রবিবার, ১ এপ্রিল, ২০১২

যুদ্ধবন্ধুদের কৃতজ্ঞতা জানালো বাংলাদেশ


একাত্তরের রণাঙ্গনে বাঙালি লড়েছে, অস্ত্র ধরেছে। পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যা মোকাবেলা করেছে। সেদিন যোদ্ধাদের খাদ্য ছিল না, ছিল না ট্রেনিং কিংবা অস্ত্র। হতাহতদের চিকিৎসা কিংবা ন্যূনতম আশ্রয়ের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। কোটি শরণার্থী পাড়ি জমিয়েছিল প্রতিবেশী দেশে। হানাদার বাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ ও অন্যান্য বীভৎসতার খবর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে জনমত সৃষ্টির সুযোগ ছিল না। এ সংগ্রামে সেদিন বাঙালিদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন দুনিয়ার বহু বিবেকবান মানুষ, সাহায্য ও ত্রাণসংস্থা। তারা এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলেন। যুগিয়েছিলেন সাহস, খাদ্য, অস্ত্র ও অর্থ। তাদের অব্যাহত সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক জনমত সৃষ্টির ধারাবাহিকতায় মাত্র ন’মাসে যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে বিজয়ের গৌরব অর্জন করে এ দেশের মানুষ। জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড বাংলাদেশের। যাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন ও সহায়তা এ বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল সেসব যুদ্ধবন্ধুদের ৪১ বছর পর সম্মাননা জানিয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল ছিল প্রতীক্ষিত সেই দিন।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে যুদ্ধবন্ধুদের হাতে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ পদক তুলে দেন প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলে ৮৩ জনের হাতে সম্মাননা পদক তুলে দেয়া হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সহযোগী বিদেশী বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে সরকার গত বছর উদ্যোগ নেয়। ২৫শে জুলাই সম্মাননা দেয়া হয় ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ৫৬১ জনের একটি তালিকা তৈরি করে বিদেশী বন্ধুদের সম্মাননা জাতীয় কমিটি। পরে দ্বিতীয় পর্যায়ে সম্মাননা দেয়ার জন্য ১৩২ জন যুদ্ধবন্ধুর তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। ঠিকানায় গরমিল হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে তাদের মধ্যে আমন্ত্রণ জানানো সম্ভব হয় ১১০ জনকে। জীবিতদের অনেকেই নিজে উপস্থিত হন। বাকিরা প্রতিনিধি পাঠান। সম্মাননা জানানোর বহু প্রতীক্ষিত এ আয়োজনে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কেন্দ্রের মূল মঞ্চ সাজানো হয় লাল-সবুজের বাংলাদেশের পতাকার রঙে। মাঝখানে ছিল জাতীয় স্মৃতিসৌধের প্রতিকৃতি। মঞ্চের দুই পাশে বসেন আমন্ত্রিত বিদেশী অতিথিরা। সকাল পৌনে ১০টার আগেই প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধান, দেশী-বিদেশী কূটনীতিক, সমাজের বিশিষ্টজন এবং সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠান মঞ্চে উঠেন সকাল সোয়া ১০টায়। অনুষ্ঠান শুরু হয় যুদ্ধবন্ধুদের ভূমিকার ওপর তথ্যচিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে। তথ্যচিত্র প্রদর্শন শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন ভূঁইয়া সম্মাননা জানানোর অনুষ্ঠানে উপস্থিত বন্ধুদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং তাদের অসামান্য অবদানের কিছু অংশবিশেষ উপস্থাপন করেন। বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে অনুষ্ঠান মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমান। অতিথিদের হাতে তুলে দেয়া হয় জাতীয় স্মৃতি সৌধের প্রতিকৃতি খচিত একটি স্মারক (স্বর্ণের প্রলেপ) এবং সিল্কের কাপড়ের ওপর লেখা অভিনন্দন বার্তা। নেপালের প্রেসিডেন্ট রাম বরণ যাদবের পক্ষে দেশটির ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ গ্রহণ করেন। একে একে মোট আটজন সাবেক ও বর্তমান রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের প্রতিনিধিরা এই সম্মননা নেন। এরপর ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ গ্রহণ করেন ৭৫ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। শুরুতেই ভারতীয় জনগণের পক্ষে প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে পদক নেন দেশটির ঢাকাস্থ হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ। এরপর মিত্রবাহিনীর পক্ষে এ সম্মাননা গ্রহণ করেন ভারতীয় প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী এমএম পালাম রাজু। সম্মাননা নেয়ার পর ভারতের অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেএফআর জ্যাকব মঞ্চে দাঁড়িয়ে সমবেতদের উদ্দেশে স্যালুট দেন। এ সময় দর্শকসারি ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হলে তিনিও বলে ওঠেন, ‘জয় বাংলা’। সম্মাননা গ্রহণ করে সবার পক্ষ থেকে অনুভূতি প্রকাশ করে বক্তৃতা করেন বৃটিশ হাউজ অব কমন্সের সাবেক সদস্য মাইকেল বার্ন। বক্তৃতায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আপনার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রকৃত নেতা ছিলেন বলেই জাতির আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পেরেছিলেন। বক্তৃতাকালে তিনিও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন। এরপর বক্তব্য রাখেন- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমনি। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মিজানুর রহমান। 
বিদেশী বন্ধুদের সমর্থন না পেলে বিজয় প্রলম্বিত হতো: প্রধানমন্ত্রী
‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বিদেশী বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন না পেলে জাতির বিজয় প্রলম্বিত হতো। তিনি বলেন, আমরা স্বাধীন জাতি এবং ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশী বন্ধুরাও আমাদের এই বিজয়ের সমান অংশীদার। আমাদের বন্ধুদের অনেকেই ইতিমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন এবং অনেককে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতার পর বেশির ভাগ সময় এ দেশ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় আমাদের স্বাধীনতায় আপনাদের (বিদেশীদের) অবদানের স্বীকৃতি দিতে বিলম্বিত হয়েছে। ২০০৯ সালে বিপুল জন সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করায় এটা সম্ভব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার এই সম্মাননা প্রদানের জন্য ৫৬১ জন বিশ্বনেতা, ব্যক্তি ও সংগঠনের তালিকা তৈরি করেছে। বাকিদেরও পর্যায়ক্রমে এই সম্মাননা প্রদান করা হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে সব বিদেশী নাগরিক, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছিলেন, তাদের কাছে আমরা চির ঋণী। দুঃসময়ের বন্ধুদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজনে বাঙালি গর্বিত। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয় যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অনেক বিদেশী বন্ধু আমাদের সমব্যথী হয়েছিলেন, অংশীদার হয়েছিলেন। আমাদের জনগণ যখন স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তখন আমরা বিদেশী বন্ধুদের কাছ থেকে পেয়েছি অকুণ্ঠ সমর্থন। বিদেশী বন্ধুরা, বাংলাদেশের জনগণের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছেন। তারা আমাদের আশা-আকঙ্ক্ষা এবং মানবিক মর্যাদা এবং আর্থ-সামাজিক ন্যায় বিচারের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। তারা মানসিক, নৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থনসহ সামরিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের যারা সহযোগিতা করেছেন, তাদের হিসাব করা এবং তাদের ব্যক্তিগত ভূমিকা নিরূপণ করা দুঃসাধ্য। তাদের অবদান এবং আত্মত্যাগ পরিমাপ করা তাই অর্থহীন। কাজেই একজনকে সম্মানিত করার মধ্য দিয়ে সবাইকে সম্মানিত করা হচ্ছে- এটা মনে করাই যুক্তিসঙ্গত হবে।
মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা প্রতীকী প্রশংসামাত্র: প্রেসিডেন্ট
প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান বিদেশী বন্ধুদের মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা প্রদানকে জাতির দুর্যোগের সময়ে পাওয়া সমর্থনের জবাবে প্রতীকী প্রশংসা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি তার বক্তৃতায় বলেন, এ সম্মাননা প্রদানের অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি তাদের অবদানের স্বীকৃতি দেয়া, যা শিষ্টাচারের পর্যায়ে পড়ে। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট বলেন, বাংলাদেশ বিদেশী বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে। এসব বন্ধু মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সমর্থন জানান এবং তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মূল্যবান অবদান রাখেন। তিনি বলেন, তাদের এ অনুপ্রেরণা ও সমর্থন আমাদের বিজয় অর্জনে সহায়ক হয়। তিনি বলেন, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব বিদেশী বন্ধু অবদান রেখেছেন তার স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাদের সম্মাননা জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ গ্রহণকারীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, এ সম্মাননা গ্রহণ করায় আমরা আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আপনাদের অসীম মহত্ত্ব, অদম্য সাহস এবং দৃঢ় চেতনা আমাদের হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। জিল্লুর রহমান আশা প্রকাশ করেন, সম্মাননা গ্রহণকারীরা বাংলাদেশের সম্মৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে দেশে ফিরবেন। প্রেসিডেন্ট বলেন, সপ্তম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত এ অঞ্চল ছিল শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু এবং বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার বিপুল সংখ্যক লোক জ্ঞান ও শিক্ষা গ্রহণে এখানে এসেছেন। নালন্দা, ওদন্তপুর, জগদ্দলা এবং সোমপুরায় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। তিনি বলেন, বাংলাদেশ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। এটি আমাদের গর্বের বিষয় যে, বাংলাদেশ হচ্ছে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।  বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বশান্তি ও প্রশান্তিতে বিশ্বাসী। বাংলাদেশ ১৯৮৮ সালের পর থেকে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বিপুলসংখ্যক সৈন্য পাঠানোর মধ্যদিয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা সোচ্চার হয়েছি। গণতন্ত্র বিকাশ, নারীর ক্ষমতায়ন, মানবাধিকার রক্ষা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, স্থানীয় সরকার কাঠামো জোরদার, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নতি, তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়ন, নারী শিক্ষা সমপ্রসারণ এবং শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে আমরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি। প্রেসিডেন্ট বলেন, নারী-শিশু স্বাস্থ্য সেবা ও আইটি ব্যবহারে উল্লেখযোগ সাফল্য অর্জন করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ এমডিজি এওয়ার্ড ও সাউথ সাউথ এওয়ার্ড লাভ করেছেন।
বিদেশী বন্ধুদের সমর্থন না পেলে বিজয় প্রলম্বিত হতো: প্রধানমন্ত্রী
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাঙালির স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা পূরণে সমর্থনদানের জন্য বিদেশী বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন না পেলে জাতির বিজয় প্রলম্বিত হতো। তিনি বলেন, আজ আমরা স্বাধীন জাতি এবং ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশী বন্ধুরাও আমাদের এই বিজয়ের সমান অংশীদার।
তিনি বলেন, দিনটি আমাদের জন্য খুবই স্মরণীয়, কেননা আজই সারাবিশ্বে আমাদের কমরেডদের তাদের মূল্যবান অবদানের জন্য স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার এ সম্মাননা প্রদানের জন্য ৫৬১ জন বিশ্বনেতা, ব্যক্তি ও সংগঠনের তালিকা তৈরি করেছে। তিনি বলেন, অন্যদের পর্যায়ক্রমে এ সম্মাননা প্রদান করা হবে। এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার স্বপ্ন বাস্তবায়নে যুদ্ধবন্ধুদের আশীর্বাদ কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আপনাদের আশীর্বাদ ও শুভ কামনা চাই, যাতে আমরা এমন বাংলাদেশ গড়তে পারি যা ১৯৭১ সালে দেশের মানুষ চেয়েছিল। আমরা এমন বাংলাদেশ গড়তে চাই- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদেশী বন্ধুদের সম্মানিত করার মাধ্যমে আমরা বস্তুত গণতন্ত্র, সমতাভিত্তিক সমাজ, সামাজিক ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের প্রতি আমাদের বিশ্বাস ও আস্থাকে সুদৃঢ় করছি। একই সঙ্গে আমরা সম্মানিত করছি সেসব অগণিত মানুষকে যারা সমতা, শ্রদ্ধা ও সম্মান লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের হিসাব করা এবং তাদের ব্যক্তিগত ভূমিকা নিরূপণ করা দুঃসাধ্য। এজন্য তিনি একজনকে সম্মানিত করার মধ্য দিয়ে সবাইকে সম্মানিত করা হচ্ছে বলে বিবেচনা করার আহ্বান জানান।
৮ রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান পেলেন ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’
নেপালের প্রেসিডেন্ট ডা. রাম বরণ যাদব: মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবস্থায় রাম বরণ যাদব বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে অসুস্থ মানুষদের চিকিৎসা প্রদান করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি ও তার সহকর্মীদের নিয়ে কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা প্রদান করা হয়। ঢাকাস্থ নেপালের রাষ্ট্রদূত হরি কুমার শ্রেষ্ঠা তার পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন।  ভুটান তৃতীয় রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক: মুক্তিযুদ্ধের সময় জিগমে দর্জি ওয়াংচুক এদেশের নিরীহ অসহায় মানুষের পাশে ছিলেন এবং অর্থনৈতিক ও সার্বিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। তার পক্ষে প্রতিনিধি লিয়নপো চেন্‌কইয়াব দর্জি তা গ্রহণ করেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম সোভিয়েত প্রেসিডিয়ামের চেয়ারম্যান নিকোলাই ভিক্টোরোভিচ পদগর্নি: মুক্তিযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং স্বাধীনতাবিরোধী দেশগুলোর চক্রান্ত ব্যর্থ করার ভূমিকার জন্য তাকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মন্ত্রিপরিষদের চেয়ারম্যান আলেক্সি নিকোলেভিচ কোসিগিন: সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য, সে সময় ভারতকে অস্ত্র সহযোগিতা প্রদানের সিদ্ধান্তের জন্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানপন্থি নীতির বিরোধিতা করে স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করার অবদানের জন্য তাকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম সোভিয়েত প্রেসিডিয়ামের চেয়ারম্যান নিওনিড ব্রেজনেভ: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল ও পলিট ব্যুরোর সর্বোচ্চ পদাধিকারী হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাৎপর্যপূর্ণ সহযোগিতা প্রদানের জন্য তাকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। তিন রাশিয়ানের পক্ষে ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার এ নিকোলেভ সম্মাননা গ্রহণ করেন। সাবেক যুগোশ্লাভিয়া প্রেসিডেন্ট মার্শাল জোসেফ ব্রজ টিটো: মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি নিপীড়িত মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ান। বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জোরালো সমর্থন জানান। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সমর্থক এবং তার ভূমিকা বাংলাদেশের পক্ষে তৃতীয় বিশ্বের সমর্থন জোরদার করে। উল্লেখযোগ্য এ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। তার পক্ষে ছেলে আলেকজান্ডার ব্রজ সম্মাননা গ্রহণ করেন।  বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড রিচার্ড জর্জ হিথ: মুক্তিযুদ্ধের সময় স্যার এডওয়ার্ড হিথ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। গণহত্যা বন্ধ করার জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে বার্তা প্রেরণ করেন এবং পার্লামেন্টে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন। বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারামুক্ত হয়ে স্বদেশের পথে লন্ডনে এলে এডওয়ার্ড হিথ তাকে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে বরণ করেন। বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। তার স্মরণে গঠিত ট্রাস্ট্রের সদস্য জেমিস এল্ডার সম্মননা গ্রহণ করেন।  নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বি.পি. কৈরালা: মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনৈতিক নেতা, গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী বি.পি. কৈরালা সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন। তিনি গণহত্যার বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন এবং বাংলাদেশের জনগণের সাহায্যের জন্য ভারতের সঙ্গে এক সঙ্গে কাজ করেছিলেন। তার এ অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। তার ছেলে প্রকাশ কৈরালা সম্মাননা গ্রহণ করেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ