রবিবার, ২৫ মার্চ, ২০১২

নরসিংদী মেয়র হত্যাকাণ্ডের আসামি মন্ত্রীর ভাই, নির্যাতিত বিএনপি নেতা

নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডে খুনের অভিযোগ ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর ভাই এবং তার ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে। অথচ বিএনপির দুই নেতাকে এ মামলায় গ্রেফতার করে নির্যাতন চালানো হয়েছে। বিএনপির নরসিংদী সদর সভাপতি নুরুল ইসলামকে চার দফায় ১১ দিন রিমান্ডে নির্যাতন চালানো হয়। এছাড়াও বিএনপির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল কবির খোকনকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। যদিও পরে তাকে পুলিশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। হত্যাকাণ্ডের সময় এ দুই বিএনপি নেতা নরসিংদী ছিলেন না। তারপরও তাদের হত্যামামলায় গ্রেফতার করে নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, বর্তমানে আলোচিত এ হত্যামামলা তদন্তে পুলিশ গড়িমসি করছে। এজাহারভুক্ত আসামি নয় এমন এক সন্ত্রাসী কিলার শরীফকে দিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা স্বীকার করিয়ে মন্ত্রীর ভাইসহ প্রভাবশালী আসামিদের এ মামলা থেকে বাঁচানোর চেষ্টার অভিযোগ উঠছে পুলিশের বিরুদ্ধে। এ কারণেই মামলার চার্জশিট প্রদানে বিলম্ব করছে পুলিশ। মামলার বাদী বলেছেন, পুলিশ মনগড়া চার্জশিট দিলে তারা এর বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি পিটিশন দাখিল করেন। প্রসঙ্গত, গত বছর ১ নভেম্বর রাত সাড়ে ৭টার দিকে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের ভেতরে নরসিংদী পৌর মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেনকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে রাত ১১টায় মারা যান। ঘটনার পর নরসিংদী শহরের উত্তেজিত মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। রাতেই নরসিংদী বিক্ষোভের শহরে পরিণত হয়। লোকমানের ক্ষুব্ধ সমর্থকরা হত্যাকাণ্ডের জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীকে দায়ী করেন। বিক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সাধারণ জনতা মুহূর্তের মধ্যেই বন্ধ করে দেয় ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ। ক্ষুব্ধ জনতা ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত হাজী সাত্তারের বাড়িতে, সার্কিট হাউস ও রেলস্টেশনে অগ্নিসংযোগ করে। টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীকে দায়ী করে নরসিংদীতে তিনদিনের হরতালের ডাক দেয়া হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তোলপাড় সৃষ্টিকারী মেয়র লোকমানের খুনিরা ক্ষমতাসীন দলের হওয়ায় পুলিশও তাদের সমীহ করে চলছে। মন্ত্রীর ভাই এজাহার নামীয় আসামি হলেও দলবলসহ প্রকাশ্যে আদালতে উপস্থিত হয়ে জামিন নিয়ে যান। আদালত চত্বর থেকে আসামি ও সন্দেহভাজন ব্যক্তি গ্রেফতারের অসংখ্য নজির থাকলেও এই আসামিদের ক্ষেত্রে ছিল ব্যতিক্রম। মন্ত্রীর ভাই ও তার ঘনিষ্ঠজন এবং দলীয় লোক আসামি হওয়ায় আদালত চত্বর থেকে সেদিন প্রকাশ্যে জামিন নিয়ে যায়, পুুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি। পরে মন্ত্রীর ভাইসহ চার আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করলে সেখান থেকে তাদের এক দিনের রিমান্ডে আনে পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে, নরসিংদী থানা পুলিশ রিমান্ডের নামে আসামিদের থানায় রেখে খোশগল্প করেছে। পরে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আসে। তারা এখন নরসিংদীতে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সূত্র জানায়, মেয়র হত্যার চার মাস পার হলেও এখনও পর্যন্ত পুলিশ এ মামলার চার্জশিট দেয়নি। আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আসায় চরম উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায় রয়েছে লোকমানের পরিবার। পারিবারিক সূত্র জানায়, খুনের মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি মন্ত্রীর ছোটভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুসহ মূল আসামিদের পুলিশ গ্রেফতারই করেনি। দীর্ঘদিন পর তারা আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করলে সেখান থেকে এক দিনের রিমান্ডের নামে আইওয়াশ করা হয়েছে। মামলার বাদী ও এলাকার সাধারণ মানুষ লোমহর্ষক এ হত্যাকাণ্ডে মন্ত্রীর ভাই, এপিএসসহ তার ঘনিষ্ঠজন স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলছে। পরিবারের লোকজন জানায়, টেন্ডারবাজিতে বাধা ও দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে মেয়র লোকমানকে মন্ত্রীর নির্দেশে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় টিঅ্যান্ডটি মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য রাজিউদ্দিন আহমদ রাজুর ছোট ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন লোকমানের ভাই (বর্তমান মেয়র) কামরুজ্জামান। আসামিদের একজন ছাড়া অন্যরা সবাই স্থানীয় এমপি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ঘনিষ্ঠ। অন্য আসামিরা হলেন মন্ত্রীর ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু, দলের জেলা শাখার সহ-সভাপতি আবদুল মতিন সরকার, দলের শহর কমিটির সাবেক কোষাধ্যক্ষ মোবারক হোসেন ওরফে মোবা, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোন্তাজ উদ্দীন ভূঁইয়া, বিএনপির সদর থানা শাখার সভাপতি নুরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগ-সমর্থক ও ব্যবসায়ী মনোয়ার হোসেন, হিরন মিয়া, নরসিংদী কলেজের ছাত্র সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি (ভিপি) তারেক আহমেদ, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর এপিএস মাসুদুর রহমান মুরাদ, আওয়ামী লীগ-সমর্থক কবির সরকার, শহর যুবলীগের সভাপতি আশরাফ হোসেন সরকার, নরসিংদী কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি মিয়া মো. মনজুর, আমির হোসেন আমু ও মামুন। মামলার এজাহারে বলা হয়, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা মেয়র লোকমানের উত্থানে ঈর্ষান্বিত হয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেন। জেলা আওয়ামী লীগের আসন্ন সম্মেলনকে কেন্দ্র করে লোকমান সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী হিসেবে প্রচার চালাচ্ছিলেন। একই পদের জন্য মন্ত্রীর ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রচার চালাচ্ছিলেন। জনসমর্থন না পেয়ে সালাহউদ্দিন কিছুদিন ধরে লোকমানকে নানাভাবে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আসছিল, যা লোকমান পরিবারের সদস্য ও হিতাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন।
এদিকে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পুলিশ বিভিন্ন স্থান থেকে এজাহারের বাইরে থাকা আরও ৯ জনকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন হাজী সেলিম, হাজী ফারুক, কিলার শরীফ, কাজী আলম, মাহফুজ ওরফে সবুজ, টিপ্পন কাজী, মীর দেলোয়ার হোসেন শরীফ, নাসির ও শাহীন। তবে শেষ পর্যন্ত শাহীন ও দেলোয়ারকে এ মামলায় আসামি করে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা দায়ের করেছে। আর বাকি ৭ জনকে লোকমান হোসেন হত্যামামলার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় তাদের এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। এদিকে এদের মধ্যে কাজী আলম ও টিপ্পন কাজী জামিনে ছাড়া পেলেও অন্যরা জেলে আছেন।
মন্ত্রীর ভাইকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ : অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রীর ভয়ে মামলার প্রধান আসামি সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুসহ এজাহারভুক্ত ১০ আসামিকেই গ্রেফতার করার সাহস পায়নি পুলিশ। মন্ত্রীর ভাই আরও চার আসামিকে সঙ্গে নিয়ে বীরদর্পে আদালতে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণ করার পর আদালত মাত্র ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলেও জামাই আদরে থেকে জামিনে ছাড়া পায়। মামলার গুরুত্বপূর্ণ ২ নম্বর আসামি সাবেক পৌর চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সহ-সভাপিত আবদুল মতিন সরকার মন্ত্রীর এপিএস মাসুদুর রহমান মুরাদ, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ভিপি মঞ্জুরসহ আওয়ামী ঘরানার সব আসামি সহসাই এ মামলায় জামিন পেলেও দুই বিএনপি নেতাকে নির্দয় নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। সম্প্রতি এ হত্যামামলার অন্যতম আসামি মোবারক হোসেন মোবা দুবাইতে গ্রেফতার হয়েছে বলে জানা গেছে।
১১ দিন রিমান্ড বিএনপি নেতার : নরসিংদী সদর থানা শাখার বিএনপির সভাপতি নুরুল ইসলামকে মেয়র লোকমান হত্যামামলায় গত ২৯ জানুয়ারি ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে। পরে তাকে রিমান্ডের নামে জয়েন্ট ইন্টারগেশন সেলে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। স্থানীয় বিএনপি নেতা ও তার এক আত্মীয় বলেন, শুধু বিএনপি করার অপরাধে তাকে লোকমান হত্যায় আসামি করা হয়েছে। যদিও নুরুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের সময় বিদেশে ছিলেন। বিদেশ থেকে ফেরার পর বিমানবন্দরে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ প্রথমে লোকমান হত্যায় তাকে তিন দফায় ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক নির্যাতন করে। নুরুল ইসলাম জানায়, ঢাকায় চোখ বেঁধে তাকে যে নির্দয় নির্যাতন করা হয়েছে এতে বাঁচার কথা নয়। অপরাধ না করে এমন নির্যাতনের শিকার যেন আর কারও না হতে হয় বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। ৭ দিন রিমান্ড শেষে আদালত তার জামিন মঞ্জুর করলেও পরে পুলিশ তাকে নরসিংদী সরকারি কলেজের জিএস রনি হত্যামামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে সিআইডিতে স্থানান্তর করলে পরদিন রনি হত্যামামলায় আদালত আরও ৪ দিনের রিমান্ডের আদেশ প্রদান করে। তবে মন্ত্রীর ভাই ও অন্যদের বেলায় ঘটেছে এর ব্যতিক্রম। গত ২০ ফেব্রুয়ারি নুরুল ইসলাম জামিনে ছাড়া পান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পৃষ্ঠাসমূহ