রবিবার, ১ এপ্রিল, ২০১২

পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন হলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন হওয়াই গণতন্ত্রের মাপকাঠি নয়। দেশের মানুষের গণতন্ত্রের জন্য বারবার আন্দোলন-সংগ্রাম করে রক্ত দিলেও কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অতীতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যতটা চেষ্টা হয়েছে, মানুষ ত্যাগ স্বীকার করেছে গণতন্ত্র চর্চা ও রক্ষার জন্য সেরকম কিছু করা হয়নি। দেশের রাজনীতি এখন সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। রাজনীতি যখন ব্যবসায় পরিণত হয় তখন সেই রাজনীতি গণতন্ত্রের ধারেকাছেও থাকে না। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘আমাদের গণতন্ত্র কোন পথে?’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সুজন সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। বক্তব্য রাখেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ, জাসদ (জেএসডি) সভাপতি আসম আবদুর রব, বিএনপি নেতা ইনাম আহমদ চৌধুরী, সাবেক ছাত্রনেতা মাহমুুদুর রহমান মান্না, আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক নূহ-উল আলম লেনিন, রাজনীতিবিদ হায়দার আকবর খান রনো, রুহিন হোসেন প্রিন্স, সংসদ সদস্য রাশেদা বেগম হীরা, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান, অধ্যাপক কামাল আতাউর রহমান, অধ্যাপক আহসানুল হক প্রমুখ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক রওনক জাহান। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেন, শুধু ৫ বছর পরপর নির্বাচন হলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের তোয়াজ নয়, সরকারের বিরুদ্ধে দ্রোহ করতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে। তিনি বলেন, মানুষ এখন অনেক সচেতন। তারা এখন বিকল্প খুঁজছে। কিন্তু তারা বিকল্প খুঁজে পাচ্ছে না। নাগরিক সমাজকে বিকল্প তৈরির দায়িত্ব নিতে হবে। শুধু ৫ বছর পরপর নির্বাচন হলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের নামে আমরা পরমুখাপেক্ষী একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছি। এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে হলে মানুষের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। মানুষ বিচার পাচ্ছে না। অধিকার পাচ্ছে না। অন্যায়-অবিচার হচ্ছে, এর বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজকেই রুখে দাঁড়াতে হবে। গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘সংবিধানে মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আজও তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কিছু ধারায় বাক স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। এই হরণ কোন কাজে আসবে না। কারণ, এদেশের রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষ অতীতে অনেক ভয়-হুমকি জয় করে এসেছে। মানুষ অনেক হুমকি উড়িয়ে দিয়েছে। এর উপযুক্ত উদাহরণ স্বাধীনতা। এখনও সেরকম কিছু করা হলে মানুষ তা উড়িয়ে দেবে। 
তিনি বলেন, আমাদের দেশে সংস্কার শব্দটিকে খারাপ শব্দে পরিণত করা হয়েছে। বিশ্বের আর কোন দেশে সংস্কারবাদীদের পেটানোর নজির নেই। কিন্তু আমাদের দেশে সংস্কারবাদীদের পেটানো হয়। তিনি বলেন, সংস্কার শব্দ যদি না থাকে তাহলে পরিবর্তন আসবে কিভাবে। আর সংস্কার না হলে তো মানুষ বিপ্লবের পথ ধরবে। আমি নিজেও এক সময় বিপ্লকের কথা বলতাম। সংস্কার না হলে দেশে আবার উৎখাত, নির্মূলের মতো শব্দ চলে আসবে। তিনি বলেন, দিন বদলের জন্য সরকার এলেও দিন বদল হচ্ছে না। মানুষের মুক্তিও আসছে না। এখন রাজনীতিতে চাঁদাবাজি, মনোনয়ন বাণিজ্য, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো শব্দ শোনা যায়। এগুলো তো গণতন্ত্রের ভাষা হতে পারে না। সরকারের সমালোচনা করলেই বিরোধী ভাবা ঠিক নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে বলেও পার পেয়ে যাচ্ছেন মহাজোটের মহানেতা এরশাদ। কিন্তু তাকে কেউ কিছু বলছেন না। 
আ স ম আবদুর রব বলেন, দেশে আদৌ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা সেটি আমার বড় প্রশ্ন। রাজনীতি এখনও পরিবারের হাতে জিম্মি। সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, দেশে এতগুলো নিরাপত্তা সংস্থা থাকার পরও প্রধানমন্ত্রীকে কেন এর দায়িত্ব নিতে হবে? আর প্রধানমন্ত্রীকে যদি এর দায়িত্ব নিতে হয় তাহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনীতির দুই আপদ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এদের তাড়াতে হলে তৃতীয় শক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে। আদালতের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্টের চেয়ারকেও কলঙ্কিত করার চেষ্টা চলছে।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে যেসব নির্বাচন হয়েছে তাতে মনে হয় রাজনৈতিক সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। উন্নত রাষ্ট্রে যেভাবে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় সেভাবে সরকারের দায়িত্বে সীমারেখা টেনে দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার অর্থে শক্তিশালী করতে পারলে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। তিনি বলেন, মানুষের অধিকারের জন্য সরকার এবং বিরোধী দলকে সংসদে কাজ করতে হবে। সংসদকে কার্যকর করতে হবে। 
বিচারপতি কাজী এবাদুল হক বলেন, সাংবিধানিকভাবে বিচার বিভাগ স্বাধীন। কিন্তু যদি বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিচারকরা রায় লেখেন তাহলে বুঝতে হবে কোথাও না কোথাও সমস্যা আছে। বুঝতে হবে বিচারক দুর্বল। এর এই দুর্বলতা তৈরি করেছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা। প্রত্যেক দলই দলের অনুগত প্রধান বিচারপতি করতে চায়। যাতে তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা যায়। 
স্থানীয় সরকার বিশেষষ্ণ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, গণতন্ত্রের সঙ্কটকে নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়। নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি উপায় মাত্র। আমাদের দেশে জবাবদিহি ও আইনের শাসনের প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি রেখে গণতন্ত্রকে সুসংহত করা যায় না। দেশের রাজনীতি এখন সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। রাজনীতি ব্যবসা হলে তা কখনও গণতন্ত্রের ধারেকাছেও যাবে না। ইনাম আহমদ চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে এখন মিথ্যাচার করা হচ্ছে। মানুষের কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা হচ্ছে। এ অবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার প্রশ্নই আসে না। 
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, নাগরিক সমাজকে এমন কিছু করতে হবে যার পক্ষে দেশের সব মানুষ দাঁড়ায়। দুই দলকে পথে আনতে হলে তাদের কিছু চাপিয়ে দিয়ে হবে না। দুই প্রধান দলের প্রধানের অহংবোধের কাছে দেশের মানুষ জিম্মি উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারাই ক্ষমতায় যায় তাদের চোখ অন্ধ হয়ে যায়। সরকারের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে তারা কিছু দেখতে পাচ্ছে না। 
হায়দার আকবর খান রনো বলেন, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে মানুষের অধিকার ও কণ্ঠরোধ সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণই প্রকাশ করে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রই এখন মিথ্যাচার করছে। এই অবস্থায় নাগরিকের নিরাপত্তা আর থাকে কোথায়? মিজানুর রহমান খান বলেন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন। কিন্তু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নিয়ে কেউ কথা বলেন না। সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এই প্রতিষ্ঠানের কাজ হলেও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া এই প্রতিষ্ঠান একটি সভাও আহ্বান করতে পারে না। তাহলে অন্য প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে কিভাবে?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ