বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

যৌতুক দিয়ে বিয়ে নয় : বিয়ের আসরে বসেও বিয়ে ভেঙে দিলো সাহসী কনে ববিতা

বিয়ের আসরে বর ডিসকভারী মোটরসাইকেল দাবি করায়, যৌতুক দিয়ে বিয়ে নয়, এমন কথা কনে বিয়ের আসরেই সাফ জানিয়ে দেন বরের পরিবারকে। একদিকে এমনই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ও অন্যদিকে যৌতুকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এক কনের সাহসী সিদ্ধান্তে বাবা-মাসহ প্রতিবেশীদের পাশে পেলেন। ঘটনাটি ঘটেছে গত সোমবার কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার মোকারিমপুর ইউনিয়নের গোলাপনগর গ্রামে।
পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গোলাপনগর গ্রামের কৃষক রাজ্জাক আলীর মেয়ে কলেজ পড়ুয়া মেধাবী ছাত্রী ববিতা খাতুনের (১৯) সাথে পাশের দৌলতপুর উপজেলার পিয়ারপুর গ্রামের রইজ উদ্দীন মালিথার ছেলে সান্টু মিয়ার (২৫) বিয়ে ঠিক হয়। পাত্রপক্ষের কোনো দাবি দাওয়া নেই, এমনই কথাবার্তা পাকা হয়েছিলো। এমনকি দেনমোহর বাবদ সমপরিমাণ টাকার গয়না দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন হবে বলে দু পরিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সোমবার বিয়ের দিন ধার্য্য হয়। ওইদিন বিয়ের আসরে প্রথমে দেনমোহর নিয়ে পাত্রপক্ষ ১ হাজার টাকার ওয়াশিল বাবদ একটি নাকফুল নিয়ে আসে। এ নিয়ে পাত্রীপক্ষ আপত্তি তুললে ছেলে ও তার পরিবার যৌতুক হিসেবে ডিসকভারি মোটরসাইকেল দাবি করে বসে।
পাত্রের যৌতুক দাবির কথা শুনে বিয়ের আসরে কনে ভেড়ামারা মহিলা ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী মেধাবী ছাত্রী ববিতা খাতুন যৌতুক দিয়ে বিয়ে করবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয় পাত্রপক্ষকে। তার এমন সাহসী সিদ্ধান্তে বাবা-মা মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ান। বাবা-মা মেয়ের এমন সাহসী সিদ্ধান্তে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পান। মেয়ের সিদ্ধান্ত তাদের সিদ্ধান্ত বলে জানিয়ে দেন পাত্রপক্ষকে। পরে অনেকেই বিয়ে দেয়ার পক্ষে থাকলেও মেয়ের দাবি যৌতুকলোভী স্বামীর ঘরে নির্যাতিত হতে চায় না বলে কনে তার সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত অনড় থাকে।
এ বিষয়ে কনের বাবা রাজ্জাক আলী জানান, যৌতুকবিহীন বিয়ে ও দেনমোহর বাবদ ৫০ হাজার টাকার কথা আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিলো দু পরিবারের মধ্যে; কিন্তু বিয়ের আসরে পাত্র ও তার পরিবার আকস্মিক যৌতুক হিসেবে মোটরসাইকেল দাবি করলে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। অতো টাকা আমার নেই। দিতে পারবো না বলে পাত্রপক্ষকে ঘটকের মাধ্যমে আগেই জানিয়েছিলাম। পাত্র সান্টু মিয়া ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে জেনেও আমার শিক্ষিত মেয়েকে যৌতুক দেবো না বিধায় তার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলাম। কনে ববিতা খাতুন জানান, প্রতিটি মেয়ের জীবনে একটি স্বপ্ন বিয়ে ও বিয়ের আসর। সেই বিয়ের আসর কলঙ্কিত হোক এটা কেউই চায় না; কিন্তু এদেশে যৌতুকের কারণে স্বামীর সংসারে অনেকেই নির্যাতিত হয়েছে এবং হচ্ছে। আমার বাবার সাধ্য নেই অতো টাকা দিয়ে মোটরসাইকেল কিনে দেবে। যে পাত্রের মধ্যে এমন কুমনোভাব, তার সংসারে আমি কখনই সুখি হতে পারবো না। পাত্রের যৌতুকের প্রতি লোভের বিষয়টি বিয়ের আসরেই প্রকাশ পায়। যে পাত্র বিয়ের আসরেই যৌতুক দাবি করে তাকে বিয়ে করা যায় না। ফলে আমি এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি।
পাত্র সান্টু মিয়া জানান, যৌতুক নিয়ে কোনো কথাই হয়নি। কতো টাকার দেনমোহর হবে এ নিয়ে ঝামেলা বেধেছিলো। আমি বিয়ে করতে চাইলেও তারা বিয়ে দেয়নি। বিয়ের ঘটক আকুব্বর জানায়, দু পক্ষের মধ্যে বিয়ের বিষয়ে কয়েক দফা কথা হয়। প্রথমে ছেলে মোটরসাইকেল চাইলেও পরে পাত্র দাবি থেকে সরে আসে। আবারও কনে পক্ষের সাথে যোগাযোগ করে কোনো দাবি নেই জানিয়ে বিয়ের দিন ও তারিখ ঠিক করা হয়। বিয়ের আসরে যে যার মতো কথার বিপরীতে কথা উঠেই বিয়েটা ভেঙে গেছে। ছেলের ভাই হান্নান জানান, যৌতুক নয়, দেনমোহর নিয়ে সমস্যা হয়েছিলো; কিন্তু আমরা পরে অনেক টাকার দেনমোহর করতে চেয়েছিলাম এবং ভবিষ্যতে কোনো দাবি করবো না বলে জানিয়েছিলাম। তবু কনেপক্ষই বিয়েটা ভেঙে দিলো। এমনকি বরযাত্রীদের মারধর ও মোটরসাইকেল আটকে রেখেছে তারা।
বিয়ের প্রস্তাব থেকে সমস্ত কিছু দেখভালের দায়িত্ব পালনকারী কনের বড় ভাই লিখন মিয়া জানান, আমার বোনকে পছন্দ হলেও পাত্রপক্ষ থেকে কয়েকবার মোটরসাইকেল দাবি করে। দাবি নাকচ করে দিলে পাত্র সান্টু মিয়া পাত্রী দেখে পছন্দ হয়েছে দাবি করে যৌতুক ছাড়াই মেয়েকে সাজিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে; কিন্তু বিয়ের আসরে দেনমোহর বাবদ ৫০ হাজার টাকার স্থলে ১ হাজার টাকা এবং যৌতুক হিসেবে মোটরসাইকেল দাবি করলে আমরা আপত্তি তুলি। তারা তখন রেগে গিয়ে ৫ লাখ টাকার দেনমোহর দিয়ে আমার বোনকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে বলে জানায়। যেখানে ৫০ হাজার টাকায় আপত্তি সেখানে ৫ লাখ টাকার কথার মধ্যে সন্দেহ হলে আমার বোন সরাসরি জানিয়ে দেয় যৌতুক দিয়ে বিয়ে করবে না। এখন যৌতুক না নিলেও পরে তারা যৌতুকের জন্য নির্যাতন করবে আশঙ্কায় আমার বোন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মোকারিমপুর ইউপির ৫ নং ওয়ার্ড মেম্বার বাবুল হোসেন জানান, যৌতুক ও দেনমোহর নিয়েই বিয়েটি ভেঙেছে বলে আমি শুনেছি।
ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাজিবুল ইসলাম সাংবাদিকদের মাধ্যমে ঘটনাটি জেনে বলেন, ঘটনাটি কী ঘটেছে আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি। তবে যৌতুকের বিরুদ্ধে কনের এমন প্রতিবাদী সিদ্ধান্তকে আমি সাধুবাদ জানাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ