রবিবার, ১ এপ্রিল, ২০১২

সন্ত্রাসের কবলে ৫০০ কোটি টাকার ফুল বাজার


তাজা ফুলের সুবাসও চাঁদাবাজদের হৃদয় গলাতে পারেনি। তাদের কবলে পড়ে এখন ধ্বংসের পথে দেশের ৫০০ কোটি টাকার ফুলের বাজার। অপার সম্ভাবনার ফুল চাষ এখন সঙ্কটের মুখে পড়েছে। চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের অব্যাহত চাঁদার দাবি এবং সন্ত্রাসের কারণে দেশের একমাত্র পাইকারি ফুলের বাজার শাহবাগ থেকে উচ্ছেদ হওয়ায় এখন পথে পথে ঘুরছেন ফুল ব্যবসায়ীরা। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ফুলচাষিদের ফুল বিক্রি। দেশের অভ্যন্তরে ফুলের বিপুল চাহিদা ছাড়াও বিদেশে ফুল রপ্তানি অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। 
ঢাকার পাইকারি ফুল ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৭ সাল থেকে রাজধানী শহরে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল বিক্রি শুরু হওয়ার পর থেকে শাহবাগ মোড়ে বসতো পাইকারি ফুলের বাজার। সারা দেশের ফুলচাষিরা তাদের জমিতে উৎপাদিত ফুল এখানে এনে বিক্রি করতেন। শাহবাগ থেকে ঢাকা শহরের খুচরা বিক্রেতারা কিনে নিতেন তাদের ফুল। শাহবাগ মোড়ের ওই জায়গাটি ছিল সিটি করপোরেশনের। দীর্ঘ ২৩ বছর চেষ্টা করেও ফুল ব্যবসায়ীরা ওই জায়গাটি ফুলের পাইকারি বিপণনের জন্য বরাদ্দ পাননি। 
২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কতিপয় চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীর উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় এবং স্থানীয় রাজনৈতিক চাঁদাবাজদের কবলে পড়ে শেষ পর্যন্ত শাহবাগ থেকে পাইকারি ফুলের বাজার গুটিয়ে রাতের আঁধারে জীবন নিয়ে পালাতে হয়েছে ফুল ব্যবসায়ীদের। শাহবাগ থেকে উচ্ছেদ হয়ে তারা পাইকারি বাজার খোলেন সাভারে। সেখানে ক্রেতা কম বলে সেখানে থেকে কৃষিবিদ বাহাউদ্দিন নাসিমের সহযোগিতায় ফার্মগেট এলাকার খামারবাড়ীতে পাইকারি বিক্রির হাট বসান তারা। সমপ্রতি কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের ওই জায়গায় তাদের নিজস্ব ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করলে আবার ভূমিহীন হয়ে পড়েছে দেশের পাইকারি ফুলের বাজার। উৎপাদিত ফুলের বিপণন নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা এখন চাষিদের মাঝে। 
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে রজনীগন্ধা ফুলের চাষ শুরু করেন যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামের কৃষক শের আলী সরদার। ১৯৮৩ সালে মাত্র ৩০ শতক জমিতে এ চাষ করেন তিনি। কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে বর্তমানে দেশের ১৯টি জেলাতে কমবেশি বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হচ্ছে ৪৭৫৬ হেক্টর জমিতে। ফুল উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করছেন ১০৬০০ কৃষক। ঢাকা শহরে কেবলমাত্র পাইকারি ফুল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৫০০ ব্যবসায়ী। সারা দেশে খুচরা ফুল বিক্রেতা ১০ হাজারের বেশি। দেশে সবচেয়ে বেশি ফুল উৎপাদিত হয় যশোর জেলায়। যশোরের ৫টি উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের ৭৫টি গ্রামের ৪৫০০ কৃষক ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত। ঢাকার ফুল ব্যবসায়ী এবং কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, তাদের পরিসংখ্যান অনুসারে বিদেশে রপ্তানিসহ পুরো দেশে অভ্যন্তরীণ বাজারে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। 
মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ফুল রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন ফুল ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশের ফুল যাচ্ছে সৌদি আরব, দুবাই ও আরব আমিরাতে। বাংলাদেশের দু’টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মণিপুরী পাড়ার ফ্লাওয়ার গার্ডেন এবং গুলশানের চায়না ম্যাডাম থাইল্যান্ড, চীন, মালেশিয়া ও ভারত থেকে সপ্তাহে প্রায় ১০ লাখ টাকার ফুল আমদানি করে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বিক্রি করছে এবং তারা বাংলাদেশে উৎপাদিত ফুলও বিদেশে রপ্তানি করছে। মণিপুরী পাড়ার ফ্লাওয়ার গার্ডেন প্রতিষ্ঠানের মালিক বাচ্চু খান জানিয়েছেন, বিদেশে ফুল রপ্তানি করতে গেলেও সমস্যা, বাংলাদেশ বিমানে বিদেশে সবজি পাঠানোর ব্যবস্থা থাকলেও ফুলের জন্য কোন স্পেস নেই। ওই দপ্তরের মন্ত্রীকে বলেও কোন স্পেস পাননি ফুল ব্যবসায়ীরা। 
বাংলাদেশে ফুল চাষ নিয়ে গবেষণা করছেন কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আবুল কালাম। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ফুল চাষের বিপুল সম্ভাবনা আছে, ফুল রপ্তানি করে আমরা বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি কিন্তু সে জন্য এই খাতটির প্রতি সরকারসহ আমাদের সবার নজর দেয়া দরকার।’
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সদস্য ও খামারবাড়ী পাইকারি ফুল বাজার পরিচালনা পরিষদের আহ্বায়ক মীর বাবরজান বরুণ জানান, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস মার্কেট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের ঝামেলা, সিটি করপোরেশন থেকে জায়গা না পাওয়ার কারণে শাহবাগ থেকে ফুলের পাইকারি বাজার উচ্ছেদ হতে হয়েছে। এখন আমাদের কোন পাইকারি বাজারের জায়গা নেই, পথে পথে ঘুরছি। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের ফুলের বাজারের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে- কারণ প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত আমাদের ফুল অন্য দেশের ফুল থেকে বেশি সময় তাজা থাকে। বরুণ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যাওয়া তো দূরে থাক, পাইকারি বাজারের জায়গা না থাকায় ফুলের দেশী বাজারও বিপদের মুখে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ