রবিবার, ১ এপ্রিল, ২০১২

লাইফ সাপোর্ট ব্যবসা


লাইফ সাপোর্টের নামে চলছে অন্য রকম ব্যবসা। অভিজাত হাসপাতাল-গুলোতে তা বেশ জমজমাট। কারণে-অকারণে রোগী নেয়া হয় অন্তিম শয়ন সিটে। সাধারণত ফুসফুস, হৃদযন্ত্র বা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ ঠিকমতো কাজ না করলে এই সেবা দেয়া হয়। হাসপাতাল-গুলোতে অপারেশনের রোগীর বেলায় বেশির ভাগ লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়। এ সময় বলা হয়, অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ। রোগী বাঁচাতে হবে। তাই রাখা হয়েছে লাইফ সাপোর্টে। রোগীকে যখন লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়, বেশির ভাগ সময়ই তাকে তখন কৃত্রিম অক্সিজেন দিতে হয়। এজন্য গলার নিচ দিয়ে সেন্ট্রাল ভেনাস বা সিভি লাইন করা হয়। কিন্তু অনেক হাসপাতালে সিভি লাইন করতে গিয়ে রোগীর লাঞ্চই ফুটো করে ফেলা হয়। অনেক সময় রোগীর মৃত্যুর পরও রেখে দেয়া হয় লাইফ সাপোর্টে। ভেন্টিলেটর খোলা হয় না। বলা হয়, এখনও নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন। তাই প্রিয়জনের বেঁচে ওঠার আশায় তাকে লাইফ সাপোর্টে রেখে অপেক্ষায় সময় গোনেন। আবার কখনও কখনও রোগী ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে ফিরে এলেও লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। সব শেষে রোগীর অভিভাবকের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় বিশাল অঙ্কের টাকার রশিদ। কখনই এনিয়ে বাদ-প্রতিবাদের উপায় থাকে না। কোন প্রশ্নও করা যাবে না। রোগী বেঁচে উঠেছে- এটাই বড় সত্য। তাই অন্য কিছু বোঝার আগেই অভিভাবকদের দিয়ে আসতে হয় কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এভাবে লাইফ সাপোর্টের নামে অর্থ আদায়ের অভিযোগ দেশের এক শ্রেণীর বেসরকারি অভিজাত হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে। তারা অমানবিক উপায়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। রোগীরা হচ্ছেন হয়রানির শিকার। লাইফ সাপোর্টকে অনেক অভিভাবক ‘রোগীদের জিম্মি রেখে মুক্তিপণ’ আদায় হিসেবে দেখছেন। আবার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কেউ কেউ দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতালের ‘লাইফ সাপোর্ট’কে ‘ভাল ব্যবসা’ বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের মতে, সব অভিজাত হাসপাতালে যে এ রকম হচ্ছে, তা নয়। কিছু কিছু হাসপাতাল বা ক্লিনিকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়-বিএসএমএমইউ’র প্রক্টর ও বিশিষ্ট চিকিৎসক প্রফেসর ডা. এএসএম জাকারিয়া স্বপন বলেন, অভিযোগটি অবশ্যই গুরুতর। আমাদের কাছেও মাঝে মধ্যে এরকম অভিযোগ আসে। বিভিন্ন সূত্র থেকে শুনি। এটা অবশ্যই অমানবিক। চিকিৎসা শুধু ব্যবসা নয়। এটা মনে রাখতে হবে। এখানে সেবা ও মানবিক বিষয় সবচেয়ে বেশি বিদ্যমান। তিনি বলেন, আইন আছে। কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই বলে প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটে। তাই সরকারের উচিত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা। তখন মানুষ হয়রানির শিকার হলে আইনের আশ্রয় নিতে পারবে। এদিকে রোগীদের অভিভাবকরা অভিযোগ করেন, জরুরি রোগী নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি সময়ই অভিজাত কয়েকটি হাসপাতালে প্রথমেই লাইফ সাপোর্টে রাখার লিখিত অনুমতি নেয়া হয়। তখন কেউই এ নিয়ে কিছু না ভেবে কাগজে সই করে দেন। পরে ছাড়পত্র নেয়ার সময় প্রায় সব রোগীকেই পরিশোধ করতে হয় আইসিইউ কিংবা লাইফ সাপোর্টের বিল। আবার অনেক হাসপাতালে ভর্তির পর একটা সময় প্রয়োজন না হলেও রোগীর পরিবারকে রোগীকে লাইফ সাপোর্টে নিতে বারবার তাগাদা দেয়া হয়। তখন রোগী বাঁচানোর জন্য খরচের কথা না ভেবেই তারা সম্মতি দেন।
দেশের খুব কম হাসপাতাল বা ক্লিনিকে লাইফ সাপোর্টের এই সুবিধা রয়েছে। ব্যয়বহুল হওয়ায় সব প্রতিষ্ঠান এই সেবা দিতে পারে না। সরকারি হাসপাতালের মধ্যে সব ক’টিতে নেই। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ কয়েকটি হাসপাতালে এই সুবিধা আছে। ঢাকায় আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতালসহ আরও কয়েকটিতে। সরকারি হাসপাতালে সিট সংখ্যা একেবারেই কম। কোথাও ৬টা। কোথাও বা ৪টা। বেসরকারির মধ্যে রাজধানীতে এ্যাপোলো, স্কয়ার, ইউনাইটেড, ল্যাবএইড, পপুলার, মডার্ন, শমরিতা, গ্রীন লাইফ, সেন্ট্রাল, কেয়ার, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালসহ হাতেগোনা কয়েকটিতে এই সুবিধা রয়েছে। এগুলোর প্রায় সব ক’টিতেই ২০টির বেশি সিট রয়েছে। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণত লাইফ সাপোর্টে ব্যয়ের পরিমাণ নির্দিষ্ট থাকে। প্যাকেজেও হয়। লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় দু’ভাবে। ভেন্টিলেটরসহ এবং ভেন্টিলেটর সাপোর্ট ছাড়া। যারা শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারেন না তাদের দেয়া হয় ভেন্টিলেটর। রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালে সিট রয়েছে ২৪টি। তারা দিনে ৬ হাজার টাকা সিট ভাড়া নেন। প্রযুক্তি সহায়তার জন্য নেয়া হয় আলাদা ফি। এটি আবার ভেন্টিলেটর বা অক্সিজেন ছাড়া। ভেন্টিলেটর দিয়ে হলে তখন দ্বিগুণ ব্যয় হয়। সঙ্গে ডাক্তার ভিজিট তো রয়েছে। এক্ষেত্রে রোগের ধরন অনুযায়ী খরচের কম বেশি হয়। রাজধানীর ল্যাবএইডে ৩০ থেকে ৩৫,০০০ টাকা খরচ হয় চিকিৎসক, ওষুধ ও ভেন্টিলেটর সহ। আর ওষুধ ও ভেন্টিলেটর ছাড়া খরচ পড়ে ১৫ থেকে ২০,০০০ টাকা। এসব হাসপাতালে ১ ঘণ্টা বা এক মুহূর্তের জন্য লাইফ সাপোর্টে নিলে তার জন্য সারা দিনের সার্ভিস চার্জসহ বিল দিতে হয়। এমনকি অল্প সময়ের জন্য ভেন্টিলেটর সুবিধা নিলেও পূর্ণ ফি দিতে হয়। একটি হাসপাতালে তো ভাল রোগীকে অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে লাইফ সাপোর্টে নিয়ে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে দেয়া হয়। সেখানে দায়িত্বে থাকেন আনকোরা চিকিৎসকরা। তারা লাইফ সাপোর্ট দিতে গিয়ে রোগীকে উল্টো অসুস্থ করে তোলেন। একটি নামী হাসপাতালের লাইফ সাপোর্ট দেয়ার সময় কৃত্রিম অক্সিজেন দিতে গিয়ে রোগীর লাঞ্চ ফুটো করে ফেলার অভিযোগ আছে। এরকম একাধিক ঘটনা ঘটেছে ওই হাসপাতালে। পরে সিনিয়র চিকিৎসকের পরামর্শে ফুটো হওয়া লাঞ্চের কারণ সম্পর্কে রিপোর্ট করা হয়- ‘নিউমোনিয়ার কারণে ফুটো হয়ে গেছে’। এভাবে রোগীকে বুঝিয়ে নিজেদের দোষ এড়িয়ে যাওয়া হয়। তবে অভিভাবকরা টের পেলেও রোগীকে বাঁচানোর স্বার্থে ভয়ে কোন প্রতিবাদ করেননি বা আইনের আশ্রয় নেননি। এক অভিভাবক এই তথ্য জানিয়েছেন। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও এমন অভিযোগের কথা স্বীকার করেন। যাদের কাছে রোগীরা পরে চিকিৎসা নিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, চিকিৎসকরা ডাক পেলে লাইফ সপোর্টে থাকা রোগীর পর্যবেক্ষণে থাকেন। বেশির ভাগ চিকিৎসকই সরাসরি এর সঙ্গে জড়িত থাকেন না। আবার অনেক চিকিৎসক নিজেই স্ব-উৎসাহে রোগীকে লাইফ সাপোর্টে নেন। এতে তাদের কমিশনেরও একটা বিষয় থাকে। অবশ্য বিএসএমএমইউ’র লিভার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুন-আল-মাহতাব (স্বপ্নীল) বলেন, ব্র্যানডেথ হলেও দু’তিনদিন রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। চিকিৎসকরা একজন রোগীকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। অভিভাবকরা লাইফ সাপোর্ট খুলে নিতে চাইলেও তো আর তা করা যাবে না। কোন চিকিৎসকই চাইবেন না রোগীকে হত্যা করতে। তবে অর্থের জন্য যদি কেউ রোগীকে জিম্মি করেন তাহলে সেটা হবে অন্যায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ