সোমবার, ২ এপ্রিল, ২০১২

ইয়াবা অফিসারের স্ত্রীও গ্রেপ্তার

ইয়াবা ব্যবসায় তাঁর 'ইনভেস্ট' কোটি টাকা। তিনি প্রতিদিন পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকার নিষিদ্ধ ইয়াবা ট্যাবলেট টেকনাফ থেকে ঢাকায় আনতেন। ইসলামী ব্যাংক ও বিভিন্ন কুরিয়ারের মাধ্যমে টেকনাফে টাকা পাঠাতেন। এরপর একজন বাহকের মাধ্যমে আসা ইয়াবা রাজধানীর ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী, মোহাম্মদপুর, মিরপুরসহ কয়েকটি এলাকায় সরবরাহ করতেন। গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তা (ফিটার) আমির হোসেন গোয়েন্দা হেফাজতে এ তথ্য দিয়েছেন।
গত শুক্রবার গভীর রাতে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের সরকারি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে তাঁকেসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ সময় তাঁর বাসা থেকে ৫০ লাখ টাকার ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। ওই রাতে তাঁর স্ত্রীকেও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয় ডিবি। গতকাল রবিবার সকালে লালবাগ এলাকার একটি বাসা থেকে তাঁকে আটক করে পুলিশ। তাঁর নাম ময়না বেগম। তিনি জাতীয় সংসদ ভবনে পিয়ন পদে চাকরি করেন। গোয়েন্দা হেফাজতে এই দম্পতিকে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মশিউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, আমির ও তাঁর স্ত্রী ময়না বেগম রাজধানীতে দীর্ঘদিন ধরে নিষিদ্ধ ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি করতেন। তাঁদের চার দিনের হেফাজতে (রিমান্ডে) এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এই দম্পতি ইয়াবা ব্যবসা সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়েছেন। তাঁরা সরকারি চাকরি করলেও কোনো রকম শঙ্কা ছাড়াই ঢাকায় এই নিষিদ্ধ ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন। পাইকারি ব্যবসায়ী হলেও তাঁরা সহযোগীদের দিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের টার্গেট করে ইয়াবা ব্যবসা করতেন।
আমির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, "ইয়াবা ব্যবসায় আমার ইনভেস্ট এক কোটি ১০ হাজার টাকা। নিজের টাকাসহ আরো চারজন 'ইনভেস্টর' আমাকে টাকা দিয়ে ব্যবসায় সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের মধ্যে শেরেবাংলা নগরের শাহীন আমাকে এক লাখ টাকা দিয়েছেন। ওই টাকার জন্য তাঁকে প্রতিদিন এক হাজার টাকা লাভ দিতে হয়। সাবেক জেলা রেজিস্ট্রারের ছেলে সুহৃদের কাছ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা নিই। সুহৃদ বর্তমানে ধানমণ্ডিতে থাকেন। রাজেস নামে এক ব্যবসায়ী পৌনে দুই লাখ টাকা দেন। রাজেস বিদেশে থাকেন। এ ছাড়া তাইয়েব নামে একজনের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিই। তাঁরা আমাকে টাকা দিয়ে ইয়াবা ব্যবসা করতে সহযোগিতা করেছেন। এই টাকার বিনিময়ে ব্যবসা করে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার টাকা লাভের অংশ তাঁদের প্রত্যেককে দিতে হতো।"
টেকনাফ থেকে ঢাকা : আমিরের তথ্য মতে, প্রতিদিন টেকনাফ থেকে কমপক্ষে ১০ লাখ টাকার বিভিন্ন ধরনের ইয়াবা ট্যাবলেট ঢাকায় আনতেন তিনি। টেকনাফের ইয়াবা ব্যবসায়ী হাফেজ মো. শফিকুলসহ সালাম, কালু ও করিম টাকা পেলেই ইয়াবা ট্যাবলেট পাঠিয়ে দিতেন। ইসলামী ব্যাংকের মিরপুর শাখার মাধ্যমে তিনি টেকনাফে টাকা পাঠাতেন। গ্রেপ্তার হওয়ার আগের দিনও তিনি ওই ব্যাংক শাখা থেকে শফিকুলের কাছে আড়াই লাখ টাকা পাঠান। টাকা পাওয়ার পরপরই শফিকুল আমিরের ক্যারিয়ার ইব্রাহিমের কাছে ইয়াবা ট্যাবলেট পাঠিয়ে দেন। ইব্রাহিম কখনো ট্রেনে আবার কখনো বাসে আবার কখনো ট্রাকের মাধ্যমে ইয়াবা নিয়ে ঢাকায় আসত। এরপর সে আমিরের সরকারি বাসায় ইয়াবা পৌঁছে দিয়ে আবার টেকনাফে ফিরে যেত। আমির কখনো খুচরা ইয়াবা বিক্রি করতেন না বলে দাবি করেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র টুইন, সুহৃদ, ফিরোজ ও তায়েব তাঁর কাছ থেকে পাইকারি দামে পাঁচ ধরনের ইয়াবা কিনে খুচরা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতেন। 'গাঢ় লাল রঙের' চম্পা নামের প্রতিপিস ইয়াবা আমির টেকনাফ থেকে ১২২ টাকায় কিনে ১৪০ টাকায় পাইকারি দামে বিক্রি করতেন। খুচরা বিক্রেতারা আড়াই শ টাকায় এটি বিক্রি করেন। হালকা গোলাপি রঙের 'আর সেভেন' ইয়াবা ট্যাবলেট বর্তমানে সবচেয়ে দামি। এই ট্যাবলেটটি আমির ৩১৫ টাকায় কিনে ৩৫০ টাকায় বিক্রি করতেন। খুচরা বিক্রেতারা এই ট্যাবলেট ৫০০ টাকায় বিক্রি করছেন। হালকা লাল রঙের 'জেপি' নামের ইয়াবা ট্যাবলেট ৩৪০ টাকায় কিনে আমির বিক্রি করতেন ৪০০ টাকায়। বর্তমান বাজারে এর দাম ৪৫০ টাকা। এ ছাড়া 'ডগ' নামে একটি ইয়াবা ট্যাবলেট রয়েছে। খুচরা ক্রেতাদের কাছে এই ট্যাবলেটের দাম ২০০ টাকা।
যেভাবে ব্যবসায়ী : আমির হোসেন বলেন, ১৯৯৭ সালে আগারগাঁও এলাকায় 'আশা কম্পিউটার' নামে দোকান ছিল তাঁর। একদিন এক যুবক তাঁর দোকানে কম্পিউটার ঠিক করতে এসে কাজের বিনিময়ে তাঁকে একটি ইয়াবা ট্যাবলেট দেয়। সেটা নেশা হিসেবে গ্রহণ করেন তিনি। এরপর আস্তে আস্তে ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন।
আগেও তিনবার গ্রেপ্তার হন আমির : আমির হোসেনকে র‌্যাব-১০ ও র‌্যাব-২ এর আগে আরো তিনবার গ্রেপ্তার করে। প্রতিবার তিনি জামিনে বের হয়ে আবারও একই কাজ করেন। তিনি জানান, তিনবার জামিন নিতে তাঁর খরচ হয়েছে প্রায় দুই লাখ টাকা। জেল খাটলেও চাকরি বহাল ছিল। প্রতিবার গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনি অসুস্থতার কথা বলে অফিস বরাবর আবেদনপত্র পাঠিয়ে দিতেন, আর তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেটি যাচাই-বাছাই না করে ছুটি মঞ্জুর করতেন। এ কারণে একসঙ্গে সরকারি চাকরি ও ইয়াবা ব্যবসা চালাতে তাঁর কোনো সমস্যা হতো না। গতকাল এক প্রশ্নের জবাবে আমির বলেন, এবার আর তাঁর রক্ষা নেই। কারণ মিডিয়ায় ফলাও করে তাঁর গ্রেপ্তারের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে।
আমির হোসেনের গ্রামের বাড়ি সিলেট সদরে। তাঁর স্ত্রীর বাড়ি বরিশালে। এই দম্পতির চার সন্তান রয়েছে। তাদের মধ্যে বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়িতে আছে। অন্য সন্তানরা আগারগাঁও এলাকায় তাঁর সরকারি বাসায় থাকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ