রবিবার, ১ এপ্রিল, ২০১২

৩০ নদীর গতিপথ পরিবর্তনে ভারতের পরিকল্পনায় প্রতিবেশীদের উদ্বেগ

সমপ্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ৩০টিরও বেশি নদীর আন্তঃসংযোগ ও তার পানির প্রবাহকে পরিবর্তন করার নির্দেশ দিয়েছে সরকারকে। এতে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ বলেছে, এমনটা করা হলে তার সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে। যেসব নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখ করার মতো দু’টি হলো- গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র। এ দু’টি প্রধান নদীর নিম্ন অববাহিকায় বাংলাদেশের অবস্থান। এ প্রকল্প নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন যোগাযোগও করা হয়নি। শুক্রবার অনলাইন বিবিসি এ খবর দিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর শিরোনাম- ‘কনসার্ন ওভার ইন্ডিয়া রিভারস অর্ডার’। এতে বলা হয়, বহু কোটি ডলারের এ প্রকল্পটি ভারত সরকার ২০০২ সালে ঘোষণা করে। কিন্তু এর পর থেকে তা ছিল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। নেপালের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেপালে এখন রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল নয়। এ সুযোগকে ব্যবহার করে ভারত বাঁধ ও  নেপাল সীমান্তে জলাধার নির্মাণ করার পথ উন্মুক্ত করতে পারে। এটি হবে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত প্রকল্প। ইংরেজিতে যাকে বলা হবে ইন্টার লিঙ্কিং প্রজেক্ট (আইএলআর)। পানি বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভারতের এ প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য নেপাল হলো আদর্শ স্থান। ভুটানেও আছে একই ধরনের লোকেশন বা স্থান। এর কতগুলো নদী পতিত হয়েছে ব্রহ্মপুত্রে। এটি ভারতীয় নদী-আন্তঃসম্পর্কীয় প্রকল্পের বড় নদ।
দীর্ঘদিনের আপত্তি: এ প্রকল্পের মূল ধারণা হলো- কর্তৃপক্ষ যেখানে মনে করবে পর্যাপ্ত পানি আছে সেই পানির গতি পরিবর্তন করে যে এলাকায় সেচ, বিদ্যুৎ ও মানুষের নিত্যদিনের কাছে পানির ঘাটতি রয়েছে সেখানে প্রবাহিত করবে। ভারতের সরকারি তথ্যমতে, তাদের জনসংখ্যা প্রায় ১২০ কোটি। প্রতিদিনই পানির চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু সরকার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আইএলআর উপস্থাপনের চেষ্টা করছে ততই তা নিয়ে বিতর্ক জোরালো হয়ে উঠছে। সমালোচকরা বলছেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। তারা আরও বলছেন, যেসব দেশের ভিতর দিয়ে নদীগুলো প্রবাহিত হয়েছে তাদের সম্মতি ছাড়া এ প্রকল্প বাস্তবায়ন টেকনিক্যাল কারণে যায় না। আদালত এ প্রকল্প নিয়ে গত মাসের প্রথম দিকে নির্দেশ দেন। তাতে বিচারকরা বলেন, প্রকল্পটির কাজ দীর্ঘদিন বিলম্বিত করা হয়েছে। এতে খরচ বাড়ছে। প্রায় ১০ বছর আগে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২ হাজার কোটি ডলার। তখন ধরা হয়েছিল এটি শেষ হতে সময় লাগতে পারে ১৬ বছর। আদালত এ প্রকল্পটির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের জন্য একটি কমিটি নিয়োগ করেছে। তাদের বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার জন্য পরিকল্পনা করতে। কিন্তু বাংলাদেশের পানি সম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন বিবিসিকে বলেছেন, এ প্রকল্পে আমরা কখনও রাজি হতে পারি না। এসব নদীর ওপর আমাদের কৃষি, অর্থনীতি ও জীবন নির্ভরশীল। এসব নদীর পানির গতিপথ পরিবর্তনের কথা আমরা কল্পনাই করতে পারি না। 
ভাটি অববাহিকায় যেসব প্রভাব পড়বে: এশিয়ার বড় দু’টি নদী গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র। এ দু’টি নদীই ভাটিতে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ভারত যেসব নদীর গতিপথ পাল্টে দিতে চায় তার মধ্যে এ দু’টি নদী রয়েছে। ভারত চাইছে এর পানির প্রবাহের গতিপথ পাল্টে তা ভারতের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে প্রবাহিত করতে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেছেন, দেখে মনে হয় ভারত মনে করছে এ নদীগুলো সীমান্তে এসে থেমে গেছে। ফলে ভাটিতে বাংলাদেশে পানি যেতে পারবে না। এ পানিসম্পদ নিয়ে তারা যদি কোন কিছু করে তবে তাতে যেন ভাটিতে বাংলাদেশে এর কোন প্রভাব পড়বে না! তিনি আরও বলেন, ভারত সব সময়ই মনে করে যে, ব্রহ্মপুত্রে বুঝি বাড়তি অনেক পানি আছে। কিন্তু তাদের দেখে এটা কখনওই মনে হয় না-  তারা এ বিষয়টা মাথায় রাখছে যে, ভাটিতে বাংলাদেশ নামে একটা সার্বভৌম দেশ আছে। এদেশটিরও পানির দরকার আছে। মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন জানিয়েছেন, ভারতের তরফে এ প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কোন আনুষ্ঠানিক  যোগাযোগ করা হয়নি। এ প্রকল্পটি নিয়ে নেপাল ও ভুটানকেও অবহিত করা হয়নি। এ বিষয়ে নেপালের জ্বালানিমন্ত্রী পোস্তা বাহাদুর বোগাতি বলেছেন, তিনি ভারতের কাছ থেকে এ প্রকল্প নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোন তথ্যই পাননি। নেপালের পানিসম্পদ বিষয়ক সিনিয়র বিশেষজ্ঞ সান্তা বাহাদুর পুন এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নেপালের ভিতরে বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ করতে ভারতকে অনুমোদন দেয়া রাজনীতিবিদদের উচিত হবে না। ভুটান এ প্রকল্প নিয়ে মোটেও খুশি নয়। ভুটানের কৃষি ও বনমন্ত্রী পেমা গিমতসো বিবিসি’র কাছে বলেছেন, আমরা মনে করি নদীগুলোর চলার পথ বহুদেশের ভিতর দিয়ে। তবে এ প্রকল্পের জন্য কোন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ভারতের সঙ্গে সরাসরি কোন কথা হয়নি। 
প্রাথমিক পর্যায়ে: পত্রিকার রিপোর্ট বা একাডেমিক গবেষণা ছাড়া আইএলআর প্রকল্পের বিষয়ে সরকারিভাবে খুব সামান্যই প্রকাশ করা হয়েছে। ২০০৬ সালে ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রীকে পার্লামেন্টে প্রশ্ন করা হয়েছিল- এ প্রকল্প নিয়ে কোন শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে কিনা। তিনি এর একটি সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন- আইএলআর প্রকল্পটি এখনও মাত্র ধারণার পর্যায়ে রয়েছে। এ প্রকল্পটি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণের পরে এর প্রভাব সম্পর্কে বলা যাবে। ফলে এ পর্যায়ে আইএলআর প্রকল্প নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের কোন প্রয়োজন নেই। তবে আইএলআর প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সমপ্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যে আদেশ দিয়েছেন তাতে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া কি শুক্রবার এ বিষয়ে ভারতের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কোন কর্মকর্তা কোন মন্তব্য করেননি। অতীতে পানি নিয়ে বাংলাদেশ, নেপাল ও পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত অনেক চুক্তি করেছে। এগুলো নিয়ে রয়েছে তীব্র বিরোধিতা। এখন চীন তার দক্ষিণের নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তন করে উত্তরের দিকে পানি প্রবাহিত করতে চায়। এ নিয়ে নয়া দিল্লির মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। চীন তিব্বতে ইয়ারলু-সাংপো নদীতে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে। চীন বলেছে, তারা কোনভাবেই ওই নদীর পানির গতিপথ পরিবর্তন করবে না। এ নদীটি ভারতে এসে ব্রহ্মপুত্র নাম ধারণ করেছে। ভারতের প্রধান উদ্বেগের কারণ- এ নদীতে চীনের ওই প্রকল্প নিয়ে। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার কারণে পানির বিষয়ে সবার দৃষ্টি থাকবে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটি সামপ্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ২০২২ সালের পরে দক্ষিণ এশিয়া হবে বিশ্বের মধ্যে এমন একটি অঞ্চল যেখানে পানিকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে অথবা সন্ত্রাসবাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ