রবিবার, ১ এপ্রিল, ২০১২

ব্যাংকার হওয়া হলো না ডালিমের


রাজমিস্ত্রী পিতার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে নিয়ে। একদিন নিজের দুঃখ দূর করবে। তার আর রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে হবে না। বাসের চাকায় মৃত্যু হয়েছে তার ছেলের। সেইসঙ্গে মৃত্যু হয়েছে একটি স্বপ্নের। তছনছ হয়ে গেছে একটি পরিবারের আশা-আকাঙ্ক্ষা। সোমবার রাত সাড়ে ন’টার দিকে নীলক্ষেত মোড়ে ঢাকা কলেজের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র মোহাম্মদ এসএম জাকারিয়া ডালিম (২৫) বাসচাপায় নিহত হন। জাকারিয়ার পিতা মো. আবদুল জলিল পেশায় রাজমিস্ত্রি। নিজের অল্প জমি ছিল। তা বিক্রি করে দিয়েছেন ছেলের পড়ালেখার খরচ যোগাতে। ভিটেমাটি ছাড়া তার আর কিছুই নেই। জাকারিয়ার চাচাতো ভাই ও দীর্ঘদিনের রুমমেট মো. কালাম মল্লিক বলেন, জাকারিয়া স্বপ্ন দেখতো ব্যাংকার হওয়ার। তার একটাই চিন্তা ছিল বাবার কষ্ট দূর করা। ঘাতক কেড়ে নিয়েছে সব স্বপ্ন। জাকারিয়ার বাড়ি বাগেরহাটের রামপাল থানার ঝনঝনিয়া গ্রামে। সহপাঠীর মৃত্যুর  জের ধরে কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ ও ভাঙচুর চালায়। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ও ছাত্ররা জানিয়েছেন, জাকারিয়া নিম্ন পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলে। বাবা-মার একমাত্র স্বপ্ন ছিল তাকে নিয়ে। তারা দুই ভাই-বোন। বড় বোন পারুল বিবাহিত। জাকারিয়া পড়ালেখার পাশাপাশি গুলশানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। তা থেকে নিজের খরচ চালিয়ে বাবা-মা’র জন্য কিছু টাকা পাঠাতেন। জাকারিয়া কিছুদিন আগে বিয়ে করেছিলেন। তার স্ত্রী নুসরাত জাহান জলি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেছেন। জাকারিয়া ইংরেজি বিভাগের ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে ভাড়া থাকতেন আজিমপুর স্টাফ  কোয়ার্টারের একটি বাসায়। জাকারিয়ার  চাচাতো ভাই ও ঢাকা কলেজের ছাত্র মো. কালাম মল্লিক। তিনি ও জাকারিয়া ঢাকা কলেজের উত্তর ছাত্রাবাসের ২১৪ নম্বর রুমে দীর্ঘ ৬ বছর ছিলেন। কালাম মল্লিকই একদিন জাকারিয়াকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। জাকারিয়ার মৃতদেহ শেষ পর্যন্ত কালাম মল্লিকই ঝনঝনিয়া গ্রামে নিয়ে যান। কথা বলতে বলতে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন কালাম মল্লিক। বলেন, তার মা একদিন জাকারিয়াকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আমি তাকে ঢাকায় নিয়ে আসি। সম্পর্কে চাচাতো ভাই। জাকারিয়া নিজের খরচ চালানোর জন্য গুলশানের একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। জাকারিয়ার রুমমেট ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র আতিকুর রহমান বাপ্পী বলেন, জাকারিয়া ভাই ৭-৮ মাস আগে হল ছেড়ে বাসা নিয়েছিলেন। আজিমপুরের একটি বাসায় থাকতেন। তিনি বলেন, জাকারিয়া ভাই বিদেশী কোম্পানিতে চাকরি করার ইচ্ছা ছিল। বিদেশে যাওয়ার জন্য আইএলটিএস করেন ২০১০ সালে। সেখানে ৫.৫০ পান। বাপ্পী বলেন, গত কোরবানির ঈদে দীর্ঘদিনের বান্ধবী জলিকে বিয়ে করেন পারিবারিকভাবে। সাউথ হলের ৩১৪ নম্বর কক্ষের বাংলা বিভাগের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র গৌরাঙ্গ বলেন, জাকারিয়া ভাই পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলাতেও দক্ষ ছিলেন। বাস চাপায় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় ক্ষুব্ধ ছাত্ররা কলেজের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও রাস্তা অবরোধ করে গাড়ি ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত নিউ মার্কেট এলাকা থেকে সায়েন্সল্যাব মোড় পর্যন্ত সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ থাকে। পরে অতিরিক্ত র‌্যাব ও পুলিশ মোতায়েন করলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, প্রত্যেক দুর্ঘটনার পরপরই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রশাসনের কাছে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করা হয়। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজ সংলগ্ন সড়কগুলোতে বেপরোয়া গতির যানবাহন চলাচল বন্ধের দাবি করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই দাবি পূরণে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এরই জের ধরে সকালে কলেজ ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীরা প্রথমে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামে। পরে যান চলাচল বন্ধ করে ঘাতক চালকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে উত্তেজিত ছাত্ররা যানবাহন লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এরপরই রড ও লাঠিসোটা নিয়ে যানবাহনে ভাঙচুর চালায়। ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মো. রহমান বলেন, কয়েক শ’ শিক্ষার্থী কলেজের সামনে রাস্তায় নেমে প্রথমে বিক্ষোভ শুরু  করে। এতে ওই সড়কে প্রায় এক ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে। পরে যানবাহন ভাঙচুরের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাস্তা পার হওয়ার সময় ঢাকা কলেজের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ডালিমকে সেফটি পরিবহনের বেপরোয়া গতির একটি বাস চাপা দেয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। রাতেই ডালিমের  লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে তার গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়। নিউ মার্কেট থানার এসআই তারেক বলেন, সকাল সোয়া ১০টার দিকে কয়েক শ’ ছাত্র রাস্তায় নেমে এসে কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। নিউ মার্কেট থানার এসআই নজরুল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তারকৃত বাসচালক ইয়াসিনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ