বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

সাংবাদিক দম্পতি হত্যা : অজ্ঞাত কারণে আশায় পানি ঢালল পুলিশ


মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরোয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনির হত্যাকা- নিয়ে নতুন করে ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছে পুলিশ। 'আমরা শিগগিরই সুসংবাদ দিতে পারব', 'মামলার তদন্তের প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে'_ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইজিপির এ ধরনের দাবির পর দুই দিন না যেতেই বুধবার ডিএমপি সংবাদ সম্মেলন ডেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে, সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকা-ের তারা কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। খুনির মোটিভ সম্পর্কেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

খুনিদের গ্রেপ্তার তো দূরের কথা, তাদের এখনো শনাক্তও করতে পারেনি গোয়েন্দারা। ঘটনার ৫ দিন পর মন্ত্রী-আইজিপির সঙ্গে ডিএমপির পরস্পরবিরোধী এই বক্তব্যে জনমনে বিভ্রান্তি ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা, তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। ক্ষমতাধর কারো চাপে পুলিশ সত্য প্রকাশে ভয় পাচ্ছে, নাকি বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে, এ নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছে। তাদের ধারণা, প্রভাবশালী একটি মহল পুলিশকে দিয়ে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য প্রচার করে মামলাটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহের অপচেষ্টা করছে। সুযোগ বুঝে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে আসল খুনিদের রক্ষা করার ফন্দি-ফিকির চালানো হচ্ছে। 

উল্লেখ্য, সাগর-রুনির খুনিসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, তাদের মুখোশ খুলে দেয়ার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে। খুনের নেপথ্য কারণ যতই নির্মম হোক না কেন, তা প্রকাশ করার জন্য তারা দাবি তুলেছেন। বুধবার দুপুরে আকস্মিক সংবাদ সম্মেলন ডাকে ডিএমপি। ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র এবং গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিণ) উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. মনিরুল ইসলাম ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে জানান, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকা-ে জড়িত সন্দেহে কাউকে এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে পুলিশ কাউকেই গ্রেপ্তার করবে না। 

ডিএমপির ছোটখাটো সংবাদ সম্মেলনের আগে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এবং ক্রাইম বিটের রিপোর্টারদের মুঠোফোনে খুদে বার্তা বা টেলিফোন করে জানানো হলেও রহস্যজনক কারণে বুধবারের এই সংবাদ সম্মেলনের খবর সেভাবে জানানো হয়নি। প্রতিটি প্রেস ব্রিফিংয়ে সংশ্লিষ্ট ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকলেও গতকাল ছিল এর ব্যতিক্রম। ডিসি ডিবি মনিরুল ইসলাম ছাড়া শুধু জনসংযোগ বিভাগের এডিসি মাসুদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। ডিসি ডিবি জানান, সাধারণত কোনো মামলার তদন্তে পুলিশের একটি দল কাজ করলেও সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তে কাজ করছে একাধিক দল। তারা সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করছেন। 

হত্যাকা-ের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে 'মোটিভ ডিসক্লোজ' করা হবে না। মামলায় বিভিন্ন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং আটক সম্পর্কে মনিরুল ইসলাম বলেন, অনেকের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। এটা সেই অর্থে জিজ্ঞাসাবাদ নয়। একটি মামলার রহস্য উদ্ঘাটনে অনেক পারিপাশ্বর্িক তথ্যের (ব্যাকগ্রাউন্ড ইনফরমেশন) দরকার হয়। এজন্য পুলিশ সবার সঙ্গেই কথা বলছে। এটাকে সাক্ষাৎকার বলা যেতে পারে। প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তি এই হত্যাকা-ে জড়িত থাকলে ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে পারে কিনা প্রশ্ন করা হলে মনিরুল ইসলাম বলেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যে কেউ হোক, গ্রেপ্তার করা হবে। আইনে প্রভাবশালীর সংজ্ঞা নেই। জড়িত যে-ই হোক, আসামি হিসেবেই তাকে বা তাদের বিবেচনা করা হবে। 

যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা রক্তমাখা বঁটিতে লেগে থাকা হাতের ছাপের সঙ্গে তাদের হাতের ছাপের মিল পেয়েছেন কিনা জানতে চাওয়া হলে এই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান তিনি। হত্যাকা-ে সাগর-রুনির ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিরোধ, পেশাগত বিরোধ, লেনদেন ও সম্পত্তি বিষয়ক বিরোধ এবং তাদের ওপর কোনো ব্যক্তি বা মহল ক্ষুব্ধ ছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। এমনকি এটা ডাকাতি বা চুরির মতো ঘটনা কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। সাগর-রুনির ৫ বছরের ছেলে মাহিন সরোয়ার মেঘকে কোনো ছবি বা ভিডিও দেখানো হয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হলে মনিরুল ইসলাম সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, তারা সব ধরনের কলাকৌশল প্রয়োগ করেছেন। ঘটনা তদন্তে গঠিত কয়েকটি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টিমের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সমন্বয়হীনতা আছে বলতে রাজি নন। গ্রেপ্তারের এখতিয়ার তদন্তকারী কর্মকর্তার। কোনো সাহায্য দরকার হলে তিনি অন্যের সাহায্য চাইতে পারেন। এর বাইরে অন্য কারো গ্রেপ্তারের সুযোগ নেই। 

তদন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কিছু প্রকাশ থেকে গণমাধ্যমকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়ে ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের মুখপাত্র বলেন, নিহত সাংবাদিক দম্পতির প্রতি নূ্যনতম অসম্মানবোধ ও শ্রদ্ধাহীনতা প্রদর্শন হয়, এমন কিছু যেন লেখা না হয়। অথচ ঘটনার দুই দিন পর ১৩ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সদর দপ্তরের নিয়মিত ক্রাইম কনফারেন্সে তদন্তের অগ্রগতি জানানোর জন্য ডাকা সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় পুলিশের মহাপদির্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। খুব শিগগিরই এর রহস্য উন্মোচন করা হবে। ঠিক এর একদিন পর মঙ্গলবার কোস্টগার্ডের প্রতিষ্ঠাবাষির্কীর অনুষ্ঠান শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, খুব শিগগিরই আপনারা এ ব্যাপারে সুসংবাদ শুনবেন। 

সাগর-রুনি হত্যাকা-ের ৫ দিন পর ঘাতক সম্পর্কে সরাসরি মুখ না খুলে রহস্যজনক আচরণ করায় ধূম্রজাল আরো ঘনীভূত হয়েছে। আদৌ কি পুলিশ ঘাতকদের চিহ্নিত করতে পেরেছে? এই হত্যাকা-ের পেছনে পরকীয়া, প্রতিহিংসা, অর্থকড়ি, পেশাগত প্রতিশোধ কিংবা অন্য কী কারণ রয়েছে, সেই রহস্য কি গোয়েন্দারা উদ্ধার করতে পেরেছে? ঘাতকদের ব্যবহূত বঁটি ও ছুরির হাতের ছাপের সঙ্গে কার হাতের ছাপের মিল পাওয়া গেছে বা নিহতদের কারো হাতের ছাপের মিল রয়েছে কিনা_ এসব প্রশ্নের কি কোনো উত্তর খুঁজে পেয়েছে গোয়েন্দারা? তাহলে কোন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আইজিপি বলেছিলেন, 'স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বেঁধে দেয়া ৪৮ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে আমরা অনেক এগিয়েছি। বলা চলে, প্রায় চূড়ান্ত সফলতার কাছাকাছি চলে এসেছি।' পরে কি কোনো প্রভাবশালী মহলের চাপে পুলিশ সেখান থেকে সরে এসেছে? এসব 'কেন'র উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেশের সচেতন মহল এখন পুলিশের ওপর থেকে আস্থা হারাতে শুরু করেছে। আর এই ফাঁকে মূল কিলার এবং কিলিং মিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যরা গা-ঢাকা দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। 

এদিকে সাগর-রুনির হত্যাকা-ের তদন্ত নিয়ে পুলিশের রহস্যময় আচরণে খোদ সাংবাদিক মহলেই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। বুধবার দুপুরে সংশ্লিষ্ট মিডিয়াকর্মীদের সবাইকে খবর না দিয়ে ডিএমপির আকস্মিক সংবাদ সম্মেলনের পর অনেকেই এ ব্যাপারে সরাসরি জনসংযোগ বিভাগের এডিসি মাসুদুর রহমানকে প্রশ্ন করেছেন। প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মীদের অনেকেই বলেছেন, এগুলো হচ্ছেটা কী? মঙ্গলবার ডিএমপির মিডিয়া সেলে প্রেস ব্রিফিং করেছেন তেজগাঁও জোনের উপ-কমিশনার ইমাম হোসেন। সেখানে ডিএমপি কমিশনার বেনজির আহমেদ বা ডিএমপির মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম কেউই উপস্থিত ছিলেন না। প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার অনেকেই এই প্রেস ব্রিফিংয়ের কথা জানতেনও না। তাহলে কার স্বার্থে, কেন তেজগাঁও জোনের ডিসি সেখানে এসে বক্তব্য দিলেন? কে তাকে এখানে নিয়ে এলো? তা নিয়েও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। তার এই আচরণ রীতিমতো রহস্যজনক বলে সাংবাদিকরা অনেকেই মন্তব্য করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, একটি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার দুইজন সংবাদকর্মী তেজগাঁও জোনের উপ-কমিশনার ইমাম হোসেনকে ডিএমপির মিডিয়া সেলে নিয়ে যান এবং তাদের অনুরোধে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত পুলিশ কোনো গণমাধ্যমকর্মীকে আটক বা গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদও করেনি। হত্যাকা-ে কোনো গণমাধ্যমকর্মীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা, তারও ধারণা পাওয়া যায়নি। একই সঙ্গে ডিসি ইমাম হোসেন আরো বলেন, 'আমার মনে হচ্ছে, এই খুনের ঘটনা নিয়ে বেশি আলোচনার কারণে খুনিরা দ্রুত সটকে পড়ছে। আরেকটি বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আমরা সংশ্লিষ্ট অনেকের ফোন বন্ধ পাচ্ছি। এমনকি অনেক মিডিয়াকর্মীও ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। কেউ হয়তো বিব্রত হওয়ার ভয়ে, আবার কেউ বা আতঙ্কে।' 

তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, সাগর-রুনির কিলিং মিশনে সম্পৃক্ত দুইজনকে ধরতে দুটি টিম ঢাকার বাইরে রয়েছে। এর একটি টিম সাভারে এবং অন্যটি টাঙ্গাইলে অবস্থান করছে। দুইজন সহকারী কমিশনারের নেতৃত্বে তিনজন ইন্সপেক্টর এবং প্রায় এক ডজন সাব-ইন্সপেক্টর এই অভিযানে অংশ নিয়েছেন। অসমর্থিত একটি সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার রাতে উত্তরার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষককে ডিবি কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল, তাকে এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ডিবি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই তিনি আত্মগোপন করেছেন। তাকে ধরতে গোয়েন্দারা মাঠে নেমেছে। ডিসি ডিবি মনিরুল ইসলাম জানান, খুনিরা যাতে পালিয়ে যেতে না পাওে, সেজন্য ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে, গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া খুনিরা যাতে বিদেশে পালাতে না পাওে, সেজন্য শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ওসমানী বিমানবন্দর এবং স্থলপথের সব ইমিগ্রেশনকে সতর্ক করা হয়েছে। তবে কারো নামের তালিকা পাঠানো হয়নি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ