মঙ্গলবার, ৩ এপ্রিল, ২০১২

মেট্রো রেল কি আসলেই ঢাকাকে বদলে দিবে?


যোগাযোগের মাধ্যম

বাস ৪৪%
রিকশা ৩৪%
প্রাইভেট কার ৪%
হাঁটা ১৪%






প্রধান বাধা
ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থার করুন দশার অন্যতম কারণগুলো সেনাবাহিনীসৃষ্ট। ঢাকার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সেনানিবাস, আর অচল তেজগাঁও বিমানবন্দর, বি জি বি হেড কোয়ার্টার। আর আছে অসংখ্য গার্মেন্টস আর ট্যানারি।

এস টি পি
২০০৪ সালে প্রণীত এস টি পি তে ঢাকার জন্য কয়েকটি মারাত্মক পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে। বলা হয়েছে এদের বাস্তবায়নে ঢাকা থেকে যানজট দূরীভূত হবেঃ

১) এম আর টি (ম্যাস র‍্যাপিড ট্রানজিট)

ক) তিনটি মেট্রো লাইন
খ) তিনটি বি আর টি বা বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট

২ )তিনটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েঃ গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি, গুলিস্তান-মহাখালি, মগবাজার

৩) দুইটি বাইপাস সড়কঃ পূর্ব ও পশ্চিম
এস টি পি তে এছাড়াও রিকশার সংখ্যা কমানোর সুপারিশ করা হয়
এস টি পি তে বর্ণিত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে লাগবে প্রায় ৫.৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এস টি পি পরিকল্পনার মূলে ছিল বিশ্বব্যাংক আর লুইস বারজার

এস টি পিঃ একটি একচোখা নীতি
যেখানে রিকশা আর পথচারীরা মোট ট্রিপের ৫০ শতাংশের বেশি প্রতিনিধিত্ব করে, সেখানে এস টি পি তে রিকশার জন্য কন পরিকল্পনাই রাখা হয়নি, বরং রিকশার সংখ্যা কমানোর জন্য বলা হয়েছে। ফুটপাথের উন্নয়নের জন্য ও কোন নিরদেশনা নেই।
এস টি পি প্রণয়ন করা হয়েছে ২০২৪ সালের মধ্যে ১ কোটি ৯৮ লাখ মানুষ ঢাকায় বসবাস করবে সে চিন্তা মাথায় রেখে, কিন্তু প্রতিবছর ৩% করে বৃদ্ধির হারে ঢাকার জনসংখ্যা ২০২৪ সালের আগেই ২ কোটি ছাড়িয়ে যাবে যখন এস টি পি আর কার্যকর থাকবে না।
বাংলাদেশের মত গরিব দেশের ছোট রাজধানীর জন্য ৫.৫২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা কোনমতেই সমর্থনযোগ্য না। এটা অবাস্তব একটি পরিকল্পনা। ঢাকার জন্য ৫.৫২ হলে সারাদেশের পরিবহন যোগাযোগের জন্য কত টাকা খরচ করা হবে?


এম আর টিই কি একমাত্র সমাধান?
ঢাকার মত ত্রি-কেন্দ্রিক নগরীর জন্য এম আর টি আসলেই একটি সমাধান। ঢাকার মূল বাণিজ্যিক কার্যক্রম মূলত মতিঝিল, মিরপুর ও কারওয়ান বাজার কেন্দ্রিক। অতএব, এই তিনটি জায়গার কথা মাথায় রেখে এম আর টির পরিকল্পনা অবশ্যই একটি ভাল ফলাফল এনে দিবে।
ঢাকার পার্কিং ব্যবস্থা পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য, তবে এম আর টির জন্য পারকিং স্পেস প্রয়োজন হয় না যা একটি সুখবর।
ঢাকার রাস্তা মোট আয়তনের তুলনার ৭ থেকে ৯ শতাংশ। এই তথ্যও এম আর টি পদ্ধতি গ্রহন করতে উদ্বুদ্ধ করে



কিন্তু মেট্রোরেল কি গ্রহণযোগ্য?
যদিও এম আর টিই ঢাকার জন্য একমাত্র সমাধান আমাদের মাথায় রাখতে হবে মেট্রোরেলের ব্যয়ের দিকটা। তিনটি মেট্রো লাইনের যে সুপারিশ এস টি পি টিম করেছে, তা বাস্তবায়ন করতে লাগবে প্রায় ২.১ বিলিয়ন ডলার। মেট্রো রেলের মোট দৈর্ঘ্য সব মিলিয়ে হবে ৭০ কিমির মত। যদি ধরে নিই যে মানুষ মেট্রো ধরতে ১ কিমি হেঁটে স্টেশনে যাবে, তবে মেট্রোরেল মোট ১৪০ বর্গ কিমি এলাকা কভার করবে, যা ঢাকার মোট আয়তনের (১৫৩০ বর্গ কিমি) ১০ শতাংশ ও না।

মেট্রোরেলের প্রতি কিমি লাইন তৈরিতে প্রায় ৫০ থেকে ২৪০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন, সাথে আছে স্টেশন তৈরি, ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ। একটি স্টেশন তৈরির জন্য প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে।
ভবিষ্যতে জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধিরও প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু মেট্রোলাইনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি খুবই জটিল ো ঝক্কিপূর্ণ কাজ। বি আর টির তুলনায় মেট্রোর খরচ প্রায় ১০০ গুন। সেই তুলনায় এটি খুব এক্তা কার্যকরও হবে না, যদি না প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহারকারীরা মেট্রোর প্রতি আকৃষ্ট হন।




মেট্রো রেলের নেতিবাচক দিক একটি লস প্রজেক্ট

সারা পৃথিবীতেই মেট্রো একটি সাদা হাতি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে এই হাতি তৈরি করার পরেও হাতি পিছু ছাড়ে না। পৃথিবীর কোন মেট্রো প্রজেক্টই আমার জানামতে লাভের মুখ দেখেনি, প্রতিটি রেল ই ভরতুকির উপর চলে।
বিদ্যুৎ কোথায়?
দেশের ৫১% মানুষ বিদ্যুতের মুখ দেখেনি, আর ৪৯% মানুষ যে কী বিদ্যুৎসুবিধা পায় তা জানা আছে। এই সময়ে একটি পরিবহনব্যবস্থা চালু করা যা সম্পূর্ণ বিদ্যুৎনির্ভর জনগণের সাথে রসিকতা ছাড়া কিছু নয়
বন্যাপ্রবণ ঢাকা নগরী
মেট্রো বন্যাপ্রবণ এলাকার জন্য নয়। মেট্রোর ভবিষ্যতের জন্য ঢাকাকে বন্যামুক্ত রাখতে হবে সবসময় যা একেবারেই অসম্ভব

ভর্তুকি কোন অপশন নয়

বিশ্বব্যাপী মেট্রোর অভিজ্ঞতা বলে যে এই ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রায় অবশ্যম্ভাবী। সাও পাওলোতে নগর সরকার ০.২ (২৫%) ডলার ভর্তুকি দেয় প্রতি ট্রিপে। কুয়ালালামপুর মেট্রো মাত্র ৩ বছরের মাথায় ১।৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ তৈরি করে, যা মালেয়শিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীন।
এস টি পি ঢাকার জন্য যে মেট্রো পরামর্শ দিয়েছে তাতে প্রতি কিমির জন্য যাত্রীদের ভাড়া গুনতে হবে ১০ টাকা, যা অধিকাংশ মানুশের জন্য সম্ভব হবে না। এই ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করতে অন্তত ৫০% ভর্তুকি দিতে হবে সরকারকে। এস টি পি অনুমান করেছে প্রায় ৫৭৪২০০০ যাত্রী বহন করবে মেট্রো, যাদের ভ্রমণের গড় দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ৫ কিমি। ফলে সরকারকে প্রতিদিন প্রায় ১৪৩.৫৫ মিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দিতে হবে। যেখানে সরকার ভর্তুকি কমাতে জালানির দাম দফায় দফায় বাড়াচ্ছে, সেখানে ভর্তুকি দিয়ে মেট্রো রেল চালানো একটি দ্বিমুখী সিদ্ধান্ত।


মোট ট্রিপের ৮ শতাংশের জন্য ১.৭ বিলিয়ন ডলার?
এস টি পি ভাষ্যমতে, ঢাকায় প্রতিদিন ৭ কোটি ট্রিপ হবে, যার মাত্র ৮ শতাংশ মেট্রো কভার করবে। মোট ভ্রমণের ৮% এর জন্য ১.৭ বিলিয়ন ডলার খরচ করা কি বুদ্ধিমানের কাজ?
অবাস্তব প্রজেক্ট

মেট্রো সেইসব নগরীর জন্য সুবিধাজনক যেখানকার মানুষের গড় আয় তুলনামুলক বেশি, অন্তত ১৮০০ ডলার (এ ডি বি, ২০০১), সেই হিসেবে ঢাকা মেট্রো রেলের জন্য এখনো প্রস্তুত নয়। ঢাকার জন্য কম খরচের বি আর টি বা এল আর টির কথা চিন্তা করা যেতে পারে

প্রজেক্টের ধীরগতি
সিঙ্গাপুরের ২০ কিমি মেট্রো তৈরিতে সময় লেগেছে ৮ বছর, আর কলকাতা রেকর্ড গড়েছে ২৫ বছর লাগিয়ে একটি মেট্রো ব্যবস্থা গড়ে তুলতে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে মেট্রো রেল বাস্তবায়নে সরকার কেন এত উদ্গ্রিব হয়ে আছে তা আমি বুঝতে পারছি না। মিডিয়াতেও মেট্রো নিয়ে তেমন কোন কথা শুনছি না। জনগণকে অনেক আশা দেখানো হলেও এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি সন্দিহান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ