বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০১২

কোন পদকে ভূষিত করা হবে তাকে?


ইট-পাথরের এই নগরীতে যখন মনুষ্যত্ববোধ খর্ব হতে চলেছে, ঠিক সে সময়ে একজন সাহসী হজরত তার নিজের জীবন উত্সর্গ করে প্রমাণ করলেন এখনও মানুষের জন্যই মানুষ। অনিশ্চয়তার নাগরিক জীবনে এখানে কেউ কারও বিপদের ভাগী হতে চায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজেকে বাঁচাতে কোনো বিপদের ঘটনা দেখেও আমরা না দেখার ভান করি। কিন্তু প্রতিবাদী হজরত তা করেননি। তারও ছিল সুখের সংসার। ছিল দু’চোখ ভরা স্বপ্ন। তার অনুপস্থিতিতে তার পরিবার আজ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ যখন জানতে পেরেছে মহত্ একজন হজরতের মৃত্যুকাহিনী, তখনই তারা প্রশ্ন তুলেছেন, কোন পদকে ভূষিত করা হবে তাকে। তার স্ত্রী ও দুটি এতিম শিশুর পাশে দাঁড়াবে কে? বিশিষ্টজনদের অভিমত, প্রথমে সরকারকেই এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তারা বলেছেন, এমন বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য হজরতকে পুরস্কৃত করতে না পারলে মানুষ কখনও একে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসবে না।

গত শুক্রবার মিরপুরে ছিনতাইয়ের হাত থেকে তিন নারীকে রক্ষা করতে গিয়ে ছিনতাইকারীদের গুলিতে নিহত হন হজরত আলী। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন তার স্ত্রী ও দুই সন্তান। নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে যে সাহসিকতার পরিচয় দিতে গিয়ে হজরতের মৃত্যু হয়েছে, এখন তা কালো মেঘের মতো ভর করেছে তার স্ত্রী ও ফুটফুটে দুই সন্তানের ওপর। এখন তারা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন তা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে।
ওইদিন মিরপুর ২ নম্বর সেকশনের রাইনখোলা এলাকায় প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন তিন নারী। এ সময় হজরত একটি ইটের টুকরো নিয়ে ছিনতাইকারীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে ছিনতাইকারীরা তাকে লক্ষ্য করে এক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। গুলিটি তার বুকের বাম দিকে বিদ্ধ হওয়ায় ঘটনাস্থলেই মারা যান কল্লোল গ্রুপের সেলস সুপারভাইজার হজরত আলী।
পারিবারিক সূত্র জানায়, গত শুক্রবার বিকেলেই ময়নাতদন্ত শেষে হজরতের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার সদর উপজেলার বল্লী এলাকায়। গতকাল সকালে সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। হজরতের কর্মস্থল কল্লোল গ্রুপের পক্ষ থেকে লাশ পরিবহন ও দাফনের খরচ বহন করা হয়েছে।
শুক্রবার রাতে হজরতের লাশ তার গ্রামের বাড়িতে পৌঁছার পরপরই সেখানে এক হূদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এলাকার শত শত লোক হজরতকে এক নজর দেখতে তাদের বাড়িতে ভিড় করে। স্বামীকে হারিয়ে বিলাপ করতে করতে পাগলপ্রায় হয়ে গেছেন স্ত্রী সালমা সুলতানা। বাবাকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছে তার ছোট্ট দুই সন্তান প্রিন্স (৭) ও প্রীতি (৩)। 
সালমা সুলতানা বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, এখন আমাদের কী হবে? আমার দুই সন্তানের কী হবে? আমি এখন বাচ্চাদের কীভাবে মানুষ করব? বড় ছেলে প্রিন্স মণিপুর স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র আর মেয়ে প্রীতি অক্সফোর্ড কিন্ডারগার্টেনে নার্সারির ছাত্রী। এখন তাদের পড়াশোনার খরচ কোথা থেকে জোগাড় হবে?
সালমা সুলতানা মোবাইল ফোনে জানান, সকালে তার স্বামী বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তিনি তার মৃত্যুর খবর পান। তিনি দৌড়ে গিয়ে হজরতকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান। এ সময় তিনি চিত্কার করে মানুষের সাহায্য চেয়েছেন। তাকে একটু হাসপাতালে নেওয়ার আকুতি জানিয়ে ছিলেন, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। তিনি বলেন, আমার স্বামী মানুষের উপকার করতে গিয়ে জান দিল। কিন্তু তার উপকারে কেউ এগিয়ে এলো না। দুনিয়াটা এমন কেন? মানুষ কেন এত বিবেকহীন হয়ে পড়েছে? 
নিহত হজরতের প্রতিবেশী তুহিন জানান, হজরত ছিলেন সাদামাটা জীবনের অধিকারী। তিনি সবসময় মানুষকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করতেন। মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। এটি ছিল তার স্বভাব। শেষ পর্যন্ত উপকার করতে গিয়েই তাকে জীবন দিতে হল। উপকার করতে গিয়ে এখন তার পরিবার অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল।
হজরতের সহকর্মী কল্লোল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের বিক্রয় ব্যবস্থাপক হাবিবুল ইসলাম রুবেল জানান, এক যুগ ধরে হজরত কল্লোল গ্রুপে চাকরি করছিলেন। তিনি ছিলেন নীতি ও আদর্শের প্রতি অবিচল থাকা একজন মানুষ। তিনি কখনোই অসত্ উপায় অবলম্বন বা খারাপ কাজে সম্পৃক্ত হননি। কাজের প্রতিও ছিলেন প্রচণ্ড নিষ্ঠাবান। তিনি বলেন, হজরত মাসিক যে টাকা বেতন পেতেন সে টাকাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। চেয়েছিলেন শত কষ্ট হলেও তার দুই সন্তানকে উচ্চ শিক্ষিত করবেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, হজরত আলী যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, রাষ্ট্রের অবশ্যই উচিত তার পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। হজরত হয়তো কোনো পুরস্কারের আশায় বা কোনো প্রাপ্তির আশায় কাজটি করেননি, করেছেন নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে। কিন্তু রাষ্ট্র যদি এমন বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য মানসিক কিংবা অর্থনৈতিক সহযোগিতা না করে তাহলে কেউ হয়তো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কারও বিপদে কখনোই এগিয়ে যাবে না। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের পাশাপাশি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে হজরতের পরিবারের পাশে সবারই এগিয়ে আসা উচিত। কেউ যদি একটি ভালো কাজ করে তবে রাষ্ট্র কিংবা সমাজের তাকে সাধুবাদ জানানো উচিত। তার এই বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি থাকা উচিত।
জানতে চাইলে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক আবদুল কাইয়ুম বলেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া। রাষ্ট্র যথাযথ নিরাপত্তা দিতে পারেনি বলেই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে এবং সেখানে উপস্থিত থাকা একজন সাধারণ মানুষ অপরাধ প্রতিহত করতে এগিয়ে গেছেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই রাষ্ট্রের উচিত ওই লোকটির পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া। আবদুল কাইয়ুম বলেন, আমাদের সমাজ-ব্যবস্থা এখন এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মানুষের চোখের সামনে অন্যায় ঘটে যাচ্ছে; কিন্তু কেউ চোখ তুলে প্রতিবাদ করছে না বা প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছে না। এ ধারা পরিবর্তন করতে হলে এমন বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য হজরতকে সম্মান জানানো উচিত।
হজরতের স্বজনরা বলেছেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য সাহসিকতাপূর্ণ কাজ করলে নানা ধরনের পদকে ভূষিত হন। তার পরিবারকেও নানাভাবে সহায়তা করা হয়। আর একজন সাধারণ নাগরিক তার জীবন উত্সর্গ করলে তাকেও কোনো পদকে ভূষিত করা উচিত বা যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা দরকার।
এদিকে গতকাল রাত পর্যন্ত হজরতের খুনিরা কেউ গ্রেফতার হয়নি। জানতে চাইলে মিরপুর থানার ওসি জানান, নিহত হজরত আলীর স্ত্রী সালমা সুলতানা বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেছেন। অস্ত্রধারী ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করতে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ