শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

বৈষম্য আর লোভ: কুমিল্লায় নারী মাদক পাচারকারী বাড়ছে

চান্দিনা (কুমিল্লা): কুমিল্লা সীমান্তে মাদক চোরাচালানির সঙ্গে আশঙ্কাজনক হারে যুক্ত হচ্ছে নারীরা। মজুরি বৈষম্যের কারণে হতাশা, কর্মসংস্থানের অভাব এবং বেশি অর্থের লোভে দরিদ্র নারীরা এ পেশায় জড়িয়ে যাচ্ছে।  
ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য কুমিল্লা সীমান্ত পথে বাংলাদেশে আসে। আর এ মাদক চোরাচালানে ব্যবহার করা হচ্ছে অসহায় ও দরিদ্র নারীদের।
এদিকে, সংশ্লিষ্ট এলাকার থানাগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নারী পুলিশ না থাকায় নারী মাদক পাচারকারীদের সব সময় আটক করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুরুষের পাশাপাশি নারীরা সমান কাজ করলেও মজুরিতে রয়েছে বৈষম্য। মাটি কাটা, পাথর ভাঙা, বোঝা বহন করা, নির্মাণ বা  ইটভাটার কাজে একজন পুরুষের তুলনায় নারীর দৈনিক পারিশ্রমিক অর্ধেকেরও কম।
একজন পুরুষ শ্রমিকের দৈনিক মজুরি আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা হলেও সমপরিমাণ শ্রম দিয়ে নারী শ্রমিক পায় ১০০ থেকে ১২০ টাকা। কোনো মিল ফ্যাক্টরিতে একই শ্রেণির একজন পুরুষ শ্রমিক প্রতিমাসে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা বেতন পেলেও একজন নারী শ্রমিক পান ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা।
বৈষম্যের শিকার নারী শ্রমিকদের এ দুর্বলতাকে কাজে লাগাচ্ছে কুমিল্লার মাদক ব্যবসায়ীরা। এখানে মাদক চোরাচালানে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে নারীরা।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে বেশির ভাগ মাদক পাচার ও বিক্রি হচ্ছে নারীদের মাধ্যমে। নারীরা সহজে শরীরে লুকিয়ে মাদক বহন করতে পারে। মাদক ব্যবসায়ীরা সেই সুবিধা কাজে লাগিয়ে মাদক পাচার ও ব্যবসায় লিপ্ত করছে নারীদের।
কুমিল্লা থেকে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার মাদক ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। আর সেগুলো বেশির ভাগই বহন করছে নারীরা। তারা বিভিন্ন কায়দায় শরীরের সঙ্গে বেঁধে যাত্রীবেশে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক পণ্য। কোনো গোপন সংবাদ ছাড়া ধরা যাচ্ছে না তাদের।
মাদক পাচারকারী নারীদের সনাক্ত করতে মহাসড়কসংলগ্ন প্রতিটি থানায় পুরুষের পাশাপাশি নারী পুলিশ নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও প্রশাসনিক জটিলতা এবং থানাগুলোতে আবাসনের ব্যবস্থা না থাকায় নারী পুলিশ নিয়োগ দিতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
গত বছর আলেখারচর থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার মহাসড়কের বুড়িচং, চান্দিনা, দাউদকান্দি থানা পুলিশ এবং আমতলী, ইলিয়টগঞ্জ ও দাউদকান্দি হাইওয়ে পুলিশ অভিযান চালিয়ে দুই শতাধিক মাদক পাচারকারীকে আটক করে, যার সিংহভাগই নারী।
পুলিশের হাতে আটক মাদক পাচারকারী নারীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, তাদের বেশির ভাগ গার্মেন্ট শ্রমিক ও পতিতা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে চান্দিনা থানা পুলিশ ২ কেজি গাঁজাসহ দুই তরুণীকে আটক করে। তারা প্যাকেটভর্তি গাঁজা শরীরের সঙ্গে চিকন তার দিয়ে পেঁচিয়ে যাত্রীবেশে গাড়িতে বসেছিলেন। মাদক পাচারকারী বীথি ও সোনিয়া জানান, তারা শুধুই বহনকারী।
মাদক ব্যবসায়ীরা কুমিল্লা শুয়াগাজী থেকে তাদের কিনে দেয়। তারা ঢাকায় পৌঁছে দিলে জনপ্রতি ৫শ টাকা পায়। এর আগে তারা হোটেলে কাজ করতো।
একই মাসে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে শরীরে বাঁধা ফেনসিডিলসহ চান্দিনা থানা পুলিশের হাতে ধরা পড়া কুমিল্লা সদর উপজেলার রোজি আক্তার (২২) জানান, তিনি ঢাকার একটি তৈরি পোশাক কারখানায় করতেন। পরে জড়িয়ে পড়েন মাদক পাচারে।
কারণ হিসেবে তিনি জানান, পোশাক কারখানায় প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা কাজ করে মাসে ৩ হাজার টাকা পেতেন। অন্যদিকে, ১০০ বোতল ফেনসিডিল কুমিল্লা থেকে ঢাকায় নিয়ে গেলে পাওয়া যায় এক হাজার টাকা।
চলতি মাসের ৩ তারিখ কুমিল্লা সদরের শাহপুর এলাকা থেকে শরীরে শতাধিক ফেনসিডিল বাঁধা অবস্থায় মা রাফিয়া বেগম ও মেয়ে ইতি আক্তারসহ চার নারীকে আটক করে বিজিবি। অন্য দু’জন হলেন- হাবু বেগম ও সারিকা আক্তার।
পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা বাংলানিউজকে জানান, মাদক পাচারকারীদের বেশির ভাগই নারী। তবে অভিযান চালিয়ে অনেক ভদ্রবেশী নারীকে আটক করা গেলেও আমরা তাদের দেহ তল্লাশি করতে পারি না। এক্ষেত্রে প্রত্যেক থানায় নারী পুলিশদের বাসস্থান নিশ্চিত করে তাদের নিয়োগ দেওয়া গেলে অনেক নারী মাদক পাচারকারী আটক সম্ভব হতো।
এ ব্যাপারে কুমিল্লার সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি-মুরাদনগর সার্কেল) জাহাঙ্গীর আলম বাংলানিউজকে জানান, এদেশের নারীরা রক্ষণশীল। শালীনতার প্রশ্নে অনেক নারী মাদক পাচারকারীদের সঠিকভাবে চেক করা যায় না।
প্রতিটি থানায় নারী পুলিশের প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের সব থানায় পরিবেশ না থাকায় নারী পুলিশ নিয়োগ দেওয়া এখনও সম্ভব হচ্ছে না। তবে ভবিষ্যতে প্রতিটি থানায় নারী পুলিশ বাধ্যতামূলক নিয়োগ থাকবে বলে আমি আশা করি।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ