবনের নানা বাঁকে মুমীনের জীবনে হতাশ হবার মতো পরিস্থিতি প্রতি পদে পদেই আসতে পারে। দুঃখ কষ্ট জীবনেই অংশ। এসব এলেই হতাশ হয়ে পড়া কোন মুমীনের লক্ষণ নয়। এগুলো এলে কি করতে হবে তা-ও আল্লাহপাক বাতলে দিয়েছেন। আল-কোরআনে বলা হয়েছে,

فَإِذَا مَسَّ الْإِنسَانَ ضُرٌّ دَعَانَا ثُمَّ إِذَا خَوَّلْنَاهُ نِعْمَةً مِّنَّا قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ بَلْ هِيَ فِتْنَةٌ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ
মানুষকে যখন দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে আমাকে ডাকতে শুরু করে, এরপর আমি যখন তাকে আমার পক্ষ থেকে নেয়ামত দান করি, তখন সে বলে, এটা তো আমি পূর্বের জানা মতেই প্রাপ্ত হয়েছি। অথচ এটা এক পরীক্ষা, কিন্তু তাদের অধিকাংশই বোঝে না। (সুরা আল জুমার, আয়াত: ৪৯)

সুরা মায়েদার ৭৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে,
أَفَلاَ يَتُوبُونَ إِلَى اللّهِ وَيَسْتَغْفِرُونَهُ وَاللّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
তারা আল্লাহর কাছে তওবা করে না কেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে না কেন? আল্লাহ যে ক্ষমাশীল, দয়ালু। (সুরা ময়েদা, আয়াত ৭৪)

وَإِذَا مَسَّ الإِنسَانَ الضُّرُّ دَعَانَا لِجَنبِهِ أَوْ قَاعِدًا أَوْ قَآئِمًا فَلَمَّا كَشَفْنَا عَنْهُ ضُرَّهُ مَرَّ كَأَن لَّمْ يَدْعُنَا إِلَى ضُرٍّ مَّسَّهُ كَذَلِكَ زُيِّنَ لِلْمُسْرِفِينَ مَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ
আর যখন মানুষ কষ্টের সম্মুখীন হয়, শুয়ে বসে, দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকতে থাকে। তারপর আমি যখন তা থেকে মুক্ত করে দেই, সে কষ্ট যখন চলে যায় তখন মনে হয় কখনো কোন কষ্টেরই সম্মুখীন হয়ে যেন আমাকে ডাকেইনি। এমনিভাবে মনঃপুত হয়েছে নির্ভয় লোকদের যা তারা করেছে। (সুরা ইউনুছ, আয়াত ১২)

قُلِ ادْعُواْ الَّذِينَ زَعَمْتُم مِّن دُونِهِ فَلاَ يَمْلِكُونَ كَشْفَ الضُّرِّ عَنكُمْ وَلاَ تَحْوِيلاً
বলুনঃ আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে তোমরা উপাস্য মনে কর, তাদেরকে আহবান কর। অথচ ওরা তো তোমাদের কষ্ট দুর করার ক্ষমতা রাখে না এবং তা পরিবর্তনও করতে পারে না। (সুরা বণী ইসরাইল, আয়াত ৫৬)

وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُواْ لِي وَلْيُؤْمِنُواْ بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ
আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে বস্তুতঃ আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য। যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে। ( সুরা বাকারাহ, আয়াত ১৮৬)

قُلِ اللّهُ يُنَجِّيكُم مِّنْهَا وَمِن كُلِّ كَرْبٍ ثُمَّ أَنتُمْ تُشْرِكُونَ
আপনি বলে দিনঃ আল্লাহ তোমাদেরকে তা থেকে মুক্তি দেন এব সব দুঃখ-বিপদ থেকে। তথাপি তোমরা শেরক কর। ( সূরা আল আন-আম, আয়াত ৬৪)

وَأَيُّوبَ إِذْ نَادَى رَبَّهُ أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ
এবং স্মরণ করুন আইয়্যুবের কথা, যখন তিনি তাঁর পালনকর্তাকে আহবান করে বলেছিলেনঃ আমি দুঃখকষ্টে পতিত হয়েছি এবং আপনি দয়াবানদের চাইতেও সর্বশ্রেষ্ট দয়াবান। (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮৩)

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اصْبِرُواْ وَصَابِرُواْ وَرَابِطُواْ وَاتَّقُواْ اللّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
হে ঈমানদানগণ! ধৈর্য্য ধারণ কর এবং মোকাবেলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পার। (সুরা আল ইমরান, আয়াত: ২০০)

হাদীস শরীফে বলা হয়েছে,
তোমাদের মধ্যে কেউ বিপদগ্রস্থ হলে সে বলবে, ‘নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্যে এবং তারই নিকট আমাদের প্রত্যাবর্তন। হে আল্লাহ, তোমার নিকট আমার দুঃখের যোগ্য পুরস্কার আছে; অতএব আমাকে তা থেকে মুক্ত কর এবং উত্তম কিছু দান কর।’’---তিরমিজি ও ইবনে মাযা।
আল্লাহ যার কল্যাণ কামনা করেন, তাকে বিপদে জড়িত করেন।---বুখারী।
মুমেন এমন কোন দুঃখ, যন্ত্রনা, রোগ এবং শোক ভোগ করে না বা সে সম্বন্ধে চিন্তা করে না যার জন্যে আল্লাহ তার পাপ মার্জনা না করেন।-তিরমিজি।
মুমীন ব্যধিগ্রস্থ হলে মহিমাময় আল্লাহ যখন তাকে মুক্তি দেন, তখন তা তার অতীত পাপের বিনিময় এবং ভবিষ্যতের জন্যে উপদেশ স্বরুপ হয় এবং মুনাফেক পীড়িত হয়ে আরোগ্য লাভ করলে তার তুলনা সেই উটের তল্য, যাকে তার প্রভূ বন্ধন করে রেখে পরে মুক্তি দিয়েছিল। কিন্তু সে জানতো না কেনই বা তাকে বন্ধন করা হয়েছিল এবং কেনই বা তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে।------আবু দাউদ।
আমার প্রভূ বলেন, আমার সম্মান ও শ্রেষ্টত্বের শপথ যাকে আমি ক্ষমা করতে ইচ্ছে করি, তাকে কখনো এ পৃথিবী হতে অপসারিত করি না যে পর্যন্ত আমি দৈহিক পীড়া এবং জীবিকার কৃচ্ছতা দ্বারা তার গ্রীবাকে পাপমুক্ত না করি।----মিশকাত।
বান্দা অত্যধিক পাপাসক্ত হয় এবং এমন কোন পূণ্য থাকে না যদ্বারা তা খন্ডিত হতে পারে, আল্লাহ তখন তাকে মুক্তি দেবার উদ্দেশ্যে দুঃখ কষ্টে জড়িত করেন।----মিশকাত।
আল্লাহ বলেন, যখন তোমাদের মধ্যে কেউ বিপদগ্রস্থ হয় সে তখন তা আমার নিকট উল্লেখ করুক।----সগির।
ধন সম্পত্তির প্রাচুর্য্যই মানুষকে ধনী করে না, বরং হৃদয়ের প্রফুল্লতাই মানুষকে প্রকৃত ধনী করে।---শায়খান।
সেই ব্যক্তিই সুখী যে খোদার বাধ্য হয় এবং তার জীবিকাকে যথেষ্ট মনে করে এবং তাতেই সন্তুষ্ট থাকে।----মুসলিম।
পার্থিব বিষয়ে সংযম আত্মা ও দেহের সৌরভ বিস্তার করে এবং পার্থিব বিষয়ে মোহ দুঃখ ও বিপদ বৃদ্ধি করে।----সগির।
(উপরোক্ত হাদীস সমুহের তথ্যসুত্র: হাদীসের আলো, বাংলা একাডেমীর পক্ষে আহমদ পাবলিশিং হাউজ, পৃষ্ঠা-২৮৭-২৯০)
এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, ঈমানের দাবিদার হলে, অবশ্যই হতাশা বা নিরাশা নামের কিছু আপনার মধ্যে থাকতে পারবে না। থাকলে ঈমান থাকবে না। এটা অবশ্যই কুফরী। আল্লাহপাক আমাদের সকলকে এ মারাত্মক কুফরী থেকে বেঁচে থাকার তওফিক দান করুন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ