রবিবার, ১ এপ্রিল, ২০১২

শতাধিক দালালের হাতে জিম্মি জরিপ অধিদপ্তর


শতাধিক দালালের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর। এখানে জাল পর্চা ও মৌজার নকশার রমরমা বাণিজ্য করছে এ দালালরা। তারা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে সেবাগ্রহীতার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে জাল কাগজপত্র। কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই এসব হলেও তারা দেখেও না দেখার ভান করছেন। এসব অপরাধের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। প্রতারক ও জালিয়াত চক্র নির্মূলে প্রায় এক বছর আগে একটি ভিজিলেন্স টিম গঠন করা হলেও তাদের নজরদারির বাইরে থেকে যাচ্ছে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। ইতিমধ্যে এ টিমে কয়েক দফা রদবদল আনা হলেও তাতে কোন কাজ হচ্ছে না। দালাল চক্রের সঙ্গে এদের অলিখিত বোঝাপড়ার অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় জমির পর্চা আর মৌজার নকশা তুলতে গিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। ক্ষেত্রবিশেষে সরকার নির্ধারিত ৬০ টাকার পরিবর্তে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কয়েক হাজার টাকা। 
সংশ্লিষ্টরা জানান, দালালরা সবসময় সংঘবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করে। ফলে কেউ তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে সাহস পান না। অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, দালালদের উৎপাতে ঠিকমতো কাজ করা যায় না। যেখানে সেখানে তাদের আনাগোনা। বলতে গেলে, দালালদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন তারা। তিনি বলেন, সম্পূর্ণ আইন বহির্ভূতভাবে এসব কাজ করা হচ্ছে। অধিদপ্তরের রেকর্ড বিভাগের কর্মকর্তাদের হাত করে এ চক্র এসব অন্যায় কাজ করে যাচ্ছে। মাঠ পর্চা বা নকশা তুলে দেয়ার নাম করে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কম্পিউটারের মাধ্যমে জাল পর্চা বানিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছে। ভূমি অধিদপ্তরের মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে লাল কালিতে বাংলায় লেখা একটি সাইনবোর্ড। এতে লেখা আছে, দালাল, প্রতারক ও জালিয়াত চক্র থেকে সাবধান। কিন্তু ওই সতর্কবাণী কোন কাজে আসছে না। ইচ্ছায় অনিচ্ছায় সেবাগ্রহীতারা দালালের খপ্পরে পড়ছেনই। 
দালালের দৌরাত্ম্যের কথা স্বীকার করে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) তাপস কুমার বসু বলেন, এখানে এসে দালালের কবলে পড়ে অনেকে হয়রানির শিকার হন। বেশ ক’জন দালাল চিহ্নিত করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দেয়ার পরও তাদের তৎপরতা বন্ধ হয়নি। বরং আদালত থেকে ছাড়া পেয়ে তাদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, এখানকার দালাল কম, বেশির ভাগ দালাল ঢাকা সেটেলমেন্ট অফিসের। তবে এদের সঙ্গে এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করা যাবে না। তিনি জানান, ভোগান্তি কমাতে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ সংক্রান্ত কার্যক্রমকে ডিজিটালাইজ্‌ড করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ঢাকা শহরের পর্চা ও নকশা ব্যবস্থাপনা ডিজিটালাইজ্‌ড করা হয়েছে। এছাড়া সাভারের সদর উপজেলার পাঁচটি মৌজায় ও নরসিংদীর পলাশ উপজেলার সব ক’টি মৌজায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে জরিপ চালানো হচ্ছে। তাপস কুমার বসু জানান, পরিচালক (প্রশাসন) সৈয়দ মো. ওয়াজেদ আলীর নেতৃত্বে কয়েক দিন আগে ভিজিল্যান্স টিম পুনর্গঠন করা হয়েছে। এর আওতায় প্রতি সপ্তায় অঘোষিতভাবে দালালদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়া ভিজিল্যান্স টিমের সদস্যরা সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখছেন। অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছে। আছে জনসাধারণের জন্য সতর্কবাণী, র‌্যাব-পুলিশের সার্বক্ষণিকের পাহারা। তারপরও মানুষ সাবধান না হলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। 
কথা হয় নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার গ্রাম থেকে আসা সাদেম আলী মণ্ডলের সঙ্গে। জমির একটি পর্চা তুলতে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে এলে সেলিম নামে এক লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়। এ সময় সেলিম নিজেকে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে পর্চা তুলে দেয়ার নাম করে তার কাছ থেকে ১২০০ টাকা নেয়। এরপর শুরু হয় বিড়ম্বনা। বিভিন্ন অজুহাতে সাদেম আলীকে ঘোরাতে থাকে সেলিম। এভাবে পার হয় সপ্তাহ। অবশেষে অধিদপ্তরের প্রবেশমুখে দায়িত্বরত এক পুলিশ সদস্যকে বিষয়টি জানান সাদেম আলী। কিন্তু তাতে কোন প্রতিকার পাননি তিনি। উল্টো দালাল চক্রের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে তাকে। অবশেষে অনেক আকুতি মিনতির পর দালাল সেলিমকে দেয়া ১২০০ টাকার মধ্যে মাত্র ১০০ টাকা ফেরত পান তিনি। এমন চিত্র তেজগাঁও ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে নিত্য দিনের। জনগণের এ দুর্ভোগ লাঘব এবং প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা নিতান্তই লোকদেখানো বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।
ভূমি জরিপ সম্পর্কিত যে কোন তথ্য জানার জন্য ভবনের নিচতলায় স্থাপন করা হয়েছে তথ্য কেন্দ্র। এর প্রবেশ ফটকে লেখা রয়েছে, ‘এখানে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ’। ফটকের কাছে গেলেই একজন জানতে চান আসার কারণ। সেবাগ্রহীতা পরিচয় দিয়ে ‘মুগদা এলাকার একটি নকশা তোলার জন্য এসেছি’ বলার পর ওই লোকটি জানতে চান, কাগজপত্র সব ঠিক আছে কিনা। থাকলে তিনি কাজটি করে দিতে পারবেন। এজন্য তিনি দুই হাজার টাকা দাবি করেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ ধরনের শতাধিক দালাল প্রতিনিয়তই এখানে সক্রিয় রয়েছে। দালাল চক্রের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে- খোকন, শফিক, জসিম, ঝন্টু, গুলু, সেলিম, হায়দার, লিটন, মিন্টু, পান্না, মোহন, বাবুল আরও অনেকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ