বুধবার, ১৪ মে, ২০১৪

ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারের বাসভবন সরিয়ে নেওয়ার দাবি ।। নজরুল স্কোয়ার ঘিরে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স গড়ার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান ।। সংস্কৃতিকর্মীদের মতবিনিময়

নগরীর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র ডিসি হিল (নজরুল স্কোয়ারথেকে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের বাসভবন সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীরা। সেই স্থানে ‘সিটি মিউজিয়াম’ করা এবং বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসককে অবিলম্বে চট্টগ্রাম থেকে বদলি করারও দাবি জানান তারা। যেকোনো মূল্যে নজরুল স্কোয়ার ঘিরে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স গড়ে তুলতে তারা বদ্ধ পরিকর।
থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে গতকাল মঙ্গলবার সকালে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত সভায় এ দাবি জানানো হয়। সভায় নেতৃবৃন্দ বলেনচট্টগ্রামের যেকোনো উন্নয়নের কথা উঠলেই এ ধরনের বাধা আসে। এর নেপথ্য কারণ কী তা খতিয়ে দেখতে হবে।
এতে সভাপতিত্ব করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট চট্টগ্রামের আহ্বায়ক সমাজবিজ্ঞানী ডঅনুপম সেন। নাট্যব্যক্তিত্ব আহমেদ ইকবাল হায়দারের সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন শহীদজায়া ও লেখিকা বেগম মুশতারী শফীকবি ও সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্তচবি উপ-উপাচার্য ডইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীমহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনঅধ্যক্ষ শীলা মোমেনডাএ কিউ এম সিরাজুল ইসলামসাংবাদিক নাসিরউদ্দিন চৌধুরীপ্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়াপ্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদারকবি ও সাংবাদিক বিশ্বজিৎ চৌধুরীওস্তাদ স্বর্ণময় চক্রবর্তী,আবৃত্তিকার অঞ্চল চৌধুরীমিলি চৌধুরী ও রাশেদ হাসানশিক্ষক নেতা অনুপ সাহাচলচ্চিত্র সংগঠক শৈবাল চৌধূরীসাংস্কৃতিক সংগঠক ফজল হোসেন প্রমুখ।
অনুপম সেন বলেনদীর্ঘ চার দশক ধরে চট্টগ্রামের ডিসি হিল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান তীর্থশালা। ডিসি হিল রাষ্ট্রের সম্পত্তি। এটা কোনো আমলার ভোগ বিলাসের বাংলো হতে পারে না। বর্তমান জেলা প্রশাসক আমাদের সাথে যে ভাষায় কথা বলেছেনতারপর তার সাথে সমঝোতার আর কোনো পথ খোলা নেই। আমরা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে আমাদের দাবির কথা বলব। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই জায়গাটি সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমন্বিত উদ্যোগে পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক বলয়ে পরিণত করার আমাদের আকাঙক্ষাকে কিছুতেই বাধাগ্রস্ত করা যাবে না।
শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফী বলেনডিসি হিলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলবেণ্ডএটাই শেষ কথা। সংস্কৃতিকর্মীদের সবসময়ই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেক আঘাত সইতে হয়েছে। এখনো আঘাত আসবে। তার জন্য আমরা পিছিয়ে পড়ব না। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে আমাদের দাবি জানাতে পারি। তবে এরই মধ্যে আমাদের দাবি হলোডিসির বাসভবন এখান থেকে অন্যত্র সরিয়ে এই স্থান সংস্কৃতিসেবীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে।
কবি ও সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্ত বলেনডিসি হিলে সাংস্কৃতিক কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে অনেক বাধা এসেছে। পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতে গিয়ে বাধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি বলেনসংস্কৃতিমন্ত্রী আমাদেরপূর্তমন্ত্রী আমাদের। আমার স্থির বিশ্বাস,আমাদের পক্ষেই তাদের অবস্থান হবে। তবে তাদেরও মনে রাখতে হবেআমলাতন্ত্রকে যতদিন বেঁধে রাখা যাবে নাততদিন জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা পাবে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ডইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেনডিসি হিল চট্টগ্রামের জন্য একটি নান্দনিক শিল্পবোধ সম্পন্ন জায়গা হতে পারে। এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে যা যা দরকার সব করতে হবে।
মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেনডিসি হিল নিয়ে যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে তা না হলেও পারত। একটি সহজ বিষয়কে জটিল করে তোলা হয়েছে। বর্তমানে আমরা একজন প্রকৃত সংস্কৃতিকর্মীকে আমাদের সংস্কৃতিমন্ত্রী হিসেবে পেয়েছি। সুতরাং তাকে নিয়ে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এই বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব।
সাংবাদিক নাসিরউদ্দিন চৌধুরী বলেনআমাদের প্রত্যাশা পূরণে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বর্তমান সরকারকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে চাপ দিতে হবে। আর এই চাপ সৃষ্টির জন্য পুনর্জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। কেননা আন্দোলন সংগ্রাম ছাড়া কোনো গণ-আকাঙক্ষা পূরণ হয়নি। আমলারা একজোট হয়ে ডিসি হিলের আধুনিকায়নে নেওয়া প্রকল্প বাতিলে বাধ্য করেছে। তারা যদি পারেতবে আমরা দল-মত নির্বিশেষ চট্টগ্রামের সকল সংস্কৃতিকর্মী একজোট হয়ে কেন আমাদের দাবি বাস্তবায়ন করতে পারব নাআমাদের সেই অনমনীয় জেদটা থাকতে হবে। তিনি বলেনবাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত এসেছে। সেই আঘাত প্রতিহত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। চট্টগ্রাম বিপ্লবের সূতিকাগার। অতীতেও আন্দোলন ছাড়া কোনো দাবি আদায় হয়নিএবারও হবে না।
প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেনপ্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণকে ধমক দেওয়ার ধৃষ্ঠতার জন্য ডিসিকে অবিলম্বে ক্ষমা চাইতে হবে। তিনি বলেনডিসি হিলে সাংস্কৃতিক বলয় হবে কি হবে নাতার জন্য ডিসির কাছে ধর্ণা দেওয়ার দরকার নেই। অতীতেও অনেকে ডিসি হিলের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধের চেষ্টা করেছে। প্রবেশ পথ বন্ধ করে দিয়েছেরাতারাতি বাসভবনের সামনে নতুন করে গেট নির্মাণ করেছে। কিন্তু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে পারেনিআগামীতেও পারবে না।
ডামাহফুজুর রহমান বলেনসরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবেডিসিরা কি রাজার ভূমিকায় থাকবে নাকি গণপ্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে থাকবে। তিনি বলেনসংস্কৃতিকর্মীরা প্ল্যানার্স ফর চিটাগাংয়ের প্রকৌশলীদের মাধ্যমে একটি প্ল্যান দিতে পারেন। পাশাপাশি ডিসির যদি কোনো প্ল্যান থাকে সেটিও মেলানো যেতে পারে। দুটি প্ল্যানের সমন্বয় করে চট্টগ্রামের জন্য যেটি ভালো হয় সেটি করা প্রয়োজন।
অধ্যক্ষ শীলা মোমেন বলেনডিসি প্রশাসকতিনি রাজা নন। এই ডিসি হিল চট্টগ্রামের ফুসফুস। জনগণের স্বার্থ তাদের বুঝতে হবে। যদি তা না পারেনতবে তারা অন্যত্র বদলি হয়ে চলে যান। তাদের বাসস্থানকে ‘সিটি মিউজিয়াম’ হিসেবে গড়ে তোলা যায়। চট্টগ্রাম শহরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ঢাকার চেয়েও পুরনো। অথচ তা কোথাও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। সেটা সিটি মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করা যায়। তিনি বলেনএখান থেকে নার্সারিগুলি ধাপে ধাপে সরিয়ে নিয়ে পুরোটা জুড়ে সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তুলতে হবে। ছোট একটি চিড়িয়াখানাও করা যায়।
ডাএ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম বলেনআমলাতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে আমরা এখনো বেরুতে পারিনি। স্বাধীন দেশে সরকারি জায়গা কখনো নিজের হয় নাএটা ডিসিকে বুঝতে হবে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেনএকের পর এক দখল হয়ে যাচ্ছে প্রতিটি সরকারি জায়গা। ডিসি হিলের মতো দেখলামবাটালি হিলের নিচে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছে ‘সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ’। কারণ সেখানে ডিআইজির বাংলো আছে। এভাবে তারা একদিন পুরো চট্টগ্রামকে গ্রাস করে নেবে। তিনি এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করার প্রস্তাব দেন এবং ডিসি হিলকে নজরুল স্কোয়ার নামে লেখার জন্য সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান।
অ্যাডভোকেট চন্দন দাশ বলেনডিসি সাহেবের বোঝা উচিত সরকারের খাস সম্পত্তি মানে রাষ্ট্রের সম্পত্তিজনগণের সম্পত্তি। এটা তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। চট্টগ্রামের মানুষের অনুভূতিতে আঘাত জনগণ কিছুতেই মেনে নেবে না। প্রয়োজনে সরকারি দল ও বিরোধী দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে এ উদ্যোগে সম্পৃক্ত করা যায়।
আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসান বলেনসম্মানটা হারিয়ে ফেললে আমাদের আর কিছুই থাকে না। আমরা শুধু জানতে চাই ডিসি হিলে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স করতে সরকার আন্তরিক কিনা। সরকারকে তার অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। তবে ডিসি হিল যেহেতু চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণ,সেহেতু অবশ্যই সরকারকে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েই তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। আমরা বিশ্বাস করিএ সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারসংস্কৃতি-বান্ধব সরকার। তাই আমাদের দাবিএখানে অবশ্যই সংস্কৃতি কমপ্লেক্স গড়ে তুলতে হবেআধুনিক মঞ্চ নির্মাণ করতে হবে। ডিসি হিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অক্ষুণ্ন রেখেই কাজগুলি করতে হবে। এই ডিসি হিলকে পরিচিত করেছি আমরাসংস্কৃতিকর্মীরাই। তাই এর ওপর ডিসি কিংবা বিভাগীয় কমিশনার নয়আমাদের অধিকারই সবচেয়ে বেশি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ