রবিবার, ১ এপ্রিল, ২০১২

তিনি থাকবেন অবিনশ্বর

২০১০ সালে মিনার মাহমুদ দেশে ফিরেছেন ১৮ বছর পর। আমরা যারা তার প্রতি মুগ্ধতা কখনও ভুলে যাইনি তাদের জন্য এটি ছিল বিশাল খবর। তিনি আবারও বিচিন্তা বের করবেন। বিচিন্তার কথা শোনামাত্র স্মৃতি ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে মন। বিচিন্তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার স্মৃতি! ১৯৮৭ সালে কনক নামে নতুন সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হলো। তখন নতুন পত্রিকা মানে সাপ্তাহিক বিচিত্রার মতো কিছু বের করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা। বাংলার বাণী’র একসময়ের ডাকসাইটে সাংবাদিক আমির হোসেনের সম্পাদনায় কনক পত্রিকায় সংযুক্ত হলেন সোহরাব হাসান, মনজুরুল হক, আহসান হাবীব, নঈম নিজাম সহ আরও অনেকে। প্রতিবেদক হিসেবে চাকরি হলো আমারও। জীবনের প্রথম ‘চাকরি’, বেতন ১৫০০ টাকা, সঙ্গে অন্যান্য ভাতা। আমি বিপুল উৎসাহে লেখালেখি শুরু করলাম। আমির ভাইরাও চেষ্টা করলেন। কিন্তু কনক বিচিত্রার ধারেকাছেও যেতে পারলো না। মন খারাপ করে অফিসে বসে থাকি। এমন সময় কিভাবে জানি হাতে এলো বিচিন্তা। 
বিচিন্তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল এর সম্পাদক। তিনি মিনার মাহমুদ। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিলেন সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। বাংলাদেশের সেই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত সাংবাদিক ছিলেন তিনি। সন্ত্রাস, স্মাগলিং, দুর্নীতি বিষয়ক বিচিত্রায় তার রিপোর্ট রুদ্ধশ্বাসে পড়তাম আমরা। পত্রিকার পাতা খুলে আরও বিস্ময়। একবারেই বিচিত্রা হওয়ার চেষ্টা করেনি বিচিন্তা। সাইজ ও চেহারায় সদ্য নিষিদ্ধ পত্রিকা সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের মতো। বাকি সবকিছু সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেটি ঠিক কিরকম তা নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তবে বিচিন্তায় এক ধরনের প্রবল তারুণ্য, বন্যতা আর আধুনিকতা ছিল। ছিল প্রচলিত রাজনীতি আর সমাজব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার নির্মোহভাবে ইতিহাস পুনর্পাঠ করার দুঃসাহস। আমি প্রায় চমকে উঠি বিচিন্তা উল্টেপাল্টে। বিচিন্তায়ই তো কাজ করার কথা আমার! 
সরাসরি মিনার ভাইকে ফোন করি। তিনি অবলীলায় চলে আসতে বলেন। আমার জীবনে সবচেয়ে স্পর্ধিত সময়ের সূচনা সেদিন থেকেই। তার সঙ্গে যতদিন কাজ করেছি কখনও কোন কাজে না বলেননি। তিনি অপার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন, আমাদেরকেও তাই দিয়েছিলেন। তিনি সাহসী ছিলেন, তার সাহস আমাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। বিচিন্তার প্রথম প্রজন্মের সাংবাদিকরা সবাই পরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছেন। এই সাফল্যের পেছনে বিচিন্তায় কাটানো সময়টুকুর বড় ভূমিকা ছিল। 
বিচিন্তা ছিল স্ফুলিঙ্গের মতো। এক বছরও টিকতে পারেনি সেই স্ফুলিঙ্গ। বিচিন্তা সমাজে প্রবলভাবে গৃহীত হয়েছিল, সমাজপতিদের কাছে হয়েছিল নিন্দিত। বিচিন্তার মতো পত্রিকার জন্য এটিই ছিল স্বাভাবিক। এরশাদ সরকার এক সময় বিচিন্তা বন্ধ করে দিয়ে মিনার ভাইকে জেলে পোরে। তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম এ ঘটনায়। দ্বিতীয় দফায় বের হওয়া বিচিন্তাকে মাঝপথে রেখে তিনি একসময় বিদেশে চলে গেলেন। তখনও খারাপ লেগেছে। নিউ ইয়র্কে তার যে জীবন তা মিনার মাহমুদসুলভ ছিল না। সেই মিনার মাহমুদকে কোনদিন দেখতে চাইনি আমি। নিউ ইয়র্কে অনেকবার গেলেও তাই দেখা হয়নি তার সঙ্গে। তিনিও নিশ্চয়ই খুব পছন্দ করতেন না প্রবাস জীবন। 
প্রায় দেড় যুগ পর তিনি দেশে ফিরেছিলেন। আবারও বিচিন্তা বের করেছিলেন। কিন্তু তিনি সময়ের ব্যবধান ধরতে পারেননি। সংবাদপত্র শিল্পে ইতিমধ্যে কালো টাকার যে দাপট শুরু হয়েছিল তার সঙ্গেও টিকতে পারেননি। এর সঙ্গে শুরু হয় তার শারীরিক অসুস্থতা ও নানা ব্যক্তিগত বিপর্যয়। বিশাল ও সম্পূর্ণ স্বাধীন জীবন কাটানো এই মানুষটা ছোট হয়ে আসা বৃত্তকে মানতে পারেননি। 
মিনার মাহমুদরা থাকলে থাকেন রাজার মতো। ধুঁকে ধুঁকে কোনমতে টিকে থাকার জন্য তাদের জন্ম হয় না। তাই হয়তো তিনি চলে গেছেন নিজের ইচ্ছেয়। তার সব কিছুই বিশাল। তাই তার অর্জনও ছিল বড়, বর্জনও। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু আমরা তাকে কোনদিনও ছাড়তে পারবো না।
তিনি থাকবেন অবিনশ্বর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ