রবিবার, ১ এপ্রিল, ২০১২

বিষক্রিয়ায় মৃত্যু মিনার মাহমুদের


আশির দশকের আলোচিত সাপ্তাহিক পত্রিকা বিচিন্তার সম্পাদক মিনার মাহমুদের মৃত্যু বিষক্রিয়ায় হতে পারে- এ তথ্য জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ। গতকাল বেলা ১১টায় ময়নাতদন্ত শেষে এ তথ্য জানান তিনি। ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, মিনার মাহমুদের হাতের নখে পাউডারজাতীয় বস্তু এবং পাকস্থলীতে তরল সাদা পদার্থ পাওয়া গেছে। এগুলো সংরক্ষণ করে মহাখালীতে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া পাকস্থলী, কিডনি ও লিভারের কিছু অংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। পরীক্ষার জন্য মিনারের ডিএনএ নমুনাও সংগ্রহ করা হয়েছে। খিলক্ষেত থানা পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাশের শরীরে কোথাও কোন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় হোটেল রিজেন্সি কর্তৃপক্ষ খিলক্ষেত থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেছে। এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা মিনার মাহমুদের ৫ পৃষ্ঠার দীর্ঘ চিঠি পরীক্ষার জন্য সিআইডি’র কাছে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা ২২ ধরনের আলামত পরীক্ষা করছে পুলিশের একাধিক সংস্থা। প্রাথমিকভাবে ঘটনা আত্মহত্যা বলে মনে হলেও খিলক্ষেত থানা পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে। একই সঙ্গে ছায়া তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের একাধিক সংস্থা। 
বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর পাঁচতারকা হোটেল রিজেন্সির একটি কক্ষ থেকে সাংবাদিক মিনার মাহমুদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধারের পর গত রাত ২টার দিকে মিনারের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তার লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। 
কি কারণে আত্মহত্যা: ঠিক কি কারণে অকুতোভয় সাংবাদিক মিনার আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, মিনার মাহমুদ তার সাংবাদিকতা পেশা নিয়ে হাতাশাগ্রস্ত ছিলেন। এ ছাড়া পারিবারিক কলহ, দীর্ঘ প্রবাস জীবন ও অসচ্ছলতা তার আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হতে পারে। মিনারের ছোট ভাই মেহেদী হাসান বলেন, ভাইয়া বেশ কিছুদিন ধরে দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমে যোগ দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কেউ তাকে সাহায্য করেনি। এ নিয়ে ভাইয়ার অভিমান ছিল। তিনি বলেন, ভাইয়া আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিলেন না। আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার সময়ও তার তেমন কোন সঞ্চয় ছিল না। মিনারের স্ত্রী লুবনা ওরফে লাজুক বৃহস্পতিবার রিজেন্সি হোটেল থেকে লাশ উদ্ধারের সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, ও আমাকে বলে গেছে মৃত্যুর পর তার লাশ নিয়ে যেন কোন সংবাদ প্রকাশিত না হয়। কেউ যেন তার লাশের ছবি না তোলে। ফটো সাংবাদিকরা মিনারের ছবি তোলার চেষ্টা করলে উত্তেজিত হয়ে পড়েন লাজুক। মিনারের অনুজ সাংবাদিক মুকুল তালুকদার বলেন, বর্তমান সময়ে অনেক নামকরা সাংবাদিকের হাতেখড়ি হয়েছে মিনার ভাইয়ের হাতে। কিন্তু কেউ শেষ মুহূর্তে তাকে মূল্যায়ন করেনি।  
যা লেখা চিঠিতে: দীর্ঘ ৫ পৃষ্ঠার চিঠিটি লেখা হয়েছে লাজুক নামের একজনকে উদ্দেশ্য করে। প্রথমে লাজুককে নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে পুলিশ। পরে পুলিশ নিশ্চিত হয় মিনার মাহমুদের স্ত্রীর নাম লুবনা ওরফে লাজুক। দীর্ঘ চিঠিতে একাধিকবার লাজুক নামটি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি পৃষ্ঠায় একাধিক কাটাকাটি। অনেক শব্দের মর্মার্থ উদ্ধার করা যায়নি। দ্বিতীয় পৃষ্ঠার শুরুতে লেখা হয়েছে, ‘লাজুক তোমার মনে প্রশ্ন উঠতে পারে কেন আমি আত্মহত্যা করলাম? গতকাল দৈনিক আজকের প্রত্যাশা থেকে রিজাইন করেছি বলে? মোটেও না। আসলে নির্দিষ্ট কোন কারণ নেই। আসলে কারও প্রতি আমার অভিযোগ নেই। অভিযোগ আছে বাংলাদেশের প্রতি। সৃষ্টিকর্তা জানেন তোমার মতো মেয়ে পৃথিবীতে নেই। সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমি জানতাম- কোথায় যাচ্ছি, কি করতে যাচ্ছি। আমাদের এতদিনের চেনাজানা। আর ফিরব না। আর দেখা হবে না। এর আগেও অনেকবার আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু পারিনি। আমার মৃতদেহের ওপর আছড়ে পড়ে তুমি কাঁদছো। এটা ভাবার পর একবার ভাবছি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি। আবার ভাবছি- না। জানি আমি ছাড়া তোমার কেউ নেই। লাজুক তুমি এখন একা, নিঃসঙ্গ। একাকী। লাজুক, আমি সাংবাদিকতা পেশায় শুধু দিয়েই গেলাম। কিছুই পেলাম না। অথচ নীতিভ্রষ্ট হতে পারিনি। নিজের ব্যাংক একাউন্টে একটি টাকাও নেই। কোথাও একফোঁটা জমি নেই। যে কথাটা আমি বলতে চাইনি, নিউ ইয়র্কে আমার জীবন ছিল আত্মকেন্দ্রিক। দাসত্বের। বাংলাদেশ ছাড়া আমি চলতে পারছিলাম না।’ 
পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে লেখা হয়েছে দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের হতাশার কথা। দেশের গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ ও বর্তমান প্রেক্ষিত নিয়েও নানা কথা লিখেছেন তিনি। মিনার লিখেছেন, ‘আমি অনেক জায়গায় চাকরির জন্য গেলাম। কিন্তু কেউ আমাকে চাকরি দিল না। সবাই চায় নতুন আর নতুন।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়কার স্মৃতি, এরশাদ সরকারের সময়ে নির্যাতন ও কারাবরণ বিষয়ে অনেক কথা লেখা হয়েছে। বেশ কিছু শব্দ একবার লিখে কেটে দিয়েছেন। কিন্তু একই কথা আবার লিখেছেন। চিঠির শেষে তিনি অসংখ্যবার লিখেছেন, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ। ‘প্লিজ’ শব্দটা অন্তত ১০ বার লেখা। একপর্যায়ে প্লিজ শব্দটির অক্ষর এলোমেলো হয়ে গেছে। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, হয়তো লিখতে লিখতেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। মিনার মাহমুদের এই চিঠিটি পরীক্ষার জন্য সিআইডি’র কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন খিলক্ষেত থানার ওসি শামীম হাসান।  
সুরতহাল: গতকাল সকালে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন খিলক্ষেত থানার এসআই শাহজাহান। তিনি বলেন, লাশের কোথাও কোন আঘাতে চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তার ডান হাতটি বুকের কাছে ভাঁজ করা ছিল। পরনে ছিল হালকা আকাশি ফুলহাতা শার্ট ও কালো রঙের একাধিক পকেটের প্যান্ট। তিনি বলেন, আমরা মোটামুটি নিশ্চিত আঘাতজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়নি। বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু হতে পারে। ভিসেরা রিপোর্ট এলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। 
খালি হাতে হোটেলে: রিজেন্সি হোটেলে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় বুধবার সকাল ১০টা ৪২ মিনিটে তিনি হোটেলে ঢুকেছেন। নিচতলায় লিফটের জন্য অপেক্ষা করার সময় তার হাতে কিছুই ছিল না। কিন্তু মিনারের কক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের ওষুধের একটি বড় প্যাকেট উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি পানীয়ের বোতল পাওয়া গেছে। কিন্তু হোটেল কর্তৃপক্ষ বলেছে তারা মিনারকে কোন ধরনের খাবার বা পানীয় সরবরাহ করেননি। রিজেন্সি হোটেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক মেজর অব. মাহবুবুল ওয়াদুদ বলেন, তিনি হোটেলে ঢোকার পর একবারের জন্যও বের হননি। তিনি কোন পানীয় বা খাবারের অর্ডারও দেননি। এ বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখছে পুলিশ। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, কক্ষের বিছানা ও বাথরুম অব্যবহৃত ছিল।  
২২ ধরনের আলামত: রিজেন্সি হোটেলে ৭০২৮ নম্বর কক্ষ থেকে ২২ ধরনের আলামত সংগ্রহ করেছে সিআইডি। এর মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ, পানীয়, হাত ও পায়ের ছাপ, চিঠি, চুল, মুখের লালা ও কলম। সিআইডি’র ফরেনসিক এক্সপার্ট এএসপি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কক্ষ থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। কোন কিছু্‌ই বাদ দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, মিনার মাহমুদের আগের লেখার নমুনার সঙ্গে এখান থেকে উদ্ধার করা চিঠির লেখা মিলিয়ে দেখা হবে। এ ছাড়া বিশেষ ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে কক্ষ থেকে সংগ্রহকৃত হাত ও পায়ের ছাপ পরীক্ষা করে দেখা হবে সেখানে অন্য কেউ ঢুকেছিল কি না। সিআইডি’র এ কর্মকর্তা বলেন, মিনারের হাতের নখে সাদা পাউটার লেগে ছিল। এ ছাড়া ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল নানা ধরনের ট্যাবলেট। এগুলোর মধ্যে বেশকিছু ট্যাবলেট ঠিল চেতনানাশক। উচ্চমাত্রার ব্যথানাশক ট্যাবলেটও ছিল। সব ওষুধ পরীক্ষা করা হবে। 
গতকাল ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ থেকে মিনার মাহমুদের স্ত্রী ডা. লুবনা লাজুক স্বামীর মরদেহ গ্রহণ করেন। পরে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ১৬ নম্বর রোডের ১৭ নম্বর বাড়িতে। সেখানে মিনার মাহমুদের মরদেহ দেখতে বিভিন্ন স্তরের লোকজন ভিড় জমান। এরপর ৩ নম্বর সেক্টরের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তার প্রথম জানাজা হয়। জানাজায় মিনার মাহমুদের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সাবেক সহকর্মী ও সাংবাদিকরা যোগ দেন। জানাজায় অংশ নিয়ে মিনারের বাল্যবন্ধু এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট একে আজাদ স্মৃতিচারণ করেন। দুপুর সোয়া ২টায় তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের আলীপুরের উদ্দেশে। মিনার মাহমুদের ছোটভাই মেহেদী হাসান জানান, আজ শনিবার সকাল ৯টায় আলীপুরের গ্রামের বাড়িতে মিনার মাহমুদের দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। পরে মরদেহ ঢাকার মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফনের কথা রয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ