বুধবার, ৭ মে, ২০১৪

সরকারি চিকিৎসকদের ‘বেসরকারি দালালি’:‘বজ্র আঁটুনি’ হয়ে যাচ্ছে ‘ফসকা গেরো’!

সরকারি হাসপাতালে সেবার মান নিয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই। স্বল্প আয়ের মানুষেরা একটু সস্তায় চিকিৎসা পেতে সরকারি হাসপাতালে যান আর সামর্থবানরা একেবারে ঠেকায় না পড়লে যান না। সেবার মান ও সংশ্লিষ্টদের আচরণ নিয়ে অভিযোগ তো আছেই তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসাধু ডাক্তারদের দৌরাত্ম্য। তবে বর্তমান সরকার স্বাস্থ্য খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে চিকিৎসকদের সার্বিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ‘বজ্র আঁটুনি’ হিসেবে মোহম্মদ নাসিমের কাঁধে দেয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। কিন্তু এতেও কিছু হচ্ছে না। চিকিৎসকরা গ্রাম-মফস্বলে যাচ্ছেন না। কমিশনখোর ‘সেবকরা’ শহরে থেকে বেসরকারি ক্লিনিকের কাছে মাথা বিক্রি করছেন। তাদের জন্যই প্রধানমন্ত্রীর ‘বজ্র আঁটুনি’ হয়ে যাচ্ছে ‘ফসকা গেরো’।

এই ‘ফসকা গেরো’ খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এমন কিছু তথ্য যা জানলে ‘সেবকদের’ প্রতি শ্রদ্ধা জনমের মতো উবে যাবে। সরকারি হাসপাতালে যাওযার আগে অন্তত পাঁচবার ভাববেন সাধারণ মানুষ। দরকার পরলে গরু-ছাগল-মুরগী বেচে বেসরকারি ক্লিনিকের দ্বারস্থ হবে স্বল্প আয়ের মানুষেরা। চিকিৎসা খাতের এই লজ্জাজনক দশা নিয়ে দেশের একটি শীর্ষ অনলাইন নিউজের ধারাবাহিক প্রতিবেদন ‘সেবকদের লজ্জা’ এর প্রথম পর্বে থাকছে সরকারি চিকিৎসকদের কমিশন কামাইয়ের কৌশল।

মোটা অংকের কমিশনের লোভে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর কাছে বিক্রি হয়ে গেছেন চিকিৎসকেরা। অর্থের মোহে সেবা দেয়ার নামে তারা রোগীর হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন হাজার হাজার টাকার প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন টেস্ট। সাথে সুপারিশ করছেন নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের। এতো টাকার টেস্ট দেখে রোগীর আরো অসুস্থ হওয়ার জোগাড় হয়। কিন্তু এতো টাকা খরচ করে টেস্টের রিপোর্টে যখন দেখে কোনো সমস্যা নেই তখন সুযোগ তৈরি হয় আরেক বিভ্রান্তির। হয়ত ভুল টেস্টের কারণে রোগ ধরা পড়েনি। তাই এবার অন্য কোথাও টেস্ট করার পরামর্শ দেয়া হয়। এভাবে টেস্টের চক্রে পড়ে স্বল্প আয়ের অনেক মানুষ চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু রোগী জানে না মাঝখান থেকে ফুলে ফেঁপে উঠছে চিকিৎসকের মানিব্যগ।

রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনিস্টিটিউটে সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, চিকিৎসক সরকারি সিল সম্বলিত স্লিপে নিজের কমিশনের অংশ লিখে রোগীকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন নিম্নমানের বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ না করলে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে রোগীর চিকিৎসা।
জাতীয় হৃদরোগ ইনিস্টিটিউটে চিকিৎসা নিতে আসা বেশ কয়েক জন রোগীর প্রেসক্রিপশনে পাওয়া যায় এমন সব চাঞ্চল্যকর তথ্য।

মাকে নিয়ে রাজশাহী থেকে ঢাকায় এসেছিলেন জুবায়ের। হৃদরোগ ইনিস্টিটিউটের বহিঃবিভাগে টিকিট কেটে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. এসএএম আব্দুস সবুরের শরণাপন্ন হন জুবায়ের। কিন্তু চিকিৎসক মায়ের সমস্যা জানতে চাওয়ার আগেই এনজিওগ্রামসহ বেশ কিছু পরীক্ষা করানোর নির্দেশ দেন। তবে শর্ত আছে। পরীক্ষাগুলো করাতে হবে ‘ইউরো বাংলা হার্ট হসপিটাল’ নামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। যার বিনিময়ে চিকিৎসক পাবেন মোটা অংকের কমিশন। সেটা তিনি স্লিপে লিখেও দিয়েছেন।
অথচ হৃদরোগ ইনস্টিউটেই এনজিওগ্রাম করানোর বেশ কয়েকটি মেশিন রয়েছে। এ ব্যাপারে জুবায়ের জানতে চাইলে ডা. আব্দুস সবুর তাকে বলেন, ‘এখানে তো ৫টি মেশিনের মধ্যে ৪টি নষ্ট। একটি দিয়ে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ চলছে। রোগীর যে চাপ তাতে মনে হয় না আপনি আগামী এক সপ্তাহতেও এই পরীক্ষা করাতে পারবেন। তার চেয়ে বরং ‘ইউরো বাংলা’ হাসপাতালে গিয়ে এনজিওগ্রামটি করিয়ে আসেন।’

এদিকে অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, গ্রাম বা জেলা পর্যায় থেকে চিকিৎসা নিতে আসা সহজ সরল মানুষগুলোকে আরো বোকা বানিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন চিকিৎসকরা। বেসরকারি হাসপাতলে যাওয়ার নির্দেশনা লেখা হয় সরকারি স্লিপে। সরকারি সিলও ব্যবহার হয় এ কাজে। যা দেখে খুব সহজেই রোগীরা মনে করেন এটাও বুঝি সরকারি কোনো হাসপাতাল। ঠিক এমনটি ভেবেই মাকে নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী জুবায়ের ছুটে যান ইউরো বাংলা হার্ট হসপিটালে। পরে বুঝতে পারেন ডাক্তারের ধান্দা।
জুবায়ের ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিবেদককে বলেন, ‘মায়ের শরীরটা কয়েক দিন যাবৎ বেশ খারাপ ছিল। তাই এখানে নিয়ে এলাম। কিন্তু এখানে আসার পর ডা. আব্দুস সবুর আমাকে অন্য একটি হাসপাতালে যেতে পরামর্শ দেন। তিনি নিজ হাতে স্লিপে বিস্তারিত লিখে দেন এবং একটি ভিজিটিং কার্ডও দেন। পরে আমি সেখানে যেয়ে দেখি এটি নিম্নমানের বেসরকারি হাসপাতাল। সেখানে তেমন কোনো আধুনিক চিকিৎসা উপকরণও নেই। এসব দেখে আর সেখানে মাকে ভর্তি করানো হয়নি। পরে আবারও হৃদরোগ ইনিস্টিটিউটে ফিরে এলে ডাক্তার মায়ের চিকিৎসা করবেন না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দেন। পরে মাকে পপুলারে ভর্তি করিয়েছি।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা করানো সুপারিশ করার কথা স্বীকার করেছেন ডা. এস এএম আব্দুস সবুর। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাদের এখানে ৫টির মধ্যে ৪টি মেশিন নষ্ট। তাই রোগীদের ইউরো বাংলা হার্ট হসপিটালে যেয়ে এনজিওগ্রাম করানোর পরামর্শ দিই।’

ডায়াগনসিসের মেশিনগুলো ঠিক করানোর উদ্যোগ না নিয়ে রোগীদের বেসকারী হাসপাতালে পাঠানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এগুলো ঠিক করাতে অনেক ঝামেলা। তাছাড়া এখানে রোগীর অনেক চাপ। তাই শুধু শুধু ঝামেলায় না যেয়ে রোগীদের বিভিন্ন প্যাকেজ দিয়ে প্রাইভেটে পাঠিয়ে দেয়া হয়।’


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইউরোবাংলা একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এখানে মূলত সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা রোগীদের আসার পরামর্শ দেন। বিনিময়ে পেয়ে যান মোটা অংকের কমিশন।
এছাড়া অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর অনেক বেসরকারি হাসপাতালে রোগীদের জিম্মি করে চলছে রমরমা ‘সেবা ব্যবসা’।

লিভার স্পেশালিস্ট প্রফেসর মো. আমিনুর রহমান। সকালে বঙ্গুবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে আর বিকেলে পপুলার ডায়াগনাস্টিকে রোগী দেখেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আমিনুর রহমান একজন প্রথম শ্রেণীর চিকিৎসক হয়েও রোগীকে সর্বদা পপুলার ফার্মার ওষুধ খেতে বলেন। অথচ পপুলার ফার্মা ওষুধ তৈরিতে খুব একটা আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারেনি। কমিশন দিয়ে এ আমিনুর রহমানের মতো প্রথম শ্রেণীর চিকিৎসকদের কমিশন দিয়ে ম্যানেজ করে ওষুধ বিক্রি করছে।

এদিকে চিকিৎসকদের নীতিবর্হিভূত এসব কর্মকাণ্ডে সরকারের সব পদক্ষেপ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। মলিন হচ্ছে জনগণের মহান সেবক চিকিৎসকদের ভাবমূর্তি। ফসকে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর বজ্র আঁটুনি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ